আজকের শিরোনাম :

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

শ্বেতাঙ্গ চরমপন্থা দমনকে কি অবহেলা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ আগস্ট ২০১৯, ১১:২৯ | আপডেট : ০৭ আগস্ট ২০১৯, ১১:৪৫

এল পাসোতে বন্দুকধারীর গুলিতে ২২ জন নিহত হওয়ার ঘটনাকে ‘অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদ’ ধরে নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে মার্কিন কর্তৃপক্ষ।

এ ধরনের সন্ত্রাসী হুমকি কতটা ভয়াবহ এবং যুক্তরাষ্ট্র আসলে একে কীভাবে প্রতিহত করছে?

পুলিশের ধারণা, সন্দেহভাজন শ্বেতাঙ্গ হামলাকারী প্যাট্রিক ক্রুসিয়াস একটি হিসপ্যানিক সংখ্যাগরিষ্ঠ শহরে এ হামলা চালানোর আগে ট্রেক্সাসে কয়েকশ মাইল গাড়ি চালিয়ে এসেছে।

ধারণা করা হচ্ছে, গুলির ঘটনার কয়েক মিনিট আগে প্রকাশিত একটি নথি, যেখানে বলা হয়েছে ‘টেক্সাসে হিসপ্যানিকদের আগ্রাসনের প্রতিশোধ এটি’ সেটিও তারই রচনা।

এক বিবৃতিতে এফবিআই বলছে, ‘এ হামলা অভ্যন্তরীণ চরমপন্থি এবং হেট ক্রাইমের পরিকল্পনাকারীদের থেকে উদ্ভূত চলমান হুমকিকে সামনে নিয়ে এসেছে।’

এতে আরও বলা হয়, আশঙ্কা রয়েছে যে, ‘এটি এবং এর আগে ঘটে যাওয়া বড় ধরনের হামলা দেখে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অভ্যন্তরীণ সহিংস চরমপন্থিরা ভবিষ্যতে একই ধরনের হামলা চালাতে উৎসাহিত হতে পারে।’

গত মাসে, এফবিআই বলেছিল, এ ধরনের সহিংসতা বেড়েই চলেছে এবং এর বেশিরভাগই হয়েছে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে।

এ সমস্যাটা আসলে কত ব্যাপক?
হেট ক্রাইমের বিষয়ে নজরদারি করা সংস্থা অ্যান্টিডিফেমেশন লিগ-এডিএল বলছে, ২০১৮ সালে ডানপন্থি চরমপন্থিরা কমপক্ষে ৫০টি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল, যা ১৯৯৫ সালের পর সবচেয়ে বেশি ডানপন্থি সহিংসতার ঘটনা সম্বলিত বছর করেছে ২০১৮ সালকে।

এডিএলের গবেষকরা বলছেন, চরমপন্থিদের হাতে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশই করেছে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

এল পাসো শহরে হামলার অনেক আগে থেকেই ডানপন্থি গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা তাদের অনলাইন যোগাযোগ কিংবা আদর্শগত ঐকমত্যের মাধ্যমে যে সব সহিংসতার ঘটনা ঘটিয়ে থাকে তা দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে বড় বড় শিরোনামে প্রকাশিত হয়।

গত এপ্রিলে ক্যালিফোর্নিয়ার পোওয়ের একটি সিনাগগে এক নারীকে হত্যা করা হয়। এর আগে গত বছর পিটসবার্গে আরেক সিনাগগে হামলায় নিহত হয় আরো ১১ জন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এ হত্যাকারীদের মধ্যে একটি সাধারণ আদর্শগত, সহিংস, গোঁড়া এবং ঘৃণার মতো বিষয়ে একই ধরনের বিশ্বাস রয়েছে। আর এসব হামলার উস্কানি মিলেছে ফোরচ্যান এবং এইটচ্যানের মতো অনলাইন কমিউনিটিতে যোগাযোগের মাধ্যমে যেখানে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদ এবং অন্যান্য উগ্র বর্ণবাদ নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করা যায়।

মার্কিন কর্তৃপক্ষ কি যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে?
এফবিআই বলছে, এ ধরনের গ্রুপগুলো থেকে উদ্ভূত হুমকির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে তাদের তদন্ত।

গত জুলাইয়ে, এফবিআইয়ের পরিচালক ক্রিস্টোফার রে মার্কিন সিনেটের বিচারক কমিটির সদস্যদের বলেন, গত নয় মাসে অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদের ঘটনায় বেশ কিছু মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

রে বলেন, এ ঘটনাগুলোকে দুটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। যার একটি হচ্ছে ‘স্বদেশী সহিংস উগ্রবাদ’ যেটি তিনি এবং এফবিআই এজেন্টরা ব্যবহার করেন বিশেষ ধরনের ব্যক্তিদের বোঝাতে যারা ‘বৈশ্বিক জিহাদি’ এবং ‘অভ্যন্তরীণ চরমপন্থি’ গ্রুপগুলো দ্বারা প্রভাবিত। আর তাদের মধ্যে রয়েছে ‘শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের কোনো ধারণা দ্বারা উদ্বুদ্ধরাও’।

‘বৈশ্বিক জিহাদ’ এবং ‘শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ’ ধারনায় অনুপ্রাণিতসহ প্রত্যেক ক্যাটাগরিতে অন্তত ১০০ জন করে ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে এফবিআই এজেন্টরা, তিনি বলেন।

তবে এফবিআইয়ের কাজ সম্পর্কে রে-এর এমন বিশ্লেষণে অনেকেই একমত হতে পারেননি। তারা বলছেন যে, গত কয়েক মাসে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের এই সংখ্যার বাইরে ডান-পন্থী চরমপন্থা দমনে এফবিআই এবং অন্যান্য সরকারি কর্তৃপক্ষ তেমন নজর দেয়নি।

এই সমালোচকরা বলছেন, মার্কিন সরকারি কর্তৃপক্ষ শুধু ‘জিহাদিদের’ ধরতেই অতিরিক্ত মনোযোগ দিয়েছে। আর এই সুযোগে, শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী গ্রুপগুলোকে দমনে পিছিয়ে পড়েছে তারা।

‘ইসলামি সন্ত্রাসবাদ যতটা গুরুত্ব পেয়েছে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী সন্ত্রাস তেমন গুরুত্ব পায়নি,’ বলেন ডার্টমাউথ কলেজের ড্যানিয়েল বেনজামিন। তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের সন্ত্রাসবিরোধী সমন্বয়ক হিসেবে ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন।

‘এফবিআই এবং পরে ডিএইচএস (মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ) জিহাদিদের কাছ থেকে আসা হুমকির প্রতিই বেশি দৃষ্টিপাত করেছে এবং এর ফলে অদেখা থেকে গেছে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের থেকে উদ্ভূত হুমকি।’

৯/১১’র ঘটনা
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আল-কায়েদার হামলার পর, ওয়াশিংটনের কর্মকর্তারা সন্ত্রাস বিরোধী কার্যক্রমে বিপুল পরিমাণ পুঁজি নিয়োগ করেছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা স্টিমসন সেন্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র ২০০২ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত অর্থবছরে শুধু সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমে ২ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে। যার উদ্দেশ্য ছিল সামরিক ও অন্যান্য মাধ্যমে আসা চরমপন্থিদের সহিংসতা রুখে দেয়া।

এ অর্থের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে মানুষকে সুরক্ষিত রাখতে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগেই খরচ করা হয়েছে ৩৫ ভাগ বা ৯৭৯ বিলিয়ন ডলার।

বিশ্লেষকদের মতে, আল-কায়েদা এবং কথিত ইসলামিক স্টেট এর হুমকি রুখতে যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে তা প্রমাণ করে যে অন্য উৎস থেকে আসা হুমকিকে তেমন কোনো পাত্তা দেয়া হয়নি। তবে তখনও শ্বেতাঙ্গ চরমপন্থি গ্রুপগুলো থেকে হুমকি বেড়েই চলছিল।

‘যেটা বোঝা যাচ্ছে তা হলো ইসলামি চরমপন্থার বিষয়ে প্রচণ্ড ধরণের কঠোরতা গ্রহণ করেছি আমরা,’ বেনজামিন বলেন।

তিনি বলেন, যখনই কর্তৃপক্ষ খোঁজ পায় যে, কোন ব্যক্তির আন্তর্জাতিক জিহাদি গ্রুপের সাথে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, তখনই তাকে নজরদারির আওতায় আনা হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে সিনাগগ গুলোতে হামলা, ডানপন্থী চরমপন্থা গ্রুপগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা হামলা কর্তৃপক্ষকে সেভাবে নাড়া দিতে পারেনি যতটা অতীতে জিহাদি গ্রুপগুলো দিয়েছিল। ‘দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, অনেক মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলির ঘটনাগুলোকে আমেরিকা বাসীদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হিসেবেই ধরা হয়,’ তিনি বলেন। ‘আর এসব হামলার পেছনের আদর্শগত মতটাকে তেমন গুরুত্বই দেয়া হয়না।’

তিনি বলেন, আরেকটি বিষয় রয়েছে যা কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে নীরব থাকতে সাহায্য করে। আর তা হল এই দেশে অন্তর্নিহিত চলমান বর্ণবাদের ধারা। ‘কর্মকর্তারা তাদেরই মতো দেখতো কারো কাছ থেকে উদ্ভূত হুমকি মোকাবেলা করতে অভ্যস্ত নয় এবং তারা সবসময় বাইরের কেউ বা কোন পক্ষের কাছ থেকে হুমকি মোকাবেলাতেই অভ্যস্ত। যাই হোক, গৃহযুদ্ধের আগে থেকে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ আমেরিকার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অংশ হিসেবে চলে আসছে।’

‘এটা ভয়ঙ্কর,’ তিনি বলেন। এটা ‘মর্মঘাতী’।

এই মতের সঙ্গে একমত হওয়ার কথা জানিয়েছেন এফবিআইয়ের সাবেক গোপন এজেন্ট ও নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রেনান সেন্টারের মাইক জার্মান।

তিনি বলেন, এফবিআই ‘সব সন্ত্রাসকে সমান গুরুত্ব দিয়ে গণ্য করেনি’। তিনি বিশ্লেষণ করে বলেন যে, এজেন্টদের মূল লক্ষ্যই ছিলো মুসলিম এবং মুসলিম-আমেরিকানরা। কিন্তু, এই সুযোগে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের প্রাণঘাতী বড় হুমকি অবহেলাতেই থেকে গেছে।’

হুমকির পরিবর্তনশীল রূপ
৯/১১ হামলার অনেক আগে থেকেই সবচেয়ে শক্তিশালী ডানপন্থী চরমপন্থিদের সংগঠনগুলো যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে। এই গ্রুপগুলোর মধ্যে একটি হল স্টর্মফ্রন্ট যেটিকে বিশ্লেষকরা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের একটি ওয়েবসাইট হিসেবে বর্ণনা করে থাকেন সেটি তৈরি করা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে।

২০১৫ সালে চার্লস্টনে একটি গির্জায় হামলা চালিয়ে ৯ জনকে মেরে ফেলার ঘটনার বন্দুকধারী ডিলান রুফ ওই ওয়েবসাইট থেকে হামলার অনুপ্রেরণা পায় বলে জানিয়েছিলো। দ্য ডেইলি স্টর্মার নামে আরেকটি সাইটও চলছে বছরের পর বছর ধরে।

কিন্তু সম্প্রতি, ডানপন্থী এবং শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের গ্রুপগুলোর জনপ্রিয়তা এবং শক্তিতে বেশ বেড়েছে এবং নতুন যোগ দেয়া সদস্যদের মৌলবাদের দীক্ষা দেয়ার বিষয়টিও বেড়েছে নাটকীয়ভাবে।

এর আগে কাউকে মৌলবাদী করে তুলতে হলে মাসের পর মাস কিংবা বছরের পর বছর সময় লাগতো। এখন, তিনি বলেন, ‘এটা মাত্র কয়েক সপ্তাহে হয়ে যাচ্ছে।’ এর ফলে মার্কিন সরকারি কর্মকর্তাদের পক্ষে সহিংসতার পরিকল্পনা এর পেছনের মূল হোতাকে খুঁজে বের করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।

এখন কি হবে?
ডানপন্থি চরমপন্থিদের হুমকি মোকাবেলায় মার্কিন কর্তৃপক্ষ তৈরি কিনা এমন প্রশ্নও দেখা দিয়েছে অনেকের মধ্যেই।

অনেকে বলেছেন যে, এই চ্যালেঞ্জের বেশ ভালোভাবেই মোকাবেলা করছে কর্তৃপক্ষ। ‘এফবিআই খুব ভালো কাজ করছে,’ বলেন ব্রিটেনের পররাষ্ট্র গোয়েন্দা সংস্থার এমআইসিক্স এর বৈশ্বিক সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের সাবেক পরিচালক রিচার্ড বেরেট। ‘এসব গ্রুপের ওপর কড়া নজর রাখছে তারা-আর এটা বেশ আগে থেকেই করছে তারা।’

মার্কিন সরকারি কর্তৃপক্ষ এল পাসোর গুলির ঘটনাকে অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদ ধরে নিয়েই তদন্ত করছে। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডানপন্থী চরমপন্থিদের দমনের চেষ্টা করছে তারা। এরইমধ্যে অনলাইনে এ ধরণের একটি সার্ভিস বন্ধ করে দিয়েছে তারা।

গত সোমবার এল পাসো হামলার পর আরও কঠোর বাক্য উচ্চারণ করেছেন ট্রাম্প। ‘এক সাথে আমাদের বর্ণবাদ, ধর্মান্ধতা আর শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের নিন্দা জানানো উচিত,’ তিনি বলেন। যদিও এই কয়েকটি শব্দ বলতে তিনি ২৪ ঘণ্টা সময় নিয়েছেন।

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ