আজকের শিরোনাম :

‘উচ্চশিক্ষার বড় সংকট মানসম্মত শিক্ষক ঘাটতি’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০১৮, ১৪:২৯

মো. আনোয়ার হোসেন, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ থেকে। তিনি জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্টডক্টরেট সম্পন্ন করেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ছিলেন জাপানের কচি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের কালচারাল ফিশারিজ এবং জার্মানির রাইন ওয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের হাইজিন অ্যান্ড মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর। দায়িত্ব পালন করেন বিসিএসআইআরের বোর্ড অব গভর্নরস ও কাউন্সিল সদস্য হিসেবে। ২০১১ সালে ইউজিসি থেকে পান শ্রেষ্ঠ গবেষকের পুরস্কার। সম্প্রতি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন জনপ্রিয় একটি দৈনিকের সঙ্গে। তা হুবহু তুলে ধরা হলো-


বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষার মান সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? এক্ষেত্রে মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা জোগানো কতটা চ্যালেঞ্জিং?

বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে অনেকটা অগ্রসর হলেও দেশের উচ্চশিক্ষা এ উন্নয়ন গতিধারাকে ধরে রাখার জন্য যথোপযুক্ত নয়। আমাদের বর্তমানে উন্নয়ন, অগ্রগতি ধরে রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যে মানের গ্র্যাজুয়েট তৈরি করার কথা, তা তৈরিতে সমর্থ হচ্ছে না।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা যে প্রক্রিয়ায় পরিচালিত হচ্ছে, তা দিয়ে যুগোপযোগী দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা অত্যন্ত দুরূহ। বিশেষ করে বিজ্ঞান শিক্ষায় যে অপর্যাপ্ত অনুদান এবং সুযোগ আছে, তা দিয়ে জ্ঞানভিত্তিক উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তিসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট বা দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা অত্যন্ত কঠিন। সুতরাং মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা কতটা চ্যালেঞ্জিং, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

গুটিকয়েক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান এক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে কেন? শিক্ষা ব্যবস্থা কীভাবে সাজালে আমরা জেলা শহরগুলোয় মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে পারব?

উন্নত দেশগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সাধারণত তিনটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করা হয়। প্রথম ক্যাটাগরির বিশ্ববিদ্যালয়, দ্বিতীয় ক্যাটাগরির বিশ্ববিদ্যালয় ও তৃতীয় ক্যাটাগরির বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে প্রথম ক্যাটাগরির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় বলা হয়ে থাকে। এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চিন্তা, চেতনা, নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে প্রধান ভূমিকায় থাকে এবং যা একটি দেশ বা জাতিকে অন্য দেশের তুলনায় এগিয়ে রাখতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সাধারণত দ্বিতীয় ও তৃতীয় ক্যাটাগরির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একটি দেশের বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী গ্র্যাজুয়েট সরবরাহ করে থাকে, যা একটি দেশকে বর্তমান অবস্থায় টিকে থাকতে ভূমিকা রাখে। আমার মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রথম ক্যাটাগরির কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। গুটিকয়েক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, যা দ্বিতীয় ও তৃতীয় ক্যাটাগরিভুক্ত। তাই এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দিয়ে বর্তমান উন্নত বিশ্বের, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গেও কমপারেটিভ অ্যাডভানটেজ বলতে আমরা যা বুঝে থাকি, তা অর্জন সম্ভব নয়।

আর মানসম্পন্ন শিক্ষার প্রথম শর্ত হলো যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক, শিক্ষা উপযোগী পরিবেশ এবং সুযোগ নিশ্চিত করা। বিশেষ করে সে ধরনের যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক প্রয়োজন, যারা বিজ্ঞানমনস্ক, উদার, মুক্তমনা, সাহসী এবং উন্নত বিশ্বের উন্নয়নের গতিধারার বিষয়ে সম্যক জ্ঞান রাখেন। দেশের জেলা শহরগুলোয় গড়ে ওঠা নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোয় এ ধরনের শিক্ষকদের আসতে উৎসাহী এবং তাদের ও তাদের পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরনের শিক্ষকরা যখন কোনো জেলা পর্যায়ের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসতে থাকবেন, তখন এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুণগত মান বাড়বে।

বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষার বর্তমান অবস্থা নিয়ে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। শিক্ষার্থীরা এখন বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার চেয়ে ব্যবসায় শিক্ষায় অধিক আগ্রহী। বিষয়টি সম্পর্কে আপনার পর্যালোচনা কী?

শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান শিক্ষামুখী করার জন্য এক থেকে ১২ বছর পর্যন্ত আমাদের যে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত, তার আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। যখন আমাদের শিক্ষার্থীরা বেড়ে ওঠে, তখনই তাদের মধ্যে এ আস্থা তৈরি করতে হবে, বিজ্ঞান শিক্ষা গ্রহণ করলে পরবর্তীতে তারা নিরাপদ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ অর্জন করতে পারবে। মূল কথা, শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানমনস্ক করে বিজ্ঞানের প্রতি গভীর আগ্রহী হওয়ার বীজ বপন করতে হবে। বিজ্ঞান শিক্ষার আগ্রহই পারে একজন কোমলমতি শিক্ষার্থীকে উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন ও চিন্তাশীল করে গড়ে তুলতে। এজন্য বিজ্ঞান মেলার আয়োজনসহ বিজ্ঞান জাদুঘর স্থাপন করতে হবে। যেন শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানকে হাতে-কলমে বোঝার সুযোগ পায়, বিজ্ঞানকে ভালোবাসে এবং বিজ্ঞানের মধ্যে বেঁচে থাকতে চায়।

দেশে বিভিন্ন পর্যায়ের বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠছে। এক্ষেত্রে দক্ষ মানবসম্পদ বিশেষত শিক্ষকের কোনো সংকট রয়েছে বলে মনে করেন কি? কীভাবে এ সমস্যার সমাধান করা যায়?

অবশ্যই সংকট রয়েছে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। দেশে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় আছে, সেগুলোয় পর্যাপ্তসংখ্যক পিএইচডিধারী মানবসম্পদ তৈরি করতে হবে, যারা এ সংকট মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে। এ কাজটি দেশের প্রথম ক্যাটাগরির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো করে থাকে। বাংলাদেশে যেহেতু প্রথম ক্যাটাগরির বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাব, তাই এক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ক্যাটাগরির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিতে হবে এবং সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এক্ষেত্রে ভারত ও মালয়েশিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা আমরা অনুসরণ করতে পারি।

বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষানীতির দুর্বলতা কী কী?

বর্তমান শিক্ষানীতিতে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা ঘোষণা করা হলেও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কিন্তু তার তেমন একটা প্রতিফলন নেই। বিভিন্ন মাধ্যমের শিক্ষা ব্যবস্থা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের প্রথম থেকেই মানসিকভাবে শ্রেণীবিভক্ত হিসেবে গড়ে তোলে। এটাকে দূর করা অথবা সহনশীল পর্যায়ে আনা আশু প্রয়োজন। তা না হলে একটি শ্রেণীবিভক্ত সমাজ তৈরি হবে। আর শ্রেণীবিভক্ত সমাজ কখনো স্থিতিশীলতা আনতে পারে না, যা উন্নয়নের প্রাথমিক শর্ত। ফলে আমরা যে উন্নত, সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, এ শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে এটা কতটা সম্ভব, তা ভেবে দেখার বিষয়।

কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দিতে বলছেন সবাই। আমাদের কারিগরি শিক্ষা যুগোপযোগী জনশক্তি গড়ে তুলতে কতটা সক্ষম? এক্ষেত্রে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যায়, যেখান থেকে সর্বোচ্চ উপযোগ মিলতে পারে?

কারিগরি শিক্ষার ওপর অবশ্যই জোর দিতে হবে। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো যুগোপযোগী করে তুলতে হবে। অজানা নয় যে, বর্তমান সরকার যুগের চাহিদা অনুযায়ী কারিগরি শিক্ষার ওপর যথেষ্ট জোর দিয়েছে। কারিগরি ইনস্টিটিউটের পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান উন্নয়নের চাহিদা মোতাবেক দক্ষ মানবসম্পদ জোগান দিতে পারবে। তবে শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার নিবিড় পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির সময় আমাদের শুধু দেশের প্রয়োজনেই নয়, বিদেশে জনশক্তি রফতানি কীভাবে করা যায়, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। তাহলে এ দক্ষ জনশক্তি শুধু দেশের চাহিদা মেটাবে না, আমাদের রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়াবে। একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমার সফর করার সুযোগ হয়েছে, সেখানকার শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমার কাছে মনে হয়েছে, বাংলাদেশের হাতে-কলমের শিক্ষার প্রতি কম জোর দেয়া হচ্ছে। অথচ এর ওপর জোর দিলে শুধু কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না, দেশে-বিদেশে উদ্যোক্তা তৈরিও সম্ভব।

উচ্চশিক্ষার সংকট কোথায়? কাঙ্ক্ষিত মানের চেয়ে পরিমাণের দিকে বেশি নজর দেয়া হচ্ছে বলে মনে করেন কি?

উচ্চশিক্ষার বড় সংকট হলো মানসম্মত শিক্ষকের অভাব। একই সঙ্গে বেশির ভাগ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই মানসম্মত শিক্ষার উপকরণ ও উপযুক্ত পরিবেশের অভাব রয়েছে। এ কারণে উচ্চশিক্ষা মানের চেয়ে পরিমাণের দিকে বেশি ধাবিত হচ্ছে।

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় কী ধরনের পরিবর্তন কাম্য? বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় এগোতে পারছে না কেন? করণীয় কী?

দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো প্রয়োজন এবং উন্নয়নের গতিধারা অর্জন করতে হলে দেশে অবশ্যই প্রথম ক্যাটাগরির গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি করতে হবে। নতুন জ্ঞান সৃষ্টি এবং তার প্রয়োগ যদি আমরা নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারব না।

উচ্চশিক্ষায় মানের চেয়ে বর্তমানে পরিমাণের দিকে অধিক নজর দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ মিলছে। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রক্রিয়া কেন?

জেলায় জেলায় যদি বিশ্ববিদ্যালয় করতে হয়, তাহলে দক্ষ ও মানসম্মত শিক্ষকের যোগদান নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষার উপকরণ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারকে বোঝাতে হবে, রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, বরং উচ্চশিক্ষা সবার জন্য সহজলভ্য ও তৃণমূলে পৌঁছে দিতে তারা এ মহতী পদক্ষেপ নিচ্ছে। 

দক্ষ শিক্ষক তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে কি? বেতন-ভাতা নিয়ে যে অভিযোগ রয়েছে, সেটি কিছুটা হলেও সমাধান হয়েছে। এখন শিক্ষার মান উন্নত হচ্ছে কি?

দক্ষ শিক্ষক তৈরিতে প্রশিক্ষণ অবশ্যই প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বর্তমান সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছে। উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্পের (হেকেপ) আওতায় ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেল (আইকিউএসি) প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও কারিকুলাম আধুনিকীকরণের ব্যবস্থা নিয়েছে। এছাড়া শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ, দেশ-বিদেশে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সম্মেলন, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই একমাত্র শিক্ষকরা নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারবেন এবং সে অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলবেন।

মানসম্পন্ন শিক্ষিত জাতি ছাড়া একটি দেশ এগোতে পারে না। আমাদের মেধাবীরা বিদেশে গিয়ে অবস্থান করছেন, তাদের ফিরিয়ে আনার কোনো প্রক্রিয়া শুরু করা যায় কিনা?

চীন, ভারত, মালয়েশিয়া ও কোরিয়া তাদের বিদেশে অবস্থানকারী নাগরিকদের ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন প্রণোদনা বা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এসব দেশের আদলে বাংলাদেশের বিদেশে অবস্থানকারী মেধাবীদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করলে অবশ্যই আমাদের উচ্চশিক্ষার গুণগত পরিবর্তন হবে বলে আমি মনে করি।

ভারত সরকার সম্প্রতি বিদেশে অবস্থানরত তাদের প্রবীণ ও দক্ষ বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞদের দেশসেবায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশ কি একই উদ্যোগ নিতে পারে না?

বাংলাদেশও এটা গ্রহণ করতে পারে। সরকার এ ধরনের সুযোগ সৃষ্টি করলে ভারত, চীন ও কোরিয়ার মতো আমাদের দক্ষ ও মেধাবী বিজ্ঞানীরাও দেশের টানে ফিরে আসা শুরু করবে বলে বিশ্বাস করি। কারণ নাড়ির টান বা মাটির টান কেউ কখনো ভুলতে পারে না। আমি যখন সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণের জন্য বিশ্বের কোনো দেশে যাই, সেখানে যদি বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কোনো বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর সঙ্গে দেখা হয়, তখন তারা দেশে এসে কাজ করার গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেন।

কোন খাতে কী পরিমাণ জনশক্তি প্রয়োজন হবে, তার ওপর নির্ভর করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সাজানো উচিত বলে মন্তব্য করেন অনেকে। এক্ষেত্রে আপনার অবস্থান কী?

দীর্ঘদিন ধরে আমার অবস্থান ছিল দেশের চাহিদাভিত্তিক উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে সাজানো। উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালগুলো এটাই অনুসরণ করে থাকে। এতে উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের সঙ্গে সঙ্গে ঝরে পড়ার হারও কমবে।

সরকার শিক্ষার হার বাড়াতে গিয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষার দিকে নজর দিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এ সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

অভিযোগটি আমি এভাবে ভাবি না। একটি উন্নয়নশীল দেশ হতে সদ্য মধ্যম আয়ে প্রবেশকারী দেশ হিসেবে প্রথম দিকে কিছুটা সীমাবদ্ধতা থাকেই। পর্যায়ক্রমে তা দূরীভূত হবে, এ সম্ভাবনাই বেশি। বর্তমান সরকার শিক্ষার মানের দিকে অনেক জোর দিচ্ছে। এর ফল দৃশ্যমান হওয়ার জন্য সময়ের প্রয়োজন আছে।

বিভাগীয় বা জেলায় অবস্থিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে কীভাবে সহায়তা জোগাচ্ছে? কী করলে আরো ভালো ফল মিলতে পারে?

বিভাগ বা জেলা পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়ায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। একই সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানে তৈরি গ্র্যাজুয়েটরা ওই অঞ্চলের তথা দেশের চাহিদা মেটাতেও সক্ষম হচ্ছে। এর ফলে উন্নয়ন বিকেন্দ্রীকরণ সহজতর হচ্ছে। তাছাড়া বিভাগীয় ও জেলা শহরে উচ্চশিক্ষার সুব্যবস্থাসহ নাগরিক সুবিধা বাড়লে মানুষ রাজধানীমুখী হবে না। বিকেন্দ্রীকরণের উন্নয়নের সুফল হিসেবে দেশের সব অঞ্চলে টেকসই ও সুষম উন্নয়ন ধারা বজায় থাকবে।

প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায়ের শিক্ষায় কোনো ধরনের সমন্বয়হীনতা দেখেন কি?

শিক্ষার প্রথম থেকেই যে শ্রেণী বিভাজন তৈরি হচ্ছে, এর পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চশিক্ষায় সমন্বয়হীনতা পরিলক্ষিত হয়। আর উচ্চশিক্ষা যারা গ্রহণ করতে আসেন, তারা অধিকাংশই পরিণত বয়সে আসেন। ফলে এ সমন্বয়হীনতা থেকেই যায়।

আপনার বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে স্বপ্ন কী? কোথায় দেখতে চান একে? কীভাবে তা বাস্তবায়ন করবেন? এটি কতটা বাস্তবসম্মত।

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি গবেষণাধর্মী ও উদ্ভাবনী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করতে চাই। এটি একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় এর তরুণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উপযুুক্ত পরিবেশ ও সুযোগ প্রদান করতে পারলে এটা বাস্তবায়ন সম্ভব। এ লক্ষ্যে আমি প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি করে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য স্থির করেছি। একই সঙ্গে গবেষণাগার পরিচালনায় যোগ্য ছাত্র ও শিক্ষক মিলে ‘টিম গঠন’ করার উদ্যোগ নিয়েছি। এ লক্ষ্যে আমার দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম বছরে একটি অত্যাধুনিক আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন জেনোম সেন্টার এবং হ্যাচারি অ্যান্ড ওয়েট ল্যাব স্থাপন করেছি।

বাংলাদেশে যে ধারণা, বিশ্বাস ও প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলে, তার সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো পার্থক্য রয়েছে কি? কেন?

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেভাবে পরিচালিত হয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিচালনায় বেশ পার্থক্য আছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি প্রধান কাজ হলো নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা। কিন্তু এ লক্ষ্য অর্জনে আমরা যথেষ্ট পিছিয়ে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি যেভাবে প্রচলিত আছে, তা উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় পরিলক্ষিত হয় না। শিক্ষার প্রকৃত উপযোগ পেতে চাইলে সরকার, শিক্ষক ও রাজনীতিবিদদের নতুন করে ভাবা উচিত নয় কি?

জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র ও গবেষণাগার হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়কে রূপান্তরে করণীয় কী? গবেষণালব্ধ জ্ঞান কীভাবে সমাজে ছড়িয়ে দেয়া যায়?

জ্ঞানচর্চাকেন্দ্র ও গবেষণাগার হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়কে রূপান্তর করার জন্য সরকারকে আরো অর্থ বরাদ্দ ও সুযোগের সৃষ্টি করতে হবে। এ অর্থ বরাদ্দের লক্ষ্য থাকবে আমাদের সমাজের বিদ্যমান সমস্যাগুলো যেন দূর করা যায়। এক্ষেত্রে ভারতের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ ও গবেষক প্রফেসর রঘুনাথ মাশেলকারের একটি উক্তি এখানে উদ্ধৃত করা যায়। তিনি বলেন, ‘জবংবধৎপয পড়হাবৎঃং সড়হবু রহঃড় শহড়ষিবফমব. ওঃ রং রহহড়াধঃরড়হ ঃযধঃ পড়হাবৎঃং শহড়ষিবফমব রহঃড় সড়হবু.’ বাংলাদেশের জন্য টেকসই প্রযুক্তি তৈরিতে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সব বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। গবেষণালব্ধ প্রযুক্তি সমাজের উপকারে ছড়িয়ে দিতে হবে। গবেষণা যেহেতু দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রক্রিয়া। সুতরাং এর ফল পেতে আমাদের আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক গবেষণা হয়, কিন্তু তার ফল বাস্তবে চর্চা করা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে করণীয় কী?

কথাটি সত্য। তবে বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণালব্ধ প্রযুক্তি কাজে লাগানোর বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিয়েছেন। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অত্যাধুনিক গবেষণাগার সৃষ্টি, শিক্ষকদের ইন্টেলিজেন্ট প্রপার্টি রাইট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টর ওপর প্রশিক্ষণ দেয়ার কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন এবং অনেকাংশে তা বাস্তবায়ন করেছেন। প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও তার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একাডেমি-ইন্ডাস্ট্রি পার্টনারশিপ স্থাপন হচ্ছে। এছাড়া ইন্ডাস্ট্রিগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় এগিয়ে এলে উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও গবেষণালব্ধ জ্ঞান বাস্তব জীবনে ব্যবহারযোগ্য হবে।
(দৈনিক বণিক বার্তা থেকে সংগৃহীত)

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ