আজকের শিরোনাম :

প্রচণ্ড গুলি গ্রেনেডের মধ্যে যেভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন গ্রিক পাইলট

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০১৯, ১৮:৪৪

২০১৮ সালের ২০শে জানুয়ারি আফগান রাজধানী কাবুলের একটি বিলাসবহুল হোটেলে হামলা চালায় তালিবান। হোটেলটিতে অনেক বিদেশীদের মধ্যে একজন ছিলেন ভাসিলেইওস ভাসিলেইও।

গ্রিক পাইলট ভাসিলেইওস ভাসিলেইও হোটেলটিতে উঠেছিলেন এখন থেকে ঠিক এক বছর আগে। দি ইন্টার-কন্টিনেন্টাল হোটেল বিদেশীদের কাছে জনপ্রিয় ছিলো, আর সে কারণেই তালিবান বন্দুকধারীরা হোটেলটিতে হামলা করে যাতে নিহত হয় ৪০ জন। তবে ভয়ংকর সেই হামলার মধ্যে পড়েও বেঁচে যান গ্রিক পাইলট ভাসিলেইওস।

ভাসিলেইওস বেঁচে গিয়েছিলেন কিভাবে?

ভাসিলেইওস বলছেন, সাধারণত রাত সাড়ে আটটার দিকে ডিনার করে তিনি কিন্তু সেদিন তিনি একটু তাড়াতাড়ি ডিনারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আর তখন সন্ধ্যা ছয়টা। তার বন্ধু কো-পাইলট মিশেন পুলিকাকস ছিলেন সাথে।

তারা সাড়ে সাতটায় ডিনার শেষ করেন এবং হোটেলের উপরের তলায় নিজের রুমে ফিরে যান কিছু ফোন করবেন বলে।

তার রুম নাম্বার ছিলো ৫২২।

" আটটা ৪৭ মিনিটে আমি অ্যাথেন্সে কথা বলছিলাম। তখন নীচে লবিতে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাই"।

এরপর তিনি দৌড়ে ব্যালকনিতে যান এবং দেখতে পান নীচে একজনকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পান। আর হোটেলের ভেতরে ও বাইরে থেকে গুলির শব্দ।

"মনে হলো আমি ভাগ্যবান, কারণ তখন আমি রেস্টুরেন্টে ছিলামনা। আর নিজেকে বললাম বেঁচে থাকার জন্য তোমাকে কিছু করতে হবে"।

এরপর ব্যালকনির দরজা খোলা রেখে রুমের দরজা বন্ধ করে দিলেন তিনি।

তার রুমে দুটি বিছানা (বেড) ছিলো।

"প্রথমে একটি ম্যাট্টেস নিলাম এবং সেটিকে দরজার বিপরীতে দিলাম যাতে করে গ্রেনেড থেকে বাঁচতে পারি। এরপর কিছু বেড শীট, তোয়ালে ও জামা কাপড় জড়ো করলাম। একটি রশি বানালাম যাতে দরকার হলে চতুর্থ তলায় কি হচ্ছে দেখতে পারি"।

পেশায় পাইলট বলেই ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট বা কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে তার প্রশিক্ষণ ছিলো।

"এরপর ভাবতে শুরু করলাম পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে আমার। হামলাকারীরা কতজন ও তারা ভবনের কোথায় সে সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিলোনা। আবার নিজেকে বোঝালাম যে পাঁচতলা থেকে লাফ দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না"।

ভাসিলেইওস সিদ্ধান্ত নেন রুমের ভেতরেই থাকার ও নিজেকে রক্ষার জন্য সম্ভাব্য যা করার আছে সেটি করার।

তবে কোনো এক কারণে সেসময় অপ্রত্যাশিত রকমের শান্ত ছিলেন তিনি।

"ম্যাট্টেস দিয়ে বিছানা বানালাম যেটা দেখতে ছিলো কিছুটা অগোছালো। এরপর লাইট বন্ধ করে দিলাম। এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম ভারী পর্দার ও ফার্নিচারের আড়ালের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকবো"।

প্রায় দেড় ঘণ্টা পার হলো এভাবে। তখনো তিনি জানেন না যে হামলাকারীরা হোটেলের প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় লবি ও রেস্টুরেন্টে প্রায় সবাইকে মেরে ফেলেছে।

এরপর তারা তৃতীয় ও চতুর্থ তলা হয়ে পঞ্চম তলার দিকেই এগিয়ে আসছিলো।

ছাদের ওপর দৌড়ানোর শব্দ আসছিলো কানে। কারণ হেলিকপ্টারের নিশানা থেকে হামলাকারীরা নিজেদের রক্ষার চেষ্টা করছিলো।

কাছেই করিডোর থেকেও গুলির শব্দ আসছিলো এবং এর মধ্যে হঠাৎ করে পুরো হোটেলের বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যায়।

পঞ্চম তলায় এসে হামলাকারীরা প্রথম যায় ৫২১ নম্বর রুমে। এরপর পরের রুমটাই ছিলো ভাসিলেইওস-এর। আর পরের রুমটাই ছিলো হামলাকারীদের পুরো রাত জুড়ে অপারেশন সেন্টার।

এক পর্যায়ে নিজের রুমে দরজার গুলির শব্দ শুনতে পান তিনি এবং তারপর মনে হলো যে অবস্থায় তিনি আছেন সেটা ঠিক ভালো পজিশন নয়।

এরপর তিনি ফ্লোরে যান ও হাটুমুড়ে খাটের নিচে ঢুকে যান যার ওপরে একটি ম্যাট্টেস ছিলো। "এমন ভাবে শুয়েছিলাম যাতে খাটের ওজন হাত ও পা দিয়ে ধরে রাখতে পারি"। খাটের জন্য বাইরে কমই দেখতে পাচ্ছিলেন তিনি।

"তারা (হামলাকারীরা) গুলি করে তালা ভাঙ্গে ও ভারী অস্ত্র দিয়ে দরজায় ধাক্কা দেয় এবং এরপর চারজন রুমে প্রবেশ করে। এরপর ব্যালকনির দরজা খোলা দেখে একজন দৌঁড়ে সেদিকে যায়"।

"এরপর পিস্তলের গুলির শব্দ শুনতে পাই এবং আমি ভেবেছি যে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমি সম্ভবত মারা যাচ্ছি। পরিবার ও সন্তানদের মুখগুলো ভেসে উঠলো মনে"।

রুমের দরজা খোলাই থাকলো। বন্দুকধারীরা আসা যাওয়া করতে লাগলো। এরপর তারা পঞ্চম তলার অন্য কক্ষ গুলোতে তল্লাশি করতে লাগলো।

তার রুমের উল্টো দিকের কক্ষেই ছিলো তার সহকর্মী এয়ার স্টুয়ার্ড ও আরও কয়েকজন পাইলট।

কখনো কখনো তাদের চিৎকার শোনা যাচ্ছিলো যখন তাদের মারা হচ্ছিলো।

"মনে হলো প্রতিটি কক্ষ তারা তল্লাশি করেছে ও যাকে পেয়েছে তাকেই খুন করেছে। প্রতিবারই তারা হাসছিলো। মনে হচ্ছিলো খেলাধুলা করছে বা বড় পার্টি হচ্ছে তাদের"।

ভোরে তিনটার দিকে পঞ্চম তলায় বড় ধরণের গুলি শুরু হয়। আবার ২০-২৫ মিনিট কোনো শব্দ ছিলোনা।

তখন তিনি খাটের নীচ থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন।

"বেরিয়ে আসার পর দেখলাম যে দুটি খাটের নীচে ছিলাম তার একটিতে গুলি। একটি খাটের কাঠ সরিয়ে তারা দেখেছে কেউ আছে কি-না। ওই দিন দ্বিতীয়বারের মতো মনে হলো অল্পের জন্য বেঁচে গেলাম"।

এরপর দীর্ঘ সময় পর রুমের দিকে ধোঁয়া আসতে শুরু করলো। তাই তিনি ব্যালকনির দিকে গেলেন।

সেখানে ডান দিকে আগুন দেখতে পান যা তার রুমের দিকে ছুটে আসছিলো।

এসময় তিনি দেখতে পান টিভি ক্যাবল ঝুলছে ছাদ থেকে যা সরাসরি নিচের দিকে চলে গেছে।

তখন তিনি কিছু এগিয়ে দেখতে যান যে ওই তারটি বেয়ে তিনি নীচে নামতে পারবেন কিনা সেটি দেখতে।

আর তখনি দুটি বুলেট।

একটি বাম কাঁদের ২০ সেমি দুর দিয়ে আরেকটি আধা মিটার দুর দিয়ে গিয়ে জানালায় লাগে।

তার ধারণা গুলি করেছিলো আন্তর্জাতিক বাহিনী যারা তাকে হামলাকারীদের একজন মনে করেছিলো।

সম্ভবত ঝুঁকে ক্যাবল চেক করার কারণে তিনি সেবার বেঁচে যান।

এরপর তিনি কক্ষের ভেতরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

এরপর ধীরে বাথরুমে প্রবেশ করেন যাতে করে কোন শব্দ না হয়।

সেখান থেকে ছুড়ি নিয়ে একটা প্লাস্টিক কেটে নেন। টিশার্ট টি টুকরো করে টেনে নাকে দেন ধোঁয়া থেকে বাঁচতে।

আরেক টুকরো মুখের সাথে পেঁচিয়ে যতটুকু সম্ভব দুধ ও পানি নেন। অনেকটা ডাবল ফিল্টারের মতো যা তিনি অ্যাথেন্স বিমানবন্দরে ট্রেনিংয়ে শিখেছিলেন।

এরপর তিনি যখন খাটের নীচে ঢুকে পড়েন তখনি রুমে ঢোকেন এক জন। আড়াল থেকে তার পা দেখা যাচ্ছিলো। তিনি আরেক জনকে কোনো নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। পরে তিনি বাথরুমে যান, এরপর ব্যালকনি ও তারপর একে-৪৭ থেকে গুলি করতে থাকেন।

"এরপর মনে হলো আমি আবারো বেঁচে গেলাম। আর এ জায়গাটি লুকোনোর জন্য ভালো মনে হলো। আন্তর্জাতিক বাহিনী নিশ্চয়ই নিয়ন্ত্রণ নেবে। মনে হলো যেখানে আছি সেখানেই থাকলেই ঠিক আছে"।

কিন্তু আন্তর্জাতিক বাহিনী সকাল থেকে রুম বরাবর গুলি বর্ষণ শুরু করলো ট্যাংক থেকে। তারা হামলাকারীদের ৫২১ নাম্বার রুমকেই টার্গেট করেছিলো। পরের দরজাতেই আমি।

তারা একই সাথে আরও কয়েকটি রুম লক্ষ্য করে গুলি করছিলো। প্রতিবারই পুরো হোটেল কেঁপে উঠছিলো।

সবকিছু ধূলায় পরিণত হচ্ছিলো। দ্বিতীয় দফায় গুলি শুরু হলো সকাল ছয়টায়।

"এরপর দেখলাম কিছু লোক আমার রুম থেকে কিছু কাপড় নিচ্ছে। এরপর কার্পেট এবং সব এক করে ডিজেল দিয়ে দিলো। পরে ৫২১ নম্বর রুম তারা জ্বালিয়ে দিলো"। বাইরে মাইনাস তিন ডিগ্রি ছিলো রাতের তাপমাত্রা।

সকাল সোয়া নয়টায় নীচের করিডোর থেকে গুলির শব্দ আসলো যা একটু আলাদা মনে হলো। আর একজন বন্দুকধারী ৫২১ থেকে তার কালাশনিকভ রাইফেল থেকে জবাব দিচ্ছিলো।

সাড়ে নয়টা থেকে সোয়া এগারটার মধ্যে আন্তর্জাতিক বাহিনী অসংখ্য গ্রেনেড নিক্ষেপ করলো। কয়েকটি ৫২১ নম্বরেও পড়লো।

সাড়ে এগারটায় মনে হলো মাত্র একজনই আছে বন্দুকধারী আমার কাছে। তার আসলে গুলি শেষ হয়ে গিয়েছিলো।

তারপরেও সে বিস্ফোরণের চেষ্টা করছিলো কিন্তু গ্যাস না থাকায় সেটি হয়নি। সে অবস্থাতেও কোনো রকমে হাসি চেপে রেখেছিলাম।

কয়েক মিনিটের মধ্যে সে হাওয়া হয়ে গেলো। আগের দিন ও রাত ঘুমানো হয়নি। একনাগাড়ে প্রায় ৩৫-৪০ ঘণ্টা জেগেছিলেন এই গ্রিক পাইলট।

"কিছুক্ষণের মধ্যেই হৈচৈ শুনলাম। লোকজন আসছে। কিন্তু তারা কারা জানিনা। ১১টা ৪০-এ আফগান উচ্চারণে একজন বললো পুলিশ পুলিশ। তারপরেও বেরিয়ে আসিনি। কিছুক্ষণ পর ইংরেজি উচ্চারণে পুলিশ শুনলাম। আমি তখন খাটের নীচ থেকে বেরিয়ে আসি। কিন্তু আমি শ্বাস নিতে পারছিলামনা। একভাবে খাটের নীচে দীর্ঘক্ষণ থাকায় বুকে ব্যথা হচ্ছিলো। ধোঁয়ায় কালো দেখাচ্ছিলো। ওইভাবে আমাকে দেখে চার কমান্ডার চিৎকার দিয়ে উঠেন, "নিচু হও। বলেই পিস্তল ঠেকান"।

"নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম আমি ক্যাপ্টেন ক্যাম এয়ারলাইন্সের। গুলি করবেন না"। তারা বিশ্বাস করতে পারছিলোনা। তারা জানতে চাইলো কতক্ষণ আছি ও কিভাবে থাকলাম"।

এরপর ছবি তুলে একজন নীচে নিয়ে এলো গ্রিক পাইলটকে। এভাবেই শেষ বারের মতো ওই হোটেল থেকে বেরিয়ে এলেন গ্রিক পাইলট ভাসিলেইওস ভাসিলেইও।

উদ্ধারকৃত সবাইকে তারা কাবুলের ব্রিটিশ ঘাঁটিতে নিয়ে গেলো। সেখানে সহকর্মী মিশেলকে দেখে তিনি বিশ্বাস করতে পারেননি।

কয়েক ঘণ্টা পর পরিবারের সাথে ফোনে যোগাযোগের সুযোগ পান ভাসিলেইওস এবং তারাও বিস্মিত হন কারণ যাদের আগে উদ্ধার করা হয়েছে তাদের মধ্যে তাকে না দেখে পরিবার ভেবেছিলো তিনি বোধ হয় আর জীবিত নেই।

"এখন আমি জীবনের প্রতিটি মূহুর্ত উপভোগ করছি। কারণ জীবনটাই একটা উপহার। কাবুলের ওই ঘটনার পর আমি বুঝতে পারছি জীবন সত্যিই দারুণ সুন্দর"। সূত্র: বিবিসি বাংলা।

এবিএন/মমিন/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ