আজকের শিরোনাম :

‘স্বাস্থ্যসেবার ওপর মানুষের আস্থা বিনষ্ট হলে চিকিৎসক সমাজও ভুগবে’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ মে ২০১৮, ১৫:২৭

ঢাকা, ১০ মে, এবিনিউজ : ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ, অধ্যাপক ও পরিচালক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ড. হামিদ ২০০১ সালে যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি এবং ২০০৮ সালে ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ড থেকে অর্থনীতি বিষয়ে পিএইচডি লাভ করেন। এর আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনের শুরুর দিকে তিনি বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা (বর্তমানে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লি.), বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) ও বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন। পরে ১৯৯৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবা ও স্বাস্থ্য খাত নিয়ে সম্প্রতি একটি জনপ্রিয় দৈনিকের সঙ্গে কথা বলেছেন এ বিশেষজ্ঞ। তা হুবহু তুলে ধরা হলো-

অর্থনীতিতে স্বাস্থ্য ব্যয় কতটা প্রভাব ফেলে?

সরকারের এ বছরের স্বাস্থ্য খাতে বাজেট ছিল প্রায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা। এ সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের মাত্র ২৩ শতাংশ। তাহলে বাকি ৭৭ শতাংশ কোথা থেকে আসছে? সরকারি হিসাবমতে, ৬৭ শতাংশ আসছে মানুষের নিজের পকেট থেকে, ৮ শতাংশ আসছে দাতাদের কাছ থেকে, বাকিটা এনজিও, বীমাসহ অন্যান্য সংস্থা থেকে আসছে। মোট যদি হিসাব করি, তাহলে প্রতি বছর প্রায় ৯৬ হাজার থেকে ১০০ হাজার কোটি টাকা আমরা স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করছি। যারা বিদেশে চিকিৎসা নিতে যায়, তাদের ব্যয় এ হিসাবে নেই। এটি ধরলে ব্যয় আরো বেশি হবে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, স্বাস্থ্য খাতে যে ব্যয় হচ্ছে, তা অর্থনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে। পদ্মা সেতুর প্রাথমিক বাজেট ছিল ২৪ হাজার কোটি টাকা। অথচ প্রতি বছর আমরা স্বাস্থ্য খাতে এর চেয়ে চার গুণ বেশি ব্যয় করি। এখন পদ্মা সেতুর বাজেট বিভিন্ন কারণে বেড়ে গেছে। বলা হচ্ছে, পদ্মা সেতু অনেক ব্যয়বহুল প্রকল্প। কিন্তু স্বাস্থ্য খাত আরো ব্যয়বহুল। এ বিশাল পরিমাণ টাকা অর্থনীতিতে ঘুরপাক খাচ্ছে। এ টাকার বেশির ভাগ যাচ্ছে ওষুধ কোম্পানিতে। কারণ স্বাস্থ্য খরচের ৬০-৭০ শতাংশ ওষুধ কিনতে ব্যয় হয়। ওষুধ শিল্পের প্রসারে এটি অবদান রাখছে। এরপর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল। সরকারি হাসপাতাল বেড়েছে। সরকারি হাসপাতালের কাঠামো সুন্দর কিন্তু মানুষ সেবা পাচ্ছে না ভিন্ন কারণে। সেটা ঠিক করা গেলে সেবা পাবে। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক থেকে শুরু করে অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন খাতে বিশাল একটা অংক ব্যয় হচ্ছে। অন্যদিকে এখন এমন কোনো জায়গা পাওয়া যাবে না, যেখানে বেসরকারি হাসপাতাল নেই। এ খাতেও বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। যদিও শিক্ষা খাতে বাজেট বেশি, কিন্তু অর্থনীতিতে শিক্ষা খাতের চেয়ে স্বাস্থ্য খাতের প্রভাব বেশি। কারণ এ খাতের সঙ্গে ওষুধসহ অন্য অনেক উপখাত জড়িত।

মানের দিক থেকে স্বাস্থ্য খাতে পরিবর্তন এসেছে কি?

প্রথমে বুঝতে হবে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে গুণগত মানটা কী? স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে গুণগত মানকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। একটি হচ্ছে মেডিকেল কেয়ার, যেটিকে আমরা বলি থেরাপিউটিক কেয়ার বা কোর মেডিকেল কেয়ার। চিকিৎসকের প্রথম কাজ হলো রোগ নির্ণয় করা। রোগ নির্ণয় করতে পারলে চিকিৎসা করা যায়। গুণগত মানের মেডিকেল কেয়ারের শর্ত হলো, সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করা এবং সঠিক প্রেসক্রিপশন দেয়া বা সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করা। রোগ নির্ণয় ও প্রেসক্রিপশন সঠিক হলে রোগ নিরাময় হয়। ট্রিটমেন্ট বলতে শুধু প্রেসক্রিপশন কিংবা চিকিৎসককে বোঝায় না। এর সঙ্গে অন্য অনেক বিষয় যুক্ত। এখানে চিকিৎসকের ভূমিকা যেমন লাগে, তেমনি রোগী বা রোগীর পরিবারের ভূমিকাও প্রয়োজন। চিকিৎসক প্রেসক্রিপশন দিলেন কিন্তু রোগী ঠিকমতো অনুসরণ করল না, তাহলে তো রোগ সারবে না। চিকিৎসকের কাজ সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করা এবং সেই অনুযায়ী প্রেসক্রিপশন দেয়া। বাংলাদেশে আগে ডায়াগনস্টিক টেস্টের সুযোগ কম থাকায় চিকিৎসকরা ম্যানুয়ালি রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করতেন। এখন এ সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ায় চিকিৎসকরা সাধারণত ডায়াগনস্টিক টেস্ট দিয়ে দেন। এটি দেয়ার পেছনে চিকিৎসকদের যুক্তি ও অধিকার রয়েছে। সমস্যা তখনই হয়, যখন এ ডায়াগনোসিস সঠিক হয় না। ফলে চিকিৎসক যে প্রেসক্রিপশন দেবেন, তা ভুল হবে। গুণগত চিকিৎসার প্রথম শর্ত হচ্ছে সঠিক ডায়াগনোসিস। আর সঠিক ডায়াগনোসিস করতে হলে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো মানসম্মত হতে হবে। বাংলাদেশে এ জায়গাটিতে অনেক দুর্বলতা রয়েছে। একটা ভরসা করার মতো ল্যাব নেই, যেখানে পরীক্ষা করালে তা আন্তর্জাতিক মানের হবে। এর প্রভাব সার্জারিতেও পড়ে এবং রোগী কিছু ক্ষেত্রে ভুল চিকিৎসার শিকার হয়। চিকিৎসক যদি সঠিকভাবে রোগীর সঙ্গে কথা বলেন, রোগের ইতিহাস জানেন এবং রোগের সিম্পটমের সঙ্গে ডায়াগনস্টিক টেস্টের রিপোর্ট মেলান, তাহলে ডায়াগনস্টিক টেস্টের মান কতটা নির্ভুল, তা বুঝতে পারবেন। চিকিৎসকের এটি খেয়াল রাখাও গুণগত স্বাস্থ্যসেবার একটি অংশ।

চিকিৎসাসেবায় দক্ষ জনবলের সংকট রয়েছে। এটি কীভাবে পূরণ করা সম্ভব?

মেডিকেল কেয়ারের মানের আরেকটি দিক হলো, নন-থেরাপিউটিক কেয়ার। এর মধ্যে রয়েছে— রোগীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা, রোগীর মধ্যে আস্থা নিয়ে আসা, রোগীকে প্রেসক্রিপশন বুঝিয়ে দেয়া ইত্যাদি। এখন আসুন সার্জারির ক্ষেত্রে সার্জারি কিন্তু একজন ব্যক্তি করতে পারেন না। সার্জারির জন্য অপারেশন থিয়েটার, নার্স, অ্যানেস্থেশিয়া অনেক কিছুর প্রয়োজন এবং এগুলো একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। দেখা যায়, সার্জন হয়তো ভালো কিন্তু অ্যানেস্থেশিয়া বা অন্য কিছুতে সমস্যা থাকতে পারে। অথবা উল্টোটাও ঘটতে পারে। যখন মাল্টিপল ইনপুট মিলে একটা আউটপুট তৈরি হয়, সেখানে কোনো একটা ইনপুটে দুর্বলতা বা মানের ঘাটতি থাকলে আউটপুট মানসম্পন্ন হয় না। এ জায়গাটায় আমাদের হাত দিতে হবে। আমাদের নীতিনির্ধারকদের বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতের নীতিনির্ধারকদের হাসপাতালে যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা দিতে হলে কী ধরনের উপকরণ সংমিশ্রণ (ইনপুট মিক্স) ও দক্ষতা সংমিশ্রণের (স্কিল মিক্স) প্রয়োজন হয়, তা বোঝার ঘাটতি রয়েছে। আমাদের দেশে মনে করা হয়, চিকিৎসক নিয়োগ দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বাস্তবে তা নয়। আসলে গুণগত মানের চিকিৎসাসেবা দিতে হলে বিভিন্ন স্কেলের (যেমন— সার্জন, নার্স, অ্যানেস্থেশিওলজিস্ট) নির্দিষ্টসংখ্যক লোকবল ও সরঞ্জাম প্রয়োজন। এখানে আমাদের অনেক ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি পূরণের জন্য সরকারের উপযুক্ত পরিকল্পনা ও তার সঠিক বাস্তবায়ন প্রয়োজন। আগামী ৫ বা ১০ বছরে কত অ্যানেস্থেশিওলজিস্ট, ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ, স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ, কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ দরকার, তা তৈরি করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া নার্স বা অন্যান্য টেকনিশিয়ানের যে ঘাটতি রয়েছে, তাও পূরণ করতে হবে। এগুলো যদি না থাকে, তাহলে তো আপনি মানসম্পন্ন সেবা দিতে পারবেন না। যেমন সার্জারির মাধ্যমে সন্তান প্রসবের কথাই ধরি। সার্জনকে সার্জারির পরও প্রসূতি মাকে দেখতে হবে, তেমনি পেড্রিয়াট্রিশিয়ান (শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ) থাকতে হবে শিশুর কোনো জটিলতা রয়েছে কিনা, তা বোঝার জন্য। কিন্তু দেখা যায়, সার্জারি করেই সার্জন চলে যান; পেড্রিয়াট্রিশিয়ানও থাকেন না। এ ধরনের সমস্যার সমাধান করতে হবে। এ সমস্যাগুলো হয় বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতালে। নন-থেরাপিউটিক কেয়ারগুলোর মধ্যে রয়েছে হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, খাবারের মান, চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্ক, চিকিৎসক ও নার্স রোগীকে কীভাবে উদ্বুদ্ধ করছেন প্রভৃতি। আমরা চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্ক নিয়ে একটা গবেষণা করছি। সেখানে দেখা হচ্ছে, কারা রোগীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন এবং কারা খারাপ ব্যবহার করেন। এখন পর্যন্ত দেখা গেছে, চিকিৎসকরা রোগীদের সঙ্গে খুব বেশি খারাপ ব্যবহার করেন না, চিকিৎসকদের নিচে যারা রয়েছেন, তারাই বেশি খারাপ ব্যবহার করেন। হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ওয়ার্ড বয়, নার্সসহ অন্যদের দৌরাত্ম্য বেশি। তবে এটা ঠিক, রোগীদের যে পরিমাণ সময় দেয়া প্রয়োজন, সেটা চিকিৎসকরা দিচ্ছেন না। ভারতীয় চিকিৎসকরা রোগীদের সময় দিচ্ছেন। আমাদের দেশের রোগীরা এখানে এসে বলে, ওদের (ভারতীয় চিকিৎসক) কথাবার্তা শুনলে আমরা অর্ধেক সুস্থ হয়ে যাই। এ জায়গাটায় আমাদের চিকিৎসকদের আসতে হবে। এ দেশের মেডিকেল কেয়ারের কোয়ালিটি যদি নষ্ট হয়ে যায় এবং মেডিকেল কেয়ারের ওপর আস্থা যদি নষ্ট হয়ে যায় (এরই মধ্যে অনেকাংশে নষ্ট হয়ে গেছে), তাহলে দেশ তো ভুগবেই, চিকিৎসক সমাজও ভুগবে। এটি ঠিক করার জন্য সব চিকিৎসক ও চিকিৎসকদের সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।

দেশে চিকিৎসা ব্যয় ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় ব্যয় অত্যধিক...

আমাদের এখন মাথাপিছু বার্ষিক স্বাস্থ্য ব্যয় ৩৭ ডলার। উল্লেখ্য, আমেরিকায় স্বাস্থ্যের পেছনে প্রতি বছর মাথাপিছু ব্যয় প্রায় সাড়ে ৯ হাজার ডলার। কিন্তু আন্তর্জাতিক মান হিসেবে এ মুহূর্তে আমাদের প্রায় ১০০ ডলার ব্যয় করা দরকার। আমাদের এই কম ব্যয়ের অর্থ হলো, অনেকে সঠিক স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারছেন না। তবে আগের চেয়ে দেশে স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় বেড়েছে কয়েকটি কারণে। আগে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে মানুষের ধারণা কম ছিল, অথবা কবিরাজের কাছে যেত কিংবা চিকিৎসার সুবিধা ছিল না। এখন কিছু হলে মানুষ কারো না কারো কাছে যায়। অন্যদিকে মানুষের আর্থিক অবস্থা আগের তুলনায় ভালো হয়েছে। এজন্য মানুষ স্বাস্থ্যের পেছনে ব্যয় করছে। এটা তো গেল চাহিদার দিক। এবার জোগানের কথা বলি। সম্প্রতি আমাদের দেশে বহু প্রাইভেট হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। অর্থনীতির সূত্রমতে, বেশি সাপ্লায়ার থাকলে সেখানে প্রতিযোগিতা হয়, আর প্রতিযোগিতা হলে মূল্য কমে যায়। কিন্তু মেডিকেল সেক্টরে সেটা হয়নি। চিকিৎসকের ফি, অন্যান্য সার্ভিস চার্জ, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে হোক কিংবা তাড়াতাড়ি মুনাফা বৃদ্ধির তাড়না থেকে বা অন্য কোনো কারণে হোক, স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ডায়াগনস্টিক টেস্টের কথা যদি বলি, সবাই জানি, সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীও জানেন, মোট ব্যয়ের ৪০ শতাংশ অর্থ অন্য খাতে চলে যাচ্ছে। এটা যদি না যেত, তাহলে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো রোগীদের কাছ থেকে ৪০ শতাংশ অর্থ কম নিতে পারত। ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো নিজেরা মুনাফা না করে ৪০ শতাংশ অর্থ দিয়ে দিচ্ছে না, তারা তাদের মুনাফা ঠিকই রাখছে। নিজ মুনাফার পর অতিরিক্ত যে ৪০ শতাংশ অর্থ নিচ্ছে, তা চলে যাচ্ছে অন্যান্য খাতে। এটা ওপেন সিক্রেট।

হঠাৎ করে কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই কোম্পানিগুলো ওষুধের দাম বাড়িয়ে দেয়। এটি দেখার কী কেউ নেই?

মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের প্রায় ১০ শতাংশ ডায়াগনস্টিক টেস্টের জন্য ব্যয় হয়। ওই ৪০ শতাংশ বাদ দেয়া হলে এ ব্যয় ৬ শতাংশে নেমে আসে। দ্বিতীয়টি হলো, ওষুধের দাম। ১৯৮২ সালে যে ওষুধ নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল, তা ছিল যুগান্তকারী। ওই সময় ওষুধের দাম নির্ধারণের জন্য একটি ফর্মুলা বেঁধে দেয়া হয়েছিল। একই ক্যাটাগরির ওষুধের দাম খুচরা ও পাইকারি মূল্য কী হবে তা নির্ধারণ করা ছিল। ১১৭টি প্রয়োজনীয় ওষুধের (এসেনশিয়াল ড্রাগের) তালিকা তৈরি করে দেয়া হয়েছিল। যে ওষুধগুলো প্রায় সবসময় আমাদের লাগে, তার প্রায় সব ওই তালিকায় ছিল। পরবর্তীকালে ওষুধ নীতি নমনীয় করা হয়েছে। নমনীয় করে যে কয়েকটি কাজ করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো গ্রুপের সংখ্যা বৃদ্ধি। নিয়ম ছিল, কোনো ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি যদি ওই তালিকার ৪০ শতাংশ ওষুধ তৈরি করে, তবে বাকি ৬০ শতাংশ উৎপাদিত ওষুধের মূল্য সে নিজে নির্ধারণ করতে পারবে। একে ইনডিকেটিভ প্রাইস বলে। পরবর্তীকালে যেটা হয়েছে তা হলো, তালিকার ৪০ শতাংশ উৎপাদন করা হচ্ছে কিনা, এটি তদারক করা হয়নি। দেখা যাচ্ছে, কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্ত ৪০ শতাংশ ওষুধ উৎপাদন না করে তালিকাবহির্ভূত ওষুধ উৎপাদন করছে এবং এগুলোর দাম নিজেই ঠিক করছে। শাহবাগের ওষুধের দোকানে গেলে দেখা যাবে, একই ওষুধ একেকজনের কাছে একেক রকম দাম। কিন্তু তালিকাভুক্ত ওষুধের দাম সব দোকানে একই রকম। ২০১২-১৩ সালের দিকে ওষুধের দাম বড় আকারে বেড়েছিল। এভাবে পর্যায়ক্রমে ওষুধের দাম বেড়েছে। ১১৭টির বাস্কেট থেকে বেশকিছু ফাস্ট সেলিং ড্রাগ বাদ দিয়ে নন-ফাস্ট সেলিং কয়েকটি ড্রাগ যোগ করা হয়েছে। যেমন— পরিবার পরিকল্পনার উপকরণ এর মধ্যে যোগ করা হয়েছে। কিন্তু পরিবার পরিকল্পনার উপকরণ তো আর এসেনশিয়াল ড্রাগ নয়। ওষুধ নীতির শিথিলতার সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা এটা করেছেন। ওষুধ কোম্পানিগুলো মার্কেটিং করে নন-লিস্টেড ওষুধের, কারণ এর দাম তারা নিজেরাই নির্ধারণ করতে পারে। প্যারাসিটামলের সঙ্গে একটু ক্যাফেইন যোগ করে ভিন্ন দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে। তালিকাভুক্ত প্যারাসিটামলের এক পাতার দাম হয়তো ১০ টাকা, এর সঙ্গে সামান্য ক্যাফেইন যোগ করে ভিন্ন নাম দিয়ে দাম রাখা হচ্ছে হয়তো ২৫ টাকা। তালিকাবহির্ভূত ওষুধ তৈরি না করলে কোম্পানিগুলো চিকিৎসকদের বিভিন্ন সুবিধা দিতে পারবে না। এক ওষুধ কোম্পানির এমডি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমরা এক দুষ্ট চক্রে পড়ে গেছি। না করলেও পারছি না, আবার না দিয়েও পারছি না।’ এ বিষয়ে সরকারের নজর দেয়া উচিত। আবার অনেক ক্ষেত্রে ওষুধের যুক্তিসঙ্গত প্রেসক্রিপশন হচ্ছে না। অন্যদিকে ওষুধের মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আমার এক চিকিৎসক সহকর্মী আমাকে বলেছিলেন, বাংলাদেশে কোনো প্যারাসিটামল কাজ করছে না। এর কিছুদিন পর আমার স্ত্রীর প্রচণ্ড জ্বর আসে। একটি দেশীয় কোম্পানির প্যারাসিটামল ট্যাবলেট ও সাপোজিটারি পর্যায়ক্রমে দেয়া হলেও কাজ করল না। তখন বিদেশী একটি কোম্পানির প্যারাসিটামল দেয়ার পর তার জ্বর কমে। এ থেকে প্রশ্ন জাগে, আমাদের ওষুধগুলো কতটা মানসম্পন্ন? উন্নত দেশে এখনো জেনেরিক ওষুধ বাজারজাতের আগে বায়োমেট্রিক টেস্ট করতে হয়। আমাদের দেশে এ ধরনের টেস্টের প্রচলন নেই। আবার কোনো কোনো চিকিৎসক ওষুধ বেশি লেখেন। আর চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই আমরা তো এখন নিজে নিজেই অ্যান্টিবায়োটিক কিনে খাই।

আমাদের মাথাপিছু ওষুধ সেবন কি বেশি?

প্রচুর। ওষুধের দাম যেমন বেড়েছে, তেমনি ব্যবহারও বেড়েছে। ব্যবহার সঠিক হলে বলার কিছু ছিল না, কিন্তু অযৌক্তিক ব্যবহার হচ্ছে। এটা রোগীর দ্বারা যেমন হচ্ছে, তেমনি চিকিৎসকদের (কোয়ালিফাইড ও নন-কোয়ালিফাইড) দ্বারাও হচ্ছে। যেমন ধরুন, ফার্মেসির দোকানে একজন চিকিৎসক বসেন। তিনি যদি ওষুধ না লেখেন, তবে ফার্মেসির মালিক মাইন্ড করবেন। তাই রোগীর তেমন কিছু না হলেও তিনি একটা ওষুধ লেখেন। আবার চিকিৎসক যদি ওষুধ না লেখেন, রোগীরা মাইন্ড করে। চিকিৎসককে এত ভিজিট দিলাম, অথচ ওষুধই দিলেন না! অথচ দেখা যাবে, রোগী দুদিন অপেক্ষা করলে বিনা ওষুধেই রোগ সেরে যেত। এজন্য চিকিৎসকরা কিছু না হলেও সাধারণত ভিটামিন লিখে দেন। আমরা জানি, ওরাল ভিটামিন তেমন কাজে লাগে না (শুধু মুমূর্ষু রোগী ছাড়া)। সার্জিক্যাল কোনো প্রসেসের জন্য, মুমূর্ষ রোগীকে সতেজ করার জন্য ওরাল ভিটামিন ব্যবহার করলে তখন হয়তো কাজে লাগতে পারে। এভাবে ওষুধের পেছনে আমাদের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। ওষুধের মানও পরীক্ষা করা দরকার। আমরা কোথায় আছি, তা দেখার জন্য এটি করতে হবে। উপাদান ঠিকমতো দেয়া হচ্ছে কিনা, উপাদানের মান ঠিক থাকছে কিনা, এগুলো দেখা দরকার। 

ওষুধের মান দেখার দায়িত্ব যাদের, তারা কতটা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে?

আমাদের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর (ডিজিডিএ) তেমন শক্তিশালী নয়। একে আরো ক্ষমতা দিয়ে শক্তিশালী করতে হবে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো বিএসটিআই, ডিজিডিএর মতো রেগুলেটরি বডিগুলোর তেমন কোনো স্ট্যাটাস নেই। এগুলোকে ডিরেক্টরিয়েট লেভেলে রাখা হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তারা ডেপুটেশনে গিয়ে ওখানে ডিজি বা উচ্চপদের কর্মকর্তা হচ্ছেন। তারা তিন বছর থাকতে পারেন। ফলে এগুলোর সক্ষমতা তৈরি হচ্ছে না। এগুলো স্বতস্ত্র ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হওয়া উচিত। এগুলোকে দুদকের মতো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা গেলে শৃঙ্খলা ফিরে আসতে পারে। আমি বলব ওষুধের মান বাড়াতে হবে, প্রেসক্রিপশন যৌক্তিক হতে হবে, কোয়াক (হাতুড়ে ডাক্তার) প্রচুর ওষুধ দিচ্ছেন, এটা রোধ করতে হবে, কোয়াকদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে, চিকিৎসকদের চিকিৎসা শিক্ষার সঙ্গে মানবিকতার বিষয়গুলো যোগ করে দিতে হবে। বিভিন্ন কারণে অনেক মেধাবী চিকিৎসক এফসিপিএস পাস করতে পারছেন না। এছাড়া অনেক চিকিৎসকের ক্যারিয়ারও নেই। দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একটি সাবজেক্ট থেকে পাস করে অনেকে সচিব হচ্ছেন। আবার দেখা যায়, অনেক চিকিৎসক যিনি কিনা ফার্স্ট বেঞ্চার ছিলেন, তিনি মেডিকেল অফিসার হিসেবে রিটায়ার্ড করছেন। এ ধরনের বৈষম্য দূরীকরণে কাজ করতে হবে। এছাড়া আরেকটি বিষয় দেখতে হবে তা হলো, বারবার চিকিৎসক পরিবর্তন করা। আমাদের ট্রিটমেন্ট প্রসেসটা যেভাবে শুরু হয়, যদি গ্রামে বাস করি, সেখানে আমাদের পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ওষুধের দোকান বা সেখানে যে কোয়াক রয়েছেন তার কাছে। ছোটখাটো রোগ হয়তো এক্ষেত্রে সেরে যায়, কিন্তু জটিল রোগ হলে তা সারে না, বরং বেড়ে যায়। এরপর যাওয়া হয় এমবিবিএসের কাছে, ততদিনে রোগটা আরো জটিল হয়ে গেছে। এরপর যাওয়া হয় বড় শহরের বড় চিকিৎসক বা হাসপাতালে। এজন্য শুরুর বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সিস্টেম কিন্তু রয়েছে। যেমন কমিউনিটি ক্লিনিক। এটি খুবই ভালো ব্যবস্থা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এর মান ধরে রাখা।

কোয়াকও তো ওষুধ লিখছে। এতে রোগীরা প্রতারিতও হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

কোয়াক কিন্তু মানসম্পন্ন ওষুধ দেন না। কারণ তিনি ফি নেন না। তিনি ওষুধ বিক্রি করে অর্থ পান। যত ওষুধ বিক্রি করতে পারবেন ততই লাভ। কারণ সেখানে তার মার্জিন রয়েছে। যেগুলো দুর্বল কোম্পানি, যাদের ওষুধের মান তেমন ভালো না, তারা বেশি মার্জিন দেয় বিক্রি বাড়ানোর জন্য। অন্যদিকে কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য যেহেতু ওষুধ রাষ্ট্রীয়ভাবে কেনা হচ্ছে, তাই এগুলো মানসম্পন্ন। কিন্তু সমস্যা হলো, যে ব্যক্তি ওষুধ দিচ্ছেন, কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রভাইডার বা সিএইচসিপি, তাকে মাত্র তিন মাসের একটি ট্রেনিং দেয়া হয়। একজন কোয়াক যখন অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছেন, তিনি না বুঝেই দিচ্ছেন বা রোগী চাইছে বলে দিচ্ছেন; কিন্তু একজন সিএইচসিপি যখন অ্যান্টিবায়োটিক দেবেন, তখন তাকে বুঝেশুনে দিতে হবে। এখানে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, সিএইচসিপি যে ওষুধ দিচ্ছেন, তিনি রোগ ঠিকভাবে ডায়াগনোসিস করতে পারছেন কিনা। সঠিক ডায়াগনোসিস করার জন্য তাকে আরো প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আবার কমিউনিটি ক্লিনিকে সিএইচসিপি না দিয়ে প্যারামেডিক দেয়া যেতে পারে। আবার প্যারামেডিক দিতে হলে এর সাপ্লাই থাকতে হবে। না থাকলে তৈরি করতে হবে। এজন্য এ নিয়ে পরিকল্পনা থাকতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে কমিউনিটি ক্লিনিক ভালো করছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যেটা হচ্ছে তা হলো, রোগী এসে বলছে, ওমুক ওষুধটা দাও, সিএইচসিপি রোগ নির্ণয় না করেই সেটা দিয়ে দিচ্ছেন। তবে নিঃসন্দেহে কমিউনিটি ক্লিনিক একটি ভালো কনসেপ্ট। এটিকে নষ্ট করা ঠিক হবে না; বরং এর ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে। একে আরো কীভাবে শক্তিশালী করা যায়, তার পরিকল্পনা করতে হবে। আবার শক্তিশালী করতে গিয়ে একে পুরোপুরি হাসপাতাল করাও ঠিক হবে না। আজকে সেখানে চিকিৎসক দিলে, কাল বলবে নার্স, অপারেশন থিয়েটার ইত্যাদি লাগবে। কিন্তু এটা তো এ কাজের জন্য নয়। ইউনিয়ন সাব-সেন্টারগুলোতেই চিকিৎসকরা থাকতে চান না, কমিউনিটি ক্লিনিকে থাকবেন কী করে? বিকল্প উপায় হলো, হয় সিএইচসিপিকে আরো ভালো প্রশিক্ষণ দিতে হবে অথবা সেখানে পর্যায়ক্রমে প্যারামেডিক নিয়োগ দিতে হবে। কমিউনিটি ক্লিনিক নিয়ে বলা এজন্য যে, সেখানে মানুষ ওষুধ চেয়ে নিলেও মানসম্পন্ন ওষুধ পাচ্ছে। অন্যদিকে ফার্মেসি বা কোয়াকের কাছ থেকে মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই মানসম্পন্ন ওষুধ পাচ্ছে না। আবার বেশি টাকা দিয়ে সেখান থেকে নিম্নমানের ওষুধ কিনছে, অন্যদিকে কমিউনিটি ক্লিনিকে অল্প ব্যয়ে মানসম্পন্ন ওষুধ পাচ্ছে। কমিউনিটি ক্লিনিকসহ সব সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে পর্যাপ্ত ওষুধের ব্যবস্থা করতে হবে। (দৈনিক বণিক বার্তা থেকে সংগৃহীত)

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ