‘অর্থনৈতিক রূপান্তরের জন্য বড় ধরনের সংস্কার জরুরি’
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ২৮ মে ২০১৮, ১৩:২৮
ঢাকা, ২৮ মে, এবিনিউজ : মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, সাবেক সচিব। বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। নব্বইয়ের দশকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বাজেট প্রণয়ন এবং শুল্ক ও কর ব্যবস্থা সংস্কার প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন। সিঙ্গাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক ফিন্যান্স বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেন তিন বছর। ২০০৯ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর প্রায় পাঁচ বছর নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির বাণিজ্য অনুষদে অর্থনীতি ও ফিন্যান্সের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত বই ফিন্যান্সিং লার্জ প্রজেক্টসের সহলেখক। বর্তমানে তিনি জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘিরে কথা হয় একটি জনপ্রিয় দৈনিকের সঙ্গে। তা হুবহু তুলে ধরা হলো-
বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য নতুন সংস্কার কতটা দরকার?
মনে রাখতে হবে, এটা নির্বাচনের বছর। তাই এ বছরের বাজেটে খুব একটা সংস্কারের আশা করা ঠিক হবে না। তবে বর্তমান সরকারই পুনর্র্নিবাচিত হোক কিংবা বিরোধী দল যারাই সরকার গঠন করুক না কেন, তাদের জন্য সংস্কারের দিকনির্দেশনা এবারের বাজেটে থাকা জরুরি।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমে সম্প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু পরবর্তী ধাপের অর্থনৈতিক রূপান্তরের জন্য বড় ধরনের কোনো সংস্কার হয়নি। ফলে কাঙ্ক্ষিত সুফল নিশ্চিত করা যাচ্ছে না আমাদের অর্থনীতি থেকে। বাংলাদেশে বড় ধরনের সংস্কার হয়েছিল নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে। এর পর প্রায় তিন দশক পার হতে চলল। অথচ অর্থনৈতিক রূপান্তরের জন্য বড় ধরনের সংস্কার হয়নি। কিছু আইন ও নীতি প্রণীত হয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে প্রান্তিক পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এখন সামনে এগোতে হলে আরেকটি বড় ধরনের সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। অন্যথায় আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী অর্থনৈতিক গতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা কঠিন হবে।
সংস্কার না হওয়া সত্ত্বেও প্রবৃদ্ধি বাড়ছে কীভাবে?
এটি হয়েছে জনমিতিক বাড়তি লভ্যাংশ বা বোনাসের জন্য। অধিক মানুষ কাজ করছে, নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমছে, ফলে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ছিল তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল, বড় ধরনের প্রাকৃতিক দৈব-দুর্বিপাকের সম্মুখীন হতে হয়নি দেশকে। কাজেই বর্তমান প্রবৃদ্ধির চালক নীতি-সংস্কার নয়; চালক হলো জনমিতিক লভ্যাংশ বা বোনাস, আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ অনুকূল পরিবেশ।
নব্বইয়ের দশকে তো একটি সংস্কার হয়েছিল। সে সম্পর্কে কিছু বলুন।
নব্বইয়ের দশকে অর্থনীতিতে ব্যাপক সংস্কার হয়েছিল। এ সংস্কারের মাধ্যমে লক্ষণীয় পরিবর্তন আনা হয়। এর মধ্যে একটি হলো শুল্কহার পরিবর্তন। তখন সর্বোচ্চ শুল্কহার এক ধাক্কায় সাড়ে তিনশ থেকে একশতে নিয়ে আসা হয়েছে। তারপর ৩০টি হার ছিল, সেখান থেকে সাত-আটটি হারে নিয়ে আসা হয়েছে। আমদানি নীতিতেও তখন পরিবর্তন আনা হয়। আগে প্রায় সবকিছুই আমদানি নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত ছিল। সংস্কারের মাধ্যমে আমদানি পণ্যকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়: (১) অধিকাংশ পণ্যই অবাধে আমদানিযোগ্য; (২) কিছু পণ্য অনুমতিসাপেক্ষে আমদানিযোগ্য; (৩) স্বল্পসংখ্যক পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ। এ সময়ই ভ্যাট প্রবর্তন করা হয়। অতীত থেকে এটি এক মৌলিক রূপান্তর।
কেবল শুল্কহার কিংবা আমদানি নীতি পরিবর্তন নয়; ওই সংস্কারে আয় করেও পরিবর্তন আনা হয়। আগে সর্বোচ্চ প্রান্তিক আয়কর হার ছিল ৫৫ শতাংশ। সেটি ৩৫ শতাংশে নিয়ে আসা হলো। এগুলো হলো র্যাডিকেল ব্রেক। তারপর মূল্য সংযোজন করের প্রবর্তন। এটি ১৯৯১ সালের কথা এবং এ সংস্কারের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান। দেশের ভবিষ্যৎ অর্থমন্ত্রীকে অবশ্যই সংস্কার মনস্ক হতেই হবে।
এরপর কিন্তু আমাদের দেশে করসংক্রান্ত ও অর্থনৈতিক সংস্কার হয়নি। উদাহরণস্বরূপ— আগের সংস্কারের ফলে এখন দেশে খাদ্য উৎপাদন না হলেও দুর্ভিক্ষ হয় না। আগে চাল আমদানিতে কড়াকড়ি ছিল। বর্তমানে তা নেই। এখন সরকার আনুক বা না আনুক বেসরকারি খাত চাল এনে বাজার ভরিয়ে ফেলে। ফলে খাদ্য ঘাটতি হয় না। বলতে গেলে, রাজস্ব, বিনিয়োগসহ সর্বত্র নব্বইয়ের প্রথম দিকে একটি সংস্কার হয়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাব অনেক দিন ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। এখন কিন্তু এটি নিয়ে বেশি দূর এগোনো যাবে না। বর্তমানে জনমিতিক বোনাসের জন্য বেশি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ঠিকই; কিন্তু অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে এটিকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়নি। ফলে কর-রাজস্ব বাড়ছে না; স্থবির হয়ে আছে। এবারো লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বিপুল রাজস্ব ঘাটতি বিদ্যমান।
আলোচ্য সংস্কারের প্রভাব কি এখনো বিদ্যমান?
নব্বইয়ের দশকের সংস্কারের কারণেই আজকের প্রবৃদ্ধির হারের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা গেছে। সেদিক থেকে এর প্রভাব এখনো কিছুটা বিদ্যমান। তবে এটি দিয়ে আর বেশি দূর এগোনো যাবে না। এখন আবারো একটি বড় ধরনের সংস্কার করতে হবে। তা না হলে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়বে।
বিরাজমান নৈরাজ্যিক অবস্থাকে কীভাবে দেখেন?
বর্তমানে দেশের আর্থিক খাতে বড় সংকট বিদ্যমান। ব্যাংকগুলোর অবস্থা নাজুক। বেকারত্বের হার চরমে। দেশে কেউ থাকতে চায় না। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত সবাই দেশ থেকে পালাতে আগ্রহী। দেশে থাকতে সবারই অনাগ্রহ। যারা নিম্নবিত্ত, তারা অনেকটা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সড়ক-মহাসড়কগুলো যানজটে নাকাল। আগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আমরা ৫ ঘণ্টায় যেতে পারতাম। মনে করতাম এটি খুব ধীরগতির। এখন ৮-৯ ঘণ্টা লাগে। এখন গাড়ি চলেই না, থেমে থাকে। বলতে গেলে অর্থনীতি একটি শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার দিকে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে অর্থনীতিকে বের করে নিয়ে আসতে হবে।
নতুন সংস্কারের ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলোয় মনোযোগ দিতে হবে?
এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে নজর দিতে হবে। এর মধ্যে একটি হলো, বিকেন্দ্রীকরণ। বাংলাদেশে সবকিছু কেন্দ্রীভূত। সব ঢাকাকেন্দ্রিক এবং সরকারপ্রধানের সিদ্ধান্তনির্ভর। এমনকি কোটার মতো একটি পুরোপুরি প্রশাসনিক বিষয়ও সরকারপ্রধানকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। বিকেন্দ্রীকরণ একসঙ্গে করা যাবে না। ধাপে ধাপে করতে হবে। কেননা আমাদের ফেডারেল কাঠামো নেই। কিন্তু আমাদের ধীরে ধীরে ওইদিকে যেতে হবে। বিকেন্দ্রীকরণের সুবিধা অনেক। যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল ব্যবস্থা কার্যকর থাকায় একেকটি জায়গার একেকটি অর্থনৈতিক গুরুত্ব তৈরি হয়েছে। ওয়াশিংটন ডিসি হলো রাজধানী। আবার বাণিজ্যিক রাজধানী হলো নিউইয়র্ক। একইভাবে একেবারে পশ্চিমাংশের সিয়াটলে মাইক্রোসফটের অফিস, অ্যামাজনসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের শহর গড়ে উঠেছে। এটা হয়েছে প্রধানত বিকেন্দ্রীকৃত ব্যবস্থার কারণে। উদ্যোক্তারা সবসময় খোঁজ করেন, কোথায় তার কারখানাটি হলে ভালো হবে, ব্যয় ও কর সাশ্রয়ের দিক থেকে সুবিধাজনক হবে, ফলে অধিকতর লাভজনক হবে। বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো ব্যাপকভাবে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় এখানে উদ্যোক্তাদের সে সুযোগ নেই এবং এখানে কোনো প্রতিযোগিতাও নেই। এখানে সবকিছুর জন্য বাংলাদেশ সচিবালয়ে যেতে হবে। কিন্তু এ রকম যদি ছয়-সাতটি জায়গা বা বিকেন্দ্রীভূত প্রশাসন থাকত, তাহলে অনেক সুবিধা হতো। এলাকাভিত্তিক অর্থনীতি গতিময়তা পেত; স্থানীয় উদ্যোক্তাদের বিকাশ ঘটত। সুতরাং সার্বিক অর্থনীতির স্বার্থেই সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে।
দুই. বেকারত্ব। এটা একটা টিকিং টাইম বোমা। দেশব্যাপী কোটা সংস্কার আন্দোলনের উৎসমূল এখানেই। কাজেই এটিকে গভীরভাবে নিতে হবে। দেশে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। এক্ষেত্রে একটি এমপ্লয়মেন্ট কমিশন হওয়া উচিত। এ কমিশনে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার লোককে রাখতে হবে। তাদের কাজ হবে ট্যাক্স পলিসিকে কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিকে কীভাবে নিয়ে যাওয়া যায়। দেশে সাত-আট লাখ বিদেশী, অধিকাংশই অবৈধভাবে কাজ করছে। এদের সংখ্যা যাতে না বাড়ে কিংবা এ সংখ্যা কীভাবে কমানো যায়, সে চেষ্টা করতে হবে। ফিসক্যাল পলিসি দিয়ে এটা সংকোচন করা যায়। বিশেষ করে পোশাক খাতের কারখানাগুলোয় উচ্চ বেতনে ভারত কিংবা শ্রীলংকার প্রচুর লোক কাজ করে। তাদের কাছ থেকে যথাযথ প্রশিক্ষণ নিয়ে যাতে দেশীয় লোক কাজ করতে পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। এগুলো সবই ফিসক্যাল পলিসি দিয়ে করা যায়। অথবা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন পাঠ্যসূচি প্রণয়ন জরুরি, যাতে শিল্পে চাহিদা থাকা লোকবল সৃষ্টি করতে পারে।
আমাদের কর ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু বলুন।
আমাদের কর ব্যবস্থাও কেন্দ্রীভূত। এটি নিয়ন্ত্রণ করে এনবিআর। এ একমুখী ব্যবস্থা দিয়ে করহার বাড়বে না। আমাদের রাজস্বের নতুন নতুন উৎস সৃষ্টি করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে বিকেন্দ্রীভূত রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থা। কেন্দ্রীয় এনবিআর দিয়ে রাজস্ব আহরণ আর বেশি করা যাবে না। আগেই বলেছি, করহার বেশি মাত্রায় রাখা যাবে না। ভ্যাটের সমস্যাও একই। এখানে হার বেশি, ১৫ শতাংশ। এক্ষেত্রে ভ্যাটহার ১০ শতাংশ করা হলে পরিপালন অনেক সহজতর হবে। আমাদের প্রথমে করদাতাদের সংখ্যা বাড়ানো উচিত; তারপর ধীরে ধীরে করহার বাড়াতে হবে। বেশির ভাগ ব্যবসায়ী ভ্যাট দেন না কেন? দুটি কারণ। এক. ভ্যাটহার বেশি এবং দুই. ক্রেডিট ম্যাকানিজম নেই। তারপর রয়েছে কর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের হয়রানি ও দুর্নীতি। এ তিনটি কারণে মানুষ ভ্যাট দিতে চায় না। সে হিসেবে শিল্প ও সেবা খাতের বিপুল অংশের ভ্যাট প্রদান হার শূন্য। এটি পুষিয়ে নেয়ার জন্য যারা দেন, তাদের ওপর বেশি ভ্যাটহার নির্ধারণ করা হয়। কাজেই এটি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা। আয়করের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা। আমাদের আয়কর হার বেশি। ব্যক্তিগত আয়কর হারে কর অব্যাহতি (ট্যাক্স একজেম্পশন) খুবই কম। এটা বাড়ালে লোকেরা কর দেবে। প্রথমে মানুষকে করজালে আনতে হবে। একই কথা প্রযোজ্য করপোরেট করহারে। করপোরেট করের ক্ষেত্রে ভারতের উদাহরণ টানা হয়। সেখানকার করপোরেট করহার অনেক কম। ব্যক্তিগত আয়করও অনেক কম। এজন্য বলছি, সার্বিকভাবে করহার কমাতে হবে। কর প্রদানে উৎসাহিত করার জন্য ‘কর বাহাদুর’ ঘোষণা করা হচ্ছে। এটা ভালো উদ্যোগ হলেও কর ফাঁকি দেয়ার জন্য বিরোধী রাজনীতিবিদদের হয়রানি করা ছাড়া কাউকে জেলে যেতে হয়নি। একটি কর ব্যবস্থায় গাজরের পাশাপাশি লাঠির ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়।
স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলোয় তো করহার অনেক বেশি। তাহলে আমাদের এখানে উচ্চ করহার থাকলে সমস্যা কী?
স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। সেখানে কর বেশি সত্য; কিন্তু তারা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জনগণের সেবা দেয়। সে করহার তো এখানে রাখা যাবে না। এখানে বিদ্যুৎ আসে-যায়, পানি পানযোগ্য নয়। রাজধানী ঢাকায় এমন কোনো জায়গা আছে, যেখানকার পানি পানযোগ্য? বিশ্বের বেশির ভাগ শহরে মানুষ টেপের পানি খায়। বাংলাদেশে ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা দিতেও রাষ্ট্র হিমশিম খায়। নিশ্চয়ই উচ্চ কর আরোপ করা হলে সেভাবে নাগরিক সেবার মানও বাড়াতে হবে। কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতায় তা খুবই হতাশাজনক। কাজেই স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের তুলনা বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
মেগা প্রজেক্টগুলোয় সরকারি অর্থ বেশি ব্যয় করা হচ্ছে। তাতে কি খুব একটা সুফল মিলছে?
মেগা প্রজেক্টের নামে রাস্তা-ঘাটসহ সবকিছু পরিত্যক্ত করা ফেলা হয়েছে। কোনো রাস্তাই এখন আর ঠিক নেই। সামান্য বৃষ্টিতেই ঢাকার রাস্তায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, মানুষের পক্ষে ঘর থেকে বের হওয়াই অসম্ভব হয়ে যায়। আগে লোকে বলত, এরশাদ সাহেব কাজ করেছে। রংপুরের রাস্তা ভালো। বলত, সাইফুর রহমান কাজ করেছে; সিলেটের রাস্তা ভালো। জিয়াউর রহমানের সময় বগুড়ার রাস্তা ভালো। আগে বলত, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু কাজ করায় বরিশালের রাস্তা ভালো। এখন সব অতীত। সন্দ্বীপের মতো পুরনো দ্বীপেও এখন সব আবহাওয়ায় সারা বছর যাতায়াত উপযোগী কোনো ব্যবস্থা নেই।
এসবই হয়েছে মেগা প্রজেক্টের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার কারণে। আমাদের নিশ্চয়ই মেগা প্রজেক্ট দরকার, এর সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ছোট প্রজেক্টও করতে হবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রজেক্টগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার। মেগা প্রজেক্টের সবগুলোয় সীমা অতিক্রম হচ্ছে, ব্যয়সীমা অতিক্রম ও সময়সীমা অতিক্রম। এর ফলে এসব প্রকল্পের যে কস্ট বেনিফিট বিশ্লেষণ ছিল, সবই উলট-পালট হয়ে গেছে। এগুলো দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। সাধারণত প্রজেক্ট যেটা করা হয়, সেটা যাতে জাতির সম্পদ হয়। কিন্তু মেগা প্রজেক্টের কিছু কিছু সময়সীমা ও ব্যয়সীমা ব্যাপকভাবে অতিক্রম করায় সেগুলো জাতির জন্য কোনো সম্পদ সংযোজন করতে পারবে না, বরং বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কাজেই ব্যয় ও সময় বাঁচাতেও আমাদের রাজস্ব ও উন্নয়ন ব্যয় বিকেন্দ্রীকরণের দিকে যেতে হবে। স্থানীয় তদারকির ফলে ব্যয়ের ক্ষেত্রে দুর্নীতি কমবে ও পূর্তকাজের মান বাড়বে।
আপনি বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলছেন। সেক্ষেত্রে প্রথমে কোন দিকে মনোযোগ দিতে হবে?
আমাদের প্রথমে জোর দিতে হবে দেশে বিদ্যমান স্থানীয় সরকারগুলো শক্তিশালীকরণে। স্থানীয় সরকারগুলোকে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে হবে। রাজস্ব আহরণেও তারা ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো ফেডারেল ব্যবস্থায় কর কেন্দ্রীয় সরকারও নেয়, প্রাদেশিক সরকারও নেয়। আমাদের এখানে ফেডারেল সিস্টেম না থাকলেও ধীরে ধীরে আমাদের করায়নের দায়িত্ব স্থানীয় সরকারকেও দিতে হবে। ধরুন, এমনিতেই ঢাকা ও প্রধান শহরগুলোয় রাস্তায় গাড়ি পার্ক করা হয়ে থাকে। রাস্তায় পার্কিং মিটার বসিয়ে ফি আদায় করা যেতে পারে। এতে স্থানীয় সরকার রাজস্ব পাবে এবং রাস্তায় অহেতুক যানজট কমবে। ঢাকায় বসে থেকে কত লোকের কাছ থেকে কর আহরণ করা হবে। কিন্তু স্থানীয় সরকার যুক্ত হলে তারা সহজেই কর আহরণ বাড়াতে পারবে। কারণ তারা জানে কার কার কাছ থেকে কর নেয়া যায়। কাজেই তারা কর আহরণে অনেক ভালো করবে। আমাদের বাস্তবিক অর্থে কর অনেক বেশি। চাঁদাবাজি আছে, দুর্নীতি আছে। বিকেন্দ্রীকরণ করা হলে এসবও অনেকাংশে কমে যাবে।
মোটা দাগে আমি তিনটি বিষয়ে জোর দেব। এক. বিকেন্দ্রীকরণ, দুই. কর্মসংস্থান সৃষ্টি বা কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য পরিষ্কার রাজস্ব প্রণোদনা (ফিসক্যাল ইনসেনটিভ) থাকতে হবে। একটি কর্মসংস্থান কমিশন করতে হবে। তিন. করহার লক্ষণীয় মাত্রায় কমানো। এটা ছাড়া কর আহরণ বাড়ানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। মূল্যস্ফীতি যেটুকু বাড়ার, সেটুকু বাড়বে। কিন্তু কর-জিডিপির অনুপাত বাড়বে না। আগেই বলেছি, কোনো একটি জায়গা নেই, যেখানে পানযোগ্য পানি পাওয়া যাবে। কিন্তু বিকেন্দ্রীকরণ করলে ছোট একটি এলাকায়ও সুপেয় পানি নিশ্চিত করা সম্ভব। একইভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ। স্থানীয় সরকার কাঠামো শক্তিশালী করা হলে স্থানীয়ভাবে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সুষ্ঠু বণ্টনের মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ করা কঠিন হবে না। আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনেই ব্যস্ত। কিন্তু বিরাট সমস্যা রয়ে গেছে ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশনে। স্থানীয়ভাবে একটি ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা গেলে নিজেদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়েই প্রয়োজন মেটাতে পারবে। বিকেন্দ্রীকরণ করলে বিনিয়োগও আকর্ষণ করা যাবে। কেবল কেন্দ্রীয় বাজেট করার দরকার নেই। এখন ডিভিশনাল বাজেট করতে হবে। তাদের অর্থ দিয়ে দেয়া হোক, তারা ভালো তদারকি করবে। সত্যি বলতে কী রাজনৈতিক, রাজস্ব ও ব্যয়ের দিক থেকে বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া আমরা বেশি দূর এগোতে পারব না।
এরশাদের সময় তো বিকেন্দ্রীকরণের চেষ্টা করা হয়েছিল। তা ব্যর্থ হওয়ার কারণ কি?
এরশাদের সময়ে বিকেন্দ্রীকরণের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সফল হয়নি। এটা ছিল মূলত একটা স্টান্ট। তাছাড়া একটি জনবিচ্ছিন্ন স্বৈরসরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ম্যান্ডেট ছিল না। তখন বিকেন্দ্রীকরণের জন্য অন্য শহর কিংবা গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো প্রস্তুত ছিল না। আগে ঢাকা বাদে অন্য শহরগুলোয় সুযোগ-সুবিধার বড় ধরনের অপ্রতুলতা ছিল। মানুষের পড়াশোনা কম ছিল, সচেতনতা ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা, অবকাঠামোর দিক থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল। এখন পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। অবকাঠামোর দিক থেকে পুরো দেশই অনেক এগিয়ে গেছে। এখন বিকেন্দ্রীকরণ করতে আর অসুবিধা আগের মতো নেই। (বণিক বার্তা থেকে সংগৃহীত)
এবিএন/সাদিক/জসিম
এই বিভাগের আরো সংবাদ