আজকের শিরোনাম :

ইতিহাসের সাক্ষী: জেরুসালেমে ইহুদী গোষ্ঠীর প্রথম সন্ত্রাসবাদী বোমা হামলা

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৬ মে ২০১৯, ২১:৫৪

১৯৪৬ সালের ২২শে জুলাই। পবিত্র নগরী জেরুসালেমের নামকরা একটি হোটেল, কিং ডেভিড হোটেল। প্যালেস্টাইন তখন ব্রিটিশ শাসনের অধীন।

সেদিন মধ্য দুপুরে বিকট বিস্ফোরণে কেঁপে উঠলো জেরুসালেম। প্রচন্ড শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণে ধসে পড়লো হোটেলের একটি অংশ। নিহত হলো মোট ৯১ জন।

মধ্যপ্রাচ্যে বড় আকারে প্রথম পরিকল্পিত সন্ত্রাসী হামলা এটি। আর এই হামলাটি চালিয়েছিল একটি ইহুদী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী, যারা ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই চালাচ্ছে তখন।

প্যালেস্টাইনে ব্রিটিশ প্রশাসনের সদর দফতর ছিল এই হোটেলেই। সেদিনের হামলার সময় ঐ হোটেলেই ছিলেন একজন মহিলা, সুশানা লেভি ক্যাম্পোস। সেদিন তিনি প্রাণে বেঁচে যান। বিবিসির মাইক লানচিনের কাছে সেই হামলার স্মৃতিচারণ করেছেন তিনি।

বিবিসির তৎকালীন রিপোর্টে এই ঘটনাকে বর্ণনা করা হয়েছিল প্যালেস্টাইনে ব্রিটিশ প্রশাসনের ওপর এক 'সন্ত্রাসবাদী হামলা' হিসেবে। সাত তলা কিং ডেভিড হোটেলের একটি কোণা পুরোপুরি ধসে পড়েছিল সেই হামলায়।

সুশানা লেভি ক্যাম্পোস ৭০ বছরেরও বেশি আগের ঐ ঘটনার কথা এখনো পরিস্কার মনে করতে পারেন।

"সব কিছু অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম না কি ঘটেছিল। তখন আমার মাথায় আর কিছু কাজ করছিল না। শুধু ভাবছিলাম, কিভাবে এখান থেকে বের হবো।"

হামলাটি চালিয়েছিল একটি সশস্ত্র ইহুদী গোষ্ঠী 'ইরগুন।' ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের জন্য লড়াই করছিল এই গোষ্ঠীটি।

নিহতদের মধ্যে ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ এবং হোটেলের কর্মীরা। সুশানা লেভি ক্যাম্পোস সামান্য আঘাত নিয়ে সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হন।

সুশানা এবং তার বাবা-মা ১৯৩০ এর দশকের মাঝামাঝি জার্মানি থেকে জেরুসালেমে চলে আসেন। জার্মানিতে তখন হিটলারের নাৎসীবাদের উত্থান ঘটছে।

বাবা-মা'র সঙ্গে সুশানা যখন জেরুসালেমে আসেন, ইসরায়েল রাষ্ট্র তখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে প্যালেস্টাইনে ইহুদীদের জনসংখ্যা তখন বাড়ছিল। সেই সঙ্গে বাড়ছিল ইহুদীদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ।

তবে তখনকার ব্রিটিশ সরকারের নীতি ছিল কিভাবে প্যালেস্টাইনে ইহুদীদের অভিবাসন সীমিত রাখা যায়। ব্রিটিশদের এই নীতি ইহুদীদের ক্ষিপ্ত করে তোলে। ব্রিটিশরা হয়ে ওঠে তাদের আক্রমণের টার্গেট।

অগ্নিসংযোগ, খুন এবং ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ তখন জেরুসালেমের পবিত্র ভূমিকে পরিণত করেছে এক বিপদজনক জায়গায়। জেরুসালেম হয়ে উঠে সন্ত্রাসের জনপদ। বেথলেহেম থেকে জেরুসালেম পর্যন্ত তখন রাস্তায় টহল দিচ্ছে সাঁজোয়া গাড়ি।

"তখন জেরুসালেমে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। আমি ঘরের বাইরে যেতে পারছিলাম না। রাস্তায় সারাক্ষণ টহল দিচ্ছে ব্রিটিশ সেনা, ব্রিটিশ পুলিশ।"

সুশান লেভি ক্যাম্পোস মনে করে করেন, রাস্তায় ব্রিটিশ সেনা আর পুলিশের উপস্থিতি বরং তাদের মধ্যে একটা নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করেছিল।

"ব্রিটিশরা আমাদের সাহায্য করছিল না। তারা ছিল আমাদের বিপক্ষে। কাজেই আমরা ব্রিটিশদের দেশছাড়া করতে চাইছিলাম।"

তবে মনে-প্রাণে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধী হলেও সুশানা প্যালেস্টাইনের ব্রিটিশ প্রশাসনেই চাকুরি করছিলেন। কিং ডেভিড হোটেলে ছিল ব্রিটিশ প্রশাসনের সদর দফতর। সেখানে তিনি টাইপিস্টের কাজ করতেন।

ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের 'ডিকটেশন' নেয়ার জন্য ঘন ঘন ডাক পড়তো সুশানার। তিনি শর্টহ্যান্ডও জানতেন। তবে ব্রিটিশ কর্তাদের অনেকেও ছিলেন ধর্মে ইহুদী। কাজেই সেরকম কোন সমস্যা হতো না।

সুশানার কাজ ছিল বেসামরিক দফতরে। কিন্তু সেই হোটেলেই ছিল আবার ব্রিটিশ প্রশাসনের সামরিক দফতরও। হোটেলটির বেজমেন্ট বা ভূগর্ভস্থ কক্ষে ছিল সামরিক দফতরের টেলিফোন এক্সচেঞ্জ। হোটেলের সংলগ্ন একটি ভবনও ছিল ব্রিটিশ সামরিক পুলিশের দখলে।

সব কিছু মিলিয়ে ইহুদী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর কাছে এই হোটেল হয়ে উঠেছিল হামলার অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু।

২২ জুলাই, ১৯৪৬। ঘড়ির কাঁটা মাত্র দুপুর বারোটার ঘর পেরিয়েছে। সুশানা হোটেলের অফিসে নিজের টেবিলে কাজে ব্যস্ত। তারপর যেন হঠাৎ দুনিয়ায় একটা ওলট-পালট ঘটে গেল।

"আমি আমার জায়গা থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ একটি বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শুনি। তারপর একেবারে অন্ধকার। আমি কিছুই দেখিনি আর। সব যেন নিস্তব্ধ। একটু পরে শুনি কেউ যেন কাশছে। আমার মনে হলো, সবাই বুঝি মারা গেছে।"

"তারপর আমি করিডোর ধরে হেঁটে যেতে লাগলাম। একটা জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। জানালাটি ছিল একটু নীচের দিকে। সেখান দিয়ে লাফ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব। পুরো হোটেলের চার পাঁচ তলা জুড়ে যে ধ্বংসযজ্ঞ সেটা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম।"

বোমা হামলার পর পুলিশ সেনবাহিনী সেখানে বুলডোজার, ক্রেন, শাবল-গাঁইতি দিয়ে উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছিল। যারা ধ্বংসস্তুপের নীচে চাপা পড়েছিল, তাদের উদ্ধারের চেষ্টা করছিল।

"আমি জানতাম নিহতের সংখ্যা হবে অনেক। আমি কাঁদতে শুরু করলাম। আমার বস মিস্টার জ্যাকব ছিলেন একজন ইহুদী ব্রিটিশ। তিনি ছিলেন খুবই ভালো মানুষ। ঐ হামলায় তিনি মারা যান।"

"আমার বাবা এর মধ্যে খবর পেলেন যে কিং ডেভিড হোটেলে হামলা হয়েছে। তিনি জানতেন, আমি এই হোটেলেই কাজ করি। আমি যখন দৌড়ে বেরিয়ে আসলাম, তখন আমার অনেক প্রতিবেশী আমাকে দেখেছিলেন। তারা আমার বাবাকে গিয়ে বললেন, আপনার মেয়ে বেঁচে আছে, আপনার মেয়ে বেঁচে আছে।"

সুশানা প্রাণে বেঁচে গেলেন। খুব বেশি আঘাতও তার লাগেনি। তবে পরবর্তীকালে তাকে প্রচন্ড মাথাব্যথায় ভুগতে হয়েছিল। সব মিলিয়ে সেদিন ৯১ জন সেখানে নিহত হয়েছিল। এদের বেশিরভাগই ছিলেন ব্রিটিশ প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং কর্মচারী। নিহতের ৪১ জন ছিলেন আরব, আর ২৮ জন ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক।

হামলাটি চালিয়েছিল যে সশস্ত্র ব্রিটিশ গোষ্ঠী, তাদের নাম 'ইরগুন।' কিং ডেভিড হোটেলে তারা বোমা বানানোর বিস্ফোরক চালান করেছিল দুধের বোতলের বাক্সের ভেতর লুকিয়ে। পুরো হোটেলটি দাঁড়িয়ে ছিল যেসব পিলার বা স্তম্ভের ওপর, তারা বোমাগুলো রেখেছিল সেসবের কাছাকাছি।

'ইরগুন' পরে দাবি করেছিল, তারা এরকম বোমা হামলার আগাম সংকেত দিয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশরা সেই সংকেত উপেক্ষা করে। তবে এটি নিয়ে বিতর্ক আছে।

যারা এই কাজ করেছিল, তাদের ব্যপারে সুশানা কি ভাবেন?

"আমি তাদের এই কাজে মোটেই খুশি নই। আমি খুবই ক্রুদ্ধ ছিলাম। তারা ব্রিটিশদের তাড়াতে চাইছিল। কিন্তু তারা যেভাবে এই কাজ করছিল, সেটা সঠিক পথ ছিল না।"

কিং ডেভিড হোটেলের ওপর এই হামলা ব্রিটেনে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি করে। এর ব্যাপক নিন্দা করা হয়।

প্যালেস্টাইনে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সন্দেহভাজনদের ব্যাপক হারে আটক করতে শুরু করে।

কিন্তু ঐ অঞ্চলে তখন দ্রুত অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে।

এ ঘটনার এক বছর পর জাতিসংঘ প্যালেস্টাইনকে বিভক্ত করে ইহুদী এবং ফিলিস্তিনিদের জন্য দুটি পৃথক রাষ্ট গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়, জেরুসালেমের ওপর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়।

জাতিসংঘের এই সিদ্ধান্তের জের ধরেই শুরু হয় মধ্যপ্রাচ্যে এক দীর্ঘমেয়াদী সংঘাত।

বোমা হামলার পরও সুশানা ব্রিটিশ প্রশাসনে তার চাকুরি করে যাচ্ছিলেন। তবে ১৯৪৮ সালে যখন ইসরায়েল স্বাধীনতা ঘোষণা করে, ব্রিটিশরা প্যালেস্টাইন ছেড়ে চলে আসে।

সুশানার বয়স এখন ৯০ এর কোঠায়। থাকেন এখন তেল আভিভে। কিন্তু ১৯৪৬ সালের ঐ বোমা হামলার ঘটনা তিনি ভুলতে পারেন না। বিবিসি

এবিএন/মমিন/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ