আজকের শিরোনাম :

‘সমন্বিত ও ভারসাম্যপূর্ণ রেল যোগাযোগই মূল লক্ষ্য’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০১৯, ১৩:২৩

নুরুল ইসলাম সুজন। পেশায় আইনজীবী। নেশায় রাজনীতিবিদ। ছাত্র-যুব নেতা থেকে হয়েছেন আইনজীবী নেতা। পঞ্চগড়-২ আসন থেকে পরপর তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। গত ৭ জানুয়ারি তার জীবনে যুক্ত হয়েছে নতুন পালক। আওয়ামী লীগের তৃতীয় দফার সরকারে হয়েছেন রেলপথমন্ত্রী। রাজনীতির প্রতি তার একাগ্রতা, ত্যাগ ও সততার পুরস্কার হিসেবেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে মন্ত্রিসভার সদস্য করেছেন। সেই দায়িত্বও তিনি ভালোভাবে সামলাচ্ছেন। এর আদ্যোপান্ত জানতে তার মুখোমুখি হয়েছিলেন- আলমগীর স্বপন। রেল মন্ত্রণালয়ের সংকট-সমস্যা এবং এ নিয়ে তার লক্ষ্য ও পরিকল্পনা উঠে এসেছে বিস্তারিত সাক্ষাৎকারে।

প্রশ্ন : রেলমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন প্রায় আট মাস। মন্ত্রিত্বের কঠিন দায়িত্ব এ সময়ে কতটা সহজ করতে পেরেছেন? কেমন কাটছে?
নুরুল ইসলাম সুজন :
রেলওয়ে সম্পর্কে আসলে আমার তেমন কোন ধারণা ছিল না। মন্ত্রণালয়ে আসার পরে রেল সম্পর্কে প্রতিনিয়ত আমি শিখছি। তবে আমি রেলমন্ত্রী হিসেবে নতুন হলেও সংসদ সদস্য হিসেবে গত ১০ বছর সরকারের সাথে কাজ করছি। কাজেই সরকারের যে মূল লক্ষ্য ও পরিকল্পনা সে-বিষয়ে আমার ধারণা আছে। যে কারণে রেল মন্ত্রণালয় সম্পর্কে আমাদের পরিকল্পনা কী, ভবিষ্যতে কীভাবে এই মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে নিতে চাইÑ এর ছক অনেকটাই করেছি। আমাদের প্রধান লক্ষ্য হলো সমন্বিত ও ভারসাম্যপূর্ণ রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

প্রশ্ন : স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর পথে আমরা। এ সময়েও কেন সমন্বিত ও ভারসাম্যপূর্ণ রেল যোগাযোগ গড়ে তোলা যায়নি। আপনি দায়িত্ব নিয়ে কারণগুলো কী খুঁজে দেখেছেন?
নুরুল ইসলাম সুজন :
অতীতে রেলই যোগাযোগের অন্যতম প্রধান বাহন ছিল। দেশ স্বাধীনের পরও ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পরিবহন কার্যক্রম হতো রেলের মাধ্যমে। নৌপথে ছিল প্রায় ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ। কিন্তু এই দীর্ঘ পথচলায় আমরা দেখছি রেলের যে সক্ষমতা আগে ছিল সেখান থেকে কমে আজ ১০ থেকে ১১ শতাংশে নেমে এসেছে। এর কারণ হলো এই সময়ে রেলের প্রতি কেউ কোনো গুরুত্ব দেয়নি। রেলকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যে তাগিদ ও উদ্যোগ সেটা ছিল না। সড়ক পরিবহনকে যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রেলকে সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অবজ্ঞা করা হয়েছে।

এক লাইনের ওপর যে রেল চলত সেই রেলের রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকমতো করা হয়নি। আমাদের ব্রিজ, আমাদের যে স্টেশন, আমাদের আগের যে অবকাঠামো এগুলোর ন্যূনতম সংস্কার করা হয়নি। ফলে ধীরে ধীরে অনেকগুলো স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন রেলের ইঞ্জিন কেনা হয়নি। নতুন যাত্রিবাহী বগি কেনা হয়নি। যেসব কারখানায় যাত্রীবাহী বগি তৈরি করার সক্ষমতা ছিল, সেখানে অবসরে পাঠানো হয়েছে অনেক দক্ষ জনবল। ১০ হাজারের মতো জনবল ছিল নীলফামারীর সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায়। সেখানে এখন জনবল মাত্র ১ হাজার ৪০০। পাহাড়পুর রেলওয়ে কারখানা সেখানেও একই অবস্থা। পার্বতীপুরে লোকামোটিভ কারখানা রয়েছে। ১৯৯১ সালে এই লোকোমোটিভ কারখানা আমরা সেখানে করেছি। যেসব লোকোমোটিভ বা ইঞ্জিন রক্ষণাবেক্ষণ দরকার, রিরোলিং বা নতুন করে সংস্কার করা প্রয়োজন কিংবা নষ্ট হয়ে গেলে সারানো এই কার্যক্রম সেখানে চলে। এসব ক্ষেত্রে আমরা জনবলের সংকটে পড়েছি। ১৯৮৬ সাল থেকে রেলে নতুন লোকবল দেওয়া হয়নি। গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে ১৯৯১ সালে প্রায় ১০ হাজারের মতো রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাঁটাই করা হয়েছে। অথচ ১৯৭৩-৭৪ সালে রেলওয়েতে জনবল ছিল ৬৮ হাজার, সেখানে নিয়োগ যদি ধারাবাহিকভাবে ও স্বাভাবিক নিয়মে চলত, তাহলে আজ রেলওয়ের জনবল থাকার কথা দেড় লাখ। আমাদের দেশের জনসংখ্যা সাড়ে ৭ কোটি থেকে ১৫-১৬ কোটি হয়ে গেছে। বাড়ছেই। কিন্তু রেলে লোকবল সংকুচিত হয়ে গেছে বৃদ্ধি পাওয়ার বদলে।

প্রশ্ন : তাহলে জনবল সংকট রেলওয়ের উন্নয়নে বড় বাধা হিসেবে দেখছেন। এক্ষেত্রে আপনার প্রস্তাব কী? নতুন জনবল নিয়োগের কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন?
নুরুল ইসলাম সুজন :
আমরা জনবল কাঠামো করেছি। সে-অনুযায়ী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি। ৫০ হাজার জনবলের প্রস্তাব দিয়েছি আমরা। স্বাধীনতার পর রেলের যে ৬৫ হাজার জনবল ছিল সেটাও চাইনি আমরা। বর্তমানে রেলওয়েতে আছে মাত্র ২৫ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। আমাদের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই চলছে। অল্পদিনের মধ্যে হবে আশা করি।

রেল মন্ত্রণালয় একটা প্রযুক্তিকেন্দ্রিক বা টেকনিক্যাল মন্ত্রণালয়। এখানে প্রকৌশলী থেকে অন্যরা যারাই কাজ করে প্রত্যেকের কাজই বিশেষায়িত ও কারিগরি। সে অনুযায়ী এখানে শুধু জনবল নিয়োগ দিলেই হয় না, তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হয়। একজনের সাথে আরেকজন কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এর সবগুলোই একসাথে করতে হয়। এখান থেকে ধীরে ধীরে পদোন্নতিরও বিধান আছে। দক্ষ জনবল তৈরি ও কাজের অভিজ্ঞতা অর্জনের যে প্রক্রিয়া, এর ছেদ পড়লে ভুগতে হয়। এ কারণে একটা লাইন আমরা সংস্কার করতে চাইলে বছরের পর বছর সময় লাগে। আর নতুন রেলপথ করতে চাইলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়।

প্রশ্ন : রেলওয়ের বিভিন্ন রুটে ট্রেনের কোচ ও ইঞ্জিনের সংকট রয়েছে। রেলে নতুন লোকোমোটিভ বা ইঞ্জিন ও কোচ ক্রয়ে আপনার পরিকল্পনা কী? শুনেছি এরই মধ্যে কিছু কোচ ও ইঞ্জিন রেলে যুক্ত হয়েছে?
নুরুল ইসলাম সুজন :
এরই মধ্যে আমরা বহু প্রকল্প গ্রহণ করেছি। এর আওতায় ৫০টি ব্রডগেজ কোচ এসেছে। এর মাধ্যমে বনলতা এক্সপ্রেস, পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ও বেনাপোল এক্সপ্রেস চালু করেছি। এরপর আমরা মিটারগেজ ২০০ কোচ আনার পরিকল্পনা করেছি। এগুলো যদি আসে তাহলে ১২ থেকে ১৫টি নতুন ট্রেন আমরা চালু করতে পারব বিভিন্ন রুটে। আমরা আশা করছি, আগামী এক বছরের মধ্যে এই কাজ সম্পন্ন করা যাবে। ইন্দোনেশিয়া থেকে এরই মধ্যে কিছু কোচ এসেছে। আগামী ৮ আগস্টের মধ্যে আমরা এই কোচগুলোর কিছু রংপুর এক্সপ্রেসের সাথে যুক্ত করতে পারব।

প্রশ্ন : রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রীদের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। সিডিউল বিপর্যয়ের শীর্ষে এই ট্রেন সার্ভিস?
নুরুল ইসলাম সুজন :
এটা থাকবে। এই লাইনটা আমাদের একটু বেশি কষ্ট দিচ্ছে। গত ঈদের সময় সিডিউল বিপর্যয় হয়েছে। এই রুটে একটা ট্রেনই যায়, একটা ট্রেনই আসে। কোনো কারণে যদি বিলম্ব হয় তাহলে ওই বিলম্ব বহন করতে হয় সারা সপ্তাহ।

প্রশ্ন : ঢাকা থেকে নীলফামারীর চিলাহাটিগামী নীলসাগর এক্সপ্রেসেরও একই অবস্থা? সিডিউল বিপর্যয়ে পড়তে হয় যাত্রীদের?
নুরুল ইসলাম সুজন :
নীলসাগরেরও একই অবস্থা। আমরা এই রুটে আরেকটা ট্রেন দেওয়ার চেষ্টা করছি। এখন ঢাকা থেকে সকালে এবং চিলাহাটি থেকে রাতে একটি ট্রেনই যাতায়াত করে। এগুলো আমরা আস্তে আস্তে করে ঠিক করে ফেলব।

প্রশ্ন : রেলের বহরে নতুন লোকোমোটিভ কী যুক্ত হচ্ছে?
নুরুল ইসলাম সুজন :
এরই মধ্যে আমরা ব্রডগেজ ৪০টি আর ১০০টি মিটারগেজ লোকামোটিভ ক্রয়ের পরিকল্পনা করেছি। এর মধ্যে একটি প্রকল্পে ১০টি, একটিতে ২০টি ও আরেকটি প্রকল্পে ৭০টি মিটারগেজ লোকোমোটিভ কেনা হচ্ছে। তবে এগুলো আসতে একটু সময় লাগবে। আমাদের লোকোমোটিভের কিছুটা ঘাটতি আছে। পুরনো লোকোমোটিভ অনেকগুলো অকেজো হয়ে গেছে। আমরা আশা করছি যে অল্পদিনের মধ্যে ভারত থেকে ১০টি করে ২০টি মিটারগেজ ও ব্রডগেজ ২০টি লোকোমোটিভ আসবে। আমরা প্রথম অবস্থায় ভারতের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলাম ভাড়া হিসেবে আনার জন্য। কিন্তু ভারত এটা ভাড়া হিসেবে না দিয়ে বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে বিনা ভাড়ায় দিচ্ছে।

প্রশ্ন : সব লোকোমোটিভ কী ভারত থেকে আসছে না-কি অন্য দেশ থেকেও?
নুরুল ইসলাম সুজন :
ট্রেনের কোচ আসছে ইন্দোনেশিয়া থেকে। আর ৪০টি লোকোমোটিভ আসছে আমেরিকা থেকে। এটা ব্রডগেজ ইঞ্জিন। আর মিটারগেজ যে ইঞ্জিন আসছে এর সবগুলো আসছে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে।

প্রশ্ন : ট্রেনে সিডিউল বিপর্যয়ের ভোগান্তির বিষয়ে আবার আসি, কোনোভাবেই কমছে না এই ভোগান্তি? কেন?
নুরুল ইসলাম সুজন :
একটি লাইনের ওপর আমাদের ট্রেন যাওয়া-আসা করছে। ট্রেনের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু লাইন তো একটাই। সেজন্য যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা ডাবল লাইন করতে না পারছি ততক্ষণ সিডিউল বিপর্যয় বা সিডিউলের যে ঘাটতির কথা বলছি এর সমাধান কঠিন। ঠিক সময়মতো ট্রেন চলে না এই যে ভাবমূর্তি সংকট রেলওয়েরÑ এ অপবাদ আমাদের বহন করতে হচ্ছে। এক লাইন থাকলে একসাথে দুই ট্রেন যাওয়া-আসা করতে পারে না। স্টেশনে এক লাইনে দাঁড়িয়ে আরেকটি ট্রেনকে পাশিং দিতে হয়। কাজেই আমি যতই সিডিউল অনুযায়ী ট্রেন ছাড়ি না কেন সিডিউল অনুযায়ী গন্তব্যে পৌঁছাতে পারব না।

প্রশ্ন : এক্ষেত্রে ডাবল লাইনের পরিকল্পনাও নিয়েছে সরকার? এর সর্বশেষ অবস্থা কী?
নুরুল ইসলাম সুজন :
ডাবল লাইনের বিকল্প নেই। এর কাজ চলছে। এরই মধ্যে ঢাকা থেকে টঙ্গী চার লাইন, টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর ডাবল লাইন প্রকল্পের কাজ চলমান। জয়দেবপুর থেকে ঈশ^রদী ডাবল লাইনের প্রকল্প এরই মধ্যে আমরা গ্রহণ করেছি। জয়দেবপুর থেকে জামালপুর হয়ে ময়মনসিংহ রুটেও ডাবল লাইনের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। আর টঙ্গী থেকে চট্টগ্রাম এটা আমাদের ডাবল লাইন আছে মিটারগেজে। তবে এই রুটে আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত যে অংশ বাদ আছে, সেখানে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইনের প্রকল্প আমরা নিয়েছি। আশা করছি, ২০২০ সালের মধ্যে সম্পন্ন হবে। এটা যদি হয় তাহলে ঢাকা-চট্টগ্রাম চলাচলের ডাবল লাইন প্রথম হবে বাংলাদেশে। কিন্তু এই লাইনকেও আমাদের ডুয়েলগেজ করতে হবে। অর্থাৎ ব্রডগেজ লাইনে আমরা রূপান্তর করছি। এই প্রকল্পে টঙ্গী থেকে আখাউড়া ডুয়েলগেজ হবে এবং ওইদিকে লাকসাম থেকে চট্টগ্রামও ডুয়েলগেজ করছি।

প্রশ্ন : কিছুদিন আগে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় বড় ধরনের রেল দুর্ঘটনা হয়েছে। প্রাণহানি ঘটেছে। দুর্বল রেলসেতু এই দুর্ঘটনার বড় কারণ। এ-রকম পুরনো ও দুর্বল সেতু তো সারাদেশেই আছে?
নুরুল ইসলাম সুজন :
আমরা আরেকটু সতর্ক হতে পারলে এ-ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে পারতাম। রেললাইনের অনেক স্থানে স্ক্রু নেই। কিছু রেলসেতু সংস্কারের অভাবে দুর্বল হয়েছে।

প্রশ্ন : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুশাসন দিয়েছেন পুরনো রেলসেতু সংস্কারের?
নুরুল ইসলাম সুজন :
কিছু সেতু আছে চলার মতো উপযোগী। কতগুলো আছে সংস্কার করতে হবে। এ নিয়ে আমাদের প্রকল্প পরিকল্পনা আছে। কিন্তু যেসব সেতুতে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন, এর জন্য আমরা প্রকল্পের অপেক্ষা করব না। প্রকল্প ছাড়াই ব্যবস্থা নিব। আর যদি মনে করি, প্রকল্পের সময় পর্যন্ত বর্তমান সেতুর মাধ্যমে পরিবহন সম্ভব, তাহলে এখনই আমরা নতুন করে হাত দিব না।

প্রশ্ন : গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী কয়েকটি রেলসেতুর সিøপার বাঁশ দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছে? এ নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে?
নুরুল ইসলাম সুজন :
বাঁশের বিষয়টি ইন্টারেস্টিং। এটা যেভাবে গণমাধ্যমে আসছে বাস্তবতা কিন্তু এমন না। মনে করেন, (নিজের খাতায় স্কেচ এঁকে দেখান) এই হলো রেললাইন, এই হলো স্লিপার। মাটির ওপরে পাথর-টাথর দিয়ে সিøপার ঠিকমতো রাখা হয়, যাতে সরে না যায়। এভাবে রেললাইন ধরে রাখা হয়। কিন্তু সেতুর ক্ষেত্রে নিচে মাটি কিংবা পাথর থাকে না।
আমাদের ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এই গ্রাম থেকে ওই গ্রাম রেললাইনের ওপর দিয়ে সাইকেল নিয়ে যাচ্ছি, ভ্যান নিয়ে যাচ্ছি। রেললাইনে মানুষ চলাচল করে প্রতিনিয়ত। ছাগল-গরু চরানো হচ্ছে। এতে সিøপারগুলো সরে যেতে পারে। তাই একটা সিøপার থেকে আরেকটা সিøপার সরে যেন না যায়Ñ এজন্য বাঁশ দিয়ে টানা দেওয়া হয় অতিরিক্ত সতর্কতার জন্য (একটু হাসি দিয়ে)। এর সঙ্গে রেল চলাচলের কোনো সম্পর্ক নেই। এই বাঁশের টানা রেল চলাচলের অনিবার্য অংশ নয়। এটা আমরা অতিরিক্তভাবে কেন দিচ্ছি? যাতে মানুষজন পার হলে সিøপার সেতু থেকে সরে না যায়। এ সমস্যা কিন্তু বিদেশে নেই। পৃথিবীর কোথায় সিøপারে বাঁশ দিয়ে টানা দেওয়ার নজিরও নেই। কারণ সেখানে আমাদের দেশের মতো সাধারণ মানুষ রেললাইন পারাপার করতে পারে না। আলদা বাউন্ডারি থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে এটা বাস্তব সমস্যা। আবার আমরা যদি লোহার পাত দেই। দেখা যায় এগুলো কয়েকদিনের মধ্যে খুলে নিয়ে যায়। সে-জন্য বাঁশ দেওয়া হয়। অনেকক্ষেত্রে কাঠের চেয়ে বাঁশ টেকে বেশি। পাতলা কাঠ তাড়াতাড়ি পচে যায়। এ কারণে অনেক সময় বাঁশ ব্যবহার করা হয় অতিরিক্ত সর্তকর্তামূলক অবস্থান থেকে। যেহেতু মানুষজন পারাপার করে। সিøপারগুলো বেঁকে যায়, সরে না যায় এটার জন্য।
কিন্তু এটার ছবি ছাপিয়ে এমন একটা মেসেজ আমরা দিচ্ছি যে রেললাইনে বাঁশ ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা এমন একটা তুলনা যে, ‘বিল্ডিং-এ লোহার বদলে বাঁশ ব্যবহার’। এ-রকম একটা ধারণা তৈরি হচ্ছে এতে। এটা একটা ভুল ধারণা।

প্রশ্ন : সারাদেশে কতগুলো রেলসেতু ঝুঁকিতে আছে। কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে কী?
নুরুল ইসলাম সুজন :
আমরা যাচাই-বাছাই করছি। এর সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান এখনও পাইনি।

প্রশ্ন : রেল সার্ভিস নিয়ে যাত্রীদের নানা অভিযোগ আছে। সিডিউল বিপর্যয়ের কথা আগেই বলেছি। টিকিট, খাবার ব্যবস্থা, টয়লেট, নানাক্ষেত্রে দুর্ভোগ পোহাতে হয় যাত্রীদের?
নুরুল ইসলাম সুজন :
আমাদের জনবলের ঘাটতি আছে। তবে আমাদের এখন যে সামর্থ্য আছে ঘাটতি-সংকট মেনে নিয়েও সামর্থ্যরে সর্বোত্তম ব্যবহার করতে চাই। রেলসেবা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাই। চেষ্টা করছি সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করতে। এছাড়া বর্তমান বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় যে ট্রেনগুলো আছে, তা আমরা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসছি। আর লিজ দিব না। গণমাধ্যম ইতিবাচক সমালোচনার মাধ্যমে রেলের সংকট ও সমস্যা দেখিয়ে দিচ্ছে। এতে আমরা অত্যন্ত খুশি। এর মাধ্যমে মানুষ রেলের অবস্থা জানতে পারছে। আবার আমরাও সচেতন হচ্ছি। ব্যবস্থা নিতে পারছি। আমাদের বন্ধু হিসেবে গণমাধ্যম কাজ করছে। বিষয়টি আমরা ইতিবাচকভাবে নিয়েছি।

প্রশ্ন : এটাই গণমাধ্যমের কাজ?
নুরুল ইসলাম সুজন :
গণমাধ্যম ভালো-মন্দ দুদিকই তুলে ধরবে। ভালো কাজ যারা করছে তাদের ভালো দিক তুলে ধরতে হবে, যাতে তারা উৎসাহিত হয়। এক রকম এপ্রিসিয়েট করা। আমি নিজেও বিভিন্ন স্থানে সফর করছি। কোথায় কি অবস্থা তা খতিয়ে দেখছি। কোনো বিশ্রাম নেই।

প্রশ্ন : ট্রেনের টিকিটের জন্য অ্যাপস চালু করেছেন। এর সুবিধা কী পাচ্ছে যাত্রীরা? গত ঈদে অ্যাপসে অনেক ভোগান্তির অভিযোগ ছিল?
নুরুল ইসলাম সুজন :
চাহিদা বেশি থাকায় কিছু সমস্যা গত ঈদে ছিল। সে-সময় সার্ভারের সক্ষমতা ও একসাথে অনেক হিট পড়ায় অনেকে অ্যাপসে ঢুকতে পারেনি। টিকিট কাটতে সমস্যা হয়েছে। তবে এবার এ-ধরনের অভিযোগ শোনা যাচ্ছে না। এবার একসাথে যদি ৫ লাখ হিটও হয়, তা সামাল দেওয়া যাবে। সেই সক্ষমতা আছে।

প্রশ্ন : এখনও অনেক জেলায় রেল সংযোগ নেই। নতুন কোন কোন রুটের পরিকল্পনা আছে মন্ত্রণালয়ের?
নুরুল ইসলাম সুজন :
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল সংযোগ হচ্ছে। এছাড়া নীলফামারীর চিলাহাটি হয়ে ভারতের হলদিবাড়ী পর্যন্ত রেল যোগাযোগ পুনরায় চালু হচ্ছে। পাকিস্তান আমলে এই রুটে রেল যোগাযোগ ছিল। পরে বন্ধ হয়ে যায়। ৭ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপন করলে হলদিবাড়ীর সাথে আবারও রেল যোগাযোগ স্থাপন করা যাবে। এ প্রকল্পের টেন্ডার হয়ে গেছে। ওয়ার্ক অর্ডারও আমরা দিয়েছি। আরেকটা নতুন লাইন আমাদের হবে। সেটা হলোÑ বঙ্গবন্ধু ব্রিজ পার হওয়ার পরে সিরাজগঞ্জ থেকে বগুড়া পর্যন্ত সরাসরি ট্রেন লাইন। পঞ্চগড় থেকে বাংলাবান্ধা নতুন আরেকটি লাইন আমরা নির্মাণ করব। এরই মধ্যে এ প্রকল্প নেওয়া আছে। মাগুরা জেলায় রেললাইন প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে।

প্রশ্ন : যমুনা নদীতে রেলের জন্য আলদা ব্রিজ নির্মাণের প্রকল্পটি কোন পর্যায়ে আছে?
নুরুল ইসলাম সুজন :
আমাদের রেলব্যবস্থা পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল দু-ভাগে বিভক্ত। পশ্চিমাঞ্চলের রেলপথ ব্রডগেজ। আর পূর্বাঞ্চলে মিটারগেজ। পশ্চিমাঞ্চলের রেল ব্যবস্থা ব্রিটিশ ভারতে কলকাতামুখী ছিল। যে কারণে গোয়ালন্দ ঘাট, ঈশ^রদী, খুলনা এই রুটগুলো অনেক সক্রিয় ছিল। আর পূর্বাঞ্চল ছিল বার্মা বা এখনকার মিয়ানমার, চট্টগ্রাম, আসাম এ অঞ্চলকে ঘিরে। এটা মিটারগেজ রেল। যমুনা নদীর ওপর দীর্ঘদিন কোনো ব্রিজ ছিল না। ১৯৯৬ সালে যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তখন যমুনা ব্রিজ চালু হয়। সড়ক সেতুর সাথে রেলপথ যুক্ত হয়। এতে প্রথমবারের মতো সরাসরি সংযোগ স্থাপন হয় রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে পশ্চিমাঞ্চলের।
এই সংযোগ আরও জোরালো ও নিরাপদ করতে যমুনা নদীতে আরেকটি রেলব্রিজ জাইকার অর্থায়নে করা হচ্ছে। বর্তমান যে সড়ক ও রেলসেতু আছে, এর ৩০০ গজ উজানে সেতুটি নির্মিত হবে। এরই মধ্যে টেন্ডার প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্নের পথে। সেতুর দুটি অংশ, পশ্চিমাংশ ও পূর্বাংশ। দুই অংশে দুটি ভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হবে। সেতুর পূর্বাংশের জন্য অর্থায়নের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সেটি মূল্যায়ন কমিটির বিবেচনায় আছে। কিন্তু পশ্চিমাংশের জন্য ঠিকাদাররা যে প্রাইজ দিয়েছে এটা কতটা যৌক্তিক ও অর্থনৈতিকভাবে আমাদের জন্য ভালো, এর মূল্যায়ন চলছে। তাদের প্রস্তাব মূল্যায়ন শেষে যদি আমাদের মনে হয় এতে আমাদের লাভ আছে, তাহলে তারা কাজ পাবে। এতে পশ্চিমাংশের জন্য নতুন করে আর টেন্ডারে যেতে হবে না। আশা করছি, এ বছরের মধ্যেই যমুনায় আলাদা রেলওয়ে সেতুর কার্যক্রম শুরু করতে পারব।

প্রশ্ন : চট্টগ্রামের কালুরঘাটে রেলব্রিজ প্রকল্প দীর্ঘদিন ঝুলে আছে?
নুরুল ইসলাম সুজন :
কালুরঘাট যে ব্রিজ হওয়ার কথা এর সড়ক ও রেলপথের প্রস্তাব যখন দেওয়া হয়েছে তখন একনেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এর ডিজাইন উপস্থাপনের জন্য বলেছিলেন। এটি আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর শুনেছি। কিন্তু কী কারণে সেটা হয়নি, আমি যেহেতু সে-সময় দায়িত্বে ছিলাম না, তাই বলা আমার পক্ষে কঠিন। তবে পরে যে প্রস্তাব লিখিতভাবে আমাদের কাছে এসেছে তাতে বলা হয়েছে, রোড কাম রেলব্রিজ একসঙ্গে না করে আলাদাভাবে রেলব্রিজ করার প্রস্তাব দেওয়ার জন্য। এ কারণে এর আগের প্রস্তাবকারী প্রতিষ্ঠান কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংক প্রকল্প থেকে পিছুটান দেয়। এ অবস্থায় আমি মন্ত্রির দায়িত্ব নেই। যেহেতু কালুরঘাট ব্রিজ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেতু, সে-জন্য কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান পুনরায় জানার চেষ্টা করি। বলি তারা যদি প্রকল্পটা করে তাহলে করবে, আর না করলে যেন জানায়। তখন প্রতিষ্ঠানটি আমাদের সাথে যোগাযোগ করে চিঠি দেয়। বলে, আলদাভাবে যে রেলওয়ে ব্রিজ করার পরিকল্পনা সেটা আমরা করব। তখন আমরা বলেছি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিতে। এটার ওপর এখন সম্ভাব্যতা যাচাই বা ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি হচ্ছে। এ প্রকল্পে এর আগে আমাদের ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব ছিল। এখন তারা ১৪০ বিলিয়ন ডলারের নির্মাণ ব্যয়ের কথা বলছে। যদিও এখনও ডিজাইন এবং সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দেয়নি। তারা ডিপিপি তৈরি করে দিলে আমরা বুঝতে পারব প্রকৃত ব্যয় কত হবে। এ পর্যায়ে এখন কালুরঘাট রেলব্রিজ প্রকল্পটি আছে। তবে আমাদের ধারণা, দু-এক মাসের মধ্যে তাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবটি পেয়ে যাব। নতুন ডিজাইন পেলে একেবারে পৃথক রেলওয়ে ব্রিজ নির্মাণের প্রস্তাবটি একনেকে পাঠানো হবে।
কালুরঘাট ব্রিজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে এটা সিঙ্গেল লাইনে হবে না। ওইদিকে মহেশখালী-মাতারবাড়ী প্রকল্প আসছে। আবার কক্সবাজারের সাথে আমাদের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এসব কারণে আমরা ডাবল লাইনের রেলব্রিজ করার পরিকল্পনা নিয়েছি। প্রতি বছর তো আর ব্রিজ করা যাবে না। একটা ব্রিজ করা হয় ১০০ বছর বা ৫০-৬০ বছর সামনে রেখে।

প্রশ্ন : দুদকের টিম কিছুদিন আগে রেল মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতির ১০টি খাত চিহ্নিত করে আপনাকে রিপোর্ট দিয়েছে। দুদক রেলের দুর্নীতি, অনিয়ম কমাতে এবং প্রাতিষ্ঠানিক ঘাটতি দূর করতে ১৫টি সুপারিশও দিয়েছে। সুপারিশ আমলে নিয়ে কী আপনারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন? অভিযোগ কী খতিয়ে দেখছেন?
নুরুল ইসলাম সুজন :
দুদকের যে সুপারিশ এটা আলাদা কিছু না। আমরা কাজ করতে গিয়ে যা দেখছি, পেয়েছি এর চেয়ে আলাদা কিছু নেই তাদের সুপারিশে। এগুলো আমাদের জানা আছে। আমাদের দৃষ্টির মধ্যে নেই সে-রকম কিছু দুদকের সুপারিশে আসেনি।

প্রশ্ন : সমস্যা যেহেতু জানাই আছে, সেক্ষেত্রে আপনারা কী ব্যবস্থা নিয়েছেন বা নিচ্ছেন?
নুরুল ইসলাম সুজন :
ব্যবস্থা বলতে প্রতিনিয়তই ব্যবস্থা নেওয়ার মধ্যেই আছি আমরা। বাকি মূল্যায়নটা আপনাদের।

প্রশ্ন : কী ব্যবস্থা নিয়েছেন এর সুনির্দিষ্ট উদাহরণ আছে কী?
নুরুল ইসলাম সুজন :
আমরা যেসব কার্যক্রম প্রতিনিয়ত করছি, তাতে সতর্ক থাকছি। কেনাকাটায় যাতে আমরা সাশ্রয়ী হই, অপচয় না করি সে-বিষয়ে সতর্ক আছি।

প্রশ্ন : এ অবস্থায় রেল মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি নেই বলে কী দাবি করবেন?
নুরুল ইসলাম সুজন :
দুর্নীতি নেই এটা বলব না। তবে আমাদের সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। আমরা সেই নীতিতে অব্যাহতভাবে আমাদের কাজ করে যাব। আপনাকে একটা জিনিস কিনতে দিলাম। আপনি ১০ টাকার জিনিস ৫০ টাকায় কিনেছেন। এ-রকম সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির তথ্য যদি আপনারা দিতে পারেন, তাহলে আমরা খুশি হব। এভাবে দুর্নীতি হচ্ছে বা অমুক জায়গায় দুর্নীতি হয়েছেÑ এ-রকম তথ্য দিতে পারলে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নিব। এর সাথে যে বা যারাই জড়িত থাকুক, যত বড় শক্তি দুর্নীতি করুক আমরা ব্যবস্থা নিব।

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ