মহামানবের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি
তোফায়েল আহমেদ
১৫ আগস্ট ২০২০, ১৪:১৩ | অনলাইন সংস্করণ
ইতিহাসের মহামানব, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৫তম শাহাদতবার্ষিকীতে- সেদিনের সেই কালরাতে জাতির পিতার পরিবারের সদস্যবৃন্দসহ যারা ঘাতকের নির্মম বুলেটে প্রাণ হারিয়েছিলেন তাদের সকলকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি ।
শোকাবহ এই দিনটি জাতীয় শোক দিবস রূপে দেশ-বিদেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় ভাবগম্ভীর পরিবেশে প্রতি বছর পালিত হয়। কিন্তু এবার ‘করোনা ভাইরাস’ মহামারি আকারে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ায় বাংলাদেশও আক্রান্ত। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সতর্কতার অংশ হিসেবে ‘জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ’ তথা ‘মুজিববর্ষ’, ‘গণহত্যা দিবস’, ‘স্বাধীনতা দিবস’, ‘বাংলা নববর্ষ’, ‘মুজিবনগর দিবস’, ‘শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস’, ‘৬ দফা দিবস’, ‘আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী’ এবং ‘শেখ কামাল ও বঙ্গমাতার জন্মদিন’ পালন উপলক্ষ্যে গৃহীত রাষ্ট্রীয় ও দলীয় অনুষ্ঠানাদি সীমিতকরণ বা স্থগিত করা হয়েছে। আশা করি, সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশাবলি সরকার অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন এবং দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণ দায়িত্বশীল আচরণের মধ্য দিয়ে এই ভয়াবহ দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।
শোকের মাস আগস্টেও ১৫ তারিখে দুনিয়ার নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু জাতির জনককে আমরা হারিয়েছি—যার জন্ম না হলে এই দেশ স্বাধীন হতো না এবং আজও আমরা পাকিস্তানের দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ থাকতাম। বছর ঘুরে এবারের শোক দিবস আমাদের জাতীয় জীবনে ফিরে এসেছে ভিন্নরূপে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ তথা ‘মুজিববর্ষ’ উপলক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপের ফলে জাতির জনকের জীবন ও কর্মের গবেষণালব্ধ বহুবিধ দিক উন্মোচিত হওয়ায় তিনি আজ স্বমহিমায় প্রকাশিত। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকে ’৯৬-এর আগে পর্যন্ত স্বৈরশাসকেরা দেশে সর্বব্যাপী ভয়ের সংস্কৃতি বলবত্ করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করেছিল। সেসব অন্যায় ইতিহাসের সত্যের সে াতে ভেসে গেছে। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে ‘আওয়ামী লীগ’, ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘বাংলাদেশ’ যে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত ও সমার্থক, আজ তা সকলের কাছে সুস্পষ্ট। বঙ্গবন্ধু রচিত দুইটি গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ জাতীয় ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দলিল। অমূল্য এই গ্রন্থদ্বয় প্রকাশ করায় বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। ইতিহাসের অনেক অজানা কথা এই বই দুটো থেকে আমরা জানতে পেরেছি।
বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হূদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছি, এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয় নাই। একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে।’ সেই লক্ষ্য সামনে নিয়ে ’৪৮-এর ৪ জানুয়ারি প্রথমে ছাত্রলীগ, পরে ’৪৯-এর ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ’৪৮ ও ’৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট, ’৫৬-এর শাসনতন্ত্র, ’৬২-এর শিক্ষা ও ’৬৪তে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন। ’৬৬তে স্বায়ত্তশাসন-স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় বাঙালির মুক্তিসনদ ৬ দফা দাবির ভিত্তিতে দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলেন, যা পরবর্তীকালে ১১ দফা দাবির ভিত্তিতে ’৬৯-এ দেশব্যাপী প্রবল গণআন্দোলন-গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে সংগ্রামী ছাত্র-জনতা জাতির জনককে ফাঁসির মঞ্চ থেকে মুক্ত করে এবং কোটি মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হন। এভাবেই মহান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ভূমিধস বিজয় অর্জন করে বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণ করেন তিনিই বাঙালির একমাত্র বৈধ রাজনৈতিক নেতা। নির্বাচনের পর সামরিক শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে টালবাহানা শুরু করলে সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগ দলীয় জনপ্রতিনিধিদের আসন্ন সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতিপর্ব শুরু করেন। এর অংশ হিসেবে ’৭১-এর ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে ১০ লক্ষাধিক লোকের সামনে জনপ্রতিনিধিদের শপথ অনুষ্ঠান; ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে পার্লামেন্টারি পার্টি গঠন ও ২১ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে শহিদ মিনারের পবিত্র বেদিতে দাঁড়িয়ে জনসাধারণকে ষড়যন্ত্র মোকাবিলা ও আসন্ন সংগ্রামের প্রস্তুতির নির্দেশনা প্রদান করেন। ৩ মার্চ আহূত জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে ১ মার্চ হোটেল পূর্বাণীতে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন প্রশ্নে যখন আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সভা চলছিল, তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের আকস্মিক বেতার ভাষণে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত ঘোষণা করলে বঙ্গবন্ধু সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা করেন। আসে ঐতিহাসিক সাতই মার্চ। যেদিন তিনি ভুবনবিখ্যাত ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণ আজ বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে আসীন। এর পর থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ পরিচালিত হতে থাকে এবং নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র জাতিতে পরিণত করে জাতীয় মুক্তির মোহনায় দাঁড় করান। ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নীলনকশা অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করলে, ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করে বলেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে হাতিয়ার তুলে নিয়ে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে একসাগর রক্তের বিনিময়ে ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর আমরা মহত্তর বিজয় অর্জন করি এবং ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বিজয়ী বীরের বেশে বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। লন্ডন হয়ে দেশে ফেরার প্রাক্কালে এক সংবাদ সম্মেলনে বিদেশি সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করেছিল, ‘আপনার দেশ তো ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে।’ উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার দেশের মানুষ যদি থাকে, মাটি যদি থাকে, তাহলে এই ধ্বংসস্তূপ থেকেই একদিন সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা সোনার বাংলা গড়ে উঠবে।’ দুইটি লক্ষ্য নিয়ে তিনি রাজনীতি করেছেন। এক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা। দুই, বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করা। গর্ব করে বলতেন, ‘আমার বাংলা হবে রূপসী বাংলা, আমার বাংলাদেশ হবে সোনার বাংলা, আমার বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড।’ আজ তিনি টুঙ্গিপাড়ার কবরে শায়িত। আর কোনোদিন তিনি আসবেন না। সেই দরদি কণ্ঠে বাঙালি জাতিকে ডাকবেন না ‘ভায়েরা আমার’ বলে।
দেশ স্বাধীনের পর শূন্য হাতে যাত্রা শুরু করেন। গোলাঘরে চাল নেই, ব্যাংকে টাকা নেই, বৈদেশিক মুদ্রা নেই। রাস্তাঘাট-পুল-কালভার্ট, রেল, প্লেন, স্টিমার কিছুই নেই। যোগাযোগব্যবস্থা ধ্বংসপ্রাপ্ত। কিন্তু অতি তাড়াতাড়ি তিনি যোগাযোগব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করেন। ভৈরব ব্রিজ, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ যেগুলো ধ্বংস করেছিল সেগুলো পুনর্নির্মাণ করেন। বঙ্গবন্ধুর একক প্রচেষ্টায় ভারতীয় সেনাবাহিনী ’৭২-এর ১২ মার্চ বাংলাদেশ ত্যাগ করে। ’৭২-এর ৭-৮ এপ্রিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের বর্ণাঢ্য কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু পুনরায় সভাপতি এবং জিল্লুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ’৭২-এর ৪ নভেম্বর মাত্র সাত মাসে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান প্রণয়ন করেন। জাতীয় সংসদের সফল নির্বাচন করে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেন। আজ যে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট মহাকাশে উেক্ষপিত হয়েছে, তারও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন ’৭৫-এ বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে। সেদিন আমি বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলাম। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন দুই ভাগে। প্রথম ভাগে পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন এবং দ্বিতীয় ভাগে আর্থসামাজিক উন্নয়ন। ’৭৪-৭৫-এ বোরো মৌসুমে ২২ লাখ ৪৯ হাজার টন চাল উত্পাদিত হয়, যা ’৭৩-৭৪-এর চেয়ে ২৯ হাজার টন বেশি। বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ডিসেম্বরে ঘোষণা দেবেন দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। যে মুহূর্তে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে স্বাভাবিক করলেন, অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি দিলেন, ঠিক তখনই ঘাতকের নির্মম বুলেটে একাত্তরের পরাজিত শক্তি, বাংলার মিরজাফর বেইমানরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। ঐ সময় তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রবাসে থাকায় ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পান।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় ’৭৫-এর ১৪ আগস্ট। প্রতিদিনের মতো সকালবেলা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর, সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গণভবনে যাই। দিনের কাজ শেষে দুপুরবেলা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই টেবিলে বসে একসঙ্গে খেয়েছি। বাসা থেকে বঙ্গবন্ধুর খাবার যেত। পরম শ্রদ্ধেয় বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব—যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জীবনসঙ্গী। সুখে-দুঃখে, আপদে-বিপদে যিনি বঙ্গবন্ধুকে যত্ন করে রাখতেন। নিজ হাতে রান্না করে বঙ্গবন্ধুকে খাওয়াতেন। খাওয়া শেষে বঙ্গবন্ধু বিশ্রাম নিলেন। এরপর গণভবনে নিজ কক্ষে বসলেন। বঙ্গবন্ধু প্রায় প্রতিদিন বিকালে মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের সঙ্গে দৈনন্দিন রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করতেন। একসঙ্গে চা পান করতেন। এরপর রাত ৯টায় স্বীয় বাসভবনে ফিরতেন। বঙ্গবন্ধুকে পৌঁছে দিয়ে আমি বাসায় ফিরতাম। যেতামও একসঙ্গে, ফিরতামও একসঙ্গে। সেদিন বঙ্গবন্ধু আমাকে কাছে ডেকে বলেছিলেন, ‘কাল সকালে আমার বাসায় আসবি। আমার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবি।’ আমার আর প্রিয় নেতার সঙ্গে প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাওয়া হয়নি।
লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি
এই বিভাগের আরো সংবাদ