আজকের শিরোনাম :

‘করোনা মোকাবেলায় জোনভিত্তিক ব্যবস্থা নিতে হবে’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ মে ২০২০, ১২:০৭

ডা. মোজাহেরুল হক। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে সরকারি চাকরিতে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। সেন্টার ফর মেডিকেল এডুকেশন ও জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন তিনি। ২০১১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিজিওনাল অ্যাডভাইজার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান থেকে প্রথম স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। পড়াশোনা করেন লন্ডন হসপিটাল মেডিকেল কলেজ এবং পরবর্তী সময় যুক্তরাজ্যের ড্যান্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে ইউনেস্কোর মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইথিকস বিষয়ে পড়াচ্ছেন ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিকেল এডুকেশনের সিনিয়র অ্যাডভাইজার হিসেবে কর্মরত। এটি বিশ্বে চিকিৎসাশিক্ষার মান নির্ধারণ ও মান তদারকি সংস্থা। দেশের করোনা পরিস্থিতিতে করণীয় বিষয়ে জনপ্রিয় একটি দৈনিকের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। তা হুবহু তুলে ধরা হলো-

করোনা মোকাবেলায় আমাদের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

দেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। এর পর থেকে আমাদের টেকনিক্যাল পারসন, বিশেষজ্ঞ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, ভাইরোলজিস্টরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ সরকারকে দিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রথম থেকে আমারও কিছু পরামর্শ ছিল। এসব পরামর্শের মধ্যে একটি বিশেষ দিক ছিল—জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং সম্পৃক্ত করতে হবে। সরকার ভালোভাবেই জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে পেরেছিল। কিন্তু জনগণ যতটা উদ্বুদ্ধ হয়ে করোনা মোকাবেলায় যোগ দেয়ার কথা ছিল, আমরা তা তেমনভাবে লক্ষ করিনি। এর দুটো কারণ থাকতে পারে।

আমরা প্রথম থেকে বলে আসছিলাম যে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এ বার্তাটি জনগণের কাছে কীভাবে গেছে, সেটি এখন আমাদের ভাবনার বিষয়। কারণ জনগণ এটাকে ভয় পায়নি। ফলে করোনা সংক্রমণ যেভাবে মানুষ থেকে মানুষে হতে পারে, সেটি জনগণ উপলব্ধি করতে পারেনি এবং সরকারও তাদের সেভাবে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। যে কারণে সরকার পরবর্তী পর্যায়ে অন্যান্য পদক্ষেপ নিলে তাতে জনগণের মাঝে যথেষ্ট শিথিলতা আমরা দেখতে পেয়েছি।

এরপর আসুন যেসব নির্দেশনা সরকার দিয়েছে সেগুলোর ব্যাপারে। নির্দেশনাগুলোর দুটো দিক আছে। একটি মানার বিষয় এবং আরেকটি মানানোর বিষয়। কেউ কেউ মানবে, কেউ কেউ মানবে না, সেটি হতেই পারে। তবে আমাদের দেশে বেশির ভাগ লোকই যেসব নির্দেশনা এসেছে, সেগুলো মেনেছে এবং ঘরে থেকেছেও। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেছে মানানোর বিষয়ে। কিছুসংখ্যক লোক অবশ্যই মানেনি। মানতে চায়নি। তাদের জন্য মানানোর বিষয়টি থাকে। এটি সরকারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব। মানাতে গিয়ে সরকার পুলিশ বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছে, এমনকি সেনাবাহিনীকেও নামিয়েছে। কিন্তু মানানোর পর্যায়ে আমরা দেখেছি সরকার মোটামুটি ব্যর্থ হয়েছে। মানুষকে মানাতে পারেনি, যার লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি। ফলে আমাদের দক্ষিণবঙ্গ, পশ্চিমাংশ ও উত্তরবঙ্গ থেকে প্রচুর লোক আসছে ঢাকার দিকে। জনসে াতের মতো। এটা আমরা আশা করিনি। আমি বলতে চাইছি, জনসচেতনতার জন্য যথেষ্ট কার্যক্রম সরকার নিয়েছে কিন্তু জনগণকে তারা উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। আর তারা ব্যর্থ হয়েছে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে।

এখনকার পরিস্থিতিতে করণীয় কী হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

সরকারের জনসচেতনতার ব্যাপারটি ছিল বিশেষ করে স্বাস্থ্যবিধি মানা। যাতে জনগণ হাত না ধুয়ে চোখ, মুখ ও নাকে হাত না দেয়। জনগণ যাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখে। জনগণ যাতে মাস্ক পরে ঘর থেকে বের হয়। এসব বিষয় আমি বলব, জনগণ কিছুটা মেনেছে। বলব, এ জায়গায় সরকারও সফল। কিন্তু পরবর্তীতে যখন লকডাউনের বিষয়টি এল, তখন কিন্তু জনগণ দ্বিধান্বিত (কনফিউজড)। কারণ সরকার লকডাউন কথাটি উচ্চারণ করেনি। তারা বলেছে সাধারণ ছুটি। আর গত ৮ মার্চ যখন প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে, বাংলাদেশে আমরা প্রায় ১৮ দিন সময় নিয়েছি কঠোর হতে। ২৬ মার্চের দিকে এসে আমরা সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছি। এ ছুটির ঘোষণাটি নিয়ে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। সেটা হলো, জনগণ এমনকি দলবেঁধে সমুদ্রসৈকতেও গেছে। ছুটি কাটাতে দেশের বাড়িতে গেছে, বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে গেছে। ফলে সরকারের সচেতনতার মধ্যে যে বিরাট অংশ ছিল ঘরে থাকার বিষয় এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়, তা দারুণভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। এর ফলে সংক্রমণটা ছড়িয়েছে। এতে সামাজিক সংক্রমণ ঘটে গেছে। যখন সামাজিক বিস্তার ঘটে, তখন সেটি রোধ করা আর সম্ভব নয়। কারণ আমরা সবাই জানি, একজন সংক্রমিত ব্যক্তি তিনজনকে সংক্রমিত করে। আবার তার সংস্পর্শে যারা আসবে, তারাও সংক্রমণ ঘটাতে পারে। সুতরাং এটি বহুগুণ বাড়তে (মাল্টিপ্লাই) থাকে এবং আমাদের দেশে ঠিক সে বিষয়টিই ঘটেছে।

সরকার লকডাউন দেয়নি সত্য, টোলারবাগের মতো জায়গায় একটি বিল্ডিং, মোহাম্মদপুরের একটি জায়গা ও মিরপুর লকডাউন করেছে। আমরা আবার জেলা প্রশাসককে জেলায় লকডাউন ঘোষণা করতে দেখেছি। আবার থানার ওসিকে দেখেছি বাড়ি লকডাউন থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায়ে লকডাউন দিতে। লকডাউনের মতো একটি কঠোর বিষয়, যেটি সংক্রমণ রোধে সবচেয়ে বেশি সহায়ক এবং একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এ পদ্ধতির সফল ব্যবহার করেছে সংক্রমণ কমানোর জন্য, সেটি বাংলাদেশে খুব শিথিলভাবে পালন করেছে জনগণ। একই সঙ্গে সরকারও লকডাউনের নিয়মনীতিগুলো সেভাবে আইনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেনি। পরবর্তীতে একটা পর্যায়ে সরকার অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে কলকারখানা খোলার প্রস্তুতি নিয়েছে এবং পোশাক শ্রমিকদের কারখানায় যোগ দিতে মালিকরা আহ্বান জানিয়েছেন। যাতে পোশাক কারখানাগুলো চালু হতে পারে। এ ব্যাপারে শ্রমিকদের চেয়ে মালিকদের বেশি প্রচেষ্টা ছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসেছে, শ্রমিকদের বলা হয়েছে না এলে তাদের চাকরি পর্যন্ত চলে যাবে। এর মানে হলো, সংক্রমণ দমন করার আগেই লকডাউন খুলে দিলাম। এতে সামাজিক বিস্তার বাড়ার আরো একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পরবর্তীতে সরকার পাটকল খুলে দিয়েছে, রেস্টুরেন্ট খুলে দিয়েছে। এই খুলে দেয়াটা এমন সময়ে করা হয়েছে, যখন সামাজিক বিস্তার ঘটছে। কিন্তু এই জায়গায় সরকারের কাছে আমাদের পরামর্শ ছিল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ যেন আমরা মেনে চলি। তারা ছয়টি শর্ত দিয়েছিল। সেগুলো পূরণ করলেই আমরা কলকারখানা খুলে দিতে পারি। তার একটি পদ্ধতি আছে। সেটিকে আমরা বলি এক্সিট প্ল্যান। কীভাবে কীভাবে কারখানা খুলব।

বিভিন্ন দেশে আমরা দেখছি এক্সিট প্ল্যান তৈরি করে ধীরে ধীরে সবকিছু খুলছে। এখনো কিন্তু তারা সেটি করছে। অথচ আমরা তা না করে তাত্ক্ষণিকভাবে খুলে দেয়ায় সামাজিক সংক্রমণ থামছে না, বরং এটি বাড়ছে। লক্ষ করলে দেখব, যত পরীক্ষা বাড়াচ্ছি তত সংক্রমণ বাড়ছে। আমরা সরকারকে পরামর্শ দিয়ে আসছি, যতক্ষণ সংক্রমণ কমে না আসছে, ততক্ষণ যেন লকডাউন শিথিল বা তুলে না নেয়া হয়। কিন্তু সরকার সেটি বিবেচনায় আনেনি।

কখন সংক্রমণ দমন হবে?

এটি ততক্ষণ পর্যন্ত বলতে পারব না, যতক্ষণ না আমরা পরীক্ষার আওতা বাড়াতে পারব। পরীক্ষার আওতা বাড়লেই আমরা বলতে পারব কী পরিমাণ সংক্রমণ হচ্ছে এখন এবং সংক্রমণটা কোথাও গিয়ে থামছে কিনা। এটাকে ডিজিজ কার্ভ বলে। এটা এখন বাড়ছে, একসময় চূড়ায় পৌঁছবে এবং একসময় আর বাড়বে না। যতক্ষণ তা না হচ্ছে, আগে থেকে অনুমান করা যাবে না যে এটি আমাদের দেশে কবে থামবে।

এর থেকে উদ্ধারের কোনো উপায় আছে কিনা?

অবশ্যই আছে। এখনকার পরিস্থিতিতে সংক্রমণ সারা দেশে ছড়িয়েছে এবং সুখের বিষয় হলো, সব জায়গায় এক রকম ছড়ায়নি। জেলাভিত্তিক পরিসংখ্যান নিতে হবে। দেখতে হবে সুনির্দিষ্ট জেলায় পরীক্ষা কত হয়েছে এবং সংক্রমণ কত হয়েছে। এটা লক্ষ করে জেলাগুলোকে যদি আমরা গ্রিন জোন, ইয়োলো জোন ও রেড জোন তিন ভাগে ভাগ করি, তাহলে সংক্রমণ দমন সহজ হবে। রেড জোন হবে এখনকার হটস্পট যেমন ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর। যেখানে ৩০০-এর উপরে সংক্রমণ থাকবে, সেসব জেলাকে বলব হটস্পট বা আমরা সেগুলোকে একটা লাল জোনের মধ্যে নিয়ে যাব। লাল জোনের জেলাগুলোকে সম্পূর্ণভাবে লকডাউন করে দিতে হবে। এটাকে কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং অন্য বাহিনীকে প্রয়োজনে সরকার ব্যবহার করবে। জনগণকে ঘরে রাখতে হবে। ঘর থেকে বের হতে দেয়া যাবে না জরুরি প্রয়োজন ছাড়া।

যেসব জেলা ইয়োলো জোনে (১০০-৩০০ শনাক্ত) থাকবে, সেখানকার উপজেলাগুলোয় কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। এর মূল দায়িত্বে থাকবেন জেলা সিভিল সার্জন। সংক্রমণের ওপর ভিত্তি করে তিনি প্রতিটি উপজেলার জন্য কৌশল ঠিক করবেন। এখানে কোনো কোনো জায়গায় কঠোর লকডাউন দিতে হবে, কোনো কোনো জায়গায় একেবারেই শিথিল হবে। কোনো কোনো জায়গায় কেবল আক্রান্তদের আইসোলেশনে নিতে, তাদের সংস্পর্শে যারা আসবে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে। আমি অবশ্যই জোর দেব উপজেলা পর্যায় থেকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করার ওপর। আইসোলেশন অবশ্যই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করতে হবে, কোনো বাড়িতে বা ঘরে সেটি করা যাবে না।

যেসব জেলায় ১০০-এর কম সংক্রমণ আছে, সেগুলো গ্রিন জোনের আওতায় পড়বে। সেখানকার সিভিল সার্জন পরিস্থিতি অনুযায়ী কৌশল ঠিক করবেন। সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ওই জেলাগুলোয় চালু থাকবে। আক্রান্ত যেখানে থাকবেন, সেখানে কঠোরভাবে আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরোপুরি চলবে। কোনো কোনো এলাকা গ্রিন জোন আর ইয়োলো জোনে মিক্সড থাকবে। কোনো উপজেলায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল থাকবে এবং কোনো কোনো জায়গায় লকডাউন পরিপালন করতে হবে। আর রেড জোনে কঠোরভাবে লকডাউন বাস্তবায়ন করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এটা করতে পারলে আমরা সংক্রমণ দমনের একটি ভালো পদক্ষেপ নিতে পারব। সফলতা নির্ভর করবে মনিটরিংয়ের ওপর এবং ওই এলাকার সিভিল সার্জন, ডিসি, এসপি সমন্বয় করে বিষয়টি তারা কীভাবে কঠোরতার সঙ্গে বজায় রাখতে পারছেন, তার ওপর। 

আপনার কি মনে হয়, সমন্বয়হীনতা দূর না করলে পরামর্শ কাজে লাগবে?

আমি আগেই বলেছি সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে। সমন্বয়টা হতে হবে জেলা পর্যায়ে, জাতীয় পর্যায়ে নয়। যতক্ষণ না পর্যন্ত এর দায়িত্ব সিভিল সার্জনের ওপর দেয়া হচ্ছে এবং ডিসি ও এসপি যতক্ষণ না তাকে সহযোগিতা করছেন, ততক্ষণ এটি বজায় রাখা ঠিকমতো সম্ভব হবে না। এজন্য জাতীয় পর্যায়ে ঘটে যাওয়া সমন্বয়হীনতাকে সমন্বয়ে আনতে হলে একমাত্র এভাবেই সম্ভব।

এখানে তো ডিসিই সর্বেসর্বা। সিভিল সার্জনের ভূমিকা তেমন নেই।

এটা একটা স্বাস্থ্য সমস্যা। এটি ডিসি-এসপির কাজ নয়। সংক্রমণের দমনের কাজটি সিভিল সার্জনের। আইনটি যদি আমরা লক্ষ করি, তাহলে দেখব এটি স্বাস্থ্য সমস্যা। আইনে স্বাস্থ্য মহাপরিচালককে দায়িত্ব দেয়া আছে এবং তিনি এই দায়িত্ব সিভিল সার্জনের মাধ্যমে প্রতি জেলায় বাস্তবায়ন করতে পারেন।

ঢাকা শহরে রোগী বাড়ায় বলা হচ্ছে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। রোগীর সংখ্যা আরো বাড়লে পরিস্থিতি কী হবে?

পৃথিবীর কোনো দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা করোনা সংক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না, প্রথম কথা। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও না। এটি দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও স্বীকার করেছেন। সেই জায়গায় আমরাও প্রস্তুত ছিলাম না। তবে আমরা যথেষ্ট সময় পেয়েছি। উহানে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। আমরা লক্ষ করেছি চীন কীভাবে সংক্রমণ সীমিত রেখেছে এবং নিয়ন্ত্রণ করেছে। দেখেছি যখন সংক্রমণ বেড়েছে, তখন তারা পরীক্ষার আওতা বাড়িয়েছে। সংক্রমিত লোকদের হাসপাতালে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করেছে। সেই হাসপাতালগুলো কিন্তু আগের প্রস্তুত হাসপাতাল নয়। ফিল্ড হাসপাতালের মতো ক্ষণস্থায়ী মেইকশিফট হাসপাতাল তারা করেছে। যাতে প্রয়োজন মতো তারা সেগুলো ব্যবহার করতে পারে। তারা সেগুলো করে জনগণকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছে, পাশাপাশি আইসোলেশনে নিতে পেরেছে যথেষ্টসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে। কিন্তু আমরা এতদিন এ কাজটি করিনি। আমাদের দরকার ছিল ব্যাপকমাত্রায় আইসোলেশন নিশ্চিত করা।

আমাদের প্রথম ভুল হলো, বিদেশ থেকে বিশেষ করে ইতালি থেকে যারা এসেছেন, তাদের একটি মেইকশিফট কোয়ারেন্টিনে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। ওই প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন আমাদের আগে থেকে প্রস্তুত রাখা উচিত ছিল। আমরা তা করিনি। আমরা সীমিত আকারে আশকোনার মতো জায়গায় তা করার চেষ্টা করেছি। যেটি আসলে তেমনভাবে প্রস্তুত ছিল না। স্বাভাবিকভাবে যেভাবে লোকজন এসেছে, তাদের সেভাবে রাখতে পারিনি এবং বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছি। এটিই আমাদের সামাজিক সংক্রমণ শুরুর প্রথম ধাপ।

পরিষ্কার একটি বিষয় হলো, সংক্রমিত লোককে আইসোলেশনে নিতে হবে এবং সেখান থেকেই হাসপাতালে সেবা শুরু। আইসোলেশনের জন্য, পরবর্তীতে চিকিৎসার জন্য ভেন্টিলেশন, অক্সিজেনসহ যেসব সরঞ্জাম লাগবে, তার প্রস্তুতি আমাদের ছিল না। এখনো নেই। আইসিইউ শয্যা এখনো সীমিত। যে হারে সংক্রমিত হচ্ছে, সেই হারে কিন্তু আমাদের প্রস্তুতি নেই। সরকার বলছে প্রস্তুতি নিচ্ছে, এগুলোর আগাম প্রস্তুতি নেয়ার দরকার ছিল। এখন ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। রোগী বাড়ার সঙ্গে শয্যা বাড়াব, এমন নয়। আগে থেকে পরিকল্পিতভাবে সার্বিক অর্থে প্রস্তুতি নিতে হবে, যাতে রোগী এলেই সেবাটা দেয়া যায়। নইলে মৃত্যুর হার কমাতে পারব না।

বর্তমান অবস্থায় আমাদের কতগুলো বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি উপজেলায় আইসোলেশন বেড স্থাপন করতে হবে। সেখানে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতিসহ। এটি প্রথম পর্যায়। পরবর্তী পর্যায়ে আমাদের ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালকে জরুরি অবস্থার প্রেক্ষাপটে সমন্বয় করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সবাইকে কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করতে পারি। সেটি করতে হলে সরকারকে ট্রিয়াজ করতে হবে। মানে একটি ত্রিমাত্রিক ব্যবস্থা করতে হবে। সেখানে থাকবে কভিড হাসপাতাল, নন-কভিড হাসপাতাল এবং সন্দেহভাজন রোগীদের জন্য ফ্লো কর্নারের মতো কিছু একটা। এটা করে রোগী দেখার ব্যবস্থা করতে হবে। সেখান থেকে যে রোগী পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত হবে কভিড আক্রান্ত নয়, সে নন-কভিড হাসপাতালে যাবে এবং যার পজিটিভ আসবে সে কভিড হাসপাতালে যাবে। এখন সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে কভিড আক্রান্ত নয়, এ ধরনের একটি সনদ ছাড়া কোনো হাসপাতালই ভর্তি করতে চাইছে না। যদিও সরকার একটি নির্দেশনা দিয়েছে ভর্তি করানো বা চিকিৎসা দেয়ার জন্য। কভিড বা নন-কভিড প্রতিটি হাসপাতালে পর্যবেক্ষণ ও আইসোলেশনের জন্য একটি কর্নার রাখতে হবে। বিশেষ করে নন-কভিড হাসপাতালে এটি নিশ্চিত করতে হবে।

তারপর পুরো দেশে যত কভিড হাসপাতাল আছে, গুরুত্বসহকারে সেখানে শিগগিরই অক্সিজেন সরবরাহ, ভেন্টিলেটর ও আইসিইউ শয্যা প্রস্তুত করতে হবে। এজন্য যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে জনবল জোগানদাতার দায়িত্ব পালন করতে হবে সরকারকেই। বেসরকারি হাসপাতালের যে জনবল আছে, পরীক্ষা থেকে শুরু আইসিইউ পর্যন্ত, তাদের ব্যবহারে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। নইলে বেড়ে চলা সংক্রমিত রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা দেয়া অত্যন্ত দুষ্কর হয়ে পড়বে। ষাটোর্ধ্ব বয়সীদের ঘরে থাকা নিশ্চিত করতে হবে, এটি আইন প্রয়োগের মাধ্যমে হলেও। কারণ তারা কো-মরবিটিতে (বিভিন্ন রোগে) ভোগেন। আর সংক্রমিত হলেও যাতে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে পারি, তার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এ জায়গায় ন্যূনতম গাফিলতিও মৃত্যুর সংখ্যাটা বাড়িয়ে দেবে।

আরেকটি বিষয় ঘন ঘন সরকারকে জনগণকে জানাতে হবে। তা হলো, ৮৫-৯০ শতাংশ লোক বিনা চিকিৎসা বা ঘরের চিকিৎসায় ভালো হতে পারবে চিকিৎসকের পরামর্শে। সুতরাং যাদের উপসর্গ আছে মনে হচ্ছে, তারা যেন সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরার্শ নেয়। পরামর্শ অনুযায়ী ঘরে থেকে চিকিৎসা নেবে। তবে তাদের আলাদা ঘরে নিয়ম অনুযায়ী আইসোলেশনে থাকতে হবে। পারিবারিক সংস্পর্শ বাদ দিতে হবে এবং এটিকে এলাকাভিত্তিক মনিটরও করতে হবে। এটি আমরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জনবলের মাধ্যমে করতে পারি।

সীমিত পরীক্ষার বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

নিয়ম হলো সারা দেশের সব লোককে পরীক্ষা করা। এটা হলো সর্বোত্তম উপায়। এর কোনো বিকল্প নেই। নইলে আমরা বুঝতে পারব না কে সংক্রমিত, কে নয়। সে জায়গায় সীমিত পরীক্ষা দিয়ে আমরা ওই লোকদের বাছাই করতে পারছি না। যতক্ষণ চিহ্নিত করতে না পারছি, ততক্ষণ সংক্রমণের সুযোগ ও ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। সুতরাং পরীক্ষা সারা দেশে ব্যাপৃত করতে হবে, পাশাপাশি সবাই যেন পরীক্ষার সুযোগ পায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। আমার পরামর্শ হলো, অবশ্যই আমাদের জনবলের ঘাটতি আছে, এটা ঠিক। জনবলের চাহিদা মেটানো সম্ভব যদি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকের জনবলকে সম্পৃক্ত করে কাজে লাগাই। আরটি পিসিআরে সম্পৃক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে দ্রুত টোকনোলজিস্ট নিয়োগ দিয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করে কাজে লাগাতে হবে।

এখন দেখতে হবে কত টেস্ট করতে আমরা সক্ষম এবং কত টেস্ট করা দরকার। আরটি পিসিআর যন্ত্রটি উপজেলা পর্যায়ে যতক্ষণ নিতে না পারছি, ততক্ষণ সেটি বলা যাবে না। আমাদের ৪৯২টি উপজেলায় পিসিআর পরীক্ষার সুযোগ থাকতে হবে। সেভাবে আমাদের পরিকল্পনা করে এগোতে হবে। এখন যা পরীক্ষা করছি, তা অতিসামান্য। আমরা প্রতি লাখে ৮৮ জনের মতো টেস্ট করছি। পৃথিবীর অন্য দেশ আমাদের চেয়ে প্রতি লাখে বেশি করছে। নেপালও বেশি করছে। ভুটান প্রায় প্রতি লাখে দুই হাজারের ওপর টেস্ট করছে। এমনকি পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলংকা বেশি করছে। সার্কভুক্ত দেশের মধ্যে আফিগানিস্তান ছাড়া প্রতি লাখে বাংলাদেশ সবচেয়ে কম পরীক্ষা করছে। এটা আমাদের বাড়াতে হবে। অনেক দেশ এক লাখও টেস্ট করছে। প্রতি লাখে এক হাজার টেস্ট করলেও সমাজে কেমন সংক্রমণ হচ্ছে, তা কিছুটা আঁচ করতে পারব। কিন্তু সঠিক বলতে পারব না।

বড় কয়েকটি কোম্পানি রেমডেসিভির তৈরি করছে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?

আমি সোজাসুজি বলব, রেমডেসিভির করোনার ওষুধ নয়। এখন পর্যন্ত কোনো ওষুধই করোনার চিকিৎসায় ব্যবহারের উপযোগী নয়। রেমডেসিভিরের কার্যকারিতা করোনা মৃদু ও মডারেট আক্রান্তদের মধ্যে কিছুটা দেখা গেছে। ৩১ শতাংশ কেসে দেখা গেছে, যেখানে ১৫ দিন হাসপাতালে থাকতে হতো, সেখানে তারা চার দিন আগে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে। এটা কোনো কনক্লুসিভ স্টাডি নয় যে এর ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যায়।

অনেক দেশ অ্যান্টিবডি টেস্টের অনুমোদন দিয়েছে। গণস্বাস্থ্য এ ধরনের কিট তৈরি করলেও অনুমোদন পেতে ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। এটিকে কী বলবেন?

গণস্বাস্থ্য যে কিট ব্যবহার করে অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করতে চেয়েছিল, সেটি দুঃখজনকভাবে আমরা এখনো বাংলাদেশে ব্যবহার করছি না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ র‌্যাপিড অ্যান্টিবডি কিট ব্যবহার করেছে। জার্মানি ব্যবহার করেছে, ভারত করেছে। আরো অনেকেই ব্যবহার করবে। এর অনেক ভালো দিক আছে। একটি হলো, আক্রান্ত হওয়ার সাত দিন হয়ে গেছে এমন রোগীদের রোগ নির্ণয় করতে পারছে। এটা একটা ভালো দিক। আমরা সাধারণত অনেকেই উপসর্গকে অবহেলা করি। উপসর্গহীনও অনেকেই থাকে। এটা দিয়ে আমরা সুন্দরভাবে স্ক্রিনিং করতে পারতাম যাদের সাতদিন হয়ে গেছে বা উপসর্গবিহীন রোগীদের। যেহেতু সস্তা এবং আমাদের হাতের কাছেই আছে, সেহেতু এটাকে ব্যবহার করা উচিত।

সংক্রমণ রোধে আমরা কোন দেশকে অনুসরণ করতে পারি?

আমাদের সামনে অনেক উদাহরণ আছে। চীনারা কী করেছে আমরা জানি। আমাদের প্রতিযোগী শ্রীলংকা কী করেছে তাও জানি। দেশটি এক মাস কারফিউ দিয়ে পরে সবকিছু খুলে দিয়েছে। ফলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে। ভিয়েতনাম তাও করেনি। তারা একটি কাজ করেছে তা হলো, বাইরে থেকে যারা এসেছে, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করেছে। কোরিয়া দিনে ২০ হাজার টেস্ট করে আইসোলেশনে, কোয়ারেন্টিনে নিয়েছে এবং চিকিৎসা দিয়েছে। প্রত্যেকেই একটি কৌশল ঠিক করে নিয়েছে। বাংলাদেশ কোনো কৌশলই গ্রহণ করেনি। এখনো কোনো কৌশল নেই। (দৈনিক বণিক বার্তা থেকে সংগৃহীত)

 এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ