কলকাতার মেয়রকে নিয়ে হঠাৎ এতো আলোচনা কেন?
প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০১৮, ২০:৩৭
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দুটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর থেকে পদত্যাগের পর কলকাতার মেয়র শোভন চ্যাটার্জীকে ঘিরে চলছে ব্যাপক আলোচনা। জল্পনা চলছে, তার এ পতনের পেছনে কাজ করেছে এক অধ্যাপিকার সাথে তার কথিত প্রেমের সম্পর্ক।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী নিজেই জানিয়েছেন, মঙ্গলবারই তার হাতে থাকা রাজ্যের দুটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর থেকে পদত্যাগ করেছেন শোভন চ্যাটার্জী । এছাড়া কলকাতার মেয়রের পদ থেকেও তাকে সরে যেতে হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে।
এর পর থেকেই সামাজিক মাধ্যম আর গণমাধ্যমে আলোচনা চলছে: কেন এক সময়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত শোভন চ্যাটার্জীকে সরে যেতে বাধ্য করলেন মুখ্যমন্ত্রী। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে মমতা ব্যানার্জীর কাছের লোক ছিলেন এই শোভন চ্যাটার্জী - যাকে নিজের ভাইয়ের মতোই 'তুই', 'তুই' করে সম্বোধন করতেন মুখ্যমন্ত্রী। এমনকি শোভন চ্যাটার্জীর ডাকনাম, কানন বলে ডাকতেন।
অথচ এখন তাকেই মন্ত্রিত্ব আর মেয়রের পদ থেকে সরে যেতে বলা হলো কেন?
যে সম্ভাব্য কারণটা নিয়ে সবচেয়ে বেশী আলোচনা চলছে, তা হল বৈশাখী ব্যানার্জী নামে এক অধ্যাপিকার সঙ্গে মেয়রের সম্পর্ক।
আর ওই সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েই তিনি যে কাজে অমনোযোগী হয়ে পড়ছিলেন, তা নিয়ে বেশ কয়েকবার মেয়রকে সতর্কও করেছেন মমতা ব্যানার্জী।
তৃণমূল কংগ্রেস সূত্রগুলি বলছে, বেশ কয়েক মাস আগে একটি দলীয় বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী নাকি তাঁর 'স্নেহের' কাননকে বলেছিলেন, 'তুই প্রেম করবি না কাজ করবি।'
এই প্রেম করা নিয়ে অবশ্য বিশেষ রাখঢাক করেননি কলকাতার মেয়র এবং সদ্য সাবেক-হওয়া আবাসন ও দমকল মন্ত্রী শোভন চ্যাটার্জী।
মিসেস বৈশাখী ব্যানার্জীকে নিজের 'ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু' বলে জনসমক্ষে দ্বিধাহীনভাবে পরিচয় দিয়ে তার ওপরে কোনও আঘাত এলে তা 'নিজের বুক দিয়ে আগলানোর কথাও' ঘোষণা করেন তিনি নিজেই।
নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি বছর দেড়েক ধরে স্ত্রী রতœা চ্যাটার্জীর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু হয় মেয়রের।
তারপরে বিষয়টা গড়ায় বিবাহবিচ্ছেদের মামলায়। তখনই বেহালা অঞ্চলের বাড়ি ছেড়ে দক্ষিণ কলকাতার এক অভিজাত এলাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে চলে আসেন তিনি।
ঘনিষ্ঠ বান্ধবী বৈশাখী ব্যানার্জীর সঙ্গেই সেই ফ্ল্যাটে থাকছেন মেয়র শোভন চ্যাটার্জী। বৈশাখী ব্যানার্জী কলকাতার একটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। তাঁর স্বামী যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ে দেশে পরকীয়া সম্পর্ক বেআইনি নয় আর। তাই মি. চ্যাটার্জী যে বেআইনি কিছু করেছেন, তা বলা যাবে না।
মাত্র ২১ বছর বয়সে কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে জয়ী হয়ে কাউন্সিলার হয়েছিলেন শোভন চ্যাটার্জী। তারপর থেকেই দ্রুত উত্থান হয় মমতা ব্যানার্জীর হাত ধরেই।
এরপরে গত প্রায় দু'দশক ধরে মমতা ব্যানার্জীর সব আন্দোলনেই নেত্রীর পাশে থেকেছেন শোভন চ্যাটার্জী।
২০১০ সালে যখন আবারও দল কর্পোরেশনের ক্ষমতা দখল করল, তখন থেকেই তিনি মেয়র। একই সঙ্গে রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরও তার হাতেই দিয়ে রেখেছিলেন মমতা ব্যানার্জী। কিন্তু সেই গুরুদায়িত্বে ইদানীং ফাঁক পড়ছিল ক্রমাগত।
কাজে অমনোযোগী হয়ে পড়ার কথাটা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন মেয়রের স্ত্রী রতœা চ্যাটার্জীও, যার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা চলছে শোভন চ্যাটার্জীর।
তিনি বলছেন, "আগে যে মানুষটা সকাল ৮টা - ৯টার মধ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেত আর ফিরত সেই রাতে, সেই শোভনবাবুই আজকাল কর্পোরেশনে মাঝে মাঝে যান, কম সময় থাকেন, বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে সাধারণ মানুষও নিজের এলাকার কাজে মেয়রকে পান না।"
একদিকে যেমন বৈশাখী ব্যানার্জীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া নিয়ে নানা গসিপ ছড়িয়েছে মেয়রকে ঘিরে, তেমনই নানা অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যেই দেখা গেছে দুজনকে একসঙ্গে।
আবার বিবাহবিচ্ছেদের মামলা চলাকালীনই নিজের কন্যার বিদেশে যাওয়ার ছাড়পত্র নিতে মেয়র পতœীকে রাতভর ধর্নায় বসতে হয়েছে মেয়র আর তার বান্ধবী যে ফ্ল্যাটে থাকেন, তার সামনে।
আবার এরই মধ্যে নারদা-নিউজ নামের একটি নিউজ পোর্টালের চালানো স্টিং অপারেশনে মেয়রকে দেখা গেছে এক বান্ডিল টাকা গ্রহণ করতে। ওই ভিডিওটির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তৃণমূল কংগ্রেস।
কিন্তু ঘটনাটা নিয়ে চলছে তদন্তও। তাই নারদা-ঘুষ কাণ্ড বলে পরিচিত ওই মামলায় মেয়রকে দোষী বলা যায় না।
পারিবারিক বিবাদ প্রকাশ্যে এসে যাওয়া এবং অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া আর কাজে অমনোযোগী হয়ে পড়া - এত কিছুর মধ্যেও সব ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু কালবৈশাখীর মতোই হঠাৎ ঝড়টা উঠল মঙ্গলবার, রাজ্য বিধানসভায়।
আবাসন মন্ত্রী হিসাবে এক প্রশ্নের যে জবাব দেন মি. চ্যাটার্জী, তারপরেই স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী উঠে দাঁড়িয়ে সেই তথ্যকে ভুল বলে প্রমাণিত করে অন্য তথ্য দেন।
সূত্রগুলি বলছে, তারপরে এক বৈঠকে কিছুটা উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ও হয় দুজনের মধ্যে।
এরপরের ঘটনা ঘটে রাজ্য সচিবালয় নবান্নে একটি সরকারী অনুষ্ঠান মঞ্চে। শোভন চ্যাটার্জীর দিকে আঙ্গুল তুলে কিছুটা উত্তেজিত ভাবেই কথা বলতে দেখা যায় মুখ্যমন্ত্রীকে।
তারপরে মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ে গিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে চলে যান শোভন চ্যাটার্জী। ক্ষুব্ধ মমতা ব্যানার্জী সঙ্গে সঙ্গেই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে পাঠিয়ে দেন রাজ্যপালের কাছে।
রাতে তিনি জানান যে শোভন চ্যাটার্জী মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেছেন। বুধবার তাঁকে কলকাতা কর্পোরেশন থেকে পদ ছেড়ে দিতে বলা হয়েছে।
শোভন চ্যাটার্জীর স্ত্রী রতœা চ্যাটার্জীর মন্তব্য, "মমতা ব্যানার্জীর কাছে বোধহয় আর কোনও রাস্তা ছিল না। এটাই হওয়ার ছিল।"
মেয়রের কাজে অমনোযোগী হয়ে পড়া এবং তার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বারে বারে সতর্কবাণী পাওয়ার পেছনে যে অন্যতম কারণ বৈশাখী ব্যানার্জীর সঙ্গে সম্পর্ক, সেটা অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে লিখছেন, আলোচিত হচ্ছে গণমাধ্যমেও।
তবে কেউ কেউ মন্তব্য করছেন যে শুধুই কি বৈশাখী, না অন্য কারণও রয়েছে? এই অংশের ইঙ্গিত তদন্ত চলতে থাকা নারদা-ঘুষ কাণ্ডের দিকে।
সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই যেমন কিছুটা 'মশলা মেশানো' মন্তব্য করছেন, তেমনই রয়েছে কিছু গান আর কবিতা।
অসীম পাল আর্য্য নামের একজন লিখেছেন, "উনি প্রেম করতে গিয়ে জীবনের সমস্ত কিছু বিসর্জন দিয়েছেন। উনি প্রেমিক-প্রেমিকাদের শেখালেন কিভাবে প্রেম করতে হয়। ওনার জন্মদিনকে বিশ্বপ্রেম দিবস ঘোষণা করা হোক।"
'সা জয়' নামের এক ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন এবছরের শ্রেষ্ঠ বাংলা সিনেমা হল "বৈশাখী ঝড়ে..শোভন গেল উড়ে"।
অমিয় চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, "শুধুমাত্র পরকীয়ার জন্যই কি শোভন বাবুর অপসারণ না অন্য কিছু!!"
ফেসবুকে যেমন দেখা যাচ্ছে কৌশিক গাঙ্গুলি নামের একজনের মন্তব্য, এই যুগে এত প্রবলেম আসবে জেনে বন্ধুর হাত না ছাড়া বিরল দৃষ্টান্ত।
আর শমিত দত্ত চান্দুর মন্তব্যে রয়েছে পরিচিত ব্যান্ডের গান: "আজ এই বৈশাখী পূর্ণিমা রাতে চল পলায়ে যাই। দিদির কথা মানবো না। তোকে ছাড়া বাঁচবো না। চল পলায়ে যাই!!!"
শোভন চ্যাটার্জীর কোনও প্রতিক্রিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে পাওয়া যায় নি, তবে তিনি ঘনিষ্ঠ মহলে দাবী করেছেন যে তিনি চক্রান্তের শিকার হয়েছেন।
আর পদত্যাগের পরে বৈশাখী ব্যানার্জীর প্রতিক্রিয়া নেওয়ার জন্য সংবাদমাধ্যম যখন তার মোবাইলে ফোন করেছে, শোনা গেছে কলার টিউন, 'আমি হৃদ মাঝারে রাখিব, ছেড়ে দেব না।' সূত্র: বিবিসি বাংলা।
এবিএন/মমিন/জসিম