আজকের শিরোনাম :

‘আমার কবিতা দৃশ্যময় স্তবকে ভরা’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০১৯, ১৪:৫৬ | আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০১৯, ০৯:৪৪

বুলান্দ জাভীর
১৯২৭-এ রচেস্টার, নিউইয়র্কে জন এ্যাশব্যারীর জন্ম। বেড়ে উঠেছেন নিউইয়র্ক রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের একটি খামারবাড়িতে। পড়াশোনা ডিয়ার একাডেমি, হার্ভার্ড এবং কলম্বিয়ায়, যেখানে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে বিশিষ্ট হয়ে ওঠেন। ১৯৫৫ সালে যান ফ্রান্সে, সেখানে তিনি প্যারিস হেরাল্ড ট্রিবিউন পত্রিকার জন্য চারুকলার সমালোচনা লিখতেন। নিউইয়র্কে ফিরে আসেন ১৯৬৫-এ। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আর্টনিউজ পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন। তিনি ব্রুকলীন কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনার পাশাপাশি নিউজউইক পত্রিকায় চারুকলার ওপর লিখতেন। তিনি নাটক এবং প্রবন্ধও লিখেছেন। জেমস স্কুইলার-এর সঙ্গে একটি উপন্যাসও রচনা করেন ‘এ সেন্ট অব ম্যাসেজ (১৯৭৬)’। তার পুরস্কারের ঝুলিতে আছে পুলিৎজার, ন্যাশনাল বুক পুরস্কার এবং ন্যাশনাল বুক সমালোচনাচক্র পুরস্কার এবং অবাক বিস্ময়ের ব্যাপার হলো সবগুলোই তার কালজয়ী সৃষ্টি ‘সেলফ পোট্রেট ইস দ্য কনভেকস মিরর’-এর জন্য। জন-কে সবচেয়ে অন্তর্লীন এবং জটিল কবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সমঝদার পাঠকমাত্রই তার হার্দ্য উচ্চারণ ঠিকই টের পান। কথোপকথনের মধ্যে মানুষের প্রকৃত সত্তাটি বেরিয়ে আসে তার গোপন আবাদ ছেড়ে। ১৯৭৭-এ সানফ্রান্সিসকোতে গৃহীত জন এ্যাশব্যারীর সাক্ষাৎকারটি এখানে বিধৃত করা হলো-

প্রশ্ন : আপনার কবিতা আপনার ব্যক্তিজীবনের কথা বলে- এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
উত্তর :
আমার আত্মজীবনী আমার কবিতায় খুব একটা আসে না। কেননা এটা বেশির ভাগ পাঠককেই বিরক্ত করে। পাঠকমাত্রই আশা করে লেখকগণ তাদের জীবনের কথা, তাদের কষ্টের কথা এবং তাদের ইতিহাসের কথা লিখবে। আমার নিজের আত্মজীবনী কখনোই আমাকে খুব একটা আকৃষ্ট করেনি। এটা সম্পর্কে যখনই ভাবতে যাই তখন একটি বিশাল শূন্যতা আমাকে এসে গ্রাস করে।
প্রশ্ন : কবি হিসেবে নিজেকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
উত্তর :
আমি কবিতা লেখা শুরু করি অন্যান্য লেখকের মতোই নিজের লেখা ছাপা হবে এটা চিন্তায় না এনেই। অবশ্য মনে ক্ষীণ একটা আশা ছিল। তবে আমার লেখা লোক পড়বে- এ ব্যাপারে খুব একটা আত্মবিশ^াস ছিল না। ফলে আমার প্রথম বই এমন সব কবিতায় ভরা, যেগুলো আমার ধারণায় আমি ছাড়া আর কোনো পাঠকপ্রিয়তা পাবে না। শৈশবে আট বছর বয়সে প্রথম লিখতে শুরু করি। এগুলো ছিল ছন্দনির্ভর এবং বক্তব্যপ্রধান। আমি এগুলো এত ভালো মনে করতাম যে এর মোহ থেকে বেরুতে পারব ভাবিনি। এগুলো বড়দিনে বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ম্যারী রবার্টস রাইনাইর্ট-এর বাসায় পড়া হতো, যিনি বৈবাহিক সূত্রে আমাদের পরিবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। যাই হোক, ছোটবেলায় আমার ইচ্ছে ছিল চারুশিল্পী হই এবং আমার বয়োসন্ধিকালেও এ স্বপ্নটি ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। হাই স্কুলে গিয়েই আমি লিখতে শুরু করি। স্কুলে একটি প্রতিযোগতিায় আমি একটি বই পুরস্কার পাই। ‘এ্যাস্থলজি অব মডার্ন ব্রিটিশ অ্যান্ড আমেরিকান পোয়েট্রি’। এর বেশির ভাগ কবি সম্পর্কেই আমি কিছুই জানতাম না। কিন্তু লাইব্রেরিতে দেখতাম। এরপর তাদের লেখা পড়তে থাকলাম এবং দেখতে পেলাম যে, খুব দ্রুত দৃশ্যমান চারুকলার তুলনায় এগুলোর প্রতি আমি বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছি। অবশ্য একেক সময় উভয় শিল্পের প্রতি মায়া মিলেমিশে যেত। কলেজে যাওয়ার পর পেইন্টিং একদম ছেড়ে দিলাম। কারণ যে রুমে আমি থাকতাম সেটি ছিল খুব ছোট। ছবি আঁকার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা ছিল না; কিন্তু লেখার জন্য জায়গা ছিল। লেখক হওয়ায় এই একটি সুবিধা। বেশি জায়গার প্রয়োজন নেই। যাই হোক, আমি তখন আমার সমসাময়িক বড় লেখকদের সম্পর্কে পড়ছিলাম এবং তাদের ওপর লিখে আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করছিলাম। তাদের মতো লিখতেও চেষ্টা করছিলাম। অডেন, ওয়ালেস স্টিভেন্স, উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস, ম্যারিয়ান মুর এবং আরও অনেক।

প্রশ্ন : আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ সামট্রিজ-এর পরিপ্রেক্ষিত কী ছিল?
উত্তর :
আমি বালামটি ইয়েল তরুণ কবি পরিষদে পাঠাই এবং তা ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ফেরত আসে। বিচারের জন্য অডেনের কাছেও পাঠানো হয়নি। তিনি সেবার পুরস্কারটি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কেননা তার কাছে পাঠানো কোনো পা-ুলিপি তার পছন্দ হয়নি। এ সময় আমাদের উভয়ের এক বন্ধু আমার পা-ুলিপি জমা দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করলে অডেন আমাকে সরাসরি দেখা করতে বলে পা-ুলিপিটি গ্রহণ করেন। যদিও তার লেখা ভূমিকা দেখে আমার মনে হয়েছে তার এই গ্রহণ কিছুটা শৈথিল্যে ভরা। আমার ধারণা, বইটির কোনো বিশেষ দিক তাকে আকৃষ্ট করলেও বিষয়গুলো তিনি খুব একটা বুঝতে পারেন নি। বস্তুত পরবর্তী সময় তাকে বলতে শুনেছি যে আমার কোনো লেখাই তিনি কখনোই এক বর্ণও বোঝেন নি। আমি এটা এ জন্য উল্লেখ করলাম যে প্রকাশিত হওয়া একটি সম্পূর্ণ সৌভাগ্য এবং যোগসূত্রের ব্যাপার। আমি অডেনকে ভালো চিনতাম না; কিন্তু বইটি প্রকাশের ব্যাপারে তাকে চিনেছি। এটা অনেকখানি প্রভাব বিস্তার করে অন্যের বেলায়। সুযোগ এবং সৌভাগ্যের ব্যাপার কবিদের জীবনেও ঘটে এবং আমরা যা ভাবি তার চেয়েও বেশি।

প্রশ্ন : বইটির ভাগ্যে কী ঘটেছিল?
উত্তর :
আমার ধারণা ছিল বইটি অদ্ভুত হয়েছে এবং প্রত্যেকে বইটি খুব পছন্দ করবে এবং আমাকে বইটি রাতারাতি সুনাম বয়ে এনে দেবে। কিন্তু বাস্তবে বইটি খুব সফল হয়নি। বইটি যখন বেরোয় আমি তখন ফ্রান্সে ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে এক বছর থাকার জন্য গিয়েছিলাম। কিন্তু থেকে গেলাম টানা ১০ বছর। ফলে এর ব্যাপারে আমার বন্ধুদের কাছ থেকে কোনোরকম অনুকূলে মন্তব্য শোনার সৌভাগ্য আমার হয়নি এবং এর ওপর কোনো রিভিউ হয়েছে বলেও আমি জানতাম না। ফ্রান্সে আমার জীবনযাপন ছিল অদ্ভুত রকমের। কেননা ভাষাটির ওপর আমার ভালো দখল ছিল না। অনেকদিন আমেরিকান কথা শোনার জন্য কান তৃষ্ণার্ত ছিল। যার বেদনার দহন থেকে আমার অনেকগুলো কবিতার জন্ম। আমেরিকার কথা যা আমি বাস্তবে শুনে ফেলেছি কিংবা পত্রিকায় পড়েছি, এগুলো আমার অনুপ্রেরণা জোগাত এবং নতুন কবিতা জন্ম দিতে সাহায্য করত।

প্রশ্ন    :    ফ্রান্সে ১০ বছর কাটানোর কী ফলাফল?
উত্তর :
এটা আমাকে আমেরিকা থেকে দূরে সরিয়ে এনেছে এবং আমেরিকান কবিতা থেকেও। কেননা তখন প্যারিসে আমেরিকান কবিতা ব্যাপকভাবে অনূদিত হত না। ফলে আমি অনেক বেশি নিজের ভিতর ডুবে যাই। আত্মমুখীন হয়ে পড়ি। আমার লেখার ভেতর দিয়ে নিজেকে অবিরাম খনন করি। ফলে অবশ্য চারুকলার সঙ্গেও আমি খুব জড়িত হয়ে পড়ি। কেননা প্যারিসের চারুকলা প্রদর্শনীগুলোর ওপর সপ্তাহে দুটো আর্টিক্যাল লিখতে থাকি। এর মধ্যে ফ্রেঞ্চ শিখতেও চেষ্টা করি। আমেরিকা এবং ফ্রেঞ্চ স্যুরয়ালিস্টদের মধ্যে বিলম্বপুষ্পিত সেতুবন্ধন হিসেবে বিবেচিত হতে থাকি। কিন্তু এটি ঠিক বলে মনে করি না এবং লোকদের এটা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। কেননা এতে তারা এ ধারণায় আরও বদ্ধমূল হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে ইউরোপীয় কোনো কবিতা যদি আমার ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে, তা হচ্ছে জার্মান এবং সøাভিক কবিতা। শুধুমাত্র র্যাঁবো যে কোনোভাবেই হোক ফ্রেঞ্চ ভাষার কৌলিন্যের বেড়াজাল অতিক্রম করে আমার মর্ম স্পর্শ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু তার পরিব্যাপ্ত ছায়ায় কোনো মহীরূহের বিস্তার সম্ভব নয়। ফলে কবিতা হয়ে উঠল খুব স্বচ্ছ এবং সাবলীল। এই কবিতা ও ফ্রান্সে থাকার আরেকটি লাভ হচ্ছে অবচেতন মনে আমেরিকার বাইরে কিছুকাল থাকার যে সুপ্ত ইচ্ছে ছিল তা তৃপ্ত করা, যাতে এ ইচ্ছেটি কখনও জাগ্রত না হয়, তাড়া না করে। যখন আমি ফিরে আসি তখন আমেরিকার জীবনের সঙ্গে অনেক বেশি একাত্ম হয়ে পড়ি। এর ল্যান্ডস্কেপের ভাষা এর বিগত জীবনের সবকিছুর সঙ্গে বেশি সম্পৃক্ত হয়ে পড়ি।

প্রশ্ন : আপনার দ্বিতীয় বই সম্পর্কে কী ভাবছেন?
উত্তর :
প্রথম বইয়ের পর আমি সংশয়তাড়িত হয়ে ভাবছিলাম কী করা যায়। কেননা এটা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম প্রথম বইয়ের মতো লেখা আর চলবে না। ফলে আমি সব ধরনের নিরীক্ষা শুরু করলাম। বাগধারাগুলো থেকে শব্দ বিছিন্ন করে ফেলা এসব। একজন চারুশিল্পীর মতো যে তার কোনো নির্দিষ্ট রং ব্যবহারে ক্লান্ত হয়ে ক্যানভাসের ওপর অন্য আঁচড় বুলিয়ে দেয় এবং দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখে এবং ভাবে কেমন লাগছে। এটা ছিল একটি জরুরি প্রক্রিয়া যতক্ষণ না আমি একটি নিজস্ব ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম। তখন আমি ভাবতাম যেহেতু আমার প্রথম বইটি সফল হয়নি, তাই দ্বিতীয় বইটি আর বেরুবে না। ফলে আমার পাঠকের হয়তো আমার প্রতি সীমিত হয়ে পড়বে। এ জন্য আমি একান্ত নিজের জন্য লিখতে শুরু করি। আত্মমোহিতের মতো করে না, নিজেকে নিজের একান্ত পাঠক ভেবে। এর বেশির ভাগ কবিতাই ছিল পাঠককুলের জন্য বিরক্তিকর, এর আপাত বিচ্ছিন্ন এবং ব্যক্তিগত স্বরের জন্য। কিন্তু এগুলো আমার ইচ্ছেকৃত ছিল না। আমি ধরেই নিয়েছিলাম এগুলো কেউই পড়বে না। ফলে কাউকে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের অবতারণা করে ক্ষুব্ধ করা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। তারপরও পরবর্তীতে আমার সেই বই বেরুল। এর বেশির ভাগ ছিল নিরীক্ষাসম্পন্ন। যখনই আমি কবিতা লিখতে যাই, তখনই তা অন্যরকম হয়ে ওঠে- এর মধ্যে অনেক কবিতা আছে, যেগুলো আমাকে খুব একটা আকৃষ্ট না করলেও অন্তর্ভুক্ত করেছি এবং এ জন্য আমার কোনো অনুশোচনাও নেই। কেননা এগুলোতে আমার নিরীক্ষা আছে এবং আমি স্বীকার করি যে এগুলো চিরস্থায়ী নাও হতে পারে। তবে আমার পরবর্তী বইটি পাঠক পেয়েছিল।

প্রশ্ন : এর আগে আপনি বলেছেন যে আপনি নিজের জন্য লেখেন; যে কারণে পাঠক পাননি। এখন আপনি পাঠক পাচ্ছেন। এতে কি আপনি কিছু ভারতম্য বোধ করছেন।
উত্তর :
কিছুটা স্বীকৃতি পাওয়ার পর আমি বুঝতে পারলাম যে লেখাটি আমি মোটেই পাঠকপ্রিয়তা পাবে ভাবিনি, সেইটিই কাক্সিক্ষত পাঠক পায়। ফলে আমাকে যদি স্বীকৃতি পেতে হয় তবে এভাবেই এগুতে হবে। সম্ভবত পাঠক কি ভাবছে এটা পাত্তা না দিয়ে আমি চূড়ান্ত প্রান্তে চলে গিয়েছিলাম। যদিও আমি বলি যে, আমি মূলত পলায়নবাদী শব্দটির ব্যাপারে সচেতন। কিন্তু আমাদের সব ধরনের পলায়নবাদিতার প্রয়োজন বলে আমি মনে করি এবং এটা কখনোই বেশি পরিমাণে আসে না। বস্তুত আমি কদাচিৎ আমার রচনার আলোচনা করি।

জন এ্যাশব্যারী

প্রশ্ন    :    আপনার লেখার আনুষ্ঠানিক সমালোচনা আপনি কীভাবে গ্রহণ করেন?
উত্তর :
সাধারণত আমার কাজের সমালোচনাকে আমি খুব কমই গুরুত্ব দিই। আমি আমার লেখা সম্পর্কে কখনও কখনও ঈর্ষান্বিত। এটা সারাক্ষণ আমার আকর্ষণ ধরে রাখে এবং আমি লিখে যাই।
যখন আমি সমালোচনা পড়ি তখন বুঝতে পারি না কী ভাবব। অনুকূলে না প্রতিকূলে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কবিতার প্রতি সহানুভূতিশীল এবং সহজ হওয়া সত্ত্বেও সমালোচনাকে কবিতার জগতে এক ধরনের সমান্তরাল অভিযান মনে হয়। এটা কখনোই আমাকে এমন ধারণা দেয় না যে, ঠিক আছে এরপর থেকে আমি ঠিক করে লিখব। আমার মূল কাজ হচ্ছে নিজের মতো লিখে যাওয়া।
আমি সমালোচকদের ছোট করছি না; কিন্তু এটা কোনোভাবেই কবিতাসহায়ক হয়ে উঠতে পারে না। সমালোচনা আমার খুব কাজে আসে না। যদিও আমি নিজেই অনেক চারুকলার সমালোচনা লিখেছি। খুব কম লোকেই আমার কবিতার ওপর খুব সিরিয়াস এবং যথার্থ সমালোচনা লিখতে পেরেছে। এটা নির্বুদ্ধিতার দোষে বাতিল বলে গণ্য নতুবা একটি মেধাবী লোকের কাজ বলে বিবেচিত হয়। খুব কম সমালোচকই দেখাতে পেরেছেন কি ছিল আমার আরাধ্য এবং কোথায় আমি সফল এবং কখন আমার পতন ঘটেছে।

প্রশ্ন : আপনি বলেছেন রাস্তায় শুনে ফেলা কথোপকথন আপনাকে অনুপ্রেরণা জোগায়। আর কী কী?
উত্তর :
পড়ার ব্যাপারে আমি একজন হাতেম তাই। হাতের কাছে যা আসে পড়ে ফেলি।
দন্ত চিকিৎসার পত্রিকা ভিক্তোরিয়ান উপন্যাস সব। বস্তুত আমি কোনো সুনির্দিষ্ট সূচি করে পড়ি না।
একজন একটি কবিতার একটি অশ্লীল প্যাসেজের ব্যাপারে মন্তব্য করছিলেন। আমি উত্তরে বললাম, এটি তাকে ক্ষুব্ধ করেছে বর্ণনার জন্য স্বল্পতার জন্য। আমেরিকানদের একটি বিশ্বাস আছে। যখন তুমি কিছু করবে তখন সেটাই করবে। আমি এটি পারি না। কবিতা যে কোনো জিনিস এবং সমস্ত জিনিস ধারণ করতে পারে। 

প্রশ্ন    :    জনসম্পৃক্ত করা কী কঠিন মনে হয়?
উত্তর
: হ্যাঁ, আমি ভীষণ সামাজিক। এটা প্রায়শই মানুষকে চিন্তিত করে। কেননা জনবিচ্ছিন্ন এবং দুরূহ নির্জন হিসেবে আমার কবিতার একটি ভাবমূর্তি দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু আমি এর সম্পূর্ণ বিপরীত। আমি যে কোনো লোক সম্পর্কে বলতে ভালোবাসি। আমি কোনো লোক বা কোনো কিছু থেকেই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করায় বিশ্বাসী নই।
আমার ভালো লেখা তখনই বেরিয়ে আসে যখন জনতার ডাকে আমি ভেতর থেকে বেরিয়ে আসি এবং জনতার তাগিদ আসে একটি কিছু করার। এসব বিষয় আমার রচনাকে সাহায্য করে।

প্রশ্ন : আপনি নিউইয়র্কের আপস্টেটের একটি খামারবাড়িতে বেড়ে উঠেছেন। এটা আপনার বোধকে কীভাবে সাহায্য করেছে?
উত্তর :
বেশ হ্রদ এবং জলরাশি আমার কবিতায় বিস্তর এসেছে। সম্ভত গ্রেট লেক- এর পাশে বেড়ে ওঠার জন্যই। এলিজাবেথ বিশপ এটার উল্লেখ করেছেন। তিনি সব সময় উপকূলে কিংবা হ্রদের পাড়ে বাস করেছেন এবং ডকইয়ার্ডে একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন।

প্রশ্ন    :    আপস্টেট নিউইয়র্কের একটি ঘোর গ্রাম্য এলাকা। তীব্র শীত আপনাকে কী নির্জনতা বোধে আক্রান্ত করেনি?
উত্তর : আমি
যেখানে থাকতাম সেটা ছিল একটি ফল উৎপাদনকারী এলাকা। খুব নিয়মমাফিক চাষ করা। না সমতল না পাহাড়ি। গড়পড়তা গ্রামাঞ্চল। এগুলো আমার কবিতায় খুব এসেছে। আমার কবিতার একটি অংশে তুমুল তুষার। আমরা ছিলাম লেকের একটি প্রান্তে। আমার বেড়ে ওঠার সময়টা আমি এর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইতাম। যখন আমি খুব ছোট; আমি রচেষ্টার-এ ছিলাম এবং এটা আমার খুব ভালোই লাগত। কেননা আমার পাশের বাড়ি এবং রাস্তায় প্রচ- সমবয়সী ছিল। একটি ক্ষুদ্র সমাজের মতো। কিন্তু এরপরই আমাকে বাবার কাছে চলে আসতে হয় এবং বাবা আমাকে কয়েক মাইল দূরের স্কুলে পাঠিয়ে দেন। ফলে শৈশবকালটি একাকী হয়ে পড়ে।

প্রশ্ন    :    আপনি উল্লেখ করেছেন ‘দি ভারমন্ট নোট বুক’ ম্যাসচুসেট্স নিয়ে লেখা। আপনি কি বলতে চান ছাঁচে বাঁধা ঘটনা এবং চিরাচরিত উপায়ে বিচার করে দেখা আপনার চরিত্রের ধাতে নেই?
উত্তর :
বেশির ভাগ লেখাই মিথ্যাচার এবং প্রতারণার এবং এমন সব কাজের জন্য করা হয়, যা আদৌ করা উচিত নয়। একবার এটা লেখা হয়ে গেলে এটাকে যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। এটা দাঁড়াল কি না দেখো।
আমার ক্ষেত্রে শিরোনামটি চমৎকার মনে হয়েছে। ভারমন্ট-এর পারিপাশির্^ক নিউইংল্যান্ড থেকে কিছু কিছু কারণে স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার। যে মুহূর্তে আপনি কল্পিত সীমান্ত পার হয়ে নিউহ্যাম্পশায়ার পড়বেন, তখন এটাকে একটি বেশি তাজা মনে হয় এবং ভারমন্টকে মনে হবে আরও বেশি সবুজ এবং সতেজ; কিন্তু অন্যদিকে ভারমন্টে কার পোর্ট, সুপারমার্কেট এক্সরেটেড মুভি এবং অন্যান্য সব জায়গায় যা আছে, তা সবই বিদ্যমান ছিল। আমার বক্তব্য হচ্ছে সমস্ত অঞ্চলগুলোই এক, যেখানে আমরা থাকি এবং আমাদের মন যেখানে থাকে।

প্রশ্ন : নোট বুকের উৎস সম্পর্কে কিছু বলুন।
উত্তর :
আমাকে নিউইংল্যান্ডের বিভিন্ন এলাকায় বাসে করে বিস্তর ভ্রমণ করতে হয়েছে। বেশির ভাগ ম্যাসাচুসেটস এবং এর বেশির ভাগ বাসেই বসে লেখা। শুধু মন চলছে না ল্যান্ডস্কেপও সেই সঙ্গে আবর্তিত হচ্ছে। বাস কোনোভাবেই একটি কাব্যিক স্থান নয়, সুতরাং এটাকে প্রেরণাহীন পরিবেশে লেখার নিরীক্ষা বলা যায়।
আমি আমার এক বন্ধু জো রেইনর্ড-এর সহায়তা নিয়ে কাজটি করি। যার কাজ সাধারণত খুব সরাসরি এবং পরিমিত। তথাপি তা স্বচ্ছতার মধ্য দিয়েও ভয়ঙ্কর।
আমি লেখার পর ইলাস্ট্রেশনগুলো সে করে দেয়। কখনও কখনও এগুলোর সঙ্গে পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলোর সম্পর্ক থাকত, কখনও আবার থাকত না। এবং কখনও কখনও এগুলোর কিছুই করার থাকত না।
প্রচ্ছদে ছিল একটি বাড়ি। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় শান্তির নীড় ধরনের একটা ভাব লেগে আছে। কিন্তু খুব গভীর অভিনিবেশ সহকারে দেখলে বোঝা যাবে এটা ১৯১০ সালের সাদামাটা বাংলো ছাড়া আর কিছুই নয়, যা আজকের ভারমন্ট বলতে একজনের মনে যে সবুজ সাটার-সহ বাড়ি ভেসে ওঠে, তা নয়। যা হোক, আমি এটা লেখার আগেই এটার নাম দিয়েছিলাম।
এটার কিছু অংশের লেখা খুবই নিরক্ষাধর্মী। এটায় আমার লেখার এমন কিছু অংশ আছে যেগুলোকে দুভার্গ্যজনকভাবে গারট্টুড মেইন প্রভাবিত বলে মনে করা হয়। কিন্তু তার লেখা আমি পড়লেও আমার মনে হয় না আমার লেখায় তার ছায়া কখনও এসে পড়েছে বিচ্ছিন্নভাবে দু-এক জায়গায় ছাড়া।

প্রশ্ন    :    কীভাবে আপনার রচনা লেখা হয়, আপনি কি রিভাইস করেন?
উত্তর :
কলেজ অধ্যাপকগণ প্রায়শই বলে থাকেন যে পুনর্লেখন এবং পুনরালোচনার মাধ্যমে লেখার মানোন্নয়নের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। যখন আমি লেখা শুরু করি তখনই তাতে প্রচুর শ্রম ব্যয় করি। তাই মনে হয় না ওগুলো এখন লিখলে খুব একটা ভিন্নভাবে লিখতে পারব। আমি পুনর্লেখন খুব কমই করি। একাধারে উচ্চাকাক্সক্ষী এবং অলস হওয়ার কারণে আমি আমার নিজস্ব পন্থায়ই আমার সমস্যাগুলো মোকাবেলা করি এবং অবচেতনভাবে মনকে শিক্ষিত করার কারণে এমন কবিতা লিখি না, যার ওপর পুনর্লেখন করতে হয় কিংবা যাকে কাটছাট করতে হয়। ফলে এটা তার চূড়ান্ত রূপ নিয়ে বেরোয়। আমি পুনর্লেখন করি না বললেই চলে।
শুধুমাত্র আমার সাম্প্রতিক কাজ ‘সেলফ পোর্ট্রেট ইন এ কনভেকস মিরর’-এ আমাকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন সাধন করতে হয়েছে। এটা আমাকে যথেষ্ট কষ্ট দিয়েছে। আমার মনে হয় আমি ৪-৫টি সংস্করণ লিখেছি। বেশির ভাগ পরিবর্তনই ছিল তুচ্ছ। যদিও মাল লেখার সাথে কোনো একটি পঙ্ক্তিরও মিল ছিল না। তথাপি পরিবর্তনগুলো ছিল সামান্য। কমা কিংবা একটি শব্দ হয়তো সেখানে আছে; কিন্তু অন্যরকম অর্থ হচ্ছে ইত্যাদি পরিবর্তন করা। এটা কবিদের এক অতি স্বাভাবিক প্রবণতা। এমন কি যে সমস্ত কবিতা আমার চেয়েও নিয়ন্ত্রিত এবং স্বেচ্ছাপ্রণোদিত। তবে একটি জিনিস আমি বুঝতে পারি না। একই অর্থও দুটি শব্দের মধ্যে ছন্দ পরায়ণ শব্দটি আমার কাছে বেশি যুৎসই বিকল্প মনে হয়।

প্রশ্ন    :    ‘সেলফ পোর্ট্রেট ইন এ কনভেকস মিরর’-এর পটভূমি সম্পর্কে কিছু বলুন? এটাকে আপনার বিভিন্ন কাজের মধ্যে সবচেয়ে সংহত বিবেচনা করা হয়।
উত্তর :
প্রথমত আমি কখনোই মনে করি না আমার কোনো কবিতা অসংহত এবং তা যদি হয়ে থাকে তবে এটাও তাই, অন্যরকম হবে কেন? এটার রচনার ধরনে একটি বিশেষ পেইন্টিং নিয়ে কাজ করছি। একজন পাঠক খুব গভীর অভিনিবেশ সহযোগে পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পাবে পর্ব থেকে পর্বান্তরে, ধারণা থেকে অন্য ধারণায় যাওয়া অন্যান্য প্রশ্নের মতোই পরোক্ষভাবে ঘটেছে। পারমিগিয়ানিনো একজন ষোড়শ শতকীয় ইতালিয়ান চিত্রকর। যিনি নিজেকে একটি উভোত্তল দর্পনে চিত্রিত করে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তার এক হাত মুখের সামনে। ফলে তার মাথার চেয়ে দ্বিগুণ দেখাচ্ছিল হাতটি এবং সমস্ত রূপটিকে মনে হচ্ছিল মহাশূন্যের একটি স্তর। এটা প্রকৃত প্রস্তাবে একটি কাঠের বলের উভোত্তল পিঠে আঁকা হয়েছিল।
এ ছবিটি সম্পর্কে আমি সব সময়ই লিখতে চেয়েছি এ কারণে যে, এটি আমাকে দীর্ঘকাল তাড়া করেছে। আমি এক বছর শীতে প্রাদেশিক শহরে এক মাস কাটিয়েছি, কিছুই করার ছিল না। খুব একটা অনুপ্রাণিত বোধ করছিলাম না। বাড়ির থেকে বহু দূরে থাকার কারণে বাড়িতেই আমি বেশির ভাগ লিখেছি।
সেখানে একদিন এক বুক স্টলে ঐ ছবিটির পনর্মুদ্রিত প্রচ্ছদের একটি বই শোভা পাচ্ছিল। আমি সেখানে গিয়ে বইটি কিনি এবং কিছুুকাল রেখে দেওয়ার পরও তার ওপর লিখতে শুরু করি। তখন খুব মিশ্র পর্যায়ের অনুপ্রেরণা বোধ করছিলাম। ফলে শেষ করার ব্যাপারে খুব একটা তাগিদ অনুভব করিনি। কিন্তু পরে নিউইয়র্ক ফিরে এসে শেষ করি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে অন্য এক সময় আমি যখন বুকস্টলটি খোঁজ করতে যাই এটাকে আর কিছুতেই খুঁজে পেলাম না। মনে হলো দোকানটি পৃথিবী থেকেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। এখানে আদৌ কোনো দোকান ছিল এমন চিহ্নমাত্র নেই। এক ধরনের কুসংস্কারের মতো মনে হচ্ছিল। বোধহয় শুধুমাত্র ঐ বইটি আমার কাছে বিক্রি করার কারণে কয়েক মুহূর্তের জন্য দোকানটি সেখানে ছিল এবং পরমুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

প্রশ্ন    :    আপনি বলেছেন যে ছোটবেলায় ইচ্ছে ছিল পেইন্টার হবেন। এখন কী পরিমাণ ছবি আঁকছেন বলে মনে করেন?
উত্তর :
আমার কবিতা দৃশ্যময় স্তবকে ভরা। কিন্তু এগুলো থেকে শুনতে চেষ্টা করি, দেখার আগে। আমি কখনই সচেতনভাবে আঁকতে চাই না, দৈবক্রমে এটা ঘটে যায়। আমারও মনে হয় ভেতর থেকেই আঁকার প্রবণতাটি এখনও যায়নি এবং সুযোগ পেলেই অন্য মাধ্যমেও হানা দেয়। আরও সবল হয়ে। মনে হয় আমার আঁকিয়ে সত্তার একটি অংশ অবচেতনভাবে আমার কবিতার মধ্যে ঢুকে পড়ে। অনেকদিন ভেবেছি আমি লেখক হিসেবে খুব একটা দৃশ্যপরায়ণ নই। কিন্তু ইদানীংকালে ধারণা পাল্টেছে। আমার কবিতার মধ্যে পটুয়াদের ভাষায় ছবি পাওয়া যাচ্ছে। কখনও কখনও শব্দগুলো অধিবাস্তব ছবি তৈরি করে, যা গ্রাফিক্স পেইন্টিং-এ বিস্তর পাওয়া যায়।
অনুবাদ : বুলান্দ জাভীর, কবি, সিইও অ্যান্ড এমডি, রূপালী ব্যাংক লি. 

এই বিভাগের আরো সংবাদ