আজকের শিরোনাম :

বন্যপ্রাণী রক্ষায় প্রচলিত আইন ও আমাদের দায়বদ্ধতা

  তপন কুমার রায়

০৮ জুন ২০২০, ১৩:০৮ | অনলাইন সংস্করণ

১.একটি অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করি। মাস দুয়েক আগের ঘটনা। জনৈক ব্যক্তি থানায় এসেছেন দুটি পোষা মৃত হাঁস নিয়ে। আগত ব্যক্তির অভিযোগ প্রতিবেশী ব্যক্তি তার হাঁস দুটিকে বিষ প্রয়োগে মেরে ফেলেছেন। এই ঘটনায় অভিযোগকারী হাসের মালিক প্রতিবেশী ব্যক্তির বিচার চান। পুলিশের শরণাপন্ন হয়ে শেষমেষ থানায় এসেছেন। পুলিশে আমি নতুন। শিক্ষানবিশ হিসেবে আমি আগত ব্যক্তির থানায় আসার হেতু শুনে অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে শুধু দাঁড়িয়ে রইলাম। উপস্থিত এক পুলিশ সদস্য আগত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে বললেন, ‘এলাকার মেম্বারকে বিষয়টি জানান নাই? উনি তো মীমাংসা করে দিতে পারেন।’ হাঁসের মালিক জানালেন, জানিয়েছেন কিন্তু মেম্বার সামান্য হাঁস মারার বিষয়ে আসতে চাননি। তাই শেষমেষ থানায় এসেছেন। ডিউটিরত ওই পুলিশ সদস্য আগত ব্যক্তির এমন জবাবে বললো, মেম্বার যদি না আসে পুলিশের তো অনেক কাজ। ভুক্তভোগী ব্যক্তির জোরালো আবদারে শেষে ওই ব্যক্তির বিস্তারিত নাম ঠিকানা লিখে নিলো থানার ডিউটি অফিসার। "আপনার বাড়ি পুলিশ যাবে। আপনি এখন যান।" এমন প্রতিশ্রুতিতে লোকটা আশাবাদী হয়ে সাইকেলের পিছনে মৃত হাঁস দুটি ঝুলিয়ে চলে গেলো।

দুটি হাঁস মারার ঘটনা মেম্বারের কাছে নিছক ছোট ঘটনা মনে হতে পারে। কিংবা থানা পুলিশের বড় বড় কাজের ব্যস্ততায় সামান্য দুটি হাঁস মারার অভিযোগও চাপা পড়তে পারে। খুন, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতির ঘটনায় দুটি হাঁস মারার ঘটনা নিছক ছোট ঘটনা মনে হলেও দেশের প্রচলিত আইন কি বলে?  প্রাণীকল্যাণ আইন-২০১৯ নামে একটি আইনেই উপরোক্ত ঘটনার প্রতিকার পাওয়া যেতে পারে। এই আইন অনুযায়ী এহেন অপরাধ অ-আমলযোগ্য অপরাধ হলেও বিষ প্রয়োগে প্রাণী হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে দন্ডদানেরও বিধান আছে। প্রাণীকল্যাণ আইন-২০১৯ এর ১৬(খ) ধারা অনুযায়ী বিষ প্রয়োগে প্রাণী হত্যার অপরাধ প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তি অনধিক দুই বছরের বিনাশ্রম কারাদন্ড এবং অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয়দন্ডেই দন্ডিত হতে পারে।  এমনকি অপরাধ তফশিলভুক্ত হওয়া সাপেক্ষে মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯ অনুযায়ীও প্রাণীকল্যাণ আইন-২০১৯ এর আওতাধীন অপরাধসমূহের বিচারকার্য পরিচালনা করা যাবে (প্রাণীকল্যাণ আইন-২০১৯, ধারা-২০)।

২."জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।" স্বামী বিবেকানন্দের এমন বাণীর অমরত্ব মানবতাকে কতখানি ছুঁতে পেরেছে তা নিয়ে বিস্তর সন্দেহ আছে। সম্প্রতি দেশে-বিদেশে বেশকিছু ঘটনাই আমার মতামতের দ্বিমত পোষণে আপনাদেরকে শান্ত করতে পারে। ভারতের কেরালায় আনারসের ভিতরে আতশবাজি ঢুকিয়ে বন্য হাতিকে খাইয়ে মৃত্যুর মুখে পতিত করার অভিযোগের ঘটনা বিশ্ববিবেককে যে ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছে তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। আমরা যে বিবেকবর্জিত হতে বসেছি সে বিষয়েও সন্দেহ কম। বুদ্ধিবলে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার হলেও মানুষ আজ নিকৃষ্টতম কাজে পটু হতে চলছে। বিদেশ থেকে দেশের কথায় আসি। চলতি বছরের শুরুতেই জানুয়ারি মাসে কক্সবাজারে গুলি করে হাতি হত্যার কথা দেশের মানুষের মনে দাগ না কাটলেও গেলো ৫ মে মাদারীপুরে খাবারের সাথে বিষ মাখিয়ে ১৫ টি বানর হত্যা করার খবর অনেকের বিবেককে নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছে। গণমাধ্যমে বানর হত্যার খবরে মানুষ নিমিষেই প্রতিবাদী মনোভাব দেখানোয় নিষ্পাপ মৃত বানরগুলোর নিথর দেহগুলো সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। সমসাময়িক কেরালার ঘটনায় দেশের মানুষ যতটা না হায় হুতাশ করেছে তার কিঞ্চিৎ পরিমাণও করেনি একই সময়ে ঘটে যাওয়া গত ৩ জুন চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বিপন্ন প্রজাতির মেছোবাঘকে পিটিয়ে হত্যা করা ঘটনায়। দুই একটি গণমাধ্যম ব্যতীত খবরটি বেশিরভাগ গণমাধ্যমেও স্থান পায়নি। গণমাধ্যমে প্রাপ্ত খবর ও ছবি অনুযায়ী মেছোবাঘ হত্যাকারীরা মৃত জীবটি ঘাড়ে নিয়ে উল্লাস করেছেন। এমন দন্ডনীয় অপরাধ করেও অপরাধীদের উল্লাস আমাদেরকে ভাবিয়ে তোলে। অবশ্য গণমাধ্যমের খবর, সংশ্লিষ্ট বনবিভাগ উক্ত ঘটনায় মামলা করবে বলেও জানিয়েছে।

এটি এখন স্পষ্ট যে, আমাদের হাতেই বন্যপ্রাণীর ভবিষ্যৎ নিহিত। মানুষের হাতেই বন্যপ্রাণীর বাঁচা-মরা। জীববৈচিত্র্য, বন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধানকল্পে প্রণীত আইনেই এর সমাধান করা আশু প্রয়োজন। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ বাস্তবায়নেই রক্ষা পেতে পারে বন্যপ্রাণীরা। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ এর ৩৬ ধারা মতে হাতি ও বাঘ হত্যা দন্ডনীয় অপরাধ। আমলযোগ্য ও জামিন অযোগ্য এই অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি কমপক্ষে ২ বছর সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদন্ড অথবা কমপক্ষে ১ লক্ষ টাকা, সর্বোচ্চ ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত এবং একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটলে সর্বোচ্চ ১২ বছর কারাদন্ড অথবা সর্বোচ্চ ১৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা দন্ডে দন্ডিত হবেন। তবে এক্ষেত্রে আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগ হলে ব্যক্তিক্রম রয়েছে। 

৩.‘বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতক্রোড়ে’ এমন প্রবাদের নিশ্চিত বিধানে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ সর্বত্র কার্যকরী পদক্ষেপ জরুরি। এই আইনেই নিহিত আছে বন্যপ্রাণীদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। যেই আইনের আলোকেই গঠিত বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণ/দমন ইউনিট যুগান্তকারী কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। বন্যপ্রাণী হত্যা, শিকার, পাচাররোধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। এক্ষেত্রে বন বিভাগকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। সহযোগিতার মনোভাবে সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে। সর্বোপরি বন অধিদপ্তরের বন বিভাগ বন্যপ্রাণী রক্ষায় সর্বোত্তম কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে প্রত্যাশা রাখি। 

লেখক- শিক্ষানবিশ উপ পুলিশ পরিদর্শক
ই-মেইল: [email protected]

এই বিভাগের আরো সংবাদ