এলবিডব্লিও বা কম ওজন নিয়ে জন্মানো শিশু
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৬ মে ২০১৮, ১৮:২৩ | আপডেট : ০৬ মে ২০১৮, ১৮:২৮
ডা. শহীদুল্লাহ চৌধুরী, ০৬ মে, এবিনিউজ : চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় জন্মের সময় যে শিশুর ওজন আড়াই থেকে প্রায় চার কেজি হয় তাকে স্টান্ডার্ড বা স্বাভাবিক ওজনের শিশু বলা হয়। আড়াই কেজির নিচের ওজনের নবজাতক শিশুকে ‘লো বার্থ ওয়েট’ বা এলবিডব্লিও বা ‘কম ওজনের শিশু’ বলা হয়। কম ওজন নিয়ে জন্মানো শিশুরা সহজেই রোগাক্রান্ত হয়। তাদের মৃত্যুঝুঁকি স্বাভাবিক ওজনের শিশুদের তুলনায় অনেক বেশি। আমাদের দেশে এসব শিশু জন্মগ্রহণের অন্যতম কারণ হচ্ছে পুষ্টিহীনতা এবং কিশোরী মায়েদের সন্তান প্রসব ও অপরিণত বয়সে সন্তান ভূমিষ্ট হওয়া। এছাড়া গর্ভাবস্থায় কোনো মায়ের হৃদরোগ, কিডনি রোগ, রক্তশূন্যতা, বড় কোনো ইনফেকশন, একলাম্পশিয়া, অতিরিক্ত রক্তস্রাব বা এ ধরণের জটিল কোনো রোগ থাকলেও নবজাতকের ওজন কম হতে পারে।
একটি বেসরকারি সংস্থা পরিচালিত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আমাদের গ্রামগুলোতে শতকরা ৩৫ ভাগ শিশু কম ওজন নিয়ে জন্ম নেয়। কিন্তু এসব শিশুর চিকিৎসার জন্য উপজেলা বা গ্রামে পর্যাপ্ত চিকিৎসাসুবিধা নেই। ফলে কম ওজনজনিত কারণে দেশে প্রতিবছর অনেক শিশু মারা যায়। এছাড়া এ ধরনের চিকিৎসাও ব্যয়বহুল। যা অনেক ক্ষেত্রে দরিদ্র জনসাধারণের পক্ষে বহন করা সম্ভব হয় না।
যেসব নবজাতক কম ওজন নিয়ে জন্মায় তাদের প্রয়োজন তাৎক্ষণিক চিকিৎসাসেবা। অধিকাংশ সময় নবজাতককে বাঁচানো সম্ভব হয় না অথবা বাঁচলেও বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যগত ত্রশুটির ঝুঁকি থেকে যায়। গ্রামের কোনো হাসপাতালে এই ধরনের চিকিৎসা নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব নবজাতককে শহরের হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু গ্রাম ও শহরের দূরত্ব অনেক। সময়ক্ষেপণের কারণে নবজাতককে বাঁচানো সম্ভব হয় না। এছাড়া নবজাতকের চিকিৎসার বিষয়ে ঝুঁকি থাকায় সহজে কেউ এ পথে এগিয়ে আসে না। যদিও আশপাশের হাসপাতালগুলোতে অনেক শিশু বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা কম ওজনের শিশুদের শহরের হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। শহরের যে কোনো হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ‘লো বার্থ ওয়েট বেবি’ বা কম ওজনের শিশুর চিকিৎসাব্যয় লাখ টাকারও বেশি।
কম ওজনের নবজাতক শিশু সহজেই রোগাক্রান্ত হতে পারে। তাই এসব শিশুর ক্ষেত্রে বিশেষভাবে যত্ন নিতে হয়। সবসময় শিশুটিকে উষ্ণ রাখতে হবে। তাপমাত্রা কিছুতেই কমতে দেয়া যাবে না। পরিষ্কার হাতে শিশুকে ধরতে হবে এবং শিশুর পরিধানের কাপড়ও পরিষ্কার রাখতে হবে। শিশুর শ্বাস প্রশ্বাসে কোনো সমস্যা দেখা দিলে সাথে সাথে মুখের ও নাকের ভেতরের লালা পরিষ্কার করে দিতে হবে। শিশুর ওজন বেশি
কম হলে তাকে জরুরিভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি করে শিশু বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে। সঠিক পুষ্টির জন্য মায়ের দুধের পাশাপাশি নাকে নল দিয়ে খাবার দেওয়া এমনকি শিরার মাধ্যমে স্যালাইন দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। শিশুর তাপমাত্রা কমে গেলে তাকে ওয়ারমার এ দিতে হবে। ইনফেকশন প্রতিরোধে অ্যান্টিবায়োটিক, সাথে কিছু ভিটামিন এবং খিঁচুনি হলে ফেনোবারবিটোন জাতীয় ওষুধও দেয়া যেতে পারে। ইনকিউবেটরে সঠিক তাপমাত্রা, অক্সিজেন সর্বোপরি সেবা শুশ্রুষার মধ্য দিয়ে কম ওজনের শিশুকে আলোর মুখ দেখানো সম্ভব।
কেসস্টাডি : ১
২০১৭ সালের ১ অক্টোবর Pre Term with Very Low Birth Weight with Early Onset Neonatal Sepsis (নবজাতকের সংক্রমণ) রোগ নিয়ে হাটহাজারীর বি আলম ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী আবু মুসার শিশুকন্যা নাজিফা’র জন্ম হয় হাটহাজারী পৌরসভার আলিফ হাসপাতালে। নরমাল ডেলিভারি ৩৭ সপ্তাহ হলেও শিশুটির জন্ম হয় ৩২ সপ্তাহে। জন্মের পর শিশুটির ওজন ছিল ১ কেজি ১০০ গ্রাম। পরদিন থেকেই নগরীর চাইল্ড কেয়ার হসপিটালে ২৬ দিন ধরে চিকিৎসাধীন থেকে সুস্থ হয় নাজিফা। পরবর্তীতে অবস্থার অবনতি হওয়ায় হাটহাজারী আধুনিক হাসপাতালে আমার কাছে নিয়ে আসলে আমি শিশুটির চিকিৎসা শুরু করি।
দেড় মাস যাবৎ রাইস টিউব (নাকে নল) দিয়ে খাবার প্রদান, ওরাল ভিটামিন ও এন্টিবায়োটিক প্রদান করা হয়। প্রতি সপ্তাহে ৩/৪ বার করে শিশুটিকে আমার কাছে নিয়ে আসা হত। সাথে অভিভাবকদের আন্তরিক প্রচেষ্টাও অব্যাহত ছিল। দীর্ঘ ৬ মাস নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা কার্যক্রম চলে। বর্তমানে শিশুটির ওজন ৫ কেজি ৫০০ গ্রাম। অভিভাবকরা শিশুটিকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে আগ্রহী হলেও অবস্থা মোটামুটি স্বাভাবিক হওয়ায় শুধুমাত্র রাইস টিউবের মাধ্যমে খাবারের পরামর্শ দেওয়া হয় এবং এতে উন্নতিও পরিলক্ষিত হয়। নাজিফার পিতা আবু মুসা জানান, আমি মনে করেছিলাম আমার বাচ্চার আয়ু মাত্র ২৬ দিন। লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে মানসিক চাপের মুখে আমি নিজে এবং আমার পরিবার হতাশ হলেও শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. শহীদুল্লাহ চৌধুরী নাজিফার নতুন জীবন দান করেছেন। এজন্য আমি আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞ ও ডা. শহীদুল্লাহ চৌধুরীর নিকট চিরঋণী।
কেসস্টাডি : ২
গত ২৮ মার্চ Pre Term with Very Low Birth Weight with Early Onset Neonatal Sepsis (নবজাতকের সংক্রমণ) Congenital Heart Disease রোগ নিয়ে চা দোকান শ্রমিক মোহাম্মদ রফিকের শিশু সন্তান বাবু এর জন্ম হয় হাটহাজারীর ফতেয়াবাদ ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে।। নরমাল ডেলিভারি ৩৭ সপ্তাহ হলেও শিশুটির জন্ম হয় ৩৩ সপ্তাহে। জন্মের পর শিশুটির ওজন ছিল ১ কেজি ৫০০ গ্রাম।
শিশুটির রোগের উপসর্গ ছিল কম ওজন, নড়াচড়া কম, শ্বাসকষ্ট বা দ্রুত শ্বাস নেওয়া, অক্সিজেন নির্ভরশীলতা, দুধ হজম না হওয়া, মায়ের দুধ না চোষা, শরীর কালো বর্ণের ধারণ করা, তাপমাত্রা কমে যাওয়া বা নিম্ন তাপমাত্রা ইত্যাদি।
২৯ মার্চ শিশুটির পিতা তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নবজাতক ওয়ার্ডের ভর্তি করে। সেখানে যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়ায় সংকটাপন্ন অবস্থায় ২ দিন পর তারা পুনরায় শিশুটিকে নিয়ে ফতেয়াবাদ ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আমার সাথে দেখা করে এবং আমার তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা শুরু হয়। শিশুটিকে রাইস টিউব (নাকে নল) দিয়ে খাবার প্রদান, অক্সিজেন থেরাপি ও এন্টিবায়োটিক প্রদান করা হয়। সংকটাপন্ন অবস্থায় বর্তমানে শিশুটির চিকিৎসা চলছে।
লেখক : নবজাতক ও শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ
(সংগৃহীত) এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি
(সংগৃহীত) এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি
এই বিভাগের আরো সংবাদ