আজকের শিরোনাম :

ইহুদী যাদুঘরে হত্যাকাণ্ড চালানো লোকটি একজন সিরিয়া-ফেরত আইএস জিহাদি

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০১৯, ১৮:১৭

ব্রাসেলসে ইহুদী-বিদ্বেষী হামলা চালিয়ে চারজনকে হত্যার ঘটনায় ইসলামিক স্টেট বা আইএস বাহিনীর হয়ে সিরিয়া যুদ্ধে অংশ নেয়া এক জিহাদিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।

ফ্রান্সে জন্ম নেয়া ৩৩ বছর বয়সী মেহদি নেমুশে নামে ওই ব্যক্তি এক বছর সিরিয়ায় লড়াইয়ে অংশ নিয়ে ফিরে আসার পর ২০১৪ সালের মে মাসে ওই হামলা চালান। বেলজিয়ামের ব্রাসেলসের ইহুদী যাদুঘরে তিনি কালাশনিকভ অ্যাসল্ট রাইফেল এবং বন্দুক থেকে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকেন ।

ঘটনাস্থলেই তিনজন নিহত এবং পরে হাসপাতালে আরও একজন মারা যায়। ওই হামলা পরিকল্পনায় সহায়তাকারী এবং অস্ত্র যোগানদাতা নাসের বেনদ্রারও হত্যাকাণ্ডের জন্য দোষী বলে প্রমাণিত হয়েছেন।

তবে তাদের সাজা এখনো ঘোষণা করা হয়নি।

দুই-মাসব্যাপী এই বিচার কার্যক্রমে সিরিয়ায় আইএস-এর সাবেক বন্দীদের সাক্ষ্য এবং অন্যান্য সাক্ষীদের বক্তব্য রেকর্ড করা হয়।

যাদুঘরে ওই হামলায় নিহতদের মধ্যে দুজন ইসরায়েলি পর্যটক, একজন স্বেচ্ছাসেবক কর্মী এবং অভ্যর্থনা-কর্মী ছিলেন।

নেমুশের আইনজীবী সর্বাত্মক চেষ্টা চালান এটা প্রমাণের জন্য যে, নেমুশে এক ব্যাপক ষড়যন্ত্রের শিকার এবং বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী, কিন্তু এই দাবির সমর্থনে জোরালো তথ্য-প্রমাণ হাজির করতে পারেননি।

কে এই মেহদী নেমুশে?

বেলজিয়ামের প্রসিকিউটরদের মতে, নেমুশে ছিলেন প্রথম কোনও ইউরোপীয় জিহাদি যে সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসেছিল ইউরোপে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর উদ্দেশ্য নিয়ে।

ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চলীয় শহর রাওবায়েক্স-এ আলজেরীয় বংশোদ্ভূত পরিবারে তার জন্ম। এর আগে ডাকাতির জন্য পাঁচ বছর জেল খাটায় ফরাসি আইন শৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষের কাছে সে পূর্ব পরিচিত ছিল। সে জানিয়েছে কারাগারে বন্দী থাকাকালীন তার পরিচয় হয় আরেক বন্দী বেনদ্রার এর সাথে। তাদের দুজনকেই "উগ্রবাদী" বন্দী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

২০১৩ সালে নেমুশে সিরিয়ায় যায় এবং এক বছর অবস্থান করে । সেইসময় সে দেশটির গৃহযুদ্ধে জিহাদিদের হয়ে লড়াই করে বলে মনে করা হয়।

তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, সেখানে অবস্থানকালে তার সাথে নাজিম লাচরাওইর-এর সাক্ষাত ঘটে । নাজিম ছিলেন ২০১৬ সালের মার্চে ব্রাসেলসে বিমানবন্দরে হামলা চালিয়ে ৩২ জনকে হত্যার ঘটনার একজন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী।

সিরিয়ায় চারজন ফরাসি নাগরিককে জিম্মি করে রাখা হয় এবং সন্দেহ করা হয় বন্দীদশায় তাদেরকে লাচরাওই এবং মি. নেমুশের হেফাজতে রাখা হয়েছিল।

যাদুঘরে গুলির ঘটনায় বিচারের মুখোমুখি করতে নেমুশেকে বেলজিয়ামের হাতে তুলে দেয়া হয়, কিন্তু ফরাসি বন্দীকে জিম্মি করার অভিযোগে তাকে ফ্রান্সেও বিচারের মুখোমুখি হতে হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

বিচারে যা ঘটলো

বিচার প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই ছিল নাটকীয়তা। ২০১৫ সালে প্যারিস আক্রমণকারীদের একমাত্র জীবিত সদস্য কারাবন্দী জিহাদি সালাহ আবদেসলামের বিচারের সাথে মিল রেখে নিরাপত্তা বিধান করা হয়েছিল।

বিচারকাজ শুরু পরপরই একজন সাক্ষীর প্রতিনিধিত্বকারী আইনজীবীর ল্যাপটপ এবং কিছু কাগজপত্র তার অফিস থেকে চুরি যায় বলে অবহিত করেন। তার পরিবর্তে বেসবল ব্যাট এবং একটি প্রতীকী বন্দুক রেখে যাওয়া হয়, এটাকে প্রসিকিউটররা মনে করেন এক ধরনের হুমকি হিসেবে।

এরপর নেমুশে ভীতি প্রদর্শনের নিন্দা জানান, এবং ৮১ বছর বয়সী সাক্ষী চিলির একজন চিত্রশিল্পী ক্লারা বিলেকে ভিলালোবোস সাক্ষ্য দেন।

তারপর আসেন হামলায় নিহত ইসরায়েলের দুই পর্যটক মরিয়ম এবং এমানুয়েল রিভার অনাথ মেয়েরা। এই দম্পতি তাদের ১৮তম বিবাহ বার্ষিকী উদযাপন করছিলেন।

১৯ বছরের আয়ালেট এবং ২১ বছরের শিরা তাদের মাকে "পরিবারের জন্য নিবেদিত প্রাণ" এবং বাবাকে "ভ্রমণ প্রিয়" বলে বর্ণনা করেন।

তিন সপ্তাহের বিচার প্রক্রিয়া চলাকালে মি. নেমুশের গ্রেপ্তারের সময়কার ভিডিও দেখেন জুরিরা।

বেলজিয়ামের সংবাদপত্রে নেমুশের ছবি ছাপা হয় - যাকে বর্ণনা করা হয় "উদ্ধত" হিসেবে এবং তার মুখে "তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি।" সবসময় সে নীরবতা অবলম্বন করতে থাকে।

কারাবন্দীদের সাক্ষ্য

২০১৩ সালের জুনে চারজন ফরাসি সাংবাদিক অপহৃত হন এবং ২০১৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তাদেরকে উত্তর আলেপ্পোতে জিম্মি করে রাখে আইএস জঙ্গিরা।

তাদের মধ্যে দুজনকে আদালতে হাজির করা হয় - নেমুশেকে তাদের বন্দীকারী হিসেবে প্রমাণের জন্য। নিকোলাস হেনিন আদালতে বলেন, নেমুশে ছিলেন, "নির্মম বিকারগ্রস্ত, আমোদপ্রিয়, আত্মপ্রেমী"।

আরেকজন বন্দী দিদিয়ের ফ্রাঁসোয়া বলেন, নেমুশে তাকে একাধিকবার পিটিয়েছে। তাদের এই অপহরণের ঘটনায় ফ্রান্সের আলাদা বিচার প্রক্রিয়ার বিষয়বস্তু।

'অতি-উগ্রবাদী'

ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ কৌঁসুলি বার্নার্ড মিশেল তার মামলা গুছিয়ে আনেন এবং দোষী সাব্যস্ত করে রায় দাবি করেন। আদালতে তিনি বলেন, নেমুশ "নিছক একজন উগ্রবাদী নয়, সে অতি-উগ্রবাদী।"

তিনি বলেন, "যদি অস্ত্র নিয়ে একটি যাদুঘরে আক্রমণ করা হিংসাত্মক এবং বর্বর না হয় তবে কোনও ঘটনাই সহিংস ও বর্বর হতে পারে না"।

তিনি যোগ করেন, "মেহদী নেমুশের জন্য হামলার শিকার ব্যক্তিদের পরিচয় মুখ্য ব্যাপার ছিল না । লক্ষ্য ছিল কেবল কারো ওপর হামলা চালানো এবং সব ছিল পূর্ব-পরিকল্পিত।"

'লেবানিজ-ইরানি-ইসরাইলি ষড়যন্ত্র'

ওই হামলাটি 'বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার ষড়যন্ত্র এবং গুপ্তহত্যা' বলে আসামী পক্ষের দেয়া কিছু যুক্তি অনেকের কাছেই হয়ে ওঠে "বিভ্রান্তিকর" ।

মি. নেমুশের আইনজীবী সেবাস্তিয়ান কোর্টি যুক্তি দেন যে, তার মক্কেল ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ইরানের বা লেবাননের গোয়েন্দা সংস্থায় নিয়োগ পেয়েছিলেন। কিন্তু এই দাবির পক্ষে প্রমাণাদি হাজির করতে পারেননি।

মি. কোর্টির বক্তব্য অনুসারে, "ওই হত্যাকাণ্ড আইএস এর দ্বারা ঘটানো হয়নি, কিন্তু, সেটি ছিল "মোসাদ এজেন্টদের হত্যার লক্ষ্যে" এবং এখানে তিনি ইসরাইলি দম্পতির জড়িত থাকার বিষয়ে ইঙ্গিত দেন । তার কথায়, হামলা চালায় "অজ্ঞাত ব্যক্তি।"

যদিও তদন্তকারীরা গতমাসে আদালতকে জানান, মোসাদের জড়িত থাকার বিষয়ে কোন ধরনের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

ওই আইনজীবী বলেন ২০১৩ সালের শেষদিকে নিরুদ্দেশ হন নেমুশ এবং ব্রিটিশ জিহাদীরা তাকে ডাবল ডিলিং এ জড়িত বলে সন্দেহ করেন। ইউরোপে ফিরে আসার পর সে গোয়েন্দা গোষ্ঠী থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, "যা কেবল তাকে ব্যবহার করে যাচ্ছিল"।

এমনকি নেমুশেকে 'ইহুদী বিদ্বেষী বলা যাবে না' বলে তার আইনজীবী এমন যুক্তি তুলে ধরেছিলেন - যেখানে তিনি বলেন যে, নেমুশে কেলভিন ক্লেইন এর জুতা পরেন। তার মানে তিনি ইহুদী ঐতিহ্যের বিরোধী নন।

এই যুক্তি তুলে ধরার পর ইহুদি সংগঠনগুলির একটি কমিটির প্রতিনিধিত্বকারী একজন আইনজীবী এই পর্যবেক্ষণকে "বিভ্রম সৃষ্টিকারী এবং অসঙ্গতিপূর্ণ" বলে অভিহিত করেন। বিবিসি

এবিএন/মমিন/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ