আজকের শিরোনাম :

ক্রাইস্টচার্চ হামলা : হতাহতদের সম্পর্কে যা জানা গেছে

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০১৯, ১১:৫২

নিউজিল্যান্ডের দুটি মসজিদে শুক্রবারের হামলায় ৫০ জন নিশ্চিত মৃত্যু ঘটেছে। পুলিশ বলেছে, তারা নিহতদের স্বজনদের কাছে একটি তালিকা হস্তান্তর করেছে, যা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি।

পুলিশ কমিশনার মাইক বুশ বলেন, মৃতদেহ এখনো হস্তান্তর করা হয়নি কারণ কর্মকর্তারা প্রত্যেক আক্রান্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিশ্চিত হওয়ার পর মৃতদেহ হস্তান্তর করা হবে।

তবে এটা নিশ্চিত যে তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থেক আসা এবং তাদের অনেকেই শরণার্থী ছিলেন, যারা ভেবেছিলেন নিউজিল্যান্ডে তাদের একটি নিরাপদ আশ্রয় মিলেছে।

এখানে এ রকম বেশ কয়েকজনের সম্পর্কে তুলে ধরা হচ্ছে যারা মৃত কিংবা নিখোঁজ হিসেবে ধারনা করা হচ্ছে-

মুসাদ ইব্রাহীম, বয়স ৩
ডিনস অ্যাভিনিউ মসজিদে হামলার পর থেকে মুসাদকে আর দেখা যায়নি। সে তার ভাই আবদিসহ তাদের বাবার সাথে বেরিয়েছিল, তারা দুজন পালিয়ে বাঁচতে পেরেছে। পরিবারটি বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়েছে কিন্তু তার কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

মুসাদের ভাই আবদি স্থানীয় খবরের সাইট স্টাফকে বলেন, ‘মসজিদের ভেতর যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে সেও একজন বলে এখন আমাদের মনে হচ্ছে...এই পর্যায়ে এসে সবাই বলছে সে মারা গেছে। 

তিনি আরও বলেন, ‘এটা বেশ কঠিন, অনেক মানুষ আমাকে ফোন করে জানতে চাইছেন কোনো ধরনের সাহায্য প্রয়োজন কিনা। এটা এই মুহূর্তে খুবই কঠিন। আমরা কখনো এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হইনি।’

সে জানায়, তার ভাই ছিল ‘প্রাণশক্তিতে ভরপুর, আমুদে এবং হাসি-খুশি থাকতে খুব পছন্দ করত।’

পুলিশ শুধু যেটুকু নিশ্চিত করেছে সেখানে তারা বলেছে, কমপক্ষে একটি শিশু নিহত হয়েছে এবং অনেকেই আহত হয়েছে। কারো নামই উল্লেখ করেনি তারা।

ক্রাইস্টচার্চের কাশমিরি হাইস্কুল জানিয়েছে যে, তাদের বর্তমান শিক্ষার্থী এবং একজন স্নাতক পাশ করা শিক্ষার্থী নিখোঁজ আছে। আরও একজন শিক্ষার্থী হাসপাতালে আছে।

দাউদ নবী, বয়স ৭১
হতাহতদের মধ্যে সর্বপ্রথম যাকে শনাক্ত করা হয়েছে তিনি দাউদ নবী। তার জন্ম আফগানিস্তানে। ১৯৮০ সালে সোভিয়েত আগ্রাসন থেকে পালাতে পরিবার নিয়ে নিউজিল্যান্ডে চলে আসেন। তিনি পেশায় একজন প্রকৌশলী ছিলেন।

নিজের অবসরের পর নিউজিল্যান্ডে একজন কমিউনিটি নেতা হয়ে ওঠেন। স্থানীয় আফগান অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং অভিবাসীদের পরিচিত একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

হামলাকারী যখন বন্দুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন দাউদ নবী মসজিদের অন্যান্যদের রক্ষা করতে নিজে সামনে এগিয়ে গিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

তার ছেলে ওমর এনবিসি নিউজকে বলেছেন, ‘প্যালেস্টাইন, ইরাক, সিরিয়া যেখান থেকেই কেউ আসুক না কেন তিনিই (দাউদ নবী) প্রথম হাত বাড়িয়ে দিতেন।’

সাইয়াদ মিলানে, বয়স ১৪ বছর
বড় হয়ে ফুটবলার হতে চেয়েছিল কিশোর সাইয়াদ মিলানে। শুক্রবার আল নূর মসজিদে মায়ের সাথে ছিল সে।

তার বাবা নিউজিল্যান্ডের সংবাদ মাধ্যমকে শনিবার বলেছেন, ‘সে মারা গেছে কি-না এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এখনো আমরা কিছু শুনিনি, তবে আমি জানি সে চলে গেছে কারণ তাকে দেখা গেছে। আমি স্মরণ করতে পারি আমার বাচ্চাকে যাকে তার জন্মের সময় প্রায় হারিয়ে ফেলছিলাম...সে একজন ছোট্ট সাহসী যোদ্ধা। সে কাউকে বা কোন কিছুকে পরোয়া করতো না। তাকে এভাবে কারো বন্দুকের সামনে পড়ে যেতে দেখাটা-এটা খুবই কঠিন। সে কোথায় আছে আমি জানি, সে শান্তিতে আছে, আমি জানি।’

তার একজন বোন ব্রাইডি হেনরি এর আগে রিপোর্টারদের বলেছেন, তাকে সর্বশেষ দেখা গেছে ‘মসজিদের ভেতর রক্তাক্ত মেঝেতে পড়ে থাকতে, শরীরের নিচের দিক থেকে রক্তপাত হচ্ছিল।’

নাঈম রশিদ, বয়স ৫০
নাঈম রশিদ মূলত পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদ থেকে আসা। তিনি ক্রাইস্টচার্চের একজন শিক্ষক ছিলেন।

আল নুর মসজিদে হামলার ভিডিওতে একটি অংশে দেখা গেছে আল-নূর মসজিদে গুলিবিদ্ধ হবার আগে নাঈম রশিদ হামলাকারীকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন।

তিনি গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন । হাসপাতালে নেয়া হলে তার মৃত্যু হয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে।

রশিদকে সবাই বীর হিসেবে দেখছেন। তার ভাই খুরশিদ রশিদ জানিয়েছেন ভিডিওটি দেখার পর তার সাহসী ভূমিকার জন্য তারা গর্বিত। বলেন, তিনি ছিলেন একজন সাহসী ব্যক্তি এবং আমি সেখানকার লোকজনের কাছে শুনেছি, সেখানে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীদের কয়েকজন বলেছেন যে তিনি সেই হামলাকারীকে থামানোর চেষ্টা করে কয়েকজনের জীবন বাঁচিয়েছিলেন।’

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে তাকে পাকিস্তানের নয়, ক্রাইস্টচার্চে সমাধিস্থ করা হবে।

তালহা রশিদ, বয়স ২১
তালহা ছিলেন রশিদের বড় ছেলে। যখন পরিবারটি নিউজিল্যান্ডে চলে আসে তখন তালহার বয়স ১১ বছর।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার মৃত্যুর খর নিশ্চিত করেছে। স্বজন ও বন্ধুদের কাছে জানা গেছে, তালহা সম্প্রতি নতুন একটি চাকরী পেয়েছিল এবং শিগগিরই তার বিয়ে করার কথা ছিল।

যেখানে তার বিয়ে নিয়ে আয়োজন শুরু হওয়ার কথা হচ্ছিল সেখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন আলোচনা চলছে এখন।

লাহোর থেকে তালহার চাচা জানান, অল্প কিছুদিন আগে যখন নাঈম রশিদের সাথে আমার কথা হচ্ছিল সে তার পাকিস্তান যাওয়ার পরিকল্পনা এবং ছেলেকে বিয়ে করানোর ইচ্ছার কথা জানিয়েছিল। কিন্তু এখন আমরা বাবা ও ছেলে দুজনের মৃতদেহ পাকিস্তানে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আয়োজন করছি।

রশিদের আহত আরেক পুত্র চিকিৎসাধীন।

ফারহাজ আহসান, বয়স ৩০
ভারতীয় নাগরিক ফারহাজ আহসান হায়দ্রাবাদ থেকে ১০ বছর আগে নিউজিল্যান্ডে আসেন এবং ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেন।

তার দুটি শিশু সন্তান রয়েছে যাদের একজন তিন বছর বয়সী কন্যা এবং আরেকজন ছয় মাস বয়সী ছেলে শিশু।

তার ভাই কাশিফ জানিয়েছেন, নিউজিল্যান্ডের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তার মৃত্যুর খবর জেনেছে পরিবারটি।

বিবিসি তেলেগু সার্ভিসকে ফারহাজ আহসানের বাবা সাইয়েদউদ্দিন বলেছেন ‘নিউজিল্যান্ড যেটি একটি শান্তি-প্রিয় দেশ হিসেবে পরিচিত সেখানে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হবে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি ’।

হোসনে আরা, বয়স ৪২ বছর
নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশ কনসাল অফিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন দুজন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। যদিও সংখ্যাটি নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তি কাজ করছে।

শুরুতে নিহতের সংখ্যা তিনজন বলা হয়েছিল পরে কনসাল অফিসার শফিকুর রহমান ভূঁইয়া বিবিসি বাংলাকে জানান, শনিবার পর্যন্ত দুজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত। তবে বিস্তারিত বলা হচ্ছে না।

হোসনে আরা আল নুর মসজিদে যখন বন্দুকের গুলির শব্দ শুনতে পান সেসময় তিনি মেয়েদের জন্য নির্ধারিত অংশে ছিলেন বলে জানা গেছে।

তার স্বামী ফরিদ উদ্দিন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ায় হুইল চেয়ার ব্যবহার করতেন এবং তিনি ছিলেন পুরুষদের কক্ষে।

‘বন্দুকের গুলির শব্দ শুনে তৎক্ষণাৎ তিনি তার স্বামীর খোঁজে ছুটে যান কিন্তু নিজেই গুলিবিদ্ধ হন এবং মারা যান’ তার ভাতিজা বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক নিউএজকে বলেন। তার স্বামী বেঁচে আছেন বলে জানা গেছে। ।

খালেদ মুস্তাফা
সিরিয়ান সলিডারিটি নিউজিল্যান্ড গ্রুপ বলছে, আল নুর মসজিদে হামলায় খালেদ মুস্তাফা মারা গেছেন। মুস্তাফা সিরিয়া যুদ্ধের পর আসা শরণার্থী ছিলেন এবং ২০১৮ সালে নিরাপদ স্বর্গ হিসেবে নিউজিল্যান্ডকে বেছে নিয়ে পরিবারসহ সেখানে চলে আসেন।

তার কিশোর বয়সী ছেলেদের একজন এখনো নিখোঁজ। আরেক পুত্র মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে এবং তার শরীরে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে।

আমজাদ হামিদ, বয়স ৫৭
পেশায় চিকিৎসক আমজাদ হামিদ প্রতি শুক্রবার আল নূর মসজিদে নামাজ আদায় করতেন।

হামলার ঘটনার পর থেকে তার কোনো খোঁজ নেই। তার পরিবার নিউজিল্যান্ডের সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন যে, তারা সব হাসপাতাল এবং সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ নিয়েছে, কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি।

সে মারা গেছে বলেই তার পরিবার আশঙ্কা করছে। তার স্ত্রী নিউজিল্যান্ড হেরাল্ডকে বলেছেন, ‘এটা ভয়াবহ...আমরা আমাদের এবং সন্তানদের জন্য আরও একটু ভালো ভবিষ্যৎ খুঁজে পাবো বলে প্রত্যাশা ছিল।’

তিনি তার স্বামীকে ‘একজন অত্যন্ত দয়ালু’ ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করেন।

২৩ বছর আগে এই দম্পতি নিউজিল্যান্ডে পাড়ি জমায় এবং তাদের দুটো সন্তান হয়। হামিদ ক্যনবেরা জেলা স্বাস্থ্য বোর্ডের কার্ডিওরেসপাইরেটরি বিভাগের বিশেষজ্ঞ ছিলেন।

তার ছেলে হুসাম হাসিদ বলেছেন, ‘এটি একটি নিরাপদ দেশ বলে মনে করা হতো নিউজিল্যান্ড চিরতরে বদলে যাচ্ছে।’

আফগান নাগরিক যাদের নাম এবং বয়স অজানা
নিউজিল্যান্ডের আফগান অ্যাসোসিয়েশন জানাচ্ছে, দ্বিতীয় আরেকজন আফগানের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত। তাদের নাম এবং বয়স এখনো জানা যায়নি।

হুসাইন আল-উমারি, বয়স ৩৫
প্রতি শুক্রবার হুসাইন আল উমারি আল নুর মসজিদে একবার যাবেনই। এর পর সেখান থেকে যেতেন তার বাবা-মায়ের সাথে ডিনারের জন্য। বৃহস্পতিবার বাবা-মার সাথে সর্বশেষ কথা বলেছেন তিনি। সে অনেক উচ্ছ্বসিত ছিল কারণ তারা সম্প্রতি নতুন একটি গাড়ি কিনেছে। তার াববা-মা জান্না ইযাত এবং হাযিম আল উমারি সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ১৯৯০-এর দশকে নিউজিল্যান্ডে আসেন। হামলার পর থেকে ছেলের কোন খবর পাচ্ছেন না বাবা-মা।

লাইলিক আব্দুল হামিদ, বয়স অজ্ঞাত
তিনি মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ নামেও পরিচিত। এই হামলায় প্রথম কোনও ইন্দোনেশীয় ব্যক্তি হিসেবে তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়েছে।

যে দুটি মসজিদে হামলা হয়েছে সেখানে আরও ৭ জন ইন্দোনেশীয় ছিলেন।

নিউজিল্যান্ডের ইন্দোনেশিয়ান দূতাবাসে পাঁচজন তাদের নিরাপদে থাকার বিষয়টি অবহিত করেছেন বলে দেশটির রাষ্ট্রদূত তানতোই ইয়াহিয়া জানিয়েছেন।

আরও চারজন পাকিস্তানি নাগরিক, যাদের বয়স অজ্ঞাত।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও চারজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে যাদের নাম: সোহায়েল শাহীদ, সাইদ জাহানদাদ আলী, সাইদ আরীব আহমেদ এবং মাহবুব হারুন। তাদের বয়স জানা যায়নি।

দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ ফয়সালের বক্তব্য অনুসারে, আরও তিনজন নিখোঁজ তবে এখনো তাদের শনাক্তকরণ বাকি আছে।

৪ মিসরীয়

মিসরের জনশক্তি ও অভিবাসন মন্ত্রনালয় ৪ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে।

ফেসবুক পোস্টে তাদের নাম মুনির সুলেমান, আহমেদ জামাল উদ্দিন আবদেল ঘানি, আশরাফ আল-মোরসি এবং আশরাফ আর-মাসরি।

জর্ডানের ৪ জন
জর্ডানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের চারজন নাগরিকের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে তবে তাদের কারো নাম ঘোষণা করা হয়নি।

আরও ৫ জন আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন

নিখোঁজ হিসেবে যাদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে জর্ডান, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, ফিজি ও সৌদি আরবের নাগরকরা রয়েছেন।

সোমালিয়ার কমপক্ষে ৪ জন হামলায় নিহত হয়েছে।

যে মসজিদ দুটোতে হামলা চালানো হয়েছিল তার একটি আল নুর যৌথভাবে পরিচালনার দায়িত্বে সোমালিয়া রয়েছে।
খবর বিবিসি

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ