আজকের শিরোনাম :

‘সংখ্যাগত দিক দিয়ে আমাদের উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ জুন ২০১৮, ১৪:০৪

ঢাকা, ০৩ জুন, এবিনিউজ : মো. মিজানুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটের সদস্য ছিলেন। বিভিন্ন বেসরকারি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার আগ্রহের জায়গার মধ্যে রয়েছে ব্র্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, স্ট্র্যাটিজিক মার্কেটিং, গ্লোবাল মার্কেটিং, সার্ভিস মার্কেটিং। পিএইচডিতে তার বিষয় ছিল ‘ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ইন বাংলাদেশ: ট্রেন্ড অ্যান্ড পারফরম্যান্স’। বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক উন্নয়নে আইসিটির ভূমিকা, বাংলাদেশে পর্যটনের সম্ভাবনা, মত্স্যসম্পদ, তৈরি পোশাক রফতানির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের কোটা ও বিধিনিষেধের প্রভাব প্রভৃতি বিষয়ে তার গবেষণাপত্র রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা, কর্মসংস্থান, অনলাইন মার্কেটিং, আগামী দিনের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ, বেসরকারি খাতের স্থবিরতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে একটি জনপ্রিয় দৈনিকের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। তা হুবহু তুলে ধরা হলো-
 
প্রথমেই দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাই। দেশের অর্থনীতি এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে?

সাধারণভাবে দেখলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমান্বয়ে উন্নতির দিকে যাচ্ছে এবং অর্থনীতির সূচকগুলো মোটামুটিভাবে ইতিবাচকই রয়েছে। সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয় জিডিপি প্রবৃদ্ধি। সরকারি হিসাবে গত অর্থবছর আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। চলতি অর্থ-বছরের লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে মূল্যস্ফীতির হার ৬-এর নিচে রয়েছে। এটা সাড়ে ৫-এর কাছাকাছি ছিল, এ মুহূর্তে একটু বেশি, তবে ৬-এর নিচে রয়েছে। এগুলো হচ্ছে কিছু ইতিবাচক দিক। আবার কিছু সূচকের অবস্থা কিছুটা হলেও নেতিবাচক। যেমন— রেমিট্যান্স একটা সময় ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধির ধারায় ছিল, তবে বিগত বছরগুলোয় এতে কিছুটা ভাটা পড়েছে। তবে এ কথাও ঠিক, আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ অস্থিরতার প্রভাব আমাদের ওপরও পড়ছে। ইউরোপ-আমেরিকার শ্রমবাজারে বুমিং অবস্থা ছিল, এখন সেখানে সংকটপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছে। অন্যদিকে যখন জিএসপি বাতিল করা হলো, বিশেষ করে ইউএস মার্কেটের ক্ষেত্রে, ধরে নেয়া হয়েছিল গার্মেন্ট শিল্পে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সৌভাগ্যক্রমে এটা পড়েনি, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইতিবাচক হয়েছে। সব মিলিয়ে কিছু পার্থক্য বাদ দিলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ইতিবাচক দিকেই রয়েছে। তবে বেশকিছু গুণগত প্রশ্ন রয়ে গেছে। সেগুলো পরিষ্কার করা দরকার। ব্যবসা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে আমার মধ্যে কিছু কনফিউশন থেকে গেছে। যেমন— সরকার বলছে, গেল অর্থবছর আমরা জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ অর্জন করেছি। অথচ আমাদের বেসকারি খাত এরই মধ্যে প্যারালাইজড হয়ে গেছে। কিছুদিন আগে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, বিমানের দুটি ডানার মধ্যে একটি এখন বিকল। তিনি যে বিকল ডানার কথা বলছেন, সেটা হলো বেসরকারি খাত। তবে পাবলিক সেক্টর এখন খুব সচল। অর্থ ব্যবস্থায় বেসরকারি খাতই হচ্ছে আসল ফ্যাক্টর এবং সরকারের তো অবশ্যই কিছু সেক্টর থাকবে। বেসরকারি সেক্টর প্রকৃতপক্ষেই বিকলের মতো রয়েছে, আমি এর সঙ্গে একমত। সরকারি সেক্টরে সরকার প্রচুর পরিমাণ টাকা ব্যয় করছে, কাগজে-কলমে হিসাব দেখলে ব্যয়ের ক্ষেত্রে আমাদের ব্যাপক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। জিডিপি ক্যালকুলেশনের সময় দুটো পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়— একটি উৎপাদন পদ্ধতি, অন্যটি ব্যয় পদ্ধতি। কাগজে-কলমে আমরা যখন ব্যয় করছি, তখন সেটিকে মেথড হিসেবে দেখলে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কারণ বিগত বছরগুলোয় ধারাবাহিকভাবে আমাদের ব্যয় বেড়েছে, অর্থনৈতিক কলেবর বেড়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যে ব্যয়গুলো আমরা কাগজে-কলমে দেখাচ্ছি, আসলেই কি তা সম্পূর্ণভাবে ব্যয় হচ্ছে? গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, এখন দুর্নীতির মহোৎসব চলছে। যে প্রক্রিয়ায় যাদের কাজগুলো দেয়া হচ্ছে, তারা কারা? কোন প্রক্রিয়ায় কাজগুলো দেয়া হচ্ছে? একটি বিশেষ দলের লোকদেরই কোনো না কোনোভাবে কাজ দেয়া হচ্ছে? ব্যয় করার আগেই কিছু অদৃশ্য ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো আমরা ধারণা করি, ওই অদৃশ্য ব্যয় যদি না করা হয়, তবে কাজ পাওয়া যাবে না। কাজের অফিশিয়ালি একটা হিসাব থাকে, এ কাজে এই পরিমাণ ব্যয় করা হবে। রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামো উন্নয়নে কখনো কখনো ৫০ শতাংশও ব্যয় করা হচ্ছে না। ছাদ, কালভার্ট, সেতু করা হচ্ছে, যেখানে রডের বদলে দেয়া হচ্ছে বাঁশ এবং কিছুদিন পরেই এটি ভেঙে পড়ছে। যে প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি এসব কাজে সম্পৃক্ত, তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, এমনটিও নয়। তারা এক ধরনের সুবিধা ভোগ করছে। অর্থাৎ যা-ই করো না কেন, তোমার শাস্তি হবে না। সুতরাং কাগজে-কলমে আমরা প্রবৃদ্ধি দেখছি যথেষ্ট ভালো কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে না। একটি অর্থনীতির সবচেয়ে বড় হাব হচ্ছে শেয়ার বাজার। ১৯৯৬ ও ২০১০ সালে শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি হয়েছে। ২০১০ সালের কেলেঙ্কারির জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল, যার প্রধান ছিলেন খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ স্যার। তিনি কিছু অবজারভেশন ও সুপারিশ দিয়েছিলেন। গণমাধ্যমে আসা তথ্য থেকে আমরা জেনেছি, বড় বড় রাঘব বোয়াল এসব টাকা লুটপাটের সঙ্গে জড়িত। তিনি একপর্যায়ে অসহায়ত্বের কথা স্বীকার করে বলেছিলেন, একমাত্র আল্লাহ-খোদা ছাড়া এদের কেউ কিছু করতে পারবে না। একইভাবে বছর দুই-তিন আগে সূচক কোথা থেকে কোথায় নামানো হয়েছে। যে লোকগুলো এ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদেরকেই আবার মার্কেট তোলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে অর্থনীতির অন্যতম একটি খাত হচ্ছে ব্যাংকিং খাত। বাংলাদেশের ইতিহাসে এত বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি কখনো হয়নি। বেসিক ব্যাংকের কথাই ধরুন। বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যানকে দুদক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ঠিক আছে, কিন্তু তার তো বাইরে থাকার কথা ছিল না। অর্থমন্ত্রী কিন্তু পাঁচবার বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেয়ার কথা বলেছেন। দুঃখের কথা, আজ পর্যন্ত ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি বুঝতে অক্ষম, তার পেছনে এমন কোন শক্তি রয়েছে, মাননীয় অর্থমন্ত্রীও পাবলিকলি নিজের অসহায়ত্বের কথা বলেছেন। হলমার্ক, বিসমিল্লাহর মতো কত বড় বড় কেলেঙ্কারি হয়েছে, কিন্তু ধরা হয়েছে শুধু ছাপোষা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। এরা তো বোর্ডের আদেশ মানতে বাধ্য। এদের বিরুদ্ধে হয়তো কিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কিন্তু নেপথ্যে যারা ছিলেন, আসলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। একটার পর একটা কেলেঙ্কারি ঘটে যাচ্ছে। এটা শুধু ব্যাংকিং খাতের কথা বললাম। প্রতিটা খাতেরই একই অবস্থা। চীনের প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের কম। আর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। সরকার যখন প্রবৃদ্ধির কথা বলে, তখন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও অনেক অর্থনীতিবিদ প্রতিবারই একটা রিমার্ক করেন। তারা নিজেদের হিসাব করা প্রবৃদ্ধির কথা বলে থাকেন। এখানে লক্ষণীয়, প্রবৃদ্ধি নিয়ে সরকার যেটা দাবি করছে এবং অর্থনীতিবিদরা যা দাবি করছেন, এ দুইয়ের মাঝে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। চীনের প্রবৃদ্ধির হার যেখানে ৭-এর কম, সেখানে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২৪ থেকে ৭ দশমিক ৪-এর দিকে যাচ্ছে, এটা বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট লাগবে। সব মিলিয়ে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমরা একটা কনফিউশনের মধ্যে রয়ে গেছি। সরকার যেটা দাবি করছে, সেটা সত্য হোক তা আমরা চাই। কিন্তু আসলেই কি তা সত্য? একটা দেশে স্থায়ীভাবে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা দরকার। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ টাকা পাচার হচ্ছে, তাও অবিশ্বাস্য। প্রথম আলোয় একটা প্রতিবেদন পড়েছিলাম, ২০১৪ সালে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। যদিও সরকারপন্থী অর্থনীতিবিদ ও অন্যরা দাবি করেছেন, এটা অনুমাননির্ভর। এটা যে সঠিক নয়, সরকার তা শক্তভাবে ডিফেন্ড করেছে তাও নয়। ওই প্রতিবেদন যদি অসত্য হয়ে থাকে, তবে তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া হলো না কেন? অসত্য হলে সরকার কেন একে চ্যালেঞ্জ করে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিল না? বিদেশে বাংলাদেশীদের সেকেন্ড হোমের কথা আমরা জেনেছি। অফিশিয়ালি এটি প্রমাণ করা কঠিন। কিন্তু দেখলে বোঝা যায়। কানাডার বেগমপাড়ার নামও অনেকের জানা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়ন হচ্ছে এটা ঠিক, কিন্তু কীভাবে হচ্ছে, কতটুকু হচ্ছে, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে। কিছু ভবন, রাস্তাঘাট নির্মাণ করা মানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়। উন্নয়নের একটি দিক হচ্ছে মানবসম্পদ, যার একটি বড় দিক হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব ছাত্র আমরা পাচ্ছি, তারা সবাই জিপিএ ৫ পেয়েছে, কিন্তু ইংরেজিতে একটি বাক্য শুদ্ধভাবে লিখতে পারে না। ইংরেজির অবস্থা কী রকম খারাপ, তা দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায়। সংখ্যাগত দিক থেকে আমাদের ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে কিন্তু মানের দিক থেকে কতটুকু উন্নতি হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিজনেসের একটি বিখ্যাত বই রয়েছে, সেখানে বলা হচ্ছে— ফড়হঃ ফবঢ়বহফ ড়হ হঁসনবৎং, হঁসনবৎং পধহ নব সরংষবধফরহম, বাবহ ঃযব হঁসনবৎং পধহ নব সধহরঢ়ঁষধঃবফ. যে নাম্বারগুলো আমরা দেখছি, তাতে সেই বইয়ের কথাগুলো মনে পড়ছে। বলতে হয়, সব মিলিয়ে একটা মিশ্র অবস্থায় রয়েছি।

যে হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, সে হারে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। বিভিন্ন খাতে প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে, কিন্তু ওইসব খাতে কর্মসংস্থান আশানুরূপ বাড়ছে না। 

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটি অর্থনীতির একটি মৌলিক রীতি। যখন অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটবে, তখন কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু বাংলাদেশে বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ছে। অর্থনীতিতে আন্ডার এমপ্লয়মেন্ট বলে একটি কথা রয়েছে। যোগ্য ব্যক্তি যদি তার যোগ্য জায়গায় না যেতে পারেন, অর্থাৎ চাকরি হয়তো পেয়েছেন কিন্তু প্রত্যাশিত চাকরিটি পাননি, এটা আন্ডার এমপ্লয়মেন্ট। আমার কাছে পরিসংখ্যান নেই, তবে ধারণা করছি দেশে এখন বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। সরকার দাবি করছে, প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৪ হতে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে তো কর্মসংস্থান বেশি হওয়ার কথা। আর যোগ্য লোকরাই কি যোগ্য জায়গায় পৌঁছতে পারছে? সরকারি যে নিয়োগ হচ্ছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে সরকার তার সরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা দ্বারা একটা এনকোয়ারি (তদন্ত) করছে, সেখানে দেখা হচ্ছে কার রাজনৈতিক মতাদর্শ কী, কে কোন মানসিকতার। আবার একই সঙ্গে দুর্নীতি করে যাদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, তাতেও যোগ্য লোক যোগ্য স্থানে যাচ্ছে না। হয়তো বলা হলো, আমরা তো পাঁচ হাজার লোককে চাকরি দিয়েছি, এটা সংখ্যার দিক থেকে ঠিক আছে কিন্তু কাদের চাকরিটা দেয়া হয়েছে? মেধার ভিত্তিতে কতজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে? বাংলাদেশের যারা নব্য গ্র্যাজুয়েট, তাদের মধ্যে হতাশা কাজ করছে। ভালো ছাত্রদের হতাশাটা আরো বেশি। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তারা নিশ্চিত নন যে, যোগ্য চাকরি তারা পাবেন। কর্মসংস্থান বাজার আমাদের জন্য এখন খুবই হতাশাজনক।

এ পরিস্থিতির উন্নতির জন্য কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে?

সরকার অনেক ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারত। যেমন— যে গার্মেন্ট শিল্প বা বায়িং হাউজগুলো আছে, সেখানকার কর্মসংস্থানের একটা বড় অংশ বিদেশীদের দেয়া হচ্ছে। এসব বিদেশী অফিশিয়ালি আসছে এক ধরনের স্ট্যাটাস নিয়ে, পরে থেকে যাচ্ছে। যেমন— কেউ হয়তো টুরিস্ট ভিসা নিয়ে এসেছে কিন্তু এখানে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে যোগ্য লোক রয়েছে, সেক্ষেত্রে আমাদের বাইরে থেকে লোক নিয়ে আসার দরকার আছে কিনা, ভেবে দেখা উচিত। আবার বাইরের যে লোক আসছে, সে যে কাজ করছে, একই কাজ বাংলাদেশের লোক করলে অনেক কম সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। কিছুদিন আগেও পত্রপত্রিকায় এসেছে কতসংখ্যক বিদেশী লোক বাংলাদেশে চাকরি করছে, বছরে তারা কত কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের অবশ্যই বিষয়টি দেখা দরকার। অন্যদিকে বিদেশে লোক পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে, কিন্তু এটি যথেষ্ট নয়। বিদেশে রেডিওলজিস্ট, নার্স এমন লোকের চাহিদা বেশি। শ্রমিকদের যদি দেশ থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে ওইসব দেশে পাঠানো যেত, তবে সেখান থেকে তারা বড় রকমের উপার্জন করে পাঠাতে পারতেন। সংখ্যা বেশি না হলেও বিশ্ববাজারে ভারতীয়রা প্রাধান্য বিস্তার করছেন। তারা এক্সিকিউটিভ পর্যায়ে চাকরি করেন বলে সাধারণ শ্রমিকের তুলনায় ৫ থেকে ১০ গুণ বেশি অর্থ পাঠাচ্ছেন। এজন্য সংখ্যার চেয়ে যোগ্য লোকদের বাইরে পাঠানোর বিষয়ে আমাদের নজর দিতে হবে। আরেকটি বিষয় হলো, মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হওয়া দরকার। বেসরকারি খাতকে আরো উৎসাহিত করতে হবে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় এখন তারল্য সংকট রয়েছে, বেসরকারি উদ্যোক্তাদের যে পরিমাণে ঋণ প্রয়োজন, তা পাচ্ছেন না। বেসরকারি খাত সংকুচিত হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কর্মসংস্থান কমে যাবে। সুতরাং সরকারকে বেসরকারি খাতকে বেশি উৎসাহিত করতে হবে। উৎসাহিত করার একটি উপায় হচ্ছে করপোরেট গভর্ন্যান্স। আর্থিক ব্যবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলে অর্থের প্রবাহ থাকবে, উদ্যোক্তারা সহজ শর্তে ঋণ পাবে, নতুন নতুন প্রজেক্ট তারা সৃষ্টি করবে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। তাই সমন্বিত একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করলে হবে না। কেননা অর্থনীতির প্রতিটি সেক্টরই একটার সঙ্গে আরেকটি জড়িত।

অনলাইন মার্কেটিং খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। তবে বিভিন্ন অভিযোগও উঠছে।

ডিজিটালি আমরা এখন অনেক এগিয়ে গেছি। গ্রামের কৃষক, স্কুল-কলেজের ছাত্ররা ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে। মার্কেটিংয়ের বড় হাতিয়ার হচ্ছে কমিউনিকেশন, লোকদের জানানো। আগে টিভি, রেডিও, বিলবোর্ড এগুলো ছিল আমাদের হাতিয়ার। ইন্টারনেট মার্কেটিং বা সোস্যাল মার্কেটিং এখন বহু লোকের কাছে পৌঁছে গেছে। গ্রামগঞ্জের লোকেরা সেলফোন ব্যবহার করে সোস্যাল মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকছে এবং তথ্যের আদান-প্রদান করছে। আমরা একটা ট্রানজিশনের মধ্যে রয়েছি। একটা ডিজিটাল যুগের মধ্যে আমরা যাচ্ছি বা গিয়েছি এবং দিন দিন এটা বেড়ে যাচ্ছে। কিছু দুর্ঘটনা হয়তো প্রথম দিকে ঘটবে। ট্রাই ও এররের মাধ্যমে একসময় আমরা পারফেকশনিস্ট হতে পারব। আশার বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো অনেক সচেতন হয়েছে, অনলাইন মার্কেটিং, টেলি মার্কেটিং, এসএমএস মার্কেটিং, সোস্যাল মিডিয়া মার্কেটিং ব্যবহার করছে। গ্রাহকরাও উৎসাহিত হচ্ছেন এসব ব্যবহারে। আমি দেখেছি অনেক ডিজিটাল শপ রয়েছে, যাদের ফিজিক্যাল অস্তিত্ব নেই। কিন্তু তারা খুব কম খরচে ও কম পয়সায় গ্রাহকের কাছে যাচ্ছে। এটা একদিকে কোম্পানিগুলোর জন্য ভালো হয়েছে, অন্যদিকে কাস্টমারদের জন্যও ভালো হয়েছে। আমি মনে করি, এটি আগামীতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠবে।

আমাদের দেশের স্ট্যাটাস আপগ্রেড হয়েছে। আগামী দিনে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কী করতে হবে?

প্রথমত. আন্তর্জাতিক যেসব সংস্থা রয়েছে, জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ডব্লিউটিও— তারা কিন্তু এক ধরনের আর্থিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। এদের যেহেতু চাঁদার পরিমাণ বাড়ানো দরকার, তাই তারা অনেক দেশকে উৎসাহিত করছে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার জন্য। তাদের পরিকল্পনার একটা অংশ হিসেবে আমরাও রয়েছি। আমাদের প্রকৃত পরিবর্তন কতটুকু হয়েছে, তা জানি না। আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশ, যেখানে নিত্যসংঘাত চলছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা মেটানোর ক্ষমতা নেই,  কিন্তু তাদের স্ট্যাটাস পরিবর্তন করা হয়েছে। নিম্নআয়ের দেশে থেকে আমরা মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে এসেছি, এটা ভালোই লাগে। কিন্তু কতটুকু উন্নতি হয়েছে, সে প্রশ্ন রয়ে গেছে। সামগ্রিকভাবে দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য কতটুকু ভালো হবে, সে প্রশ্নও রয়ে গেছে। প্রাথমিকভাবে যা দেখি, দরিদ্র দেশ হিসেবে রফতানির ক্ষেত্রে আমরা যে সুযোগ-সুবিধা পেতাম, সেটা থেকে বঞ্চিত হলাম, আমরা বিদেশে সাবসিডি পাওয়ার ক্ষেত্রে যে সুযোগ-সুবিধা পেতাম, সেখান থেকে কিছুটা বঞ্চিত হব। বিদেশী ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে যে নিম্নহার পেতাম, সেখান থেকে বঞ্চিত হতে হবে। এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার জন্য আমরা প্রস্তুত কিনা, তা জানি না। আমাদের ভালো হওয়ার চেয়ে, ওই সব প্রতিষ্ঠানের ভালো হয়েছে, যারা চেয়েছিল আমাদের চাঁদার পরিমাণ বাড়ুক, যারা চেয়েছিল তাদের ঋণগুলো উচ্চসুদে কিছু দেশ গ্রহণ করুক। তাদের এ লক্ষ্য পূরণে আমরা সুন্দরভাবে সায় দিয়েছি। দেশের স্ট্যাটাস পরিবর্তনের আগে এ চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে মোকাবেলা করা যাবে তা নিয়ে আরো ভালোভাবে ভাবার প্রয়োজন ছিল।

বেসরকারি খাতের স্থবিরতা থেকে বের হওয়ার উপায় কী?

প্রথম কথা হচ্ছে, উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে এবং সরকারের উদ্যোগের সঙ্গে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ব্যবসায়ী, ক্রেতা, বুদ্ধিজীবী থেকে সমাজের সব স্তরের সহযোগিতা দরকার। সরকারকে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে আর্থিক ব্যবস্থাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে পরিচালনার জন্য সৎ ও যোগ্য লোক আনতে হবে। এটি হলে আলটিমেটলি সব ঠিক হতে শুরু করবে। যেমন— ব্যাংকগুলো যদি লুট না হতো, তাহলে ব্যাংকে টাকা থাকত, ব্যাংক তো অলসভাবে অর্থ ফেলে রাখত না; টাকা বেশি হলে ব্যাংক সুদহার কমাবে, ডিপোজিট হার কমাবে; ডিপোজিট হার কমালে একটা নেগেটিভ প্রভাব হয়তো পড়বে, তা হলো— ডিপোজিট কমবে, পাশাপাশি বেসরকারি খাতে যারা আছে তারা বলবে, আমরা তো কম সুদে টাকা নিতে পারব, কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস, কস্ট অব ক্যাপিটাল কমে যাবে। কমে গেলেই অটোমেটিক্যালি বেসরকারি খাত উৎসাহী হবে। এর মাল্টিপল ইফেক্ট রয়েছে। ব্যবসা করে অতিরিক্ত মুনাফা হলে অতিরিক্ত মুনাফার একটি অংশ বিনিয়োগে যাবে। সুতরাং একটি সাইক্লিক অর্ডারে চলতে থাকবে। মূলকথা, আর্থিক ব্যবস্থা কীভাবে চলবে তা সরকারকে ঠিক করতে হবে। বেসরকারি খাতকে কীভাবে উৎসাহিত করা যায়, সরকার তা জানে না— এটা বিশ্বাস করি না; সরকার জানে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকারের আন্তরিক ইচ্ছা আছে কিনা। কেননা আন্তরিক ইচ্ছা থাকলেই তো তখন করপোরেট গভর্ন্যান্স প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। এটি করতে গেলে দুর্নীতিবাজরা বিরাগ হবে। সরকার তাদের বিরাগ করতে চায় কিনা, সেটা একটা প্রশ্ন। আমি মনে করি, সরকারের অনেক ভালো দিক রয়েছে। সরকার যদি এ দিকগুলোর দিকে মনোনিবেশ করে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে, তাহলে সবাই এগিয়ে আসবে সহযোগিতা করার জন্য।

মার্কেটিংয়ের শিক্ষক হিসেবে এ বিষয়ে দক্ষ জনশক্তি কতটা গড়ে উঠছে বলে মনে করেন?

পরিমাণগত দিক থেকে বললে মার্কেটিং কেন, সব শিক্ষায় জনসংখ্যা বেড়ে গেছে। তবে গুণগত মানের কথা বললে সব দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছি। আমি বিশ্বাস করি, একটি দেশের সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে মার্কেটিং খুবই দরকার। বিজনেসের প্রধান ফাংশন হচ্ছে মার্কেটিং। কারণ উৎপাদন করা হলো কিন্তু মার্কেটিংয়ে দুর্বল, তাহলে উৎপাদন বন্ধ হতে বাধ্য। উৎপাদন কম কিন্তু মার্কেটিংয়ে খুবই দক্ষ, অটোমেটিক্যালি আপনি মার্কেটিংয়ে মনোনিবেশ করবেন, যখন দেখবেন মার্কেটিংয়ের জোরে দেশে-বিদেশে পণ্য রফতানি/বিক্রি করতে পারছেন। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য দক্ষ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দুটোই দরকার। দক্ষ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজন দক্ষ শিক্ষক ও প্রশিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন  ছাপা হয়েছিল, যেখানে দেখানো হয় আগে কতজন শিক্ষক ছিলেন এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে কতজন শিক্ষক হয়েছেন। নিয়োগ নিয়ে এত বড় অনিয়ম কোথাও হয়নি। পরিতাপ ও দুঃখের বিষয়, এখানকার যোগ্য শিক্ষকরা হতাশ, তারা উৎসাহ বোধ করছেন না। আর মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ না হওয়ার মানে কম দক্ষতার শিক্ষক এখানে আসছেন। আর কম দক্ষতার শিক্ষক কম দক্ষতার ছাত্র তৈরি করেন। আল্টিমেটলি একটার সঙ্গে আরেকটা সম্পৃক্ত। তবে এ থেকে উদ্ধারের অনেক পথ রয়েছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। (বণিক বার্তা থেকে সংগৃহীত)

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ