আজকের শিরোনাম :

ডিসপেপসিয়া বা অজীর্ণ নিরাময়ে হোমিওপ্যাথি

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ মে ২০১৮, ১৯:৫১

ডা. প্রধীর রঞ্জন নাথ, ১৫ মে, এবিনিউজ : মানুষের মেরুদণ্ডে শক্ত হাড় ছাড়াও হাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে নরম হাড় (ইন্টারভারটেব্রার্ল ডিক্স/জ্যলের মতো) থাকে, যা গাড়ির স্প্রীং বা শক অ্যাবজারবারের মতো কাজ করে। সাধারণত আরও অনেক কারণ ছাড়াও একটানা বসে থাকার কারণে ডিস্কের স্থানচ্যুতি (প্রোলাপস) হয়ে সংলগ্ন মেরুরুজ্জু (স্পাইনাল কর্ড) বা স্নুায়ুমূলের (নার্ভ রুট) উপর চাপ পড়ে, ব্যথা পায়ের দিকে নামতে শুরু করে। এভাবেই ব্যথার উৎপত্তি শুরু হয়। বর্তমানে আমাদের দেশে এই ধরনের কোমর/ঘাড় ব্যথা মানুষের সংখ্যা কম নয়।

আমরা জীবনের প্রায় সময় কর্মস্থলে বসে বা দাঁড়িয়ে কাটায়। কেউ ৮ থেকে ১০ ঘন্টা বা কেউ আরও বেশি সময় ব্যয় করেন। যাঁদের কোমর, ঘাড়, হাঁটু, গোড়ালি ব্যথা এবং শরীরে মেদে পরিপূর্ণ (মোটা হওয়া)। আপনি যতই ব্যস্ত থাকুন না কেন, কয়েক মিনিটের জন্য হলেও চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান এবং রিলাক্স করুন। প্রথমে উঠে হাঁটাহাঁটি/পায়চারি করা এবং শরীরকে একটু এদিক–সেদিক নড়াচড়া করা। এরপর হাত দু’টা শরীরের দু’দিকে প্রসারিত করে ডানে–বায়ে ঘুরিয়ে নিন। কোমরটাকে একটু সামনে–পেছনে, ডানে–বায়ে ও চক্রাকারে ঘুরাতে পারেন। এগুলো ছাড়া উঠা–বসাও করতে পারেন। এভাবে ২–৩ ঘন্টা পর পর অবশ্যই করবেন। যতই ব্যস্ততা থাকুক না কেন একটানা বসে বা দাঁড়িয়ে কাজ করার কথা পরিবর্তন করুন। যদি আপনি সময় বের করতে না পারেন তবে দুপুরের খাবার/লাঞ্চ করার আগে করে নিতে পারেন। এগুলো করার জন্য যদি পরিবেশ না থাকে তবে সিঁড়ি বেয়ে উপরে–নিচে উঠা–নামা করতে পারেন। এছাড়া যাঁরা নামাজ পড়েন তাঁরা নামাজ পড়তে পারেন। আমি নিজেরও একটানা চেয়ারে বসে বা কাজ করার ফলে এমন সমস্যা হয়ে থাকে। আমি কখনও একটানা বসে কাজ করি না, কিছুক্ষণ বসে থাকলে উঠে হাঁটাহাঁটি বা শরীর নড়াচড়া করে পুনরায় বসি। এভাবে কিছু সময় ব্যয় করার ফলে আপনার অফিসে কাজের গতি বাড়বে, আপনি সুস্থ ও প্রাণবন্ত থাকবেন সব সময়।

ডিসপেপসিয়া বা অজীর্ণ এমন একটি রোগ যা বেশিরভাগ লোককেই কম বেশি এ সমস্যায় পড়তে হয়। পল্লী অপেক্ষা শহরবাসীরাই এই রোগে অধিক আক্রান্ত হয়ে থাকে।

ডিসপেপসিয়া কি :

ডিসপেপসিয়া অর্থে গরহজম, আমরা যা আহার করি, তা রীতিমত পরিপাক না হলে শরীরস্থ সমস্ত যন্ত্রের ক্রিয়ার ব্যতিক্রম হয়, ফলে শরীর ক্রমশঃ দুর্বল, রক্তহীন ও অকর্মণ্য হয়ে পড়ে, এটিই ডিসপেপসিয়া বা অজীর্ণ রোগ। এই রোগের প্রকারভেদ আছে, যথা– তরুণ অজীর্ণ এবং পুরাতন অজীর্ণ।

১. তরুণ অজীর্ণ রোগ : ইহাতে হঠাৎ আক্রমণ করে। সাধারণত খাবারের হের ফের জনিত কারণে হয়ে থাকে। চিকিৎসা এবং উপবাস বা আহারে সংযমী হলেই ২/১ দিনের মধ্যে রোগী আরোগ্য লাভ করে থাকে।

২. পুরাতন অজীর্ণ রোগ : যদি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে তবেই পুরাতন অজীর্ণ দোষ বা ক্রনিক ডিসপেপসিয়া হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণত বয়স্কদের এই ক্রনিক ডিসপেপসিয়া রোগ হয়ে থাকে। এতে পাকাশয়ের শ্লৈষ্মিক ঝিল্লিসমূহে প্রদাহজনিত পরিবর্তনাদি সংঘটিত হয়। এর সাথে পাকাশয়ের শৈথিল্যভাব কিংবা বিবৃদ্ধি সংযুক্ত হতে পারে। ফলে পাকস্থলীতে পরিপাক বা হজমশক্তি কমে যায়।

ডিসপেপসিয়ার কারণ:

১. পরিপাক যন্ত্রের যান্ত্রিক পরিবর্তন, যেমন পাকস্থলীর ক্ষত বা পেপটিক আলসার, পিত্তথলিতে পাথর, আইবিএস (খাদ্যনালীতে খাবার সহ্য না হওয়ার সমস্যা), অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সার, অন্ত্রে ক্যানসার, মায়োকার্ড্রিয়াম ইসকেমিয়া (হৃদপিন্ডের মাংসপেশিতে রক্তপ্রবাহে স্বল্পতা), দীর্ঘস্থায়ী বৃক্কের নিস্ক্রিয়তা (ক্রনিক রেনাল ফেইলিওর) ইত্যাদি কারণে ডিসপেপসিয়া হয়।

২. পরিপাক যন্ত্র হতে যে সমস্ত রস নিঃসৃত হয়ে ভূক্ত দ্রব্য পরিপাক হয়, তাদের পরিমাণ বা গুণের তারতম্য, যেমন–অতিরিক্ত চিন্তা, কু–সংবাদ, শোক, পাঠ ইত্যাদিতে নার্ভাস–সিস্টেমের স্বাভাবিক ক্রিয়ার ব্যতিক্রম হয় তাতে ডিসপেপসিয়া হয়।

৩. অবৈধ পানাহারণ্ডযেমন মদ্যপান, অতিরিক্ত লংকা, মরিচ, রাই প্রভৃতি ব্যবহার, আইসক্রিম, অতিরিক্ত চা, কফি ইত্যাদি। স্টিমুল্যান্ড ও উত্তেজক দ্রব্যাদি পানাহারে এবং বাজারে প্রস্তুত বাসি, পচা, অখাদ্য–কুখাদ্য আহারে ডিসপেপসিয়া হয়।

৪. অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ : কিছু কিছু এলোপ্যাথিক ওষুধ এর কারণে ডিসপেপসিয়া হতে পারে। যেমন–এনএসএআইডি (প্রদাহ ও ব্যথা কমানোর ওষুধ) কর্টিকো, স্টেরয়েড, ডিগক্সিন, আয়রন এবং পটাশিয়াম সাপ্লিমেন্ট। এছাড়া মদ পান করলে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলে এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় ডিসপেপসিয়া হয়ে থাকে। খুবই সতর্ক হতে হবে যদি এসব কারণের সঙ্গে শরীরের ওজন কমতে থাকে, রক্তশূন্যতা দেখা দেয় ও ঢোক গিলতে অসুবিধা হয়। রক্ত বমি হয়, কালো পায়খানা হয়। কিংবা উভয়ই হতে থাকে এবং পেটে কোনো চাকা অনুভূত হয়। তাহলে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

ডিসপেপসিয়ার লক্ষণ:

১. কোষ্ঠবদ্ধ (ডিসপেপসিয়ার একটা প্রধান লক্ষণ)।

২. ক্ষুধালোপ কিংবা রাক্ষুসে ক্ষুধা, সর্বদা ঝাল, অম্ল, গরম মশলাযুক্ত দ্রব্যাদি আহারে ইচ্ছা।

৩. পাকস্থলীতে বায়ুজমা ও সেই বায়ু ঊর্ধ্বগতি হয়ে শ্বাস–প্রশ্বাসে কষ্ট, বুক ধড়ফড়ানি, বিষাদ ঢেকুর।

৪. পাকস্থলীতে অম্ল সঞ্চয় তজ্জন্য, টক্‌, ঢেকুর, চোঁড়া ঢেকুর, বুক জ্বালা, মুখে জল উঠা, গলায় পুটুলি আটকিয়ে থাকা বোধ ইত্যাদি।

৫. ভুক্তদ্রব্য পরিপাক না হয়ে বমি, বাহ্যে।

৬. পাকস্থলীর ঊর্ধ্বদেশে অগ্রকড়ার স্থানে বেদনা স্পর্শকাতরতা, পেট সর্বদা ভারীবোধ ও পেটে অশান্তি এবং পেট ফুলে দমশম হওয়া।

৭. শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমে অনিচ্ছো, অল্প পরিশ্রমেই ক্লান্তি, অবসাদ, মনমরা, স্ফুর্তিহীনতা, মেজাজ খিটখিটে একটুতেই ক্রোধ, অনিদ্রা, নিদ্রায় স্বপ্ন, মাথাধরা, চোখে কম দেখা, অন্ধকার দেখা, মুখের চেহারা বিবর্ণ, ক্লিষ্ট চোখ বসা, শরীরের রঙ ফেকাসে কিংবা হলদে হওয়া, ঠোঁটের মুখের, জিবের, চোখের রক্ত কমে আসা প্রভৃতি।

৮. হাত পা সর্বদা ঠাণ্ডা, একটু ঠাণ্ডাতেই ঠাণ্ডা লাগা।

৯. ক্রমশঃ শরীরের মাংস ও শক্তি কমে আসা, শীর্ণ অকর্মণ্য ও দুর্বল হয়ে পড়া।

পরীক্ষা–নিরীক্ষা :

চিকিৎসকের পরামর্শ মতো যার ক্ষেত্রে যেটি প্রযোজ্য সেই অনুযায়ী পরীক্ষা করতে হবে, যেমন–আলট্রাসনোগ্রাম, ইসিজি, বুকের এক্সরে, রক্তের ইউরিয়ার পরিমাণ নিরূপন, ইলেকট্রোলাইট, যকৃত ক্রিয়ার পরীক্ষা (লিভার ফাংশান টেস্ট) ইত্যাদি।

পথ্যাদি:
যতক্ষণ পরিপাকের ব্যাঘাত বর্তমান থাকে, ততক্ষণ কোন গুরুপাক খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করা অবিধেয়। দুধসাগু, দুধবার্লি, কচি ডাবের জল, ঘোলের শরবৎ এবং অবস্থা বিশেষে জীয়েল মাছের ঝোল, নরম ভাত ও রাত্রিকালে দুধ, প্রভৃতি সহজপাচ্য খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করা উচিত। খুব বেশি পরিমাণে খাওয়াও ঠিক হবে না।

হোমিওপ্যাথিক প্রতিবিধান :
ডিসপেপসিয়া নিরাময়ে হোমিওপ্যাথিতে অত্যন্ত ফলদায়ক ওষুধ আছে। লক্ষণ সাদৃশ্যে নির্দিষ্ট মাত্রায় নিম্নলিখিত ওষুধ প্রয়োগ করে এই রোগ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। যথা : ১. নাক্সভমিকা ২. এন্টিমক্রুড ৩. পালসেটিলা ৪. সালফার ৫. ইপিকাক ৬. লাইকোপোডিয়াম ৭. কার্বোভেজ ৮. চায়না ৯. নেট্রামফস ১০. ম্যাগনেসিয়া ফস ১১. ক্যালিমিউর ১২. আর্সেনিক ১৩. ব্রায়োনিয়া ১৪. ফসফরাস ১৫. ক্যালকেরিয়া ১৬. আইরিস ভার্স ১৭. এসিড ফস ১৮. পডোফাইলাম ১৯. সিপিয়া ২০. কোনিয়াম ২১. অ্যালুমিনা, ২২. অ্যালোজ, ২৩. অ্যানাকার্ডিয়াম ২৪. আর্সেনিকাম ২৫. আর্জেন্ট নাট্রিকাম ২৬. অ্যামোন মিউর, ২৭. সালফিউরিক এসিড ২৮. বিসমার্থসহ আরো ফলদায়ক ওষুধ আছে। তার পরেও চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন করা উচিত। (সংগৃহীত)

এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ