আজকের শিরোনাম :

‘সত্তরের দশকে ঢাকা শহরে হিজাব পরিহিত নারী দেখা যেত না’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৪:০২ | আপডেট : ০৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ১০:১৭

ড. নেহাল করিম, সমাজবিজ্ঞানী। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে পিএইচডি সম্পন্ন করেন ভারতের পুনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আগ্রহের ক্ষেত্র সামাজিক পরিবর্তন, সামাজিক উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা, সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন প্রভৃতি বিষয়। দায়িত্ব পালন করছেন নাজমুল করিম স্টাডি সেন্টারের পরিচালক, ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের একাডেমিক অ্যাডভাইজার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত জার্নাল অব সোসিওলজির সম্পাদক হিসেবে। তার বহু গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক জার্নালে। সম্প্রতি বেড়ে চলা ধর্মীয় উগ্রবাদ, সামাজিক অস্থিরতা, পারিবারিক সম্পর্কে পরিবর্তন, সামাজিক সংহতি, পারস্পরিক সহনশীলতা, মূল্যবোধগত বিবর্তন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে জনপ্রিয় এশটি দৈনিকের সঙ্গে কথা বলেন। তা হুবহু তুলে ধরা হলো-

হাজার বছর ধরে বাংলাদেশ তথা পুরো বাংলা অঞ্চলে ধর্মীয় সহাবস্থান দেখেছি। ইদানীং এক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটে ধর্মীয় উগ্রবাদের বিস্তার দৃশ্যমান। এর পেছনে কী কারণ বলে মনে করেন?

ধর্মীয় উগ্রবাদ এসেছে মূলত অর্থনৈতিক বা আর্থিক স্বার্থ থেকে। আমাদের এখানে মুসলিম ছাড়াও বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী যুগ যুগ ধরে বাস করে আসছে। কিন্তু বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের খুব একটা সমস্যা হয় না। সমস্যা হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রধানত হিন্দুদের সঙ্গে। এটি কেন হয়? যেহেতু অর্থনৈতিক স্বার্থ আছে, সেজন্য। একটি স্বার্থান্বেষী মহল মনে করে, হিন্দুরা না থাকলে তাদের ব্যবসা, সহায়সম্পত্তি তারা পাবে। এ অর্থনৈতিক স্বার্থ আছে বলেই একটি চক্র হিন্দুদের প্রতি একটু অসহনশীল। এটি উচিত নয়।

ধর্মীয় উগ্রবাদ বাড়ার পেছনে সমাজ ব্যবস্থাও অনেকটা দায়ী। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এমন যে, যেখানে ছোটবেলা থেকে শিশুদের বলে দেয়া হয় ওটা জেলেপাড়া, ওটা হিন্দুপাড়া, ওটা জোলাপাড়া, ওটা বেদেপাড়া ইত্যাদি। এসব কথা বলার ফলে আমাদের মনমানসিকতায় বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে, তারা অন্য সম্প্রদায়ের লোক। এজন্য আমাদের মনে হিংসা-বিদ্বেষ জেগে আছে। আমাদের যদি হিংসা-বিদ্বেষ না থাকত কিংবা যদি বলা হতো সব ধর্মীয় গোষ্ঠী, বর্ণ এক; তাহলে সম্প্রদায়গত এ পার্থক্য সৃষ্টি হতো না।

পারিবারিক শিক্ষাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে কোনো সংস্কার মানি না। কারণ যে পরিবেশে বড় হয়েছি, সেখানে আমাকে কোনো ধর্মীয় বা অন্য কোনো সংস্কারের ধারেকাছে আসতে দেয়া হয়নি। কাজেই ছোটবেলায় যে স্কুলে পড়েছি, সেখানে সব সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়ে পড়ত। সঙ্গত কারণে সবার সঙ্গে আমার সুমধুর সম্পর্ক। অন্য সম্প্রদায় বলে সহপাঠীদের প্রতি বৈষম্য বা ভিন্ন কোনো চিন্তা আমার মধ্যে আসেনি। অথচ আজকে বাংলাদেশে বিরাজ করছে ভিন্ন চিত্র।

একটি উদাহরণ দিই। বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক মুসলিম সম্প্রদায়ের দেশ হলো ইন্দোনেশিয়া। সেখানেও কিন্তু এত ধর্মান্ধতা নেই, যা বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে। আজকে বাংলাদেশে বাঙালি সংস্কৃতি কিন্তু একেবারেই নেই। শুধু আমরা বাংলায় কথা বলি। আমাদের চালচলন, আচার-ব্যবহার, বেশভূষা সবই বিভিন্ন দেশের হয়েছে। বিশেষভাবে বলতে গেলে সৌদি আরবের যে সংস্কৃতি, সেটি চলে আসছে এখানে। জন্ম, বেড়ে ওঠা, কর্মক্ষেত্র সবই এ নগরে হওয়ায় আমি নিজে দেখেছি, সত্তরের দশকে ঢাকা শহরে হিজাব পরিহিত নারী দেখা যেত না। আশির দশকেও এমনটা দেখা যায়নি। কিন্তু গত কয়েক দশকে এক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন হয়ে গেছে। এটি কোনো সুস্থ বা ইতিবাচক পরিবর্তন নয়। যদি বাঙালি সংস্কৃতির দিক থেকে বলি, আজকের প্রবণতা আমাদের সংস্কৃতি নয়; এটি ধর্মীয় সংস্কৃতি। আমরা বরং ধর্মীয় সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছি। মোটকথা, উল্লিখিত কারণগুলোর জন্য ধর্মীয় উগ্রবাদ বাড়ছে।

শুধু মুসলিম নয়, অন্য সম্প্রদায়গুলোর মধ্যেও ধর্মীয় উগ্রবাদ বাড়ছে। কেন?

প্রথমত. মনমানসিকতা এবং দ্বিতীয়ত. ধর্মীয় পরিচয়টিকে তারা অস্তিত্বের লড়াই মনে করে, যার কারণে ধর্মীয় উগ্রবাদ বাড়ছে। বাংলাদেশের একজন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মনে করে এটি তার অস্তিত্ব, এটি তাকে শক্তি দেয়। তার ধারণা, এতে সে অন্য দেশের সমর্থন পাবে। সেটি হতে পারে থাইল্যান্ড, চীন, জাপান, লাওস, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি। সব ধর্মের লোকজন কমবেশি সব দেশে রয়েছে। অর্থাৎ নিজেকে আরেকটু শক্তিশালী মনে করা, ধর্মকে বেশি প্রাধান্য দেয়া। আমাদের দেশেই ধরুন। একজনকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, তোমার পরিচয় কী। সে প্রথমে তার ধর্মীয় পরিচয় দেবে। আসলে একজন মানুষের পরিচয় ধর্ম নয়। তার প্রথম পরিচয় হবে প্রাণীগত পরিচয়। সে মানুষ। দ্বিতীয় পরিচয় হবে জাতিগত। তৃতীয় পরিচয় হবে ভৌগোলিক। চতুর্থ পরিচয় হবে আঞ্চলিক এবং পঞ্চম বা সর্বশেষ পরিচয় হবে ধর্মীয়।

সমাজে আগে যে পারস্পরিক সহনশীলতা ছিল, সেটি কমে যাচ্ছে। একের চিন্তাধারা বা মত অন্যে সহ্য করতে পারছে না। এক্ষেত্রে অনেক সময় সহিংসও হয়ে উঠছে মানুষ। এ প্রবণতা কীভাবে দেখেন?

প্রথম কথা, ঘরে ঘরে মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে, চাকরিজীবী হচ্ছে। শিক্ষিত হচ্ছে বটে, কিন্তু চিন্তাচেতনার ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। আমাদের মধ্যে নৈতিকতা, মার্জিত বোধের প্রচণ্ড ঘাটতি। লেখাপড়া করলে বা প্যান্ট-শার্ট পরলেই যে কেউ মার্জিত বোধসম্পন্ন হবে, তা নয়। আমরা অধৈর্য কেন হচ্ছি, আমাদের শোনার সময় কেন নেই? আমরা এখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। আরো কত বৈষয়িক লাভ করা যায়, সেজন্য আমরা অন্যকে সহ্য করছি না। সময়ও দিচ্ছি না। আগে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে মেলামেশা ছিল। একে অন্যের খোঁজখবর রাখত। এখন মানুষের ব্যস্ততা বেড়েছে। ফলে উৎসব ও শোকের বাড়ি ছাড়া কারো সঙ্গে এখন আর দেখা হয় না। আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে এখন ফোনে ফোনে কথা হচ্ছে। মানুষের সময় কমে গেছে তা নয়, সময়টা বিভিন্নভাবে কাজে লাগাচ্ছে। যাদের গাড়ি আছে বা যারা বাসে-রিকশায় চড়ে, তারা আর বিরক্ত হয় না। কারণ সবার স্মার্টফোন আছে। সেটি নিয়ে সময় কেটে যাচ্ছে। এটি কিন্তু একটি বড় ডাইভার্সন। টেলিভিশনে বসেই সিনেমা দেখতে পাচ্ছে। এখন আর হলে যেতে হচ্ছে না। স্মার্টফোনের মাধ্যমে এখন বিভিন্ন বিলও পরিশোধ করা যায়। বলতে গেলে বিজ্ঞান প্রযুক্তির উন্নতির ফলে মানুষ ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে।

এক্ষেত্রে সবচেয়ে ক্ষতি হচ্ছে আমাদের শিশুদের। তাদের চিত্তবিকাশ ও শারীরিক গঠনের জায়গা আমরা বাংলাদেশ তথা ঢাকার মতো বড় শহরগুলোয় দিতে পারছি না। সব খালি জায়গা দখল হয়ে গেছে। ধানমন্ডি ৮ নং-এর খেলার মাঠ ক্লাব করে অর্থবান একটি বিশেষ গোষ্ঠী ব্যবহার করছে। উত্তরায়ও এমনটি করা হয়েছে। খালি মাঠ না থাকলে শিশুরা কোথায় দৌড়াদৌড়ি করবে? দৌড়াদৌড়ি না করলে তাদের শারীরিক গঠন পোক্ত হবে না। আজকে ৭৫ বা তার বেশি বয়সী যেকোনো লোককে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলবেন, পাঁচ-ছয় মাইল হেঁটে স্কুলে যেতেন। পুকুরে নিয়মিত সাঁতার কাটতেন। এখন দৃশ্যপট পুরো বদলে গেছে।

আগে জমির বিরোধ নিয়ে খুনোখুনি হলেও এখন তুচ্ছ ঘটনায় তা হচ্ছে। কেন?

এখানে অনেকগুলো বিষয় রয়েছে। প্রথমত. স্বার্থগত ব্যাপার। দ্বিতীয়ত. মনমানসিকতার ব্যাপার। তৃতীয়ত. পারিপার্শ্বিকতার ব্যাপার এবং চতুর্থত. ও প্রধানত. যার যার বেড়ে ওঠার ওপর তার আচার-আচরণ প্রতিফলিত হবে। কার কত পিছুটান আছে, তার ওপর এটি নির্ভর করে। আমরা কিন্তু সবাই কৈবর্ত। কিন্তু বিয়ের সম্বন্ধ করতে গেলে কেন পরিবার দেখি? আমাদের মধ্যে যারা পিয়ন-চাপরাসির চাকরিও করে, তারা একটি রীতিনীতির (নর্মস) মধ্যে থাকে। অফিসের নিয়ম-কানুনগুলো মেনে চলে। এর ছাপ পরিবারেও পড়ে। যে কারণে দেখা যায়, পিয়ন-চাপরাসির ছেলে-মেয়ে এক রকম, আবার সেলফ এমপ্লয়েড অর্থাৎ মুদির দোকান থেকে শিল্পপতি তাদের ছেলেমেয়েদের ব্যবহার আরেক রকম। বলতে গেলে মানুষের আচরণে পিছুটান একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এখন তুচ্ছ ঘটনায় যে খুনোখুনি হচ্ছে, তাতে উল্লিখিত পিছুটানের ঘাটতি দেখি।

বতর্মানে পারিবারিক সম্পর্ক ক্রমে শিথিল হচ্ছে, বিবাহ বিচ্ছেদের হারও বাড়ছে। এর আর্থসামাজিক পটভূমি কী?

আগে বিজ্ঞান প্রযুক্তির এত উন্নতি হয়নি। মানুষের হাতে অফুরন্ত সময় ছিল। আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগে স্বামী-স্ত্রী হলে সিনেমা দেখে কোনো এক আত্মীয়ের বাসা হয়ে নিজের বাসায় ফিরত। কিংবা কোনো আত্মীয় অসুস্থ হলে তাকে দেখতে হাসপাতালে যেত। এখন মুমূর্ষু না হলে যায় না। এখন এ অভ্যাসগুলো নেই। পারিবারিক সম্পর্কগুলো দিনকে দিন শিথিল হচ্ছে। এখন মানুষ বৈষয়িক হয়ে গেছে। অন্যকে এখন আর সময়ও দিতে চায় না, আবার স্বার্থবোধটাও বেশি জাগ্রত হয়েছে। আমি সবচেয়ে অবাক হই, যখন দেখি কোনো সন্তান তার বাবা-মাকে অবহেলা করে। যে মা একই সঙ্গে পাঁচ-ছয়জন সন্তান লালন-পালন করতে পারে, তাকে কোনো সন্তান দেখভাল বা লালন করতে পারে না! এটি খুবই দুঃখজনক। এত নৈতিক অধঃপতন! কোনো বিবেক কাজ করে না, মানবিক মূল্যবোধ কাজ করে না— মাকে মারে, বাবাকে মারে।

এক্ষেত্রে আকাশ সংস্কৃতি, ইন্টারনেট, মোবাইল বা সামাজিক মাধ্যম প্রভাব ফেলছে কিনা?

অবশ্যই। আকাশ সংস্কৃতির কারণে পরকীয়া বেড়ে যাচ্ছে। প্রেম-ভালোবাসা বাড়ছে। এর কারণে বৈবাহিক সম্পর্ক টিকছে না। টিকছে না মানে মনমানসিকতার বদল ঘটছে। বিয়ের আগে কোনো জুটি একসঙ্গে হয়তো অনেক খাওয়া-দাওয়া করেছে, ঘুরেছে বিস্তর। কিন্তু বিয়ের পর হয়তো স্বামী নাক ডাকে, তাতে তার অস্বস্তি। টেলিভিশন দেখার সময় বউ চায় একটি চ্যানেল দেখতে, জামাই চায় আরেকটি চ্যানেল দেখতে। এখানে যে সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব বিরাজমান, এসবের কারণে ধৈর্য হারিয়ে ফেললে তখন বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। ইদানীং আরো তুচ্ছ ঘটনায় বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটছে। আসলে বিয়ে একটি যৌথ প্রকল্প। আমার সবকিছু স্ত্রীর ভালো লাগবে, এটি হতেই পারে না। স্ত্রীরও আমার সবকিছু ভালো লাগবে, তা নয়। দুজন আলাদা মানুষ। একেবারে ভালো লাগবে না, তা নয়। কিছু কিছু মিল থাকবে, ভালো লাগবে। কিছু বিষয় ভালো লাগবে না। সেক্ষেত্রে পারস্পরিক শ্রদ্ধার নিরিখে অন্তত দুজনেরই মানিয়ে চলা (ব্যালান্স) উচিত; যেহেতু এটি যৌথ প্রকল্প।

সামাজিক অস্থিরতা এখন প্রকট। এটি কি অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে নাকি এর পেছনে অন্য কোনো বিষয় প্রভাবক ভূমিকা রাখছে?

বৈষম্য আগেও ছিল। এখন এটি বেশি দৃশ্যমান। সেটিও মূল কথা নয়। মূল কথা হলো, মানুষের মধ্যে লোভ-লালসা, স্বার্থবোধ বেশি জেগে উঠেছে। ও পাবে, আমি পাব না কেন? ও গাড়ি চড়ছে, আমি চড়ব না কেন? মানুষের মধ্যে বিবেচনা কমে গেছে। মূলত স্বার্থবুদ্ধি থেকেই এমন আচরণ করছে মানুষ। ফলে সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। নষ্ট হচ্ছে সামাজিক সংহতি।

বৈষম্য কমানো বা সামাজিক সংহতি রক্ষায় অর্থনৈতিক উৎপাদন প্রক্রিয়া বদলানোর প্রয়োজন আছে কিনা?

অবশ্যই। বিদ্যমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৭ বছর হয়েছে। আমরা এখনো এগোতে পারলাম না। মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদের মতো একজন নেতা দরকার আমাদের। তাহলে আমরা ভালোভাবে এগোতে পারব। একটা কথা মনে রাখা দরকার, যতক্ষণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে না পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সাফল্যমণ্ডিত হতে পারবে না। আজকে বিপুল অর্থ খরচ করে সরকার স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে, তাতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বা গ্রামের লোকের কী সুবিধা হলো। শহরের মুষ্টিমেয় কিছু লোকের জন্য ফ্লাইওভারসহ অবকাঠামো করলে সাধারণ মানুষের তাতে কী লাভ। কিংবা ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন উদযাপনে লাইট শো ও কনসার্টে জনগণের কী সুফল। এগুলো ব্লাফ ও পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার ফল। অনুৎপাদনমূলক বিভিন্ন কাজে রাষ্ট্রের যে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়, তা দিয়ে জেলা হাসপাতালগুলো সহজেই আধুনিকায়ন করা যায়।

সামাজিক সংহতির জন্য সাংস্কৃতিক চর্চার গুরুত্ব কতখানি?

সামাজিক সংহতি দৃঢ় করতে সাংস্কৃতিক চর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। এখন দেশে সাংস্কৃতিক চর্চা সেভাবে হচ্ছে না। আগে পাড়ায় পাড়ায় ক্লাব ছিল, যাত্রাপালার দল ছিল, গান হতো, খেলাধুলার আয়োজন হতো। সেগুলো কমে যাচ্ছে। এসব চর্চা মানুষের মনমানসিকতায় একটা বড় পরিবর্তন আনে। এখন খেলার মাঠ নেই। কিছু ছেলে রাস্তার মোড়ে লাইটপোস্টের নিচে আড্ডা দিচ্ছে। ছোট ছোট টং দোকানে আড্ডা দিচ্ছে। এগুলো সুস্থতার লক্ষণ নয়। বরং সামাজিক অস্থিরতার কারণ। আর অসহিষ্ণু হব না কেন? কেননা বিজ্ঞান প্রযুক্তির দ্রুত উন্নতি ঘটেছে। তার ওপর আমরা ঔপনিবেশিক শক্তির অধীনে ছিলাম। সে কারণে আমাদের মনমানসিকতা রয়েছে কত দ্রুত বাড়ি-গাড়ি করা যায়। ফলে আমরা নিজেদের মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলছি।

আমাদের বুর্জোয়া রাষ্ট্র হয়েছে বটে, কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামন্তীয় আচরণের ছাপ দৃশ্যমান। এটা কেন?

আমাদের দেশে ইউরোপীয় অর্থে সামন্তপ্রথা ছিলই না। কিন্তু আমরা সবকিছুতেই সামন্তীয় মনোভাব নিয়ে আছি। মনমানসিকতা এমন যে আমরা যেন সবাই রাজ রাজড়ার বংশধর। এগুলো হলো মানবিক গুণের অভাব। আমাদের দেশে অনেক বাড়ি আছে, যেখানে দুই রকম চালের ভাত রান্না করা হয়। কাজের লোকদের জন্য এক রকম ভাত। আবার নিজেদের জন্য আরেক ধরনের ভাত। কাজের লোকদের অনেক ক্ষেত্রে ঘরের ভেতরে ঢুকতেও দেয় না। এ ধরনের আচরণ আমাদের হীনম্মন্যতারই বহিঃপ্রকাশ। এ ধরনের আচরণ আমরা রাষ্ট্র কাঠামোর বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে দেখছি, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক।

সামাজিক সংহতি দৃঢ় করতে রাষ্ট্রের কী করণীয় বলে মনে করেন?

বাংলাদেশের মতো দেশে রাষ্ট্র কিছুই করতে পারবে না। রাষ্ট্রের কাছে আশা করা উচিত নয়। রাষ্ট্রের অনেক কাজ বাকি আছে। রাষ্ট্র এখনো মৌলিক কাজগুলো করেনি। কিংবা যেগুলো ধরেছে, সেগুলো সম্পন্ন করেনি। রাষ্ট্রের প্রথম কাজ হলো, বাংলাদেশের সব মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দিক থেকে কোনো চিন্তাভাবনা দেখছি না। এখানে মনমানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। রাষ্ট্র যদি সত্যিই জনগণের কল্যাণ করতে চায়, তাহলে তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে হবে। সেটি করলে দেশ এমনিতেই উন্নত হবে। সর্বোপরি সামাজিক অস্থিরতা হ্রাস পাবে এবং সামাজিক সংহতি বজায় থাকবে।

এক্ষেত্রে সামাজিকভাবে কী করা যায়?

অস্থায়ী ভিত্তিতে কিছু করা যাবে না। সমাজ ব্যবস্থা পুরো ঢেলে সাজাতে হবে। খোলনলচে বদলে দিতে হবে। বর্তমানে যে ব্যবস্থা চলছে, সেটি পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থার অধীনে কোনো অবস্থায়ই রাষ্ট্রের বা সমাজের কল্যাণ হবে না। এখানে মুষ্টিমেয় কিছু লোক সুবিধা পাবে। যেসব বড় প্রকল্প হচ্ছে, তা থেকে কিছু লোক সুবিধা পাচ্ছে, সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না। আমরা জিম্মি হয়ে আছি। আমরা সাহস হারিয়ে ফেলেছি। আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগে যে প্রতিরোধ, প্রতিবাদ ও প্রতিকার ছিল, আজকে তা নেই। আজকে সবাই লেজুড়বৃত্তি করছে, দলদাস হয়ে গেছে। একটি সহজ বিষয়, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সরকার এমন মহৎ কাজ করবে না, যা জনগণের বৃহত্তর কল্যাণে আসবে। কথায় কথায় উৎসব হয়, এসব উৎসবে বিপুল অর্থ খরচ হয়; যার কোনো উপযোগিতা নেই। (দৈনিক বণিক বার্তা থেকে সংগৃহী)

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ