‘সাত মেয়ের পর ছেলে’
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৭:৪১
ভারতের জাতীয় ফুটবল ক্লাব মোহনবাগানের সভাপতি টুটু বসু কন্যাসন্তানদের জন্য চরম অপমানজনক একটি মন্তব্য করার পর তা নিয়ে ধিক্কার পড়ে গেছে - সমাজের নানা শ্রেণীর মহিলাদের তীব্র সমালোচনার পর তিনি ক্ষমা চাইতেও বাধ্য হয়েছেন।
মোহনবাগান ক্লাব গতকাল বুধবারই কলকাতা ফুটবল লীগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে দীর্ঘ আট বছর পর।
বহুদিন পর ক্লাবের এই সাফল্যে তার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে টুটু বসু একটি টিভি চ্যানেলকে বলেছিলেন, "সাত বছর ধরে মেয়ে হচ্ছিল। অবশেষে এবার একটা ছেলে হল। এরকম হলে আপনার যেমন আনন্দ হবে, আমারও এখন ঠিক সেরকম লাগছে!"
টুটু বসু এই মন্তব্য করার পরই তার ভিডিও আগুনের গতিতে ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে অজস্র মানুষ সেই ভিডিও দেখে প্রতিক্রিয়া জানাতে থাকেন।
টুটু বসু নামে বেশি পরিচিত হলেও তার আসল নাম স্বপনসাধন বসু। কলকাতা শহরের বিজনেস টাইকুনদের অন্যতম তিনি, কার্গো বা শিপিং থেকে শুরু করে মিডিয়া - বিভিন্ন খাতে শত শত কোটি টাকার টার্নওভার তার ব্যবসার।
শুধু তাই নয়, তৃণমূল কংগ্রেস তাকে ভারতের রাজ্যসভায় এমপি করেও পাঠিয়েছিল। পরে টুটু বসুর ছেলেও তার জায়গায় পার্লামেন্টারিয়ান হয়েছিলেন।
ভারতের 'জাতীয় ক্লাবে'র স্বীকৃতি পাওয়া মোহনবাগানের সঙ্গেও তিনি বহু বছর ধরে যুক্ত, এখন ওই ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের প্রেসিডেন্ট পদে রয়েছেন তিনি।
এহেন টুটু বসু কীভাবে কন্যাসন্তানের জন্ম নিয়ে ওই ধরনের সাঙ্ঘাতিক মন্তব্য করতে পারলেন, তা নিয়ে চরম বিস্ময় ও নিন্দা জানাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবী সমাজ।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেনস স্টাডিজ বিভাগের প্রধান ড: শমিতা সেন বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, "এই ধরনের কথা কেউ বলতে পারেন না যদি তার মনের মধ্যে সেটা না-থাকে।"
"অনবধানে তার মনের গভীরের একটা কথা বেরিয়ে এসেছে বলেই আমার বিশ্বাস। আসলে পুত্রসন্তানের আকাঙ্ক্ষা বা 'সান প্রেফারেন্স' যে আমাদের মজ্জায় মজ্জায় সেটাই এতে আবারও বোঝা গেল!"
তিনি আরও যোগ করছেন, "সাত সংখ্যাটাও বোধহয় খুব ইন্টারেস্টিং। সাত ভাই চম্পার গল্পে যেমন সাত বাইয়ের পর এক বোন হওয়ার কথা আছে, এখানে তিনি সেটাকে উল্টে দিয়ে সাত বোনের পর এক ভাইকে এনেছেন। সাত সংখ্যার এই কালচারাল রেফারেন্স থেকে বোঝা যায় জিনিসগুলো কীভাবে ভাবনার গভীরে প্রোথিত হয়ে থাকে।"
নারীবাদী আন্দোলনের অগ্রণী মুখ, অধ্যাপক শাশ্বতী ঘোষও মনে করেন টুটু বসুর মতো লোকজন কন্যাসন্তানদের বৈষম্যের দৃষ্টিতে দেখেন বলেই সম্ভবত তাদের উচ্ছ্বাসও ওই ভাষাতেই প্রকাশ করেন।
তিনি বলছিলেন, "আমাদের জনপ্রিয় চিত্রতারকা দেব আফ্রিকায় একবার টাফ শ্যুটিং শিডিউলের পর খুব ক্লান্ত, এটা বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন মনে হচ্ছে যেন 'রেপড' হয়ে গেছি। এখন আবার টুটু বসুর এই 'শকার'। আজকের সমাজেও মেয়েদের যে কী চোখে দেখা হচ্ছে, সেটা তো এগুলো থেকেই বোঝা যায়।"
সন্তান ছেলে না মেয়ে হবে, এটা নির্ভর করে বাবা 'এক্স' না 'ওয়াই' - তাকে কী ক্রোমোজোম দিচ্ছেন, তার ওপর। মায়ের এখানে কোনও ভূমিকা নেই, কারণ মা-র কাছ থেকে সন্তান সব সময়ই 'এক্স' ক্রোমোজোমই পেয়ে থাকে।
সেই বৈজ্ঞানিক তথ্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে শাশ্বতী ঘোষ আরও বলছিলেন, "টুটু বসু নিজেও তো একজন বাবা। আমি জানি না তার কোনও কন্যাসন্তান আছে কি না, কিন্তু তার ছেলেই হোক বা মেয়ে - তার জন্য তিনিই যে একমাত্র দায়ী এটা মনে রাখলেও বোধহয় ভাল করতেন!"
তবে মোহনবাগান সভাপতিকে অতটা কড়া ভাষায় আক্রমণ করতে রাজি নন বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের একজন, ভারতের সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারজয়ী লেখক বাণী বসু।
বাণী বসু বিবিসিকে বলছিলেন, "এই কথা থেকে যে মনোভাব বেরিয়ে এসেছে সেটা যে পছন্দ করার মতো নয় তা মানি। তবে কি, ভাষার লবজেও এমন কিছু কথাবার্তা থাকে যা বহুদিন ধরে চলে আসছে। মানুষ সব সময় অত ভেবেচিন্তেও বলে না, মুখ দিয়ে ওগুলো অনেক সময় এমনিই বেরিয়ে আসে।"
"আজকাল তো আবার 'পলিটিক্যালি কারেক্ট' কথাবার্তা বলার হিড়িক পড়েছে। আমার মনে হয়, রাজনৈতিকভাবে শুদ্ধ কথাবার্তা বলতে গিয়ে ভাষার পুরনো ইডিয়মগুলো, দেশজ প্রবাদ-প্রবচনগুলো আমরা নষ্ট করে ফেলছি। টুটুবাবুর মন্তব্যকে সমর্থন করছি না, কিন্তু এটা নিয়ে অত হইচই করার কিছু আছে বলেও মনে হয় না।"
সাহিত্যিক বাণী বসু টুটু বসুকে এক রকম 'বেনিফিট অব ডাউট' দিতে তৈরি থাকলেও তার প্রতি অতটা নরম মনোভাব দেখাতে একেবারেই রাজি নন ড: শমিতা সেন।
নিজের গবেষণার রেফারেন্স দিয়ে তিনি বলছিলেন, "পশ্চিমবঙ্গের দিকেও যদি আজ তাকাই, দেখব এখানেও নারীদের ফার্টিলিটি ডিক্লাইন হয়েছে, পরিবারের আকার অনেক ছোট হয়েছে। এই রাজ্যে লিঙ্গ অনুপাতও খুব খারাপ নয়। সেই পটভূমিতে দেখলেও কিন্তু বলতে হবে বড্ড সেকেলে, বড্ড পুরনোপন্থী কথাবার্তা বলেছেন তিনি।"
"আর তা ছাড়া তিনি তো সমাজের এলিট, সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর লোক। এই ধরনের অভিজাত ঘরে আজকাল ছেলেমেয়ের ফারাক অনেক কমে গেছে। সে সব ঘরে মেয়েরা কী না করছে - বড় বড় চাকরি করছে, অ্যাডভেঞ্চারে যাচ্ছে, স্টার্ট-আপ খুলছে, চাঁদেও পাড়ি দিচ্ছে। তারপরেও তিনি কী করে এ ধরনের কথা বলতে পারেন আমার মাথায় ঢোকে না!"
অধ্যাপক শাশ্বতী ঘোষও যোগ করছেন, "মোহনবাগান সভাপতির নিশ্চয় জানা উচিত ফুটবল মাঠে মেয়েরা যাওয়া শুরু করার পর থেকেই মাঠের পরিবেশ অনেক ভদ্রসভ্য হয়েছে, গালাগালির ধরনও পাল্টেছে। এখন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট নিজেই যদি মেয়েদের জন্য অপমানজনক কথাবার্তা বলেন, তাহলে তারা কীভাবে গ্যালারিতে বসতে ভরসা পাবেন?"
এই তুমুল সমালোচনা ও আক্রমণের মুখে টুটু বসু নিজে অবশ্য এদিন একটি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, তার ওই মন্তব্যের জন্য তিনি দু:খ প্রকাশ করছেন ও কাউকে আঘাত করা তার কখনওই উদ্দেশ্য ছিল না।
"আমার পরিবারেও পুত্রবধূরা, নাতনিরা আছেন - কাজেই কন্যাসন্তানের গুরুত্ব আমি জানি। পুত্রকন্যারা সবাই আমাদের পরিবারের আত্মজ", এই কথা বলে তিনি বুধবার ফুটবল মাঠে করা মন্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। সূত্র: বিবিসি বাংলা।
এবিএন/মমিন/জসিম
এই বিভাগের আরো সংবাদ