আজকের শিরোনাম :

ব্র্যান্ডের মোড়কে নকল পণ্য

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:১৩

দেখলেই মনে হবে নামিদামি বিদেশি সব পণ্য। কিন্তু নামিদামি ব্র্যান্ডের মোড়ক ও নাম নকল করেই ভেজাল পণ্য সামগ্রী দীর্ঘদিন ধরে বাজারজাত করছে অবৈধ সব প্রতিষ্ঠান।

সাভারের আশুলিয়ায় মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভেজাল বিরোধী অভিযান চালায় র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযান পরিচালনা করেন র‌্যাব-৪ এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিজাম উদ্দিন। তাদের অভিযানে ধরা পরে তিনটি কোম্পানির ফ্যাক্টরি। যেখানেই অবৈধভাবে চলছিল ভেজাল পণ্য তৈরি ও বিক্রির কার্যক্রম।

কোম্পানি তিনটি হল- আশুলিয়া ইউনিয়নের কাঠগড়া পশ্চিমপাড়া এলাকার জান্নাত ইন্ডাস্ট্রিজ বিডি লিমিটেড, খেজুরবাগান এলাকার রক্স কনজুমার প্রোডাক্টস লিমিটেড ও কুমকুমারী বাজার এলাকায় এভারওয়ে টয়লেট্রিজ কারখানা।

এসব কারখানায় বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশনের (বিএসটিআই) অনুমোদন না থাকায় ৪৩ লাখ টাকা জরিমানা করে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। সেইসঙ্গে দুটি কারখানাকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে।

সিলগালা করা দুই কোম্পানির নাম ‘রক্স কনজুমার পোডাক্টস’ ও ‘জান্নাত ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’। এই দুই কোম্পানির নেই কোনো ধরনের বৈধতা ও লাইসেন্স। এরপরও দিনের পর দিন অবৈধভাবেই চলছে তাদের ব্যবসা।

এছাড়া এরা তাদের পণ্যে ব্যবহার করছেন এমন সব মোড়ক যা দেখলেই ধোঁকা খেতে পারেন ভোক্তারা। কেননা তাদের পণ্যের মোড়কগুলো নামি দামি বিদেশি সব ব্র্যান্ডের মোড়ক। দেখতে ঠিক একই রকম, এমনকি নামেও রয়েছে কারচুপি। এভাবেই নামিদামি সব ব্র্যান্ডের মোড়ক ও নাম নকল করে দিনের পর দিন ধোঁকা দিচ্ছেন ভোক্তাদের।

জান্নাত ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে ও র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, একটি প্রতিষ্ঠানের নামে অন্তত ৩৩টি প্রোডাক্ট বিক্রি করে চলেছেন তারা। অথচ লাইসেন্স নেই একটিরও। শুধু তাই নয়, নোংড়া ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি করা হচ্ছে এসব পণ্য। কোনো প্রকার কেমিস্ট বা ল্যাব পর্যন্ত নেই তাদের, যার মাধ্যমে অন্তত যাচাই করা যায় পণ্যগুলো মান সম্মত কিনা?

বিভিন্ন রকম সাবান, বল পেন, সরিষার তেল, বাল্ব ইত্যাদি সব ভেজাল পণ্য পাওয়া যায় এ প্রতিষ্ঠানে। প্রতিষ্ঠানের ৩৩টি পণ্যের মধ্যে রয়েছে, মেট্রো বল সাবান, মেট্রো ডিটারজেন্ট পাওডার, এক্সেল মিনি, এক্সেল চায়না ওয়াশ, পঁচাশি সাবান, বাংলা সাবান, বল সাবান, নাইস গোল্ড সাবান, গুড়া সাবান, ফেনা লন্ড্রি সাবান, মাজনী মেগা সাইজ, বলপেন পেন্সিল পেন, বলপেন হাই মাদ্রাসা, মেট্র মশার কয়েল (লাল), নাইস ব্যান্ড ১০০ মশার কয়েল, মেট্রো বাল্ব, চায়না বাংলা এনার্জি লাইট, মানিকগঞ্জ সরিষার তেল, মেট্রো ভোল্টা এনার্জি ইত্যাদি।

তবে প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বরত নাসির এসব পণ্যের একটিরও কোনো বৈধতা কিংবা লাইসেন্স দেখাতে পারেন নাই। এমনকি পণ্যগুলোর মান নিয়েও কোনো ধরনের বৈধতা দেখাতে অপারগ হন তিনি। পরে কারখানার মালিক মোবারক হোসেনকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা ও সেইসঙ্গে কারখানাটিকে সিলগালা করে দেওয়া হয়।

রক্স কনজুমার প্রোডাক্ট নামের আরেক কোম্পানির ফ্যাক্টরিতেও মিলে একই চিত্র। অন্তত ১৫টি প্রোডাক্ট বাজারে ছাড়ছেন তারা। কিন্তু এসব প্রোডাক্টের নেই কোনো বিএসটিআই অনুমোদন আর লাইসেন্স। প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চঞ্চল মাহমুদ লাইসেন্স দেখালেও শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায় ওই লাইসেন্স এর মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে ২০০৯ সালে। মানে ১০ বছর ধরে কোনো ধরনের অনুমোদন আর লাইসেন্স ছাড়াই অবৈধ পণ্য বাজারে বিক্রি করছেন তারা।

চঞ্চল মাহমুদ আরও বলেন, বসুন্ধরা গ্রুপের থেকে তারা তেল ক্রয় করে আনেন। এরপর ওই সব তেল আবার বাজারে ছাড়ছেন অন্য মোড়ক আর ভিন্ন নামে। এসব পণ্য ক্রয়ের চালান দেখতে চাইলে তিনি দেখান নরসিংদী থেকে দুলাল চন্দ্র সাহা নামে একজন মাল কিনেছেন। অথচ এই দুলাল সাহা কে তার কোনো পরিচয় তাদের কাছে নেই। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, দুলাল সাহা বসুন্ধরা থেকে পণ্য ক্রয় করেছেন। আর এরপর তারা দুলাল সাহার থেকে পণ্য ক্রয় করেছেন। অথচ দুলাল সাহার থেকে পণ্য ক্রয়ের কোনো চালান নেই তাদের কাছে।

প্রতিষ্ঠানের মালিকের নাম হাজী মতিউল্লাহ। কিন্তু তার কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি অসুস্থ বলে জানান প্রতিষ্ঠানের কর্মরতরা। শেষমেশ আসেন প্রতিষ্ঠানের আরেক হাবিবুল্লাহ বুলু। তিনি শেষে জানান, ১০ বছর ধরে তিনি তার প্রতিষ্ঠানের ফ্যাক্টরিতে আসা তো দূরের কথা কোনো ধরনের খোঁজ খবর ও নেন না। এমনকি তার প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সের মেয়াদ ১০ বছর আগে শেষ হয়ে গেছে সেই খবর ও নেই তার কাছে। র‍্যাবের প্রশ্নের সম্মুখীনে দায় চাপিয়ে দেন কর্মচারীদের ওপর। পরে অবশ্য নিজের দোষ স্বীকার করে নেন।

প্রতিষ্ঠানের ১৫টি পণ্যের মধ্যে দেখা যায়, ভারতের রিন কোম্পানির নামকরণে রিম, সার ফেক্সেল নামকরণে সুপার এক্সেল নামক ডিটারজেন্ট। শুধু তাই নয় ঠিক ওই কোম্পানির মতই মোড়ক ব্যবহার করছেন তারা। যা দেখলে যে কেউ ধোঁকা খেতে পারেন। ভোক্তাদের বুঝার পর্যন্ত উপায় নেই।

এসব পণ্য কোথায় বিক্রি করা হচ্ছে জানতে চাইলে মালিক জানান, এসব পণ্য উত্তরবঙ্গে সাপ্লাই দেওয়া হয়।

শেষে কারখানার মালিক হাবিবুল্লাহ বুলুকে ৩০ লাখ টাকা জরিমানা ও সেইসঙ্গে কারখানাটি সিলগালা করে দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিজাম উদ্দিন।

তিনি জানান, আশুলিয়ার কাঠগড়া পশিচমপাড়া এলাকার জান্নাত ইন্ডাস্ট্রিজ বিডি লিমিটেড কারখানার মালিক মোবারক হোসেন দীর্ঘদিন ধরে বিএসটিআই এর অনুমোদন না নিয়ে ও অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে সাবান ডিটারজেন্টসহ ৩৩টি পণ্য তৈরি করে বাজারজাত করে আসছিলেন। পরে এলাকাবাসীর অভিযোগের ভিত্তিতে আজ ওই কারখানায় অভিযান চালিয়ে কারখানার মালিক মোবারক হোসেনকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা ও সেইসঙ্গে কারখানাটিকে সিলগালা করে দেয়া হয়েছে।

রক্স কনজুমারে অভিযান পরিচালনা শেষে নিজাম উদ্দিন জানান, কোম্পানিটিতে অভিযানে অন্তত ১৫টি প্রোডাক্ট আমরা পেয়েছি। যার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কসমেটিক্স, সাবান, তেল, ডিটারজেন্ট, চিনি, লবণ ইত্যাদি পাওয়া যায়। যেগুলোর কোনো ধরনের অনুমোদন নেই। তারা বিএসটিআইয়ের নকল অনুমোদন ব্যবহার করে পণ্য বাজারজাত করে যাচ্ছেন। কিন্তু মূলত তাদের কোনো ধরনের অনুমোদন নেই বলে আমরা অনুসন্ধানে পেয়েছি।

তিনি আরও বলেন, তারা যে তেলটি এখানে বাজারজাত করছেন, সেটা তারা খোলা বাজার থেকে কিনে আনছেন। এরপর নকল বিএসটিআই এর অনুমোদন ব্যবহার করে সেটিকে বাজারজাত করছেন। অথচ এর কোনো অনুমোদন আমরা পাই নাই।  

এসব অপরাধের জন্য প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, ম্যানেজার ও অন্যান্য যারা আছেন তাদেরকে ৩০ লক্ষ টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে দুই বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে বলে জানান নিজাম উদ্দিন।

এবিএন/শংকর রায়/জসিম/পিংকি

এই বিভাগের আরো সংবাদ