আজকের শিরোনাম :

স্বেচ্ছায় ২০০ বিষধর সাপের কামড় খেয়েছেন যিনি

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৯:৫১

বিশ্বে প্রতি পাঁচ মিনিটে একজন সাপের কামড়ে মারা যায়। সেই সাথে বাকি চারজন সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়। এ হিসাবে, প্রতি বছর বিশ্বে ৫৪ লাখ মানুষ বিষাক্ত সাপের কামড় খায়। বিষক্রিয়ায় মারা যায় ১ লক্ষ ৩৮,০০০ জন।

বিশ্বের যে কোনো বিষধর সাপের বিষকে অকার্যকর করে দেবে এমন এক অব্যর্থ ওষুধ তৈরির গবেষণায় নিজেকের উৎসর্গ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের সাবেক একজন ট্রাক-চালক টিম ফ্রেডি।

দু'শরও বেশিবার তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বেচ্ছায় বিষাক্ত সাপের কামড় খেয়েছেন।

কমপক্ষে ৭০০ বার সাপের বিষ শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে ঢুকিয়েছেন। সাপের বিষের প্রক্রিয়ার ভিডিও করে সেই ফুটেজ তিনি ইউটিউবে প্রকাশ করেছেন।

আজ (শনিবার) আন্তর্জাতিক সাপের কামড় বিষয়ক সচেতনতা দিবস উপলক্ষে বিবিসির সাথে কথা বলেছেন টিম ফ্রেডি।

তাৎক্ষণিক যন্ত্রণা

ইউটিউবে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, বিষধর একটি মাম্বার পরপর দুটো কামড় খেয়েই টিম ফ্রেডি ক্যামেরায় তার অভিজ্ঞতার কথা বলছেন। সে সময় তার হাত দিয়ে দরদর করে রক্ত ঝরছে।

বিবিসিকে তিনি বলেন, "ব্ল্যাক মাম্বা কামড়ালে সাথে সাথেই প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়ে যায়। আপনার মনে হবে এক হাজার মৌমাছি যেন আপনাকে একসাথে কামড়েছে।"

"একটি মৌমাছির হুলে বিষের পরিমাণ থাকে সাধারণত এক থেকে দুই মিলিগ্রাম। কিন্তু একটি মাম্বা কামড়ালে শরীররে ৩০০ থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম বিষ ঢুতে যেতে পারে।"

"কামড়ের পরপরই জায়গা ফুলে যায়। কতটা বিষ ঢুকেছে ফোলার মাত্রা দেখে দেখে আমি বুঝতে পারি। খুবই যন্ত্রণা হয়।"

ভয়ঙ্কর এবং অনৈতিক

কিন্তু তার ইউটিউব ফ্যানরা যতটা উচ্ছ্বসিত, সবাই ততটা নয়। লিভারপুল স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ড স্টুয়ার্ট এইনসওয়ার্থ বিবিসিকে বলেন, "বুঝতে পারিনা কেন কিছু মানুষ এগুলো করে। প্রথমত, এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, তাছাড়া এটা অনৈতিক। আমরা এরকম মানুষের সাথে কাজ করিনা।"

বিশ্বের যে সব প্রতিঠান নতুন অভিন্ন একটি বিষ কাটানোর ওষুধ তৈরির চেষ্টা করছে, ব্রিটেনের লিভারপুলের এই প্রতিষ্ঠান তাদের একটি।

সাধারণত নতুন কোনো ওষুধ গবেষণাগারে ইঁদুর বা অন্য কোনো প্রাণীর ওপর প্রয়োগ করা হয়। যখন তা কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়, তখনই তা নিয়ন্ত্রিত একটি পরিবেশে মানুষের ওপর পরীক্ষা করা হয়।

"কিন্তু এ ধরণের প্রক্রিয়ায় (টিম ফ্রেডি যা করছেন) মানুষের মৃত্যু হতে পারে। এটা করা উচিৎ নয়।"

কিন্তু ওষুধ শিল্পে সাপের বিষ প্রতিরোধী ওষুধ নিয়ে গবেষণায় সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাব রয়েছে।

ব্রিটেন ভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ওয়েলকাম ট্রাস্ট, যারা সাপে কাটার চিকিৎসায় নতুন একটি ওষুধ তৈরির জন্য গবেষণা করছে, তাদের মতে "উৎপাদন, নিরাপত্তা এবং ওষুধের কার্যকারিতার ব্যাপারে আন্তর্জাতিকভাবে অভিন্ন কোনো মানদন্ড নেই। "

জীবনের ঝুঁকি

সোশ্যাল মিডিয়াতে জনিপ্রয়তা পেতে তিনি নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলছেন - এই অভিযোগ নাকচ করেছেন ফ্রেডি।

"শুধু ইউটিউব ভিডিও বানানোর জন্য আমি এটা করিনি। আমি জীবন বাঁচাতে চেয়েছি। যাদের সাথে আমি কাজ করবো এমন চিকিৎসক খুঁজে পাওয়ার জন্য আমি ইউটিউবকে ব্যবহার করেছি। আমি এক ধরণের বাজি ধরেছিলাম যেটা কাজে লেগেছে।"

বিশ্বের সাপের প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৩০০০। এদের মধ্যে দুশ'র মতো প্রজাতি এতটাই বিষধর যে তারা কামড়ালে মানুষের মৃত্যু হতে পারে বা মানুষ অঙ্গ হারাতে পারে।

বিষধর এই প্রজাতির অনেকগুলোর সাথেই পরিচিত ফ্রেডি।

কেউটে হোক, ভাইপার হোক বা ব্ল্যাক মাম্বা, গত ২০ বছরে তিনি দুশ' বারেরও বেশি স্বেচ্ছায় বিষধর এসব সাপের কামড় খেয়েছেন।

এছাড়া, ৭০০ বার বিভিন্ন সাপের বিষ শরীরে ইনজেক্ট করেছেন।

সাপে কামড়ালে শরীরে কত বিষ ঢুকবে তার পরিমাণ একেক সময় একেক রকম। কখনো কখনো সাপ কামড়ালেও বিষ ছাড়েনা। কী পরিমাণ বিষে কেমন প্রতিক্রিয়া তা বুঝতে ইনজেকশন করে শরীরে বিষ প্রয়োগের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

"আপনার শরীর যদি ব্ল্যাক মাম্বার মত সাপের বিষ-প্রতিরোধী না হয়, তাহলে এটা আপনার স্নায়ুতন্ত্রকে আঘাত করবে। আপনি শ্বাস নিতে পারবেন না, আপনার চোখ বন্ধ হয়ে আসবে। কথা বলতে পারবেন না, এবং ধীরে ধীরে আপনি অসাড় হয়ে পড়বেন। কিন্তু একইসাথে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আপনি সবকিছু বুঝতে পারবেন," ফ্রেডি বলেন।

কেউটের কামড় সাংঘাতিক

ফ্রেডি তার বাড়িতে বেশ কয়েক প্রজাতির বিষধর সাপ রাখেন, এবং তাদের কামড় খেয়ে প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করেন।

"আমার কাছে আফ্রিকান জল কেউটে রয়েছে। এর কামড় ভয়াবহ।" জল কেউটের বিষে দেহের স্নায়ুতন্ত্র অবশ করে ফেলে।

"অন্য কিছু জাতের কেউটে সাপের বিষে সাইটোটক্সিন থাকে যার ফলে অঙ্গহানি হতে পারে।"

একটি তত্ব রয়েছে যে ধীরে ধীরে শরীরে বিষের মাত্রা বাড়ালে, শরীর একসময় বিষ-প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। ফ্রেডি সেটাই অনুসরণ করছেন। কবে অনেক বিজ্ঞানী এই তত্ব গ্রহণ করেন না।

শরীরকে বিষ প্রতিরোধী করে তোলা

বর্তমানে যে একটি মাত্র সাপের বিষ কাটানোর ওষুধ রয়েছে, জীবজন্তুর শরীরে এই তত্ব প্রয়োগ করেই তা তৈরি হয়।

উনবিংশ শতাব্দী থেকে অ্যান্টি-ভেনম বা সাপের বিষ প্রতিরোধক ওষুধ তৈরির প্রক্রিয়ায় কোনো পরিবর্তন হয়নি।

ঘোড়া বা ভেড়ার শরীরে স্বল্প মাত্রায় সাপের বিষ ঢুকিয়ে সেই রক্ত থেকে অ্যান্টিবডি বা বিষ প্রতিরোধক রাসায়নিক সংগ্রহ করা হয়।

"সাপ আমাকে হত্যা করতে চায়, কিন্তু আমি মরতে চাইনা। সুতরাং আমি আসলে এখানে ঘোড়ার ভুমিকা পালন করছি। ঘোড়ার মত আমরা কেন নিজেদের শরীরকে বিষ প্রতিরোধী করে তুলতে পারিনা?" - ফ্রেডির প্রশ্ন।

৫২ বছর বয়সী সাবেক এই ট্রাক ড্রাইভার কোনো বিজ্ঞানী নন। কখনো তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাননি। কিন্তু সাপের কামড়ে মৃত্যুর ভীতি থেকে গত ২০ বছর ধরে তিনি ব্যতিক্রমী এই কাজে লিপ্ত হয়েছেন।

প্রথমে তিনি পরীক্ষা শুরু করেন মাকড়সা এবং বিছা দিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে কেউটে সাপ এবং ব্ল্যাক মাম্বা সাপ নিয়ে কাজ শুরু করেন।

তার শরীরে এখন অনেক ক্ষত। কয়েকবার মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছেছিলেন।

"প্রায় ১২ বার আমাকে কঠিন সঙ্কটে পড়তে হয়েছে। প্রথম বছরে দুটো কেউটের কামড়ে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আপনাকে শিখতে হবে। কোনো ডাক্তার বা বিশ্ববিদ্যালয় এটা আপনাকে শেখাতে পারবে না।"

দু-বছর আগে টিম ফ্রেডির এই ইউটিউব ভিডিও নজর কাড়ে প্রখ্যাত রোগতত্ববিদ জেকব গ্ল্যানভিলের।

মি. গ্ল্যানভিল ওষুধ নির্মাতা ফাইজারের প্রিন্সিপ্যাল বিজ্ঞানী ছিলেন। চাকরি ছেড়ে নিজেই অ্যান্টি-ভেনম তৈরির জন্য কোম্পানি খুলেছেন।

তিনি বলেন, "টিম যা করছে তা অসামান্য। কিন্তু এটা বিপজ্জনক। এটা করার জন্য আমি অন্য কাউকে পরামর্শ দেবো না।"
ফ্রেডির রক্তের নমুনা ব্যবহার করে নতুন একটি অ্যান্টি-ভেনম তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছে মি. গ্ল্যানভিলের কোম্পানি। বিবিসি

এবিএন/মমিন/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ