আজকের শিরোনাম :

‘প্রবৃদ্ধির সঙ্গে পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১১:৫৯ | আপডেট : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১২:০১

কাজী খালিদ আশরাফ। স্থপতি, অধ্যাপক, নগরবিদ ও স্থাপত্য ইতিহাসবিদ। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্থাপত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে স্নাতকোত্তর এবং পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষকতা করেছেন আমেরিকার প্র্যাট ইনস্টিটিউট, টেম্পল, হাওয়াই ও পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্থাপত্য, ল্যান্ডস্কেপ, নগরের নকশা ও বিন্যাস তার লেখার অন্যতম বিষয়বস্তু। তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে ডিজাইনিং ঢাকা: আ মেনিফেস্টো ফর আ বেটার সিটি, লুই কান: হাউজ অব দ্য নেশন, দ্য হার্মিট’স হাট: আর্কিটেকচার অ্যান্ড অ্যাসেটিসিজম ইন ইন্ডিয়া উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে তার নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে বেঙ্গল ইনস্টিটিউট ফর আর্কিটেকচার, ল্যান্ডস্কেপস অ্যান্ড সেটেলমেন্টসের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত। নগরবিন্যাস, পরিকল্পনা, পারিপার্শ্বিক পরিবেশসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একটি জনপ্রিয় দৈনিকের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। তা হুবহু তুলে ধরা হলো-

বিভিন্ন অর্জন শর্তেও বাসযোগ্য নগরীর তালিকায় ঢাকার নীরব উপস্থিতি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে কতটা প্রভাবিত করবে বলে মনে করেন?

‘আ নিউ ইকোনমি নিডস নিউ আরবান ফর্ম’। আরবান ফর্ম অনেক রকম হতে পারে। যেমন বিমানবন্দর একটি আরবান ফর্ম। ঢাকায় আগে মেট্রোরেল ছিল না, এখন হচ্ছে। এটিও একটি নতুন আরবান ফর্ম। আরবান ফর্ম ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চাহিদায় যেমন নতুন আরবান ফর্ম তৈরি হয়, আবার নতুন আরবান ফর্মের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। তবে অনেক সময় এটি এমনভাবে তৈরি হয়ে যেতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদি নয়, স্বল্পমেয়াদি চাহিদা পূরণ করে। এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমিয়ে দিতে পারে। এদিকে পরিবেশ-প্রতিবেশ বিনষ্ট করে এমন আরবান ফর্ম তৈরি করে যদি আমি বলি, এখানে তো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে, সেক্ষেত্রে সে প্রবৃদ্ধি কতটা টেকসই হবে তা একটি প্রশ্ন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্ষণস্থায়ী, এটি ওঠানামা করে। আমাদের ঝুঝতে হবে ইকোলজিক্যাল ভ্যালুরও অর্থনৈতিক মূল্য রয়েছে। আমরা এর পরিমাপ করি না। আমরা কেবল ২০তলা ভবনের অর্থনৈতিক মূল্যটাই দেখি। এখানে দুটি বিষয়ের সমন্বয় করতে হয়।

অপরিকল্পিত নগরায়ণের ক্ষতিকর দিক কোনগুলো?

ঢাকা বড় শহর। তাই একে সামলানোও সহজ নয়। এখানে ট্রাফিক বিশৃঙ্খল, কিন্তু একটা নিয়মের মধ্যেও থাকছে। বাড়িঘর তৈরির প্রক্রিয়াগুলো কখনো নিয়মের মধ্যে থাকছে আবার কখনো নিয়ম ভাঙা হচ্ছে। এভাবেই শহরটা এগিয়ে যাচ্ছে। সব ক্ষেত্রে যে অপরিকল্পিত নগরায়ণ হচ্ছে তা নয়। এখানে অভিভাবক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তারা কাজ করছে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সুশৃঙ্খল পরিকল্পনা। ঢাকা মূলত বেগবান, গতিময় শহর। এখানে যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হোক না কেন, তার আগে অন্য কিছু ঘটে যাচ্ছে। অনেকটা সাবলীলভাবেই তা ঘটছে। বিষয়গুলোকে সমন্বয়ের অভাব বলা যায়। সবকিছু এত দ্রুত ঘটছে যে ঢাকার মাস্টারপ্ল্যানকে ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এটি একটা দিক। অন্যটি  হলো, আশির দশকে আবাসন শিল্পের বিকাশ। তবে সে সময় শহরটা ছোট ছিল, সমস্যাগুলোও এত জটিল ছিল না। বর্তমানে আবাসন শিল্প অর্থনৈতিকভাবে ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সরকারি এজেন্সির মতোই শক্তিশালী হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিকল্পনাগুলো ঢাকার মূল মাস্টারপ্ল্যানের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা চিন্তার ব্যাপার। নামমাত্র পরিকল্পিত হাউজিং করা হয়েছে। আমি বলব, এক্ষেত্রে তারা কী ধরনের পরিকল্পনার কথা ভেবেছে? আমাদের শহরের কাঠামো বিন্যাসের ৮০ শতাংশ আবাসিক। তারপর আসে সাংস্কৃতিক, প্রাতিষ্ঠানিক, পরিকাঠামোগত স্থাপনা। শহরের ধরন তৈরি হয় আবাসিক বাড়িঘর থেকে। যদিও শহর হচ্ছে অর্থনৈতিক ইঞ্জিন। ঢাকার জমির দাম এশিয়ার অন্য বড় শহর ছাড়াও ম্যানহাটনের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এর মানে ঢাকায় বড় অংকের মুনাফা তোলার তাগিদ রয়েছে। তাই পরিকল্পিত হাউজিংয়ের কথা বললেও এটি মূলত মুনাফা তৈরির তাগিদ থেকে করা হচ্ছে। সমস্যা হলো, আর্থিক সুবিধা অর্জনের জন্য আমরা ঢাকার ভূ-পরিবেশকে ধ্বংস করছি। ঢাকা আকারে ছোট ও উঁচু শহর ছিল। এর আশপাশের জলাশয়, নদীনালা, খালবিলগুলো ভরাট করে শহরের পরিধি বৃদ্ধি করে তথাকথিত পরিকল্পিত হাউজিং করা হচ্ছে।

দীর্ঘমেয়াদে কী ধরনের সমস্যা তৈরি হবে?

দীর্ঘমেয়াদে কেন, এ মেয়াদেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্লট তৈরি হচ্ছে জলাভূমির নিচু জায়গা ভরাট করে, যা পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য ক্ষতিকর। যেকোনো জায়গায় উন্নয়নের প্রথম বিষয়বস্তু হবে হাইড্রোলজি। পানিপ্রবাহ বন্ধ না করে পানিপ্রবাহের সঙ্গে কাজ করে যেকোনো ধরনের উন্নয়ন চিন্তা করা যায়। কিন্তু আমরা জলাভূমি ভরাট করে, পানিপ্রবাহকে দূরে ঠেলে উন্নয়ন চিন্তা করি। বাংলাদেশ তো ব-দ্বীপ। পানি উধাও হয়ে যাবে না, পাশের গ্রামটা প্লাবিত হবে। আমরা উন্নয়ন পরিকল্পনা করার সময় এত কিছু চিন্তা করি না, আমাদের শুকনো জায়গা পেলে হলো। আমি বলব না পরিকল্পনা হচ্ছে না, পরিকল্পনা হচ্ছে কিন্তু তা ত্রুটিপূর্ণ। সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলো জলাভূমি, জলাশয়, ধানের জমিগুলোকে বিনষ্ট করে সীমিত লোকজনের জন্য প্লট তৈরি হচ্ছে। এর অর্থনৈতিক সুবিধা স্বল্পমেয়াদি এবং এটি সবার জন্য নয়।

হাউজিং তৈরিতে আমরা কতটা সফল?

একেবারেই না। আমি মনে করি, ‘হাউজিং ইজ দ্য ফ্যাব্রিক অব দ্য সিটি।’ আমাদের দেশে পরিকল্পনা মানে প্লটিং। যারা আগে থেকে সুবিধা ভোগ করছে, তাদের আবার সাবসিডি দিয়ে জায়গা দিচ্ছি। ধানমন্ডিতে যেমন করা হয়েছে, ওই একই মডেলে উত্তরা ও পূর্বাচলে জায়গা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। অথচ যাদের সত্যিকার অর্থে আবাসনের প্রয়োজন, তাদের কথা ভাবছি না। যেমন মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের জন্য ঢাকায় আবাসনের ব্যবস্থা নেই। বিশ্বের অন্যান্য শহরের এমন অবস্থা নয়। এমনকি ভারতেও সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের জন্য নানা ধরনের বন্দোবস্ত রাখা হয়। বেসরকারি আবাসনের ক্ষেত্রে ওদের সরকারের নিয়মনীতিগুলো মানতে হচ্ছে যে উক্ত প্লটের উল্লিখিত অংশ নিম্নবিত্তদের জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে। অথচ ঢাকায় অভিজাত ও উচ্চমধ্যবিত্ত ছাড়া এ সুবিধা কেউ পাচ্ছে না। যারা এটা করছেন, তারা কতটুকু বুঝে করছেন কিংবা তারা সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত কিনা, এ প্রশ্নগুলো এসে যায়; যা লুকালে লাভ নেই। গুলশানকে ঢাকার অভিজাত এলাকা বলা হয়। এটির পরিকল্পনা ত্রুটিপূর্ণ। রাস্তাগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য নেই, সাধারণ কোনো সুবিধা নেই। মডেল টাউন মানে সারি সারি বাড়ি নয়; বরং খেলার জায়গা, খোলা পরিসরের উপস্থিতি। আমরা দারুণ দারুণ বাড়ি করছি কিন্তু শহরের কী অবস্থা! বাড়ির সঙ্গে শহরের অসামঞ্জস্য দেখা দিয়েছে। এমনকি ফুটপাতের কথাই যদি বলি তাহলে আমি বলব, আমরা ফুটপাত কী তা বুঝি না। কোনোটা খুব উঁচু, বারবার ওঠানামা করতে হয়, কোনো কোনো জায়গায় ফুটপাত দুই থেকে আড়াই ফুট উঁচু। ফুটপাত কখনো চার থেকে ছয ইঞ্চির বেশি হয় না। এদিকে ফুটপাতগুলো চওড়া মাত্র চার ফিট। ১০ ফিটের নিচে ফুটপাত হলে পথচারীর হাঁটতে অসুবিধা হয়। ফলে তারা ফুটপাতে না হেঁটে রাস্তায় নেমে আসে। যারা শহর পরিকল্পনা করছেন, তারা শুধু বাড়িগুলোর কথা চিন্তা করছেন। অথচ শহরের প্রথম শর্ত পথচারীদের হাঁটার জায়গা দেয়া। ঢাকার রাস্তা খুব ছোট নয়। ট্রাফিক প্ল্যানিং বিশেষজ্ঞরা অনেক আগেই বলে দিয়েছেন, গাড়ির সংখ্যা বাড়লে রাস্তা চওড়া করলেই সমাধান হয় না। ঢাকায় হাঁটা যায় না, এদিকে আমরা ফুটপাত নষ্ট করে রাস্তা কমিয়ে দিচ্ছি; বরং উল্টোটা হওয়া উচিত।

শহরকে কীভাবে পরিচ্ছন্ন উপায়ে সাজানো যায়?

যারা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে থাকেন অথবা পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন, তাদের প্রথমে ‘শহর কী’ তা বুঝতে হবে। তারা যদি ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে এগিয়ে যান তাহলে মুশকিল। সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায় থেকে এমন লোকদের নিয়োগ দিতে হবে, যারা শহর সম্পর্কে ধারণা রাখেন। আমি মনে করি, ঢাকা শহরের সমস্যা সমাধানে ঢাকার বাইরে যাওয়া প্রয়োজন। তার মানে অন্যান্য শহর ও মফস্বল শহরের দিকে নজর দিতে হবে। এ শহরগুলোকে আরো আকর্ষণীয়, নাগরিকবান্ধব ও নতুন সুযোগ-সুবিধার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। গ্রামে শহরের সুবিধা নিয়ে যাওয়া জরুরি। তাহলে সেখানকার মানুষদের শহরে আসার তাগিদ হবে না। অথচ আমরা ঢাকার ভুলে ভরা পরিকল্পনাগুলোই ছোট শহরগুলোয় নিয়ে যাচ্ছি। যেমন কুমিল্লা। আগে এ শহরে সুন্দর দোতলা বাড়ি, দীঘি এগুলো দেখতাম। এখন সেখানে আট-দশতলা ভবন হচ্ছে। এগুলো কিন্তু নিয়ম করে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ১০-১২ তলা বাড়ি বানালে যে ভালো শহর তৈরি হবে তা নয়, বরং এর ফলে ঘনত্ব বাড়ছে, পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাসসহ রাস্তার ওপর চাপ বাড়ছে। এভাবে মনোরম ও বাসযোগ্য শহরগুলোকে আমরা বসবাসের অনুপযোগী করে তুলছি। কারণ ছোট শহরগুলোকেও আমরা ঢাকা শহরের মডেলে তৈরি করছি। ঢাকার মডেল সমস্যাসংকুল। এমন একটি মডেলকে আমরা অন্যান্য শহরে ছড়িয়ে দিচ্ছি। নাগরিক (সিভিক) শব্দটার সঙ্গে সভ্যতা (সিভিলাইজেশন) ও শহর (সিটি) শব্দের বুত্পত্তি অনুযায়ী সম্পর্ক। সভ্যতা মানে এটা নয় যে আমরা টাকা বানাব। সভ্যতা মানে আমি শহরের বাসিন্দা, আমার অধিকার থাকবে, আমি বিভিন্ন সুবিধা ব্যবহার করতে পারব। শহরের বিভিন্ন সুবিধার মধ্যে রয়েছে পার্ক, খেলার জায়গা, খোলা পরিসর, দোকান, লাইব্রেরি, মিউজিয়াম— এগুলো সাজানো-গোছানো থাকবে, আমি হেঁটে গিয়ে এগুলো ব্যবহার করতে পারব। আমরা নাগরিক সুবিধা, নাগরিক সংস্কৃতি, নাগরিক পরিসরকে বিসর্জন দিয়ে কতগুলো অর্থনৈতিক মডেল দাঁড় করাচ্ছি। বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাচ্ছে বলছি। বিষয়টি সম্পূর্ণ ভুল। সিঙ্গাপুরের ফুটপাত কিন্তু ২০ ফুট। দ্বিতীয়ত রয়েছে গণপরিবহন ব্যবস্থা। যতদিন পর্যন্ত ঢাকায় বাসের পাশাপাশি ট্রেন না আসবে ততদিন কিছুই সম্ভব হবে না। শহর পরিকল্পনা করতে গিয়ে আমরা যদি এলিভেটেড রোডের দিকে জোর না দিয়ে এলিভেটেড ট্রেনের দিকে জোর দিতাম তাহলে কিন্তু বেশি লাভ হতো। যদিও এখন এমআরটির কাজ চলছে। কাজটি আরো আগে করা উচিত ছিল।

ঢাকার মডেলকে কি পরিবর্তন করা সম্ভব?

আমি নেতিবাচকভাবে চিন্তা করতে চাই না। স্বল্প সময়ে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, তবে ধাপে ধাপে সম্ভব। এখানে পাল্টা মডেল দিতে হবে।

‘বুড়িগঙ্গা’, ‘আগামীর ঢাকা’ বা ‘ঢাকা নেক্সাস’ পরিকল্পনায় আপনারা কিছু মডেল দেখিয়েছেন। ঢাকার বর্তমান অবকাঠামোয় এটা কার্যকর করা কতটা বাস্তবসম্মত?

আমরা বর্তমান অবকাঠামো ধরেই পরিকল্পনা করেছি। এর বাইরে গিয়ে চিন্তা করিনি। আমরা বলিনি রাস্তার জায়গায় খাল তৈরি করতে হবে। এটাও কিন্তু করা যায়। যেমন দক্ষিণ কোরিয়া করেছে। চংগাইচিওন ক্যানেলটা দারুণ উদাহরণ। আমরা এখন এলিভেটেড রাস্তা তৈরি করছি। ইউরোপ, আমেরিকা এগুলো আর করে না। শহরের মাঝ দিয়ে এখন কোনো দেশ আর এলিভেটেড রাস্তা তৈরি করে না। সত্তরের দশকে সিউল শহরের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত খালটি ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হলে তা ভরাট করে এলিভেটেড হাইওয়ে তৈরি করা হয়। যেমনটা ঢাকায় আমরা করি, যা কিনা উন্নয়নের প্রতীক। যা-ই হোক, সে সময় যে ইঞ্জিনিয়ার ওই এলিভেটেড রোড তৈরি করেছিলেন, তিনি পরে সিউলের মেয়র নির্বাচিত হলে গোটা স্থাপনা ভেঙে সেখানে পুনরায় খাল তৈরি করলেন। গল্পটি মজার। সিউলের ওই খালের পাড়টি বর্তমানে দারুণ একটি জনপরিসর। বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে আমরাও এমন একটি উদ্যোগ নিতে পারি। অতীতে ঢাকায় অনেক জনপরিসর ছিল। আমরা তা পুনরুদ্ধার করি না কেন! ঢাকার সবচেয়ে বড় সম্পদ নদীর পাড়। আমাদের উচিত এগুলো উদ্ধার করা, যা কোনো কঠিন কাজ নয়। এতে নতুন কোনো জায়গা বা কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিগ্রহণ করতে হবে না। কারণ নদীর পাড় সরকারি জায়গা। একে যদি জনপরিসর বানিয়ে দেয়া যায় তাহলে মানুষের সমাগমের মাধ্যমে জায়গাগুলোয় নতুন অর্থনীতি সৃষ্টি হবে। 

আপনাদের মডেল নিয়ে কি সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কারো সঙ্গে কোনো আলোচনা করেছেন? যদি করেন তাহলে তাদের পক্ষ থেকে বিষয়টি কতটা আমলে নেয়া হচ্ছে?

প্রথম বিষয়টা হচ্ছে, একটি কল্পচিত্র দেখানো যে ঢাকার বিভিন্ন জায়গাকে ঘিরে এমন একটি পরিকল্পনা করা সম্ভব। শুধু কথায় বলা নয়, কীভাবে হবে, ঢাকার জন্য কোনটা উপযুক্ত ও প্রযোজ্য, তা এঁকে দেখাতে হবে। কাজটি পারেন স্থপতিরা। আমরা মূলত এটাই করে দেখাচ্ছি, কল্পচিত্র তৈরি করছি এবং মানুষের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। আমরা সবাইকে অবগত করছি যে বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে একটি দারুণ পরিসর তৈরি করা যেতে পারে, যা অনেক বেশি খরচের বিষয় নয়। প্রয়োজন সমন্বয় সাধন ও ইচ্ছা। তবে বাড়ি তৈরি আর শহর তৈরির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। নিজেদের আগ্রহের জায়গা থেকে কিছু কাজ আমরা নিজেরাই করছি। আবার কিছু ক্ষেত্রে শহরের মেয়ররা আমাদের আমন্ত্রণ করেছেন। আমাদের প্রতিটি শহরের নিজস্বতা রয়েছে। আমরা তাই বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে সেখানকার মানুষ, পরিবেশ, পরিস্থিতি জরিপের মাধ্যমে কাজ শুরু করি। শহরের অবকাঠামো সম্পর্কে ধারণা নিই, শহরের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানার চেষ্টা করি যে তারা কী ধরনের শহর চান। ওই বিষয়গুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে আমাদের চিন্তা ও পরিকল্পনা করতে হয়। কোনো ধারণা ছাড়া হুট করে আমরা কোনো পরিকল্পনা করি না।

বেঙ্গল কেন নগর পুনর্বিন্যাসে আগ্রহী হলো?

প্রথমত, আমরা নগর পরিকল্পনা করি না, ডিজাইন করি। একটা শহর পুনর্বিন্যাস করতে হলে মাল্টি ডিসিপ্লিনারি টিমের প্রয়োজন হয়। ঢাকার নগর পরিকল্পনায় অংশগ্রহণকারী দলটি মাল্টি ডিসিপ্লিনড কিনা, আমি জানি না। তাই শুরু থেকে আমরা এ ধরনের টিম তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমাদের মধ্যে সাধারণ একটা ধারণা রয়েছে যে স্থপতিরা বাড়ি ডিজাইন করেন। অথচ স্থপতিদের কাজ হচ্ছে জটিল একটি বিষয় ঘিরে বিকল্প ধারণা প্রদান করা, তার চিত্ররূপ দেয়া এবং ভবিষ্যেক চিন্তা করা। আমার কাছে একটা বাড়ি যেমন, শহরও তেমন। আমরা মনে করি, স্থাপত্য মানে একটি নির্দিষ্ট বাড়ি। শহর যেমন স্থাপত্য, তেমনি গ্রাম গোছানোও স্থাপত্য। নির্দিষ্ট কোনো ভবন তৈরি নয়, বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে বড় পরিসরে কাজ করা। আমাদের ছোট দেশ, এখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি, সম্পদ কম, তাই এখানে পরিকল্পনা করে কাজে নামতে হবে। আর পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে হলে মাল্টি ডিসিপ্লিনারি পদ্ধতিতে করতে হবে। যারা পরিকল্পনা করবেন, তাদের এ সময়ের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে জ্ঞাত হতে হবে। অন্যান্য উদাহরণ সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। প্রচলিত পরিকল্পনা মডেলে চলবে না। আবাসন, সড়কসহ বিভিন্ন পরিকল্পনার সঙ্গে যারা জড়িত, তারা বর্তমান চাহিদার চ্যালেঞ্জটা নিতে পারছেন কিনা, তা দেখতে হবে। আমাদের চ্যালেঞ্জগুলো দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। চ্যালেঞ্জগুলোকে শনাক্ত করতে আমরা প্রস্তুত কিনা, সেটাও প্রশ্ন। স্থাপত্য, পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের প্রচলিত প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা রয়েছে। আরবান ডিসিপ্লিন, ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেকচার বলে কোনো বিভাগ বাংলাদেশে নেই। অভাব রয়েছে আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ডিসিপ্লিনেরও। বিষয়গুলো উপলব্ধি করে আমাদের নতুনভাবে ভাবতে হবে। নতুন দক্ষ লোক তৈরি করতে হবে, যারা চ্যালেঞ্জগুলো গ্রহণ করতে পারবে। কিন্তু এটাই হচ্ছে না। প্রচলিত চর্চা ও তার প্রয়োগ এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে না। চ্যালেঞ্জগুলো আমাদের আরো বেশি সাহসিকতার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। প্রথমে ‘শহর’ সম্পর্কিত ধারণাটা পরিষ্কার করতে হবে। শহর কীভাবে গোছাব, কোন ক্ষেত্রগুলোকে অগ্রাধিকার  দেব, এ বিষয়গুলো জানতে হবে। জনপরিসর, যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার প্রদান না করে শুধু প্লট আর বাড়ি বানালে হবে না। গুরুত্ব নির্ধারণে আমাদের সমস্যা রয়েছে। আমরা এখন মেট্রোরেল করছি, যা আরো পাঁচ বছর আগে করলে ঢাকার অবস্থা এতটা খারাপ হতো না। ইকোলজিক্যাল বোঝাপড়ায়ও আমাদের শূন্যতা স্পষ্ট। প্রথম আমাদের পানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ঠিক করা চাই। পানির সঙ্গে কীভাবে বসবাস করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে। জলাভূমিকে অটুট রেখে আবাসন পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। জাতীয় পরিকল্পনায় আমাদের শহর, আবাসনের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। ড্যাপ (ডিটেইল এরিয়া প্লান) হয়তো কোনটা জলাভূমি বা কোনটা পুকুর, তা ঠিক করে দিচ্ছে, এগুলোকে অক্ষুণ্ন রাখার কথা বলছে কিন্তু বাস্তবে বিপরীত পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে জায়গা দখল, নদী ভরাটসহ এক ধরনের চাপ রয়েছে। এ বিষয়গুলোকে সমস্যা হিসেবে চিন্তা না করে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারত। আমরা যদি জলাভূমিকে অটুট রেখে আবাসন তৈরি করতে পারতাম, সেক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হতো না। তবে আমরা এ ধরনের নমুনা দেখছি না। কিন্তু কাউকে না কাউকে বিষয়টি করে দেখাতে হবে। আর এ কাজ স্থপতিরাই করতে পারেন। আমি কমিশন পেলাম, কাজ পেলাম, তারপর আমি বিষয়টি সবার সামনে উপস্থাপন করব তা নয়। আমি ছবি এঁকে দেখাতে পারি। যারা নীতিনির্ধারক বা কর্তৃপক্ষ, যেমন রাজউক ওই নকশাগুলো দেখার আগ্রহ প্রকাশ করতে পারে। বিষয়গুলোকে দ্বন্দ্বমূলক চিন্তা না করে মিশ্রভাবে এগোনো যায় কিনা, তাও বিবেচ্য। জলাভূমিকে স্বাভাবিক রেখেও হাউজিং তৈরি করা যায়। বিশ্বের এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে।  (দৈনিক বণিক বার্তা থেকে নেয়া)

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ