আজকের শিরোনাম :

‘শেখ হাসিনা দেওবন্দ বিষয়টা বুঝেছেন’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২০, ১০:০২

কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি আদায়ে যে কয়েকজন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন, আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। বর্তমান সরকারের আমলে স্বীকৃতির বিষয়টি তিনিই প্রথম উত্থাপন করেছিলেন। 

২০১১ সালে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশনের কো-চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। দেশের সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলন ও জঙ্গিবাদ দমনেও আল্লামা মাসঊদের রয়েছে ব্যাপক অবদান। 

ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে ১৯৭৬ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথমস্থান অধিকার করে ফাজিল পাস করেন।

তিনি শোলাকিয়া জাতীয় ঈদগাহের ইমাম, জাতীয় দ্বীনি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ও বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার সভাপতি, ইকরা বাংলাদেশের পরিচালক, এশিয়া ফাউন্ডেশনের বিশেষ পরামর্শক, ফাউন্ডেশন ফর গ্লোবাল পলিসি স্টাডিজ, ইসলামিক রিসার্চ কাউন্সিল অব বাংলাদেশ, ইকরা মাল্টিমিডিয়া ওয়ার্ল্ডওয়াইড লিমিটেডের সভাপতি এবং মাসিক পাথেয় পত্রিকার সম্পাদক।

আল্লামা আহমদ শফীর (রহ.) ইন্তেকালের অব্যবহিত পর তার মূল্যায়ন, অবস্থান ও কওমি পরিমণ্ডলের নানা বিষয়-আশয় নিয়ে জনপ্রিয় একটি দৈনিকের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। তা হুবহু তুলে ধরা হলো-

প্রশ্ন : কওমি স্বীকৃতির জন্য আপনি দৌড়ঝাঁপ করেছেন। স্বীকৃতির এক বছর পেরিয়ে যাবার পর এখন আলোচনা উঠছে- স্বীকৃতি কতটুকু ফলপ্রসূ হলো?

ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : ফল পাবার সময় এখনই না। আরও অপেক্ষা করতে হবে। মাত্রই তো ধানের বীজ বপন হলো। বীজ শক্ত হবে, চারা গজাবে, চারা বড় হবে, আবার চারা রোপণ হবে, চারা ঘন সবুজ হবে, শীষ হবে, ধান আসবে, ধান শক্ত হবে, পোক্ত হবে। 

তারপরও শত বিপর্যয়ের সম্ভাবনা থাকে। ফল পেতে তাড়াহুড়া করলে হয় না, সময়-প্রজ্ঞা-পরিকল্পনা লাগে। 

সৌদির এক সেমিনারে পাকিস্তান বেফাক বোর্ডের সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা হানিফ জালন্ধরির সঙ্গে দেখা হল। তিনি বিস্মিত হয়ে আমাকে বললেন, আপনারা তো ইতিহাস করে দিয়েছেন। স্বীকৃতি, তা-ও আবার দেওবন্দের সব উসূল ঠিক রেখে! 

এটা শুধু কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি নয়, খোদ দেওবন্দকেই স্বীকৃতি প্রদান। আপনারা যা করেছেন, তা পাকিস্তানেও আমাদের পক্ষে সম্ভব না।

একটা জিনিস থেকে উপকৃত হতে হলে তিনটা জিনিসের দরকার হয়- এক. সময়, দুই. প্রজ্ঞাপূর্ণ নেতৃত্ব ও তিন. সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনা। 

কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, হাইয়াতুল উলইয়াতে এর কোনোটাই নেই। এতদিন নেতৃত্বে ছিলেন আল্লামা আহমদ শফী (রহ.)। তিনি যে বয়স অতিক্রম করছিলেন, তাতে তার সৃষ্টিশীলতার কোনো সুযোগ বা শক্তি ছিল না। 

আর এসব নেতৃত্বের জন্য সৃষ্টিশীলতার দরকার হয়। তার অধীনে যারা ছিলেন তারা নিজেরাও সৃষ্টিশীল চিন্তা করেননি। কথা বলেছেন সব আল্লামা শফীর (রহ.) রেফারেন্সে। এভাবে এক শতাব্দী সময় দিলেও গাছে ফল ধরবে না।

প্রশ্ন : স্বীকৃতির আগেও দেশের অনেক শিক্ষাবিদ বিভিন্ন ফোরামে প্রশ্ন তুলছেন বোর্ডের/সংস্থার অধীনে ইউনিভার্সিটি লেভেলের স্বীকৃতি দেওয়া হলো। এটা কতটা মূল্যায়িত হবে?

ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : অবশ্যই মূল্যায়িত হবে, যদি মূল্যায়ন নিতে পারি। সংস্থা বা বোর্ডের অধীনে সার্টিফিকেটের প্রচলন ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে আছে। একটা হলো আনুষ্ঠানিক, আরেকটা অনানুষ্ঠানিক। 

নজরুল ইসলামের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই, কিন্তু অনানুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আছে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতন থেকে পাশ করে আফগানিস্তানে গেছেন চাকরি করতে। স্বাধীনতাপূর্ব সে সময়ে শান্তিনিকেতন ছিল অনেকটা কওমি মাদ্রাসার মতো। কোন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তার লিয়াজোঁ ছিল না। 

সৈয়দ সাহেব আফগান থেকে ফ্রান্সে গেলেন পিএইচডি করতে। তার তো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিলও না- কীভাবে পিএইচডির অনুমতি পেলেন? 

এই ঘটনা যখন ইউজিসির চেয়ারম্যান একে আজাদ সাহেবকে বললাম, তিনি বললেন, আপনারা সংস্থার অধীনেই স্বীকৃতি নেন। পিএইচডি, ডিগ্রি যাবতীয় যা লাগে, তার ব্যবস্থাপনা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে করা যাবে।

প্রশ্ন : ইউসিজির সঙ্গে পরবর্তী সময়ে আলোচনা কতদূর এগিয়েছে? আদৌ আলোচনা হয়েছে?
 
ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ :
না, আলোচনা এগোয়নি। কীভাবে আলোচনা হবে? যারা স্বীকৃতির মঞ্চে, তারা তো আমাকে কথাই বলতে দেয় না। সহযোগিতা করতে গেলে হাত ভেঙে দেয়।

প্রশ্ন : আল্লামা শফীর (রহ.) পরে আপনি কাকে বেফাক মানে কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের প্রধান হিসেবে দেখতে চেয়েছেন?

ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : এখানে তো আমার চাওয়া-না চাওয়ায় কিছু আসে-যাবে না। যদিও বেফাক বোর্ড প্রথমে যারা গঠন করেছিলেন, তাদের পাঁচজনের মধ্যে কেবল আমিই বেঁচে আছি। 

গত হয়ে যাওয়া অন্যতম হলেন মাওলানা আশরাফ আলী, মাওলানা শামসুদ্দিন কাসেমি, মাওলানা রেজাউল করিম ইসলামাবাদী এবং মাওলানা ফজলুর রহমান।

প্রশ্ন : কওমি স্বীকৃতি ঘোষণার সময়ে সময় আপনি ৫ মে শহীদদের হত্যাকাণ্ডের তদন্তের বিচারের দাবি জানিয়েছেন...

ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : আমি তদন্তের দাবি জানিয়েছিলাম, কিন্তু যারা দাবি জানানোর কথা, তারা জানায়নি। অনেক সময় এ নিয়ে আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও অনেক কড়া কথা বলেছি। তিনি আমার কথাগুলো সহ্য করে উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। 

মাওলানা মোহাম্মদ আলী সাক্ষী, তিনি সেখানে ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী খুব উদার। হয়তো রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে কখনও কখনও তাকে কঠোর হতে হয়।

প্রশ্ন : তদন্ত-প্রক্রিয়া পরবর্তীতে এগিয়েছে? বা শুরু হয়েছে?

ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : হবে কীভাবে। যাদের দাবি জানানোর কথা, তারা তখনও তদন্তের দাবি জানায়নি, আজও দাবি করে না। হেফাজতের শীর্ষ নেতাসহ একটা তদন্ত কমিটি করার দাবি ছিল। 

এখন তো তারা ৫ মের শহীদ শব্দটিকে চাঁদা তোলার মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। যতদিন জিইয়ে রাখা যাবে, ততদিন চাঁদাও তোলা যাবে। তবে দাবি না জানানোর পেছনে স্বার্থ ছাড়াও আতঙ্ক আরেকটা কারণ হতে পারে হয়ত বা।

প্রশ্ন : ৫ মের আক্রান্তদের আপনি শহীদ মনে করেন কিনা?

ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : শোনেন, একটি হল রাজনৈতিক শহীদ; দ্বিতীয়টি হল শরিয়তের পরিভাষার শহীদ। তৃতীয়ত হল ফজিলতের শহীদ। 

৫ মে যারা নিহত হয়েছে,  তাদের শরিয়তের পরিভাষায় শহীদ বলা হবে না। তবে যাদের নিয়ত সহিহ ছিল, আল্লাহর কালিমা বুলন্দ করার জন্য এসেছিল, তারা শহীদের মর্যাদা ও ফজিলত পাবে। আমি দোয়া করি, আল্লাহ তাদের শহীদী মর্যাদা দান করুন।

প্রশ্ন : শোনা যায়, ৫ মের হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দেওয়া ও সহনীয় করার জন্য স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। এটা আসলে একটা দরকষাকষির মাধ্যম ছিল...

ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : এটা আমি মনে করি না। কারণ স্বীকৃতি যখন দিয়েছেন, ততদিনে সরকার হেফাজত দমন করে ফেলেছে। মানুষ ভাবতোই না যে হেফাজত আবার উঠে দাঁড়াতে পারবে। এই পর্যায়ে এসে দরকষাকষি করার কোনো মানে হয় না। 

আমি যতটুকু বুঝেছি- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেওবন্দ বিষয়টা বুঝেছেন। তিনি ভেবেছেন- কওমি মাদ্রাসার বিরাট এই জনগোষ্ঠী এ দেশেরই নাগরিক। নাগরিকদের উন্নয়ন ছাড়া দেশ এগোতে পারে না। তাই তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন।

প্রশ্ন : স্বীকৃতির পরে শোকরানা মাহফিল দিয়ে সরকারকে তোষামোদি করা হলো কিনা?

ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : এটা তোষামোদি না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনেকদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করছি- তিনি তোষামোদে ভোলার মানুষ নন। তোষামোদ করে তার নিকটবর্তী কেউ হতে পারেনি। 

শোকরানা মাহফিল হয়েছে তার কাজের শুকরিয়া জানানোর জন্য। কওমি স্বীকৃতির আন্দোলনটি অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে চলছে। স্বীকৃতির বিষয়টাতে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাও একমত ছিলেন না। কিন্তু শেখ হাসিনা একক প্রচেষ্টায় স্বীকৃতি দিয়েছেন। 

এতবড় কাজটি করলেন, তাকে সংবর্ধনা জানানোটা দরকার ছিল। হাদিসেই তো আছে- যে মানুষের শুকরিয়া আদায় করতে পারে না, সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে পারে না।

প্রশ্ন : কিন্তু কওমি জননী বলা হয়েছে তাকে
 
ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ :
এটা মাহফিলের পক্ষ থেকে বলা হয়নি। এছাড়া কারও কারও বক্তৃতায় যে তোষামোদি প্রকাশ পেয়েছে, সেটা একান্তই তার নিজের।

প্রশ্ন : করোনাকালে সরকার কওমি মাদ্রাসায় অনুদান দিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এটা স্বীকৃতির মন্দ ফল...

ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : এটা যারা বলছে, তারা মেরুদণ্ডহীন। নিজেদের প্রতি তাদের আস্থা নেই। বিপর্যয়ে সরকার সবখাতে অনুদান দিয়েছে, এখানেও দিয়েছে। অনুদান পেলেই অনুগত বা নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাব- এটা দুর্বল মানসিকতা। 

প্রশ্ন : স্বীকৃতি তো হয়ে গেলো। এটাকে ফলপ্রসূ করার জন্য আলেমগণ যদি উদ্যোগ না নেয়, পরিকল্পনা না গ্রহণ করে, তাহলে সরকার হস্তক্ষেপ করবে কিনা?

ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : সরকার হস্তক্ষেপ করবে বলে মনে হয় না। এটা যেহেতু আলেমদের বিষয়, তারা যে পরিকল্পনা দিবে, সরকার সে-মতে কাজ করবে, সহায়তা করবে। এখন স্বীকৃতিকে ফলপ্রসূ করার দাবি ওঠা উচিত। 

দেশে অনেক ক্ষেত্র রয়েছে, কওমি আলেমদের সেখানে ইনক্লুড করা যায়। যেমন- সরকারি মসজিদের ইমাম, প্রাইমারি, হাইস্কুল এবং কলেজের ধর্মশিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী স্টাডিজের প্রফেসর ইত্যাদি আরও অনেক জায়গা রয়েছে । কিন্তু দাবি জানিয়ে এর জন্য আগে প্রস্তুত হতে হবে।

প্রশ্ন : ইসলামী ফাউন্ডেশনের দারুল আরকাম মাদ্রাসা প্রজেক্ট কওমি মাদ্রাসার বিকল্প চেষ্টা দাঁড় করানোর পরিকল্পনা কিনা?

ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : এটা করেছেন প্রধানমন্ত্রী, তাকে তো আন্তরিক বলেই মনে হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক ডিজি মরহুম শামীম আফজাল তখন প্রধানমন্ত্রীকে এ বিষয়ে বুঝিয়েছিলেন।

কিন্তু কওমি মাদ্রাসার বিকল্প তো সম্ভব না। খোদ সরকার কেন, কেউ এর বিকল্প দাঁড় করাতে পারবে না। কওমি মাদ্রাসা একটি অভিনব শিক্ষাপদ্ধতি। বিকল্পের চিন্তাটা মরহুম শামীম আফজালের থাকলে থাকতেও পারে।

প্রশ্ন : ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নতুন ডিজি নিয়োগ করা হলো। প্রস্তাবিত ডিজি হিসেবে আপনার নামও ছিল বলে গুঞ্জন আছে...

ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : আমার নাম ছিল হয়ত, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে কোন প্রস্তাব দেয়া হয়নি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনে যখন চাকরি করেছি, তখন সেটা চাকরি হিসেবে করিনি, কৌতূহল হিসেবে করেছি। 

আমার একটা ইচ্ছে ছিল- ডিগ্রি না থেকেও তাদের সঙ্গে টক্কর দেয়া। মওদুদিরা যখন ক্ষমতায় আসে, তখনও আমার চাকরির আট বছর বাকি। কিন্তু মওদুদিদের অধীনে চাকরি করতে হবে ভেবে চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। 

নিজের পরিবারের দিকেও তাকাইনি। তারপর কখনও বেতন চাইনি। পেনশনও পাইনি আজ পর্যন্ত। আমি যেন পেনশন না পাই, তাই তারা আলাদা একটা রেজুলেশন করেছিল। চাইলে আমি এখন রেজুলেশন বদলে পেনশন নিতে পারি। কোনও কিছু পাওয়ার জন্য লালায়িত নই। তবে পেলে না করি না।

প্রশ্ন : কওমি পরিমণ্ডলের একটা আওয়ামীবিরোধী ইমেজ আছে। কিন্তু আপনি বরাবর আওয়ামী লীগের পক্ষে-এটা কেন হল?

ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : সাংগঠনিকভাবে আমি আওয়ামী লীগের কেউ নই। তবে আওয়ামী লীগকে সহযোদ্ধা হিসেবে পেয়েছি। বিএনপির আমলে আমাকে জেলে যেতে হয়েছে । 

মুক্তিযুদ্ধ থেকে নিয়ে বাঙালি ও বাংলাদেশের সব মৌলিক অর্জনে আওয়ামী লীগের সফল নেতৃত্ব ছিল। গত দশ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, একটা ক্ষেত্র দেখান- যেখানে আমি আওয়ামী লীগ থেকে সুবিধা নিয়েছি। 

তবে আমি যে স্বপ্ন দেখি, যে পরিকল্পনা করি, তাতে বিএনপিকে পাশে পাইনি কখনও, আওয়ামী লীগকে সহযোগী হিসেবে পেয়েছি। কওমি স্বীকৃতি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইত্যাকার অনেক ক্ষেত্রে আমার স্বপ্নপূরণে তারা সহযোগীতা করেছে। 

ইহুদিদের একটা চক্রান্ত হল- যদি কাউকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাও, তার কথাকে গুরুত্বহীন করে দিতে চাও, তাহলে তাকে এমনভাবে হেয়প্রতিপন্ন কর, যেন সমাজ তার কথা শুনলেই নাক সিঁটকায়। 

আমার মওদুদিবিরোধী আন্দোলনকে দমানোর জন্য, আমাকে হেয় করার জন্য মওদুদিবাদীরা আমাকে হেনস্থা করতে সদাতৎপর। এতে যোগ দিয়েছে কওমি মাদ্রাসার সরল কিছু ছাত্র।

প্রশ্ন : তাহলে বাংলাদেশের আলেমদের সঙ্গে আপনার বিরোধের মূল জায়গাটা কী?

ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : আলেমদের সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই। এটা আমার দাবি। তারা যদি বিরোধ মনে করে থাকে, তাদের জিজ্ঞেস করুন, বিরোধের মূল কারণ কী? কোনো হক্কানি ওলামায়ে কেরামের সঙ্গে আমার মৌলিক বিরোধ নেই। 

পদ্ধতিগত মতপার্থক্য থাকতে পারে। যেমন আমি বাংলাদেশে এখন ইসলামের মূল শত্রু মনে করি মওদুদিবাদকে। হয়তো অন্যদের কাছে এটা দুই নম্বরে। এতটুকুই পার্থক্য। এটাকে বিরোধ বলে না।

প্রশ্ন : মারকাযুদ দাওয়াহর মাওলানা আবদুল মালেক সাহেবের সঙ্গে আপনার দ্বন্দ্বের কথা শোনা যায়...

ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : সে তো আমার ছাত্র সমতুল্য। তাকে স্নেহ করতে পারি, প্রতিদ্বন্দ্বী বানাতে পারি না। আমি কাউকে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করি না। সব আলেম আমার সহযোগী এবং সহযাত্রী।

তবে একটা কথা- মাওলানা আবদুল মালেকের বয়সও যেমন কম, তেমনি জ্ঞানেও পরিপক্বতা আসেনি। বাড়াবাড়ি আছে তার মধ্যে।

প্রশ্ন : তাবলিগের বিভক্তির বিতর্কেও অনেকে মনে করেন- আপনি সাদ কান্ধলভির সমর্থক। অথচ আপনি দেওবন্দে পড়েছেন...

ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : আমি নিজেই বলেছি- দেওবন্দের মতই আমার মত। দেওবন্দের পরামর্শ নিয়েই আমি দুদলকে মেলানোর চেষ্টা করেছি। কারণ আমি চাই না, হকপন্থী এতবড় একটি দলে ভাঙন সৃষ্টি হোক। 

আমাকে সমর্থন দিয়েছেন দেওবন্দের মুহতামিম নোমানী সাহেব, মরহুম মাওলানা সাঈদ আহমদ পালনপুরী সাহেব, মাওলানা আরশাদ মাদানীও মাহমুদ মাদানী সাহেব। 

সুতরাং কারও বিভ্রান্তি থাকার কথা নয়। প্রথম তিনজন পরামর্শ করে আমাকে অনুমতি দিয়েছেন। আমি সাদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি।
 
প্রশ্ন : সাদ সাহেবের ভুলগুলো নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?

ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : কিছু ভুল তিনি মানেন, অনেকগুলোই মানতে চান না, বিশ্লেষণ পেশ করেন। আলেমদের সঙ্গে মিলনের জন্য তিনিও আগ্রহী। ঠিক হয়েছিল তিনি দেওবন্দ যাবেন। 

দেওবন্দ থেকে হযরত আরশাদ মাদানি আমাকে বললেন, তিনি গেলে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হবে কিন্তু পরে তিনি কেন যাননি, তা বোধগম্য নয়। হয়তো আশেপাশের কেউ তাকে বিভ্রান্ত করেছে।

প্রশ্ন : জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আপনি এক লাখ আলেমের শান্তির ফতোয়া প্রকাশ করেছেন। র‌্যাব থেকে প্রকাশিত জঙ্গিবাদের অপব্যাখ্যা ও ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা বইয়ে আপনার সম্পাদনার কাজ আছে। জিহাদ ও জঙ্গিবাদ নিয়ে আপনার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি বলুন।

ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : জিহাদকে অস্বীকার করা কোনো মুমিনের পক্ষে সম্ভব না। জিহাদ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। যদিও এটি আরকানে খামসা তথা পাঁচ স্তম্ভের অন্তর্ভুক্ত না বা ফরজে আইন না, তবে কখনও কখনও ফরজে আইন হয়ে যায়। 

এটাকে অস্বীকার করলে কুফরির বহুল আশঙ্কা আছে। আমি নিজেকে মুমিন মনে করি; তাই আমার পক্ষেও জিহাদ অস্বীকার করা সম্ভব না। তবে জিহাদ ও জঙ্গীবাদ একজিনিস নয়। জিহাদ অনেক ব্যাপক জিনিস। কোনও কোনও ক্ষেত্রে জিহাদ এবং জঙ্গিবাদ- দুটোর বাইরের প্রতিফলন একই রকম কিন্তু মৌলিকভাবে দুটি ভিন্ন জিনিস। 

যেমন- তাকাব্বুর ও গাইরাত (অহঙ্কার ও আত্মসম্মানবোধ)। দুটোর প্রকাশ একই কিন্তু মৌলিকভাবে দুটোর মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। তাকাব্বুর হারাম আর গাইরাত আবশ্যক।

আল্লামা ইদ্রিস কান্ধলভি একটা উদাহরণ দেন। একটি ছুরি- ডাক্তারের হাতেও ছুরি থাকে, ডাকাতের হাতেও ছুরি থাকে। ডাক্তারও ছুরি দিয়ে কাটাকাটি করেন, ডাকাতও করে। ছুরির কাজের প্রতিফলনটা কিন্তু একই। কিন্তু কোনো পাগলও ডাক্তারকে ডাকাত বলবে না। কাজ দেখলে মনে হয় দুটো এক। 

কিন্তু মৌলিকভাবে দুটো আলাদা। এটা হলো অনুভবের পার্থক্য। সুতরাং জিহাদ ও জঙ্গিবাদকেও এই মৌল অনুভবের মাধ্যমে পার্থক্য করতে হবে।

এছাড়াও জিহাদের বাহ্যিক কিছু আলামত আছে।  জিহাদের পাঁচটি পর্যায়। এরমধ্যে সর্বশেষ হলো কিতাল। বাকিগুলো নিয়ে বিতর্ক নেই। বিতর্ক সর্বশেষটি নিয়ে। এটিকে আলাদা শব্দে বলা হয়েছে- কিতাল। 

তাই বোঝা গেল, জিহাদ মানেই কিতাল নয়। জিহাদের কতগুলো শর্ত আছে। এক. আমীর হওয়া। রাসূল (সা.) মক্কায় থাকতে জিহাদ করেননি। কারণ তখনও তিনি রাজনৈতিক আমির হননি। 

দুই. সক্ষমতা। সক্ষমতার পরিমাপ হল- শত্রুর অন্তত অর্ধেক শক্তি থাকা। শত্রুর যদি ১ হাজার যুদ্ধবিমান থাকে, তাহলে আমার থাকতে হবে পাঁচশ বিমান। তার যদি সৈন্য দুই লাখ থাকে, আমার থাকতে হবে এক লাখ সৈন্য। 

সূরা আনফালে যেমন বলা হয়েছে (আয়াত ৬৬)- তোমাদের মধ্যে যদি দৃঢ়চিত্ত একশ' লোক বিদ্যমান থাকে, তবে জয়ী হবে দুশর ওপর। আর যদি তোমরা এক হাজার হও তবে আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী জয়ী হবে দুহাজারের ওপর আর আল্লাহ রয়েছেন দৃঢ়চিত্ত লোকদের সঙ্গে।

তিন. জিহাদের জন্য একটা স্থান লাগে; যেখান থেকে যুদ্ধের জন্য বের হবে, যুদ্ধ শেষে ফিরে আসবে। শাহ আহমদ শহীদ (রহ.) বালাকোটের যুদ্ধে সীমান্ত এলাকা কেন বাছাই করেছেন? কারণ সেই এলাকা ছিল ব্রিটিশ শাসনের বাইরে। সেখান থেকে যুদ্ধে বের হবেন, যুদ্ধ শেষে সেখানে ফিরে যাবেন।

প্রশ্ন : অনেকে বলেন- হলি আর্টিজানে যারা হামলা করেছে তারা নয় বরং যেসব সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে গুলি ছুড়েছে, তারা জিহাদ করেছে...

ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ :  হতে পারে। আসলে জিহাদ তো বিভিন্ন ধরনের। এটা নির্ভর করবে যার যার নিয়তের ওপর। এটা আমল; আমলের ভিত্তি নিয়তের ওপর। কার নিয়ত কী ছিল, সেটা জানা আমার সম্ভব না।

প্রশ্ন : তালেবান সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?

ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : তারা যতদিন কুফরি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, তারা জিহাদের সাওয়াব পাবে। যেমন রাশিয়া ও আমেরিকার কাফের সৈন্যদের বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধ করেছে। কিন্তু এখন যখন নিজেদের মধ্যে লড়াই শুরু করেছে, তা নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।

প্রশ্ন : আপনার নামে একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। সেটা কি আপনার?

ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : এটা আমি জানি না। আমাকে আরও অনেকেই বলেছেন। অথচ আমি কম্পিউটারও চালাতে জানি না। আমি লেখালেখিও করি হাতে। এই অ্যাকাউন্ট আমার না।

প্রশ্ন : দীর্ঘ সময় দেয়ার জন্য শুকরিয়া।

ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : আপনাদেরও।
(দৈনিক যুগান্তর থেকে নেয়া)

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ