শেখ কামাল : শুদ্ধশীল তরুণসমাজ ও জাগ্রত শুভবোধ

  সুভাষ সিংহ রায়

০৫ আগস্ট ২০২০, ১১:১৫ | অনলাইন সংস্করণ

শেখ কামাল বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ সন্তান। মাত্র ২৬ বছরের জীবন ছিল তাঁর। শেখ কামালের বিশ্বাসে ছিল দৃঢ়তা। সেই সময়ের যুবসমাজকে তিনি ভরসার কথা শোনাতে চেয়েছেন। কেননা তিনি জানতেন, আছে এক শুদ্ধশীল তরুণসমাজ। আছে শুভবোধ। এইটুকু জেনে যাক তারা অন্ধকারই শেষ কথা নয়। এই যুদ্ধ রক্ত হিংসাদ্বেষের ওপারে। আরেক চেতনার আলো জ্বলে ওঠে নিস্তব্ধ আঁধারে। শেখ কামাল নীতিগতভাবে এই চেতনাকে ধারণ করতেন। কিন্তু এই অল্প বয়সের জীবনে কী করেছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। বাস্কেট বল খেলতেন, দারুণ ক্রিকেট খেলতেন, ভালো অভিনয় করতেন, নাট্য সংগঠক ছিলেন, দারুণ সেতার বাজাতেন। স্বাধীন বাংলাদেশের ফুটবল খেলার আধুনিকতার জনক। শেখ কামাল অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। শেখ কামাল মুক্তিযুদ্ধের সময় সর্বোচ্চ

C-in-C (Specialist) ট্রেনিং গ্রহণ করেন। ট্রেনিং শেষে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেখলেন যুবসমাজ বিভ্রান্ত, দিশাহীন। শেখ কামাল লক্ষ করেছিলেন সমাজ যেন তারুণ্যবিরোধী হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তরুণরা প্রতিবাদী—সমাজের সামনে যাওয়ার পথ যারা আগলে রাখে, তরুণরা তাদের রুখে দিতে চায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শেখ কামাল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তারুণ্যকে সমর্থন করতে হবে; তাদের সামনে ভালো উদাহরণ থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। বিষাদগ্রস্ত দিনে তরুণরা জাগিয়ে দিতে পারে সারা দেশের বিবেকটাকেও।

শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াঙ্গনে তাঁর পদচারণ খুব ছোটবেলা থেকেই। তাঁর বাল্য স্কুল ছিল ঢাকার সেগুনবাগিচার প্রখ্যাত ডনস স্কুলে। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত আচরণের কারণে ক্লাস শিক্ষিকা মিসেস এলিজাবেথ শেখ কামালকে মনিটর নিযুক্ত করেন। একজন মেধাবী ও হাসিখুশি ছাত্র হিসেবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সহজেই সক্ষম হন শেখ কামাল। স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নয়, বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানেও তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। ডনস স্কুলের পরে তিনি ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শাহীন হাই স্কুলে ভর্তি হন। প্রথম বছরেই স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তিনটি স্বর্ণ ও সাপ্তাহিক সাংস্কৃতিক উৎসবে দু-দুটি প্রথম পুরস্কার ও একটি সম্মানসূচক সনদ পেলে তাঁর বহুমুখী প্রতিভার কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। শেখ কামাল ১৯৬৭ সালে শাহীন হাই স্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি ১০০ মিটার দৌড় ও হাই জাম্পে প্রথম স্থান এবং ২০০ মিটার দৌড় ও লং জাম্পে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে চমক সৃষ্টি করেন। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় শেখ কামাল দুইবার চ্যাম্পিয়ন হন।

কলেজের বার্ষিক সাংস্কৃতিক সপ্তাহে কবিতা আবৃত্তি, উপস্থিত বক্তৃতা, নির্ধারিত বক্তৃতা ও কৌতুকে অংশগ্রহণ করে একে একে তিন-তিনটি প্রথম পুরস্কার লাভ করে ছাত্র, শিক্ষক সবার প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। শেখ কামাল ১৯৬৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে আইএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। একজন কৃতী ক্রীড়াবিদ হিসেবে খুব অল্প সময়েই তিনি সুপরিচিতি লাভ করেন। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হিসেবে বিভিন্ন ভলিবল টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেছেন। আন্ত বিভাগ প্রতিযোগিতায় তাঁর দল চ্যাম্পিয়ন হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সপ্তাহ উপলক্ষে আয়োজিত ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ব্যাডমিন্টনে মুরাদ লতিফকে নিয়ে তিনি দ্বৈতে রানার্স-আপ হন। স্বাধীনতার আগে শেখ কামাল ধানমণ্ডি ক্লাবের হয়ে রাইট ব্যাক পজিশনে ফুটবল খেলতেন। ১৯৭৪-৭৫ মৌসুমে জাতীয় ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দলের সহ-অধিনায়ক ছিলেন।

১৯৬৮ সালে তিনি ধানমণ্ডি ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান ও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক নীতি শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, ক্রীড়াক্ষেত্রেও তা প্রকট হয়ে ওঠে। ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যে অনুষ্ঠেয় ক্রিকেট খেলায় পূর্ব পাকিস্তানের চার-পাঁচজন খেলোয়াড়ের অন্তর্ভুক্ত থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে দেখা গেল বাঙালিদের মধ্য থেকে শুধু রফিকুল হাসানকে নেওয়া হয়েছে। শেখ কামাল একজন ভালো ক্রিকেটারও ছিলেন। স্বাধীনতা-উত্তর তিনি একজন নির্ভরযোগ্য ক্রিকেটার হিসেবে উদীচী এবং ধানমণ্ডির হয়ে খেলেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট দলের একজন নিয়মিত সদস্য ছিলেন শেখ কামাল। আবাহনী ক্রীড়াচক্রে একসময় বল হাতে ওপেনিং করেছেন জাহাঙ্গীর শাহ বাদশার সঙ্গে।

২.

দেশের বিপথগামী তরুণদের খেলাধুলার মাধ্যমে সুস্থ-সুন্দর পথে ফেরানোর পরিকল্পনা ছিল তাঁর। তাঁর দরদ ছিল ব্রাদার্স ইউনিয়নের জন্য। এই ক্লাবের অর্থ সংকট ঘোচাতে তিনি শিল্পী রুনা লায়লাকে দিয়ে গানের শোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের শেষের দিকে মধুমিতা হলে অনুষ্ঠিত এই শোর গল্প বলেছেন আবাহনীর গোলাম সারোয়ার টিপু, ‘এই শোর সব অর্থ গিয়েছিল ব্রাদার্সের ফান্ডে, সেটি নিয়ে বেশি তৎপর ছিল কামাল। তার নিজের ক্লাবে টিকিট কেনার বাধ্যবাধকতা জারি করেছিল। আবাহনীর জন্য কারো কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা পেলে তার একটি অংশ কয়েকটি ক্লাবে দেওয়া হতো।’

ক্লাব সব সময় নিজের স্বার্থ দেখে, কম টাকায় খেলানোর চেষ্টা করে খেলোয়াড়দের। এদিকে খেলোয়াড়রা চাইছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠা। আর এই প্রতিষ্ঠা দিতে তাঁদের সঙ্গে শরিক হন শেখ কামাল। তিনি বিশ্বাস করতেন, খেলোয়াড়রা ফুটবল খেলে আর্থিক এবং সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হলেই খেলাটির উন্নতি হবে। তাই খেলোয়াড়দের স্বার্থটা আগে ছিল তাঁর কাছে। দুস্থ খেলোয়াড়দের সাহায্য-সহযোগিতা দিতে ১৯৭৫ সালে গঠিত ‘বঙ্গবন্ধু কল্যাণ ট্রাস্ট’-এরও অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশে ফুটবল ফেডারেশনের জন্ম ১৯৭২ সালে। তার আগের ফুটবল কমিটির সদস্য থাকলেও শেখ কামাল স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ফুটবল ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটির কোনো পদে ছিলেন না। তবে সদস্য ছিলেন বাফুফের প্রশিক্ষণ ও জাতীয় দল নির্বাচক কমিটির। এই কাজটি তিনি বেশ উপভোগ করতেন।

প্রেসিডেন্সি কলেজের অভিভাষণে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘নূতনত্বে আর নবীনত্বে প্রভেদ আছে। নূতনত্ব কালের ধর্ম, নবীত্ব কালের অতীত। মহারাজ বাহাদুর আকাশে যে জয়ধ্বজা ওড়ান, আজ সে নতুন, কাল সে পুরানো। কিন্তু সূর্যের রথে অরুণধ্বজা ওড়ে, কোটি কোটি যুগ ধরে প্রতিদিনই সে নবীন। নতুন আসে অকস্মাতের খোঁচা দিতে, নবীন আসে চিরদিনের আনন্দ দিতে।’ শেখ কামাল সব সময় চির নতুনের ডাক দিয়ে মূলত চির নবীনদের সন্ধান করেছেন। 

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক, প্রধান সম্পাদক- দৈনিক বাংলা সময়, সাপ্তাহিক বাংলা বিচিত্রা ও এবিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম।

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

এই বিভাগের আরো সংবাদ