আজকের শিরোনাম :

যে কারণে নাগরিকত্ব নিয়ে শঙ্কায় আসামের বাংলাভাষীরা

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০১৮, ১২:০২

ঢাকা, ২৮ জুলাই, এবিনিউজ : ‘আমরা ৩০ জুলাইয়ের জন্য দুরুদুরু বক্ষে অপেক্ষা করছি। শুধু আমরা অসমীয়া বাঙালিরা নই, অন্য অনেক গোষ্ঠীর মানুষই অপেক্ষা করে আছে ওই দিনটার জন্য।’

আগামী সোমবার প্রকাশিত হবে জাতীয় নাগরিক পঞ্জীর চূড়ান্ত খসড়া, যা নিয়ে আসামের কয়েক লাখ বাংলাভাষী হিন্দু-মুসলমান আশঙ্কায় আছেন যে, তাদের নাম ওই তালিকায় থাকবে কিনা।

বরাক উপত্যকায় শিলচর শহরের বাসিন্দা এবং আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন। তার আশঙ্কার কথা।

তার মতোই আগামী সোমবার ৩০ জুলাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছেন রাজ্যের একেবারে অন্য প্রান্তে, বাকসা জেলার শালবাড়ির বাসিন্দা, ছাত্র নেতা ইব্রাহিম আলিও অপেক্ষায় আছেন সেই দিনটার জন্য।

তিনি বলেন, ‘আমরা তো আশঙ্কায় আছি ওই দিন অনেক ভারতীয় নাগরিকের নামও না নাগরিকপঞ্জী থেকে বাদ পড়ে যায়।’

আসাম রাজ্যে ১৯৫১ সালের পরে এই প্রথমবার নাগরিক পঞ্জী হালনাগাদ করা হচ্ছে। নাগরিক পঞ্জী থেকে কারো নাম বাদ যাওয়ার অর্থ, তাদের অদূর ভবিষ্যতে বিদেশি বলে চিহ্নিত করা হবে।

ভারতীয় নাগরিকত্ব খুইয়ে তারা অচিরেই পরিণত হবেন রাষ্ট্রবিহীন মানুষে।

ইতোমধ্যেই বিদেশি বলে বহু মানুষকে চিহ্নিত করেছে আসামের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালগুলো। প্রায় ৯০০ জন আটক রয়েছেন বন্দি শিবিরে।

বঙ্গাইগাঁও জেলার বাসিন্দা ও সারা আসাম বাঙালী ছাত্র যুব ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সম্রাট ভাওয়াল বলছিলেন, ‘এমন বহু মানুষকে বিদেশি বলে রায় দিয়েছে ট্রাইব্যুনালগুলো, যাদের সব নথিপত্র থাকা স্বত্ত্বেও শুধু শুনানির দিন হাজিরা দেয় নি বলে একতরফা রায় হয়ে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘পুলিশও আগে হাজিরার নোটিস দেয়নি, তাই এরা জানতেই পারেনি যে তাদের নামে ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়েছে। অথচ সেই পুলিশই বিদেশি রায় হওয়ার আধ ঘণ্টার মধ্যে লোককে খুঁজে বার করে থানায় ডেকে নিয়ে যায়। ছবি আর আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দেয়। অনেক মানুষ এভাবে বিদেশি বলে চিহ্নিত হয়ে গেছেন।’

হঠাৎ করে রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ার যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তার কারণ হলো, ৩১ ডিসেম্বর মাঝরাতে প্রকাশিত হওয়া আংশিক খসড়া নাগরিক পঞ্জী।

সাবেক উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য বলছিলেন, ওই তালিকা থেকে বাদ পড়েছিল বহু ভারতীয় নাগরিকের নাম, যার মধ্যে তার নিজের পরিবারের সদস্যদের নামও ছিল না।

তার কথায়, ‘এ যে আশঙ্কাটা তৈরি হয়েছে, তার যে একেবারে ভিত্তি নেই, তা তো নয়। ৩১ ডিসেম্বর যে আংশিক খসড়া প্রকাশ করা হয়েছিল, তার মধ্যে বহু সত্যিকারের ভারতীয় নাগরিকের নাম ছিল না। এদের অনেকেই পুরুষানুক্রমে আসামের বাসিন্দা এবং সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি। তবুও তাদের নামও যখন বাদ পড়ে, তখন আশঙ্কা তো থাকবেই সাধারণ মানুষের মধ্যে।’

আসামের জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে যে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে বিপুলসংখ্যক মানুষ আসামে ঢুকে পড়েছেন। এই কথিত বিদেশীদের চিহ্নিত করতেই জাতীয় নাগরিক পঞ্জী হালনাগাদ করার দাবী ওঠে।

কিন্তু খসড়া তালিকায় দেখা গেছে বহু ভারতীয় নাগরিকের নামও বাদ পড়েছে, যেমন শালবাড়ির বাসিন্দা ছাত্র নেতা ইব্রাহিম আলির গোটা পরিবারের নামই ওই খসড়া তালিকায় ছিল না।

ইব্রাহিম আলি বলেন, ‘এর আগে যখন এনআরসি [জাতীয় নাগরিক পঞ্জী] হয়েছিল ১৯৫১ সালে, সেখানে আমার দাদুর নাম ছিল। আমার দাদুর নাম ১৯৬৬ সালের ভোটার তালিকায় রয়েছে। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে জমির খাজনা দিয়েছি, তার রসিদ আছে। তবুও আমাদের গোটা পরিবারের কারো নাম আংশিক তালিকায় ওঠেনি।’

শুধু যে বাংলাভাষীদের নাম বাদ পড়েছিল ওই তালিকা থেকে তা নয়। বাদ গেছে অনেক অসমীয়া মানুষের নামও।

নাগরিক পঞ্জী হালনাগাদ করার পেছনে যে ছাত্র সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করছে, সেই অতি শক্তিশালী অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন বা আসুর প্রধান উপদেষ্টা সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্য বলছিলেন, ‘এটা ঠিকই, প্রথম খসড়া তালিকায় অনেক সত্যিকারের ভারতীয় নাগরিকের নাম বাদ গেছে। শুধু বাংলাভাষী নয়, অনেক অসমীয়া মানুষেরও নাম বাদ গেছে।’

তিনি বলেন, ‘আমার নিজের পরিবারের কিছু সদস্যের নামও ছিল না সেখানে। কিন্তু ওই আংশিক তালিকার পরে একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাওয়া হয়েছে, সত্যিকারের নাগরিক, যারা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে এসেছেন, তাদের নাম নিশ্চই চূড়ান্ত তালিকায় থাকবে। এতে বাংলাভাষী মানুষদের আতঙ্কিত হওয়ার কী আছে!’

তিনি আরও দাবি করছিলেন, আসু কখনই নাগরিক পঞ্জী হালনাগাদ করার দাবিটাকে বাঙালিবিরোধী বা মুসলমান বিরোধিতার জন্য করেনি। অবৈধ বাংলাদেশিদের চিহ্নিত করার জন্যই এ দাবি।

ভট্টাচার্যর সংগঠন আসুর নেতৃত্বেই ৮০-এর দশকে চলেছিল রক্তক্ষয়ী আসাম আন্দোলন, যার সমাপ্তি হয়েছিল ১৯৮৫ সালে আসাম চুক্তির মাধ্যমে।

ওই চুক্তির একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল নাগরিক পঞ্জী হালনাগাদ করার প্রতিশ্রুতি।

যেদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়, সেই ২৫ মার্চকে ভিত্তি তারিখ ধরা হয়, অর্থাৎ তার আগে পর্যন্ত যারা আসামে এসেছেন, তাদের বৈধ ভারতীয় বলেই ধরা হবে। তার পরে আসা মানুষদের ঘোষণা করা হবে অবৈধ বিদেশি।

চুক্তির প্রায় তিন দশক পরে শুরু হয় নাগরিক পঞ্জী হালনাগাদের সেই কাজ। প্রায় ৩ বছর ধরে ৪০ হাজার কর্মী অফিসার নাগরিক পঞ্জী হালনাগাদের কাজ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে।

আসামে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী প্রকাশের প্রধান অফিসার, প্রতীক হাজেলার কাছে বাংলাভাষীদের এই আশঙ্কার প্রসঙ্গ তুলে হাজেলা বলছিলেন, ‘আশঙ্কা তো তখনই তৈরী হয় যদি কারও প্রতি অবিচার করা হয়। এক্ষেত্রে যারা নাগরিকত্বের জন্য নথিপ্রমাণ পেশ করতে পারেননি, তাদের যদি তালিকার বাইরে রাখা হয়, তা হলে অবিচারটা হল কোথায়? তাই আশঙ্কাই বা কেন তৈরী হবে? চূড়ান্ত খসড়ার পরেও যদি কোনো সত্যিকারের ভারতীয়র নাম বাদ যায়, তিনি তো একমাসের মধ্যে আবারও দাবি পেশ করতে পারবেন!’

নাগরিক পঞ্জী প্রকাশ নিয়ে আসামের বাংলাভাষী মুসলমান-হিন্দুদের যে আশঙ্কা অমূলক সেই কথাটা বলছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা ও লেখক হিরণ্য কুমার ভট্টাচার্য।

কুমার ভট্টাচার্যর কথায়, ‘যারা আশঙ্কার কথা বলছে, নিশ্চই তাদের আশঙ্কার কোনো কারণ রয়েছে। যদি সত্যিই কেউ ভারতীয় নাগরিক হয়, তা হলে কেন তারা ভয় পাবে? তাদের তো আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। আসলে নাগরিক পঞ্জী নিয়ে এ আশঙ্কা, আতঙ্ক এগুলো একটা স্বার্থান্বেষী মহল তৈরি করছে।’

‘অসমীয়া বিরোধী একটা মহল তো সবসময়েই সক্রিয় যারা চায় না নাগরিক পঞ্জীর কাজ শেষ হোক। এই প্রক্রিয়া কখনই বাঙালীবিরোধী বা মুসলমান বিরোধী নয়।’

অন্যদিকে বাঙালি প্রধান বরাক উপত্যকার বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ মনে ঠিক বিপরীত ধারণাটাই রয়েছে।

আসাম পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান পল্লব ভট্টাচার্য  বলেন, আমরা বেশ কিছু এলাকা চিহ্নিত করেছি, যেখানে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে। আসামে বেশ কিছু মৌলবাদী শক্তি তো সক্রিয়। নাগরিক পঞ্জী নিয়ে সেই সব শক্তির পাশাপাশি ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকেও বেশ কিছু সংগঠন এ নিয়ে আসরে নেমেছে। তাদের সবাইকেই নজরে রাখা হয়েছে। সেনা, আধাসামরিক বাহিনী আর পুলিশবাহিনীকে প্রস্তুত করা হয়েছে।

এ ছাড়াও আমরা সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা সচেতনতা প্রচার চালাচ্ছি যে এন আর সি বেরুনো মানেই এটা নয় যে যাদের নাম বাদ যাবে তারা বিদেশি বলে চিহ্নিত হয়ে যাবে। দাবি পেশ করার একমাস সময় আছে, এটাও প্রচার করছি আমরা।
খবর বিবিসি বাংলা

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ