আজকের শিরোনাম :

পাকিস্তানে শিয়ারা কেন ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাচ্ছে?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০২ জুন ২০১৮, ১৩:১৬

ঢাকা, ০২ জুন, এবিনিউজ : ক্লোস সার্কিট ক্যামেরা থেকে নেয়া উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে ৩০ বছর বয়সী নাঈম হায়দারের দুই হাত পেছনে হাতকড়া লাগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

একটি মসজিদের ক্লোস সার্কিট ক্যামেরা থেকে এ ছবিটি নেয়া হয়েছে।

ছবিতে দেখা যাচ্ছে, কিছু ব্যক্তির মুখে মুখোশ লাগানো এবং কিছু পুলিশের পোশাকে রয়েছে।

এটা ২০১৬ সালের ঘটনা এর পর থেকে মি: হায়দারের আর কোন খোঁজ নেই।

ক্লোস সার্কিট ক্যামেরার ছবি থাকা সত্ত্বেও পুলিশ এবং অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা আদালতে বলেছে যে মি: হায়দার তাদের হেফাজতে নেই।

গত দুই বছর ধরে যে ১৪০ জন শিয়া নিখোঁজ হয়েছে মি: হায়দার তাদের মধ্যে অন্যতম।

শিয়া অধিকার কর্মীরা এ তথ্য দিচ্ছে। তাদের পরিবার বিশ্বাস করে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের উঠিয়ে নিয়ে গেছে।

মি: হায়দারসহ নিখোঁজ ১৪০ জন শিয়া মতাবলম্বীর মধ্যে ২৫ জন করাচীর বাসিন্দা।

মি: হায়দারের পরিবার বলছে, নিখোঁজ হবার দুই দিন আগে সে এবং তাঁর গর্ভবতী স্ত্রী উজমা হায়দার ইরাকের কারবালা থেকে পাকিস্তানের করাচীতে ফিরে এসেছিল।

ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের জন্য তারা কারবালায় গিয়েছিল।

মি: হায়দার নিখোঁজ হবার পর তাঁর স্ত্রী একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। সে শিশু এখনো তার বাবাকে দেখেনি।

উজমা হায়দার বিবিসিকে বলেন, " আমার সন্তানরা সবসময় আমাকে জিজ্ঞেস করে, তাদের বাবা কখন বাড়িতে আসবে? আমি তাদের কী উত্তর দেব? কেউ আমাদের বলছে না তিনি কোথায় আছেন?কেমন আছেন? তাঁর অপরাধ কী? সেটা আমাদের বলুক।"

অন্য শিয়া মতাবলম্বী যারা নিখোঁজ হয়েছেন তাদের গল্পও মোটামুটি একই রকম।

তাদের সকলের অভিযোগ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা রাতে তাদের উঠিয়ে নিয়ে গেছে।

করাচী শহরের একটি বাড়িতে কিছু মহিলা, যারা নিখোঁজ শিয়াদের পরিবারের সদস্য, তারা অভিযোগ করেছেন কেন তাদের পরিবারের সদস্যদের উঠিয়ে নেয়া হলো এবং তাদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ?

এসবের কিছুই জানেন না তারা।

তবে শিয়া সম্প্রদায়ের নেতারা বলছেন, যাদের উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তারা সিরিয়ার একটি গোপন মিলিশিয়া দলের সদস্য।

এমনটাই শিয়া সম্প্রদায়ের নেতাদের জানানো হয়েছে বলে তারা উল্লেখ করেন।

এ গোপন মিলিশিয়া দলটির নাম যাইনাবাইয়ুন ব্রিগেড।

ধারণা করা হচ্ছে, পাকিস্তানের প্রায় এক হাজার শিয়া এ মিলিশিয়া দলের সদস্য এবং তারা সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পক্ষে লড়াই করছেন।

ইসলামের নবী মুহাম্মদের নাতনী যাইনাব বিনতে আলী, যিনি শিয়া মতাদর্শের অনুসারী ছিলেন, তাঁর নাম অনুসারে এ মিলিশিয়া দলটি গঠন করা হয়েছে।

যাইনাব বিনতে আলীর মাজার রয়েছে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে। মিলিশিয়া দলটির কাজ হলো সুন্নি উগ্রপন্থী ইসলামিক স্টেট গ্রুপ যাতে সে মাজারটির কোন ক্ষতি করতে না পারে।

ধারনা করা হয় এ যাইনাবাইয়ুন মিলিশিয়া দলটি সিরিয়ার আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রণক্ষেত্রে লড়াই করেছে। এদের মধ্যে আলেপ্পো অন্যতম।

তবে পাকিস্তানের নিখোঁজ শিয়াদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক কোন অভিযোগ দায়ের করা হয়নি।

নিখোঁজ শিয়াদের সন্ধানের দাবীতে করাচীতে আন্দোলন করছেন রাশেদ রিজভী। বিভিন্ন বিক্ষোভ কর্মসূচীতে তিনি বলেছেন, যাদের আটক করা হয়েছে তাদের হয়তো ছেড়ে দেয়া হোক, নতুবা আদালতে উপস্থাপন করা হোক।

তিনি বলেন, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফেরার পর অধিকাংশ ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে।

গোয়েন্দা সংস্থাদের প্রতি ইঙ্গিত করে রাশেদ রিজভী বলেন, " রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কিছু ব্যক্তি আমার কাছে এসেছিল। তারা আমাকে বুঝিয়েছে যাতে আমরা আন্দোলন না করি। আমি তাদের জিজ্ঞেস করেছে, কেন তাদের আটক করা হয়েছে? তারা বলেছে, এসব লোক সিরিয়ায় গিয়েছিল ইসলামিক স্টেট গ্রুপ এবং আল-কায়েদার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য।"

" আমি তাদের বলেছি, যদি সেটাই হয়ে থাকে তাহলে তাদের আদালতের সামনে আনুন। যদি সেটা না করেন, তাহলে আদালত রেখে লাভ কী?"

এ বিষয়ে বিবিসির তরফ থেকে পাকিস্তানী নিরাপত্তা বাহিনীর মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে তারা কোন উত্তর দেয়নি।

পাকিস্তানে মানুষ নিখোঁজ হয়ে যাবার বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর। সরকারি হিসেবে দেখা যায়, নিখোঁজ হয়ে যাওয়া প্রায় ১৫০০ ঘটনার কোন নিষ্পত্তি হয়নি।

এই নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মানুষের মধ্যে রয়েছে সন্দেহভাজন সুন্নি জিহাদি, ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর নেতা এবং সরকারের সমালোচনাকারী বিভিন্ন ধর্ম নিরপেক্ষ ব্যক্তি।

পাকিস্তানের সরকার সবসময় বলে যে নিখোঁজ হয়ে যাবার পেছনে যেভাবে নিরাপত্তা বাহিনীকে ঢালাওভাবে দোষারোপ করা হয়, সেটি ঠিক নয়।

তাছাড়া নিখোঁজ হয়ে যাবার সংখ্যাকে বড় করে দেখানো হয়ে বলেও সরকার উল্লেখ করেছে।

যেসব শিয়া মতাবলম্বীদের উঠিয়ে নেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে অল্প কয়েকজনকে পরবর্তীতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তরুণ জানালেন, তাঁকে আটক করে একটি ছোট অন্ধকার ঘরে রাখা হয়েছিল।

সেখানে তাকে ব্যাপক নির্যাতন করা হয় বলে সে তরুণ জানালেন।

তাঁর কাছে যাইনাবাইয়ুন মিলিশিয়া দল সম্পর্কে বারবার জানতে চাওয়া হয়েছিল।

তারা জনতে চেয়েছিল, সে তরুণ এ মিলিশিয়া দলের কাউকে চেনে কিনা? কিংবা এ দলটির অর্থের উৎস কোথায়?

আরেকজন সামাজিক কর্মী সামার আব্বাসকে ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে ইসলামাবাদ থেকে আটক করা হয়েছিল।

সে সময় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সমালোচক কিছু ব্লগারকেও আটক করা হয়।

জনগণের তীব্র সমালোচনা ও চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।

কিন্তু মি: আব্বাস ২০১৮ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত আটক ছিলেন।

মি: আব্বাসকে জানানো হয়েছিল যে তাঁর কোন দোষ নেই। কিন্তু তিনি আটক থাকা অবস্থায় তাঁর পুরো পরিবার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।

সে ভয় তাঁর পরিবার এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

মি: আব্বাস বলেন, তাঁর কাছে যাইনাবাইয়ুন মিলিশিয়া দল সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল।

তিনি বলেন, "ওরা আমাকে বলেছে, তুমি সিরিয়ায় লোক পাঠানোর সাথে জড়িত। আমি বলেছি, আমি জীবনে কখনো সিরিয়ায় যাইনি।"

সিরিয়ায় যেসব বিদেশী যোদ্বারা আছে তাদের সমন্বয়ে 'যাইনাবাইয়ুন ব্রিগেড' গঠিত হয়েছে এবং এই ব্রিগেডের সাথে ইরানের সম্পর্ক আছে।

যাইনাবাইয়ুন ব্রিগেডের পক্ষে লড়াই করতে গিয়ে যারা মারা গেছেন তাদের কিছু ছবি সে ব্রিগেডের সাথে সম্পৃক্তরা ইন্টারনেটে আপলোড করেছে।

নিহত যেসব ব্যক্তির ছবি আপলোড করা হয়েছে তাদের অনেকেই পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপজাতি অধ্যুষিত এলাকার।

এখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিয়া জনগোষ্ঠী বসবাস করে। সুন্নি জিহাদিরা বিভিন্ন সময় সে এলাকাকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করেছে।

গবেষকরা মনে করেন সিরিয়ায় যুদ্ধ করতে গিয়ে ১০০'র বেশি পাকিস্তানী যোদ্ধা নিহত হয়েছে, যাদের পরিবার ইরানের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পেয়েছে।

পাকিস্তানে শিয়া সম্প্রদায়ের নেতারা বলেন, দেশটির গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মনে করে যাইনাবাইয়ুন ব্রিগেড থেকে দেশে ফিরে তাদের সদস্যরা ইরানের কথা মতো কাজ করবে এবং সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা তৈরি করবে।

তবে শিয়া সম্প্রদায়ের নেতারা মনে করেন, সে ধরনের কোন সম্ভাবনা নেই।

নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারগুলো বলছে যে তাদের স্বজনরা কোন ধরনের অস্ত্রধারী গোষ্ঠীর সাথে জড়িত নয়।  সূত্র: বিবিসি বাংলা

এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ