আজকের শিরোনাম :

‘নগরের স্বতন্ত্র ভৌগোলিক চরিত্র বুঝে পরিকল্পনা বাংলাদেশে দৃশ্যমান নয়’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০১৯, ১৫:২১

ড. আদনান মোরশেদ। বুয়েট থেকে স্থাপত্যে অনার্স; এমআইটির স্থাপত্য বিভাগ থেকে মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের পর ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল গ্যালারি অব আর্ট থেকে প্রি-ডক্টরাল ফেলোশিপ ও স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশন থেকে পোস্টডক্টরাল সম্পন্ন করেন। বর্তমানে কাজ করছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের চেয়ারপারসন হিসেবে। তিনি সোসাইটি অব আর্কিটেকচারাল হিস্টোরিয়ানসের বোর্ড অব ডিরেক্টরসের সদস্য, ন্যাশনাল এনডোমেন্ট ফর দ্য হিউম্যানিটিজ গ্রান্টের বিচারক ও ২০১৫ অ্যালিস ডেভিস হিচকক বুক অ্যাওয়ার্ডের জন্য সোসাইটি অব আর্কিটেকচারাল হিস্টোরিয়ানস কমিটির প্রধান ছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আধুনিক স্থাপত্য, নগরায়ণের ইতিহাস ও তত্ত্ব, বৈশ্বিক ইতিহাস, শহুরে পরিবেশবিদ্যা এবং উন্নয়নশীল দেশের টেকসই নগরায়ণ প্রকল্প নিয়ে অসংখ্য বক্তব্য রেখেছেন। বাংলাদেশের নগর পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয় জনপ্রিয় একটি দৈনিকের। তা হুবহু তুলে ধরা হলো-

বিশ্বব্যাপী নগরায়ণ ধারণায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। পুরনো অনেক ধ্যান-ধারণা বদলে গেছে। নগরায়ণ আসলে কেমন হওয়া উচিত?

সনাতনভাবে আমাদের সমাজ ছিল গ্র্রামীণ। আমাদের ঢাকার আবহও ছিল গ্রামীণ। ষাটের দশকের ছবিগুলো দেখলে মনে হয় ঢাকা একটি গ্রাম। এখানে একটা-দুটো গাড়ি দেখা যায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে নগর জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৭ শতাংশ। এ বাস্তবতার মধ্যে তৈরি পোশাক খাতের আবির্ভাব ঘটল। আরো কিছু শিল্পায়ন হলো। আশির দশকের মাঝামাঝি বা শেষে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেখা গেল। নব্বইয়ের দশকে গ্রাম থেকে শহরমুখী বিশাল এক জনস্রোত দেখা গেল। এই অভ্যন্তরীণ অভিগমন বিভিন্ন কারণে ঘটেছে। এক. শহর টেনে এনেছে। কারণ শহরে সুযোগ-সুবিধা বেশি। দুই. গ্রামে নদীভাঙন, কৃষি খাতের বাইরে কাজের সুযোগ না থাকাসহ বিভিন্ন পুশ ও পুল ফ্যাক্টরের কারণে বিশাল গ্রামীণ জনগোষ্ঠী শহরমুখী হলো। শহরমুখী অভিগমনের এ প্রবণতায় আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। এটি উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটি সাধারণ চিত্র। হঠাৎ করে কোনো প্রস্তুতি ছাড়া বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী নগরমুখী হলো। আমাদের প্রস্তুতি ছিল না, নীতি ছিল না। খেয়াল করলে দেখা যাবে, ১৯৯০ ও ২০০০ সালের প্রথম দিকে আমাদের যা হয়েছে, সেটিকে ঠিক নগরায়ণ বলা যাবে না। এটাকে বলা যাবে গ্রামের একটি বৃহত্তর সম্প্রসারণ।

আমাদের কোনো নগরায়ণের পলিসি প্রিপারেশন ছিল না। বিশাল একটা গ্রাম। বিপুল মানুষ আসা শুরু করল। ফলে নগর ব্যবহারের ব্যাপারগুলো আমাদের তৈরি হয়নি। এটা কিন্তু বাংলাদেশের কোনো একক চিত্র নয়। আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে প্রস্তুতি ছাড়া গ্রাম থেকে শহরে মানুষ কাজের সন্ধানে এসেছে। এ ধরনের নগর এলাকার সম্প্রসারণের ফলে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অনেক পরিবর্তন হলো। বিষয়টি এমন, নগরে এসেছি গ্রাম্য স্বভাব নিয়ে। এজন্যই আমরা দেখি, রাস্তার দুদিক থেকেই অনেক জায়গা দখল করা হয়েছে। হকার ফুটপাত দখল করে হরেক পণ্য বিক্রি করছে, মানুষ এদিক-সেদিক হাঁটছে। এটা হচ্ছে গ্রামীণ ব্যবহার। মানে গ্রামের হাট শহরের রাস্তায় বসে যাচ্ছে। বাসগুলো যখন একটি স্টেশনে আসে, তখন সেগুলো যেভাবে মুখোমুখি ধাক্কাধাক্কি করে, এটি একদম গ্রামের নৌকার ব্যবহার। গ্রামের নৌকাগুলো যখন ঘাটে আসে, তখন কিন্তু ধাক্কাধাক্কি করে যাত্রী নেয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগে। এখানে বাসের ধাক্কাধাক্কি নৌকার মতো। অর্থাৎ একটি বড় গ্রামে গ্রাম্য স্বভাব নিয়েই আমরা রয়েছি। সরকার, প্রশাসন এটা ধীরে ধীরে বোঝা শুরু করল যে আমাদের এই বৃহৎ গ্রামটিকে শহরে রূপান্তর করতে হবে। দেরিতে আমরা নগরায়ণের রাজনীতিটা বুঝেছি। ধীরে ধীরে পলিসি হলো, কিছু রাস্তাঘাট করা হলো, অবকাঠামো হলো। এভাবে এগোচ্ছে।

এটা কি অপরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে, নাকি কোনো মাস্টারপ্ল্যান মোতাবেক করা হয়েছে?

এমনিতে গতানুগতিক কিছু মাস্টারপ্ল্যান তো ষাটের দশকে হয়েছে। ১৯৫৯ সালে প্রথম মাস্টারপ্ল্যান করেছিল ব্রিটিশ নগর পরিকল্পনা কোম্পানি মিনোপ্রিও, স্পেন্সলি ও ম্যাকফ। মাস্টারপ্ল্যান কিন্তু ২০-২৫ বছর অন্তর হচ্ছে। কিন্তু গ্রামীণ সমাজ হওয়ায় মাস্টারপ্ল্যানের মর্মার্থ ঠিক বোঝা যায়নি। কিছু বিচ্ছিন্ন বাস্তবায়ন হয়েছে, সার্বিকভাবে কিছু হয়নি। মাস্টারপ্ল্যান মানে হলো একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা। সামগ্রিক পরিকল্পনা করার যে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও নাগরিক দক্ষতা, সেটি হতে লেগেছে প্রায় ১৫-২০ বছর। এজন্য আমাদের বিক্ষিপ্ত নগরায়ণ হয়েছে। যাকে আমি বলি প্রতিক্রিয়াধর্মী নগরায়ণ। এর মানে হলো, একটি সমস্যা হয়েছে, সেটি সমাধান করতে হবে। রানা প্লাজা ধসে পড়েছে। এখন ভবনগুলো মজবুত করার কিছু পলিসি করতে হবে। বলা যায়, প্রতিক্রিয়াধর্মী নগরায়ণের ফলে মাস্টারপ্ল্যানের মানসিকতা আমাদের গড়ে ওঠেনি। এটা ধীরে ধীরে হবে বটে, কিন্তু কিছুটা দেরিও হয়ে গেছে। এর মধ্যে পরিবেশগত বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে। ঢাকার পূর্বাচলের বিষয়টি বিবেচনা করা যাক। নিম্ন জলাভূমি মাটি ভরাট করে পূর্বাচল তৈরি করা হয়েছে। নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট করে ফেলা হচ্ছে। এখানে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো আমরা যদি কিছুটা রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে পারি, তাহলে বেঁচে যাব। শুধু সদিচ্ছাই যথেষ্ট নয়। অবকাঠামো উন্নয়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণের ভারসাম্য রক্ষার একটি নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে হবে।

পরিকল্পনা তো পরিকল্পনাবিদরাই করেছেন। পূর্বাঞ্চল বলুন, গুলশান বলুন কিংবা ধানমন্ডি বলুন, পরিকল্পনাবিদদের পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়েছে...

এটি ভালো প্রশ্ন। দেশে যারা পরিকল্পনা করছেন, তারা অবশ্যই উন্নয়ন ও পরিকল্পিত শহর চান। কিন্তু তাদের মধ্যে পাশ্চাত্যের কিছু গতানুগতিক পরিকল্পনার ধারার প্রভাব রয়েছে। তা থেকে তারা বেরোতে পারেন না। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম সব অঞ্চল বা শহরের আলাদা আলাদা ভৌগোলিক চরিত্র আছে। এ ভৌগোলিক চরিত্র, মানুষের ব্যবহার বুঝে, আগামী ২০-৩০ বছর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বুঝে পরিবেশ সচেতন যে একটি নগরায়ণ করার পরিকল্পনা সেটি নেই। উন্নত বিশ্বে ১৯১০-২০ সালের দিকে যা হয়েছে, সেটিকে এখন আমরা মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় এনে করছি। ড্যাপ নগরায়ণের একটি ভালো ইনস্ট্রুমেন্ট, কিন্তু এটি প্রয়োগের যে দক্ষতা এবং এজন্য যে ধরনের আইন প্রয়োগের প্রয়োজন, সেই দক্ষতা আমরা অর্জন করতে পেরেছি কিনা, আমি সন্দিহান। মহাপরিকল্পনা যে হয়েছে, তাতে দুটো জায়গায় গাফিলতি আছে। এক. এ পরিকল্পনায়ও দক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ। ১৯৫৯ সালে ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানের দ্বারা যে মাস্টারপ্ল্যান করা হয়েছিল, সেটি লন্ডন থেকে বড় সাহেবরা এসে এখানকার ভৌগোলিক চরিত্র না বুঝে করেছে। আমাদের এখনকার নগর পরিকল্পনাবিদরাও গতানুগতিকতার এ ধারায় নগর পরিকল্পনা করছেন। এখানে নগরের স্বতন্ত্র চরিত্র বুঝে পরিকল্পনা দৃশ্যমান নয়। নগর পরিকল্পনা শুধু একটি ডিসিপ্লিনের বিষয় নয়; পরিকল্পনাবিদ, নৃতত্ত্ববিদ, স্থপতি, সমাজবিদ, নগর প্রশাসক ও রাজনীতিবিদ এদের সবার সমন্বিত প্রচেষ্টার একটি ফসল হচ্ছে নগর পরিকল্পনা। এখানে নগর পরিকল্পনাকে একটি টেকনিক্যাল সাবজেক্ট হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত। এটি আসলে শুধু টেকনিক্যাল সাবজেক্ট নয়। গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মতো নগরায়ণও একটি জটিল, গোলমেলে বিষয়। জনসম্পৃক্তি ছাড়াও প্রয়োজন পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়ানুগ দৃষ্টিভঙ্গি।

নগর পরিকল্পনা এখন একটি ভালো রাস্তা বা ভবন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অন্য দিকগুলো দেখা হয় না... 

হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। আমাদের পরিকল্পনা চেতনা প্রায়ই ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। আমাদের এ অঞ্চলের মানুষ কীভাবে রাস্তা ব্যবহার করে এবং নিজস্ব নগর চরিত্র কী, সেটি আমলে নিয়ে পরিকল্পনা নেয়া হয় না। যেমন ওভারব্রিজ। ওভারব্রিজগুলো আমরা প্রতীকী অর্থে বসিয়ে দিই, যেখানে নগরপিতারা এসব বেশি দেখতে পাবেন। যেখানে দেখলে এটি একটি প্রতীকী অর্থে ব্যবহার হবে। কিন্তু যে জায়গায় মানুষের বেশি সমাগম হচ্ছে, যেখানে দিলে মানুষ খুব অনায়াসে রাস্তা পারাপার করতে পারবে, সেখানে আমরা অনেক সময় দিই না। বলতে গেলে অনেক জায়গায় গাফিলতি। এক. আমরা নগরায়ণকে রাজনৈতিক প্রতীক হিসেবে দেখছি। যেমন চট্টগ্রাম শহরের ফ্লাইওভার, যেটি বহদ্দারহাটে গিয়ে মিলেছে। এটিকে সরকারের শাসনের ভালো প্রতীক হিসেবে দেখানো হচ্ছে। আমি মনে করি, আস্তে আস্তে আমাদের আশাবাদও বাড়ছে; দক্ষতাও বাড়ছে। এখন মানুষকে পরিকল্পনার প্রক্রিয়ায় আনার প্রচেষ্টা ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে।

অনেকেই বলছেন, ঢাকাকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে রাজধানী অন্যত্র সরানো উচিত। এক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?

আমি নিজেও ঢাকা থেকে রাজধানী সরিয়ে ফেলার কথা অনেকবার বলেছি। ময়মনসিংহের দিকে যেতে পারি। ওই অঞ্চল তুলনামূলক উঁচু। বন্যা কম হয়। সেখানে সরিয়ে ফেলার কথা আমি বলেছি। কিন্তু আমার মনে হয় ঢাকাকে এখনো পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।

কোন পদক্ষেপ আগে নেয়া প্রয়োজন?

আমার মনে হয় প্রথমে করতে হবে বিকেন্দ্রীকরণ। কিছু মন্ত্রণালয় ঢাকা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। যেমন রেলওয়ে হেডকোয়ার্টার একসময় চট্টগ্রামে ছিল। এটি ঢাকায় রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। নতুন সরকার যদি এখন কিছুটা সদিচ্ছা নিয়ে কয়েকটি মন্ত্রণালয় রাজশাহী, খুলনায় স্থানান্তর করে তাহলে কোনো অসুবিধা নেই। আজকের এই ডিজিটাল যোগাযোগের যুগে অনায়াসে এটা করা যায়। আমরা উন্নত বিশ্বে দেখছি যে আজকাল অফিসেও যেতে হয় না। বাসায় বসে অনলাইনের মাধ্যমে কাজ করছেন অনেকে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল কর্মীরাও বাসায় বসে কাজ করছেন। যেমন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সিলেটে নিয়ে গেলে অসুবিধা কী? এমনটি হলে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা কমে আসবে। আমি মনে করি, ঢাকা শহরে আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেয়া উচিত নয়। এখন এখানে যথেষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় আছে। বিশ্ববিদ্যালয় চলে যাক অন্যান্য শহরে। উন্নত স্বাস্থ্যসেবা কেউ পেতে চাইলে তাকে ঢাকায় আসতে হয়। বিকেন্দ্রীকরণ করা হলে এটি হবে না। আমাদের কিছু বিশেষায়িত হাসপাতাল বরিশালে চলে যেতে পারে। পদ্মা সেতু কিছুদিন পর নির্মাণ সম্পন্ন হবে। আমরা ফরিদপুর বা খুলনায় অনেক কিছু স্থাপন করতে পারি। ট্যুরিজম মিনিস্ট্রি রাজধানীতে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। সেটি চলে যেতে পারে পটুয়াখালীর দিকে। আজকাল বরিশাল এয়ারপোর্টে প্রতিদিনই ফ্লাইট যাচ্ছে। আমার মনে হয়, আমরা যদি ঢাকাকে বাঁচাতে চাই তাহলে বিকেন্দ্রীকরণের কোনো বিকল্প নেই। ঢাকাকে বাঁচাতে জনসংখ্যার চাপ কমিয়ে আনতে হবে। এটি কমিয়ে আনা ছাড়া কোনো উপায় নেই। বিকেন্দ্রীকরণে সরকার দৃঢ় পদক্ষেপ নিলে হয়তো সেটি সম্ভব।

রাস্তা-ঘাট নির্মাণ করা হচ্ছে। অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে। এত কিছু হচ্ছে, কিন্তু যানবাহনের গতি কমে যাচ্ছে কেন?

এখন যানজটে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ঢাকাকে বলা হচ্ছে যানজটের রাজধানী। এখানে আমি আরেক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলতে চাই, নগর পরিকল্পনাবিদ, ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ার, ট্রান্সপোর্টেশন প্ল্যানাররা বলছেন, গাড়ির গতিবেগ কমে যাচ্ছে, গাড়ির গতিবেগ এ শহরে আমরা কীভাবে বাড়াতে পারি। এর বিপরীতে গিয়ে আমি বলব, আমাদের এখন প্রচেষ্টা হওয়া উচিত নগরে গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে আনার ওপর। মানে আমাদের সাপ্লাই চেইনের ওপর নজর না দিয়ে সাপ্লাইয়ের ডিমান্ড কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, সে চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনটা কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, তার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের এলাকাভিত্তিক পরিকল্পনা করতে হবে। কেউ উত্তরায় থাকে, স্বাস্থ্য, শিক্ষা বা কাজের জন্য তাকে যেন ধানমন্ডি বা মতিঝিলে যেতে না হয়। নিজের এলাকায় থাকলে গাড়ি কেনার প্রয়োজনও কমে যাবে। আমি আগেও বলেছি, ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত তার নিরাপত্তা ও নিরাপদ বাহন হিসেবে গাড়িকে দেখছে। কিন্তু আজকাল উন্নত বিশ্বে দেখছি নতুন প্রজন্ম ব্যক্তিগত গাড়িতে খুব একটা উৎসাহিত হচ্ছে না। তারা মেট্রোরেল বা গণপরিবহন ব্যবস্থার প্রতি ঝুঁকছে, বাইকের ব্যবহার বাড়ছে। কয়েক বছরের ব্যবধানে ঢাকায় মেট্রোরেল আসছে। নতুন প্রজন্ম গণপরিবহনকেন্দ্রিক হলে আমি মনে করি ধীরে ধীরে গাড়ি কেনার প্রবণতা কমবে। উন্নত বিশ্বে এ ধারণায় এরই মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। সেখানে ব্যক্তিগত গাড়িকে দেখা হয় নগরের অন্যতম ‘ভিলেন’ হিসেবে। আমরা যদি মাদ্রিদ, অসলো, কোপেনহেগেনসহ ইউরোপের কিছু ভালো শহরের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, তারা সেন্ট্রাল সিটিতে ব্যক্তিগত গাড়ি নিষিদ্ধ করছে। কোপেনহেগেনকে ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিউট্রাল করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। একেবারে গাড়িবিহীন শহরে পরিণত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আস্তে আস্তে ভারতেও এ ধরনের পরিকল্পনার কথা আসছে। কিন্তু আমাদের এখানে ক্রমেই ভোগবাদী সমাজ তৈরি হচ্ছে। প্রগতি সরণি বা তেজগাঁওয়ে ব্যাপকভাবে কার ডিলার বাড়ছে। এর অন্যতম কারণ গাড়িকে আমরা প্রাধান্য দিচ্ছি আমাদের উন্নতির লক্ষণ হিসেবে। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক স্বপ্ন বলা যেতে পারে যে গাড়ি কেনা। ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে সে’—এই যে ভোগবাদী সংস্কৃতি আমাদের ছোটবেলা থেকে শেখানো হয়েছে, এটি আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে হবে, অর্থনৈতিক উন্নতি যদি হয়, সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য সংরক্ষণের একটি ব্যাপার আছে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ৬ দশমিক ৯ শতাংশ ডায়াবেটিসে ভোগে। ঘরে ঘরে ডায়াবেটিস রোগী। ডায়াবেটিসের কিন্তু একটি পরিবেশগত উৎসও রয়েছে। আমরা হাঁটছি না। সারা দিন অফিসে আছি কিংবা যেখানে আছি সেখানে সেডানটারি একটি লাইফস্টাইল যাপন করছি। কম্পিউটারের ব্যবহার বাড়ছে। অন্যান্য কাজও আমরা বসে বসে করছি। গাড়ির গতিবেগ না বাড়িয়ে আমরা যদি গাড়ির প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে আনার ওপর প্রাতিষ্ঠানিক নগর প্রশাসনিক একটা দর্শন তৈরি করি, আমার মনে হয় ধীরে ধীরে এক্ষেত্রে সুফল মিলবে। নগর পরিকল্পনা যদি এমন হয়, বাসা থেকে কাজে যেতে হবে আধা কিলোমিটার দূরত্বে, তাহলে আমরা হেঁটে যেতে পারি। হেঁটে যেতে পারি বললেই তো হবে না, জায়গাটি করে দিতে হবে। দখল-দূষণ-দুর্গন্ধ সবকিছু মিলে ফুটপাত পথচারীবান্ধব নয়। আমি বলব, পথচারীদের জন্য একটি নারকীয় পরিবেশ রাস্তায় বিরাজ করছে। আমরা হেঁটে যেতে পারি না। তবে আমরা যদি ধীরে ধীরে নগর পরিকল্পনার দর্শনে হাঁটাকে প্রাধান্য দিই, বাইকিংকে প্রাধান্য দিই, তাহলে গাড়ি কেনার চাপ কমে আসবে। এদিকেই আমাদের নজর দিতে হবে।

আমার মনে হয়, আমাদের নগর পরিকল্পনাবিদরা গাড়ির প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে আনতে কী করতে হবে, সেটি অ্যাড্রেস করেননি। তারপর আমাদের স্বাস্থ্যগত নানা অসুবিধা হচ্ছে। বর্তমানে আমরা একটি গবেষণা করছি, পরিবেশের কারণে আমাদের পারিবারিক চিকিৎসা ব্যয় কত হয়। আমরা দেখছি, স্বাস্থ্যসেবায় পারিবারিক মেডিকেল বিলের বিপুলাংশ খরচ হচ্ছে পরিবেশগত নানা কারণে। ব্রঙ্কাইটিস বা শ্বাসকষ্ট, আর্থ্রাইটিস বা হাঁটতে পারছি না, ডায়াবেটিস, এসবের উৎস অনেক সময়ই পরিবেশগত। ধানমন্ডি লেক বা রমনা পার্কে দেখি স্বাস্থ্যসচেতনরা ‘স্বাস্থ্য হাঁটা’ যাকে বলে সেটি করছেন। কিন্তু আমরা স্কুলে বা বাজারে হেঁটে যাচ্ছি না। প্রয়োজনীয় হাঁটার বিষয়টি যদি আমরা নগর পরিকল্পনায় নিয়ে আসতাম, তাহলে স্বাস্থ্য খাতের অনেক খরচ কমে যেত। আমার মনে হয় এখানেই নগর প্রশাসনের চাপ দেয়া উচিত। দৃষ্টিটা ওখানেই দিতে হবে। তাহলে গাড়ি কেনার প্রয়োজনীয়তা অনেক কমে যাবে। একটি উদাহরণ দিই, স্পেনের বার্সেলোনা বনাম যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের হিউসটন শহরটাকে যদি আমরা দেখি, তাহলে দেখব দুটোরই জনসংখ্যা প্রায় সমান। দুটো শহরেরই বাসিন্দা আনুমানিক ৪০ লাখ। কিন্তু হিউস্টন শহরটি অনেক জায়গাজুড়ে করা। মানে জনবসতির ঘনত্ব কম। আর বার্সেলোনা অনেক ঘনবসতিপূর্ণ, যার জন্য মানুষ হেঁটে কাজে যেতে পারে অথবা এখন গণপরিসর ব্যবহার করে সহজেই সময় সাশ্রয় করা যায়। আমাদের ঢাকা হয়ে যাচ্ছে ছড়ানো-ছিটানো এবং নগর পরিকল্পনায় স্বশাসিত এলাকা (জোন) নেই। কেউ থাকে ধানমন্ডি, পড়াশোনা করার প্রতিষ্ঠান উত্তরায়। ন্যূনতম ২ ঘণ্টা যানজট পেরিয়ে যেতে হয়। তাহলে নতুন প্রজন্মের মনস্তাত্ত্বিক জগতটা কীভাবে বেড়ে উঠছে? সহজেই বুঝতে পারি যে পরিবেশের প্রতি, সমাজের প্রতি তাদের আগ্রহ কমে যাবে। তারা সবসময় নগরকে দেখবে ভয়ংকর নারকীয় জায়গা হিসেবে। এটাকে অবশ্যই বদলাতে হবে। (দৈনিক বণিক বার্তা থেকে নেয়া)

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ