আজকের শিরোনাম :

করোনাভাইরাস: পত্রিকা বিক্রিতে বিরাট ধস, সার্কুলেশন কমেছে অর্ধেক

  বিবিসি বাংলা

২৬ মার্চ ২০২০, ১৬:৪৬ | অনলাইন সংস্করণ

কাগজের মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে এমন আশঙ্কায় সংবাদপত্রের গ্রাহকেরা বাসা এবং অফিসে বিপুলভাবে ছাপা কাগজের সাবস্ক্রিপশন বাতিল করা শুরু করেছেন।

শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই সংবাদপত্র বিক্রি ৫০ শতাংশ কমে গেছে বলে জানাচ্ছে ঢাকা ভিত্তিক সংবাদপত্র হকারদের সংগঠন সংবাদপত্র হকার্স কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি।

সমিতির প্রধান অ্যাকাউন্ট্যান্ট মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, "অনেক বাসাই লকডাউন করে দিয়েছে, কাউকেই তো ঢুকতে দিচ্ছে না। দুধ, কাজের লোক কাউকেই ঢুকতে দিচ্ছে না।"

তিনি বলছেন, অনেকে ফোন দিয়ে বলছে যে পত্রিকা দিয়েন না এবং এটা বলছেন একদম হুট করেই।

"একজন বন্ধ করলেই আরেকজনের মাথায়ও এটা কাজ করে যে আমরাও বন্ধ করে দেই," জানাচ্ছিলেন ইকবাল হোসেন।

পত্রিকা হকারদের এই সমিতি নিশ্চিত করেছে যে তাদের সদস্যরা এর আগে দিনে ৩০ লক্ষ টাকার পত্রিকা বিক্রি করতেন, কিন্তু এরই মধ্যে বিক্রি ১৫ লক্ষ টাকায় নেমে এসেছে।

সমিতি জানাচ্ছে, ঢাকায় পত্রিকা হকার রয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার, আর করোনাভাইরাসের আতঙ্কের মধ্যে এদের অনেকের হাতে এখন কোনো কাজ নেই বললেই চলে।

বাংলাদেশে অন্যতম শীর্ষ দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলোর সার্কুলেশন বিভাগের প্রধান এ বি এম জাকারিয়া বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেছেন যে গোটা দেশে পত্রিকাটির মূদ্রন কমানো হয়েছে ৫০ থেকে ৬০ হাজারের মতো।

"আমাদের হকাররা কাজে আসতে পারছে না, স্কুল-কলেজ, অফিস বন্ধ, পাঠক কই পাবো।"

গতকাল অর্থাৎ বুধবারের হিসেব অনুযায়ী প্রথম আলোর প্রায় ৭০ হাজার কপি কম বিক্রি হয়েছে।

ঢাকার বাইরে কী অবস্থা

আব্দুল খালেক বগুড়ার একজন হকার, যিনি দৈনিক ৭০০ পত্রিকা বিলি করতেন বিভিন্ন বাসায়। কাল পর্যন্ত তিনি বিলি করেছিলেন ২০০ কপি, আজ অবশ্য একটিও নয়।

বগুড়ার সাতমাথায় পত্রিকা সংগহে অন্য যেকোনো স্বাভাবিক দিনে প্রায় ৩০০ হকার আসতেন। আজ সকালে সেখানে হাতেগোনা কয়েকজনকে দেখা গেছে বলে জানালেন স্থানীয়রা।।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বগুড়ার একজন সাংবাদিক বলেন, "মানুষ এখন ভয়ে আছে, মনে করছে সবকিছুতে ভাইরাস, তাই ভরসা করতে পারছে না।"

"আমাদের এখানে ৩০০ হকার আছে, যাদের মধ্যে অর্ধেক আজ পত্রিকা বিক্রি বন্ধ করেছে।"

অন্য জেলাগুলোতেও পাঠকদের মধ্যে প্রবল করোনাভাইরাস আতঙ্ক কাজ করছে। কক্সবাজারে থাকেন সোনিয়া আফরিন ইশিতা, তিনি পত্রিকা বন্ধ করেছেন পাঁচদিন হলো।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, "পত্রিকা কত মানুষের হাত ঘুরে আসে। সেটায় জীবানু থাকতে পারে। সেই ভাবনা থেকে পত্রিকা নেয়া বন্ধ করেছি।"

তবে তিনি খবর জানা বন্ধ করেননি। "প্রাত্যহিক জীবনে পত্রিকা না রাখার কোনো প্রভাব পড়েনি আসলে সেভাবে। কারণ অনলাইনেই বেশিরভাগ সময় খবর পড়া হয়।"

রাজশাহী জেলার সিফাত তাসনিম বলেন, শুধু হকার না, বরং বিভিন্ন হাত ঘুরে বাসায় পৌঁছায় বলে তার পরিবার এখন ছাপানো পত্রিকা কেনা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তিনি বলেন, "হকারের হাতের ছোঁয়া লাগবে, সে তো বাইরে থাকে। শুধু হকার না, সেটা বিভিন্ন হাত থেকে তারপর আমাদের বাসায় পৌঁছে, যা এখনকার পরিস্থিতি বিবেচনা করলে একেবারেই উচিত না। তাই সবদিক বিবেচনা করেই বন্ধ রাখা হয়েছে আপাতত।"

ফাতিমা তানজিম থাকেন বরিশালের সদরে - তিনিও বাসায় পত্রিকা রাখা বন্ধ করে দিয়েছেন।

সিলেটে থাকেন আদিব হাসান, তিনি পত্রিকা রাখতে চান কিন্তু হকারই বলে দিয়েছে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত পত্রিকা দেয়া হবে না।

ঢাকার পাঠকরা যা বলছেন

ঢাকার শাহজাহানপুর এলাকার সুস্মিতা মিশু বিবিসি বাংলাকে জানালেন যে তাদের পত্রিকা হকার নিজে থেকেই বুধবার থেকে পত্রিকা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।

নুসরাত পারুল, ঢাকার উত্তরায় থাকেন। তিনিও পত্রিকা নেয়া বন্ধ করেছেন। "পুরো মাসের বিল দিয়ে ১৯ তারিখ থেকে পত্রিকা বন্ধ করেছি। বলেছি ৩১শে মার্চ পর্যন্ত না দিতে।"

সৈয়দা নুরুন নাজিয়া তার বাবার স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে বন্ধ করেছেন বাসায় পত্রিকা রাখা।

"আমার বাবার ডায়াবেটিস, হাই প্রেশার। পত্রিকা যেহেতু অনেক হাত ঘুরে আমার হাতে আসছে এবং এটাকে আসলে ডিজইনফেক্ট করার উপায় নেই, তাই আমি অফ করে দিয়েছি।"

ইফতিয়ার আহমেদ আজমাইন বলেন, "শুনেছি পত্রিকায় নাকি ভাইরাস সংক্রামিত হতে পারে না, তবুও হকার অনেক স্থানে চলাফেরা করে, সেই ভয় থেকেই পত্রিকা বন্ধ।"

ঢাকার আরেক অধিবাসী ফারাহ জেবিন শাম্মী বলেন, "যে হকার নিয়ে আসবে সে কি রিস্ক ফ্রি? সে কতগুলো বাসায় পেপার বিলি করে? যেহেতু আমার কাছে অপশন আছে .. পত্রিকার অনলাইন ভার্সনেই তো সব পেয়ে যাচ্ছি।"

পত্রিকায় বিজ্ঞাপন 'পত্রিকা ঝুঁকিপূর্ণ নয়'

প্রথম আলোর সাকুর্লেশন বিভাগের প্রধান এ বি এম জাকারিয়া অবশ্য বলেন, আপনারা নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন পত্রিকার পেছনে আলাদাভাবে লেখা রয়েছে পত্রিকার মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ায় না।

তিনি বলেন, "আমরা হকারদের গ্লাভস দিচ্ছি, মুখে পরার মাস্ক দিচ্ছি, শুধু মানুষের মধ্যে আতঙ্ক কমাতে।"

সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা নোয়াব হকারদের মধ্যে ৩,০০০ হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং ২৩,০০০ মাস্ক ও ২৩,০০০ গ্লাভস বিলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সংগঠনটি একটি বিবৃতিও দিয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে যে ছাপানো পত্রিকা করোনাভাইরাস বহন করে না।

ঢাকা মেডিকেলের একজন চিকিৎসক শাহরিয়ার আমিন পত্রিকা রাখা বন্ধ করেননি বলে জানিয়েছেন বিবিসি বাংলাকে। তিনি বলেন, "পেপার তো রাখি আগে থেকেই, বন্ধ করলাম না। পড়ি না অবশ্য বেশি, আর ওরা বারবার বলে কাগজ দিয়ে করোনা ছড়ায় না।"

ফুয়াদ পাবলোও পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখেই পত্রিকা রাখছেন।

রায়হান আহমেদ বলছেন, এখনো পত্রিকা রাখছেন, তবে করোনাভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কার বিষয়টি তাকে কিছুটা হলেও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।

ঢাকায় থাকা সাদিক ইভান বলছেন, "ইংরেজি ও বাংলা দুটো রাখতাম বাসায়। ইংরেজিটা বন্ধ করে দিছি। বাংলাটা বাধ্য হয়েই রাখতে হচ্ছে। নানু অনলাইনে পড়তে পারে, কিন্তু মজা নাকি পায় না। পাকিস্তান পিরিয়ড থেকে পড়ে অভ্যস্ত তো। ছাপা পত্রিকা উনার লাগবেই।"

এবিএন/মমিন/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ