আজকের শিরোনাম :

আনিসুজ্জামান, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

  ড. আতিউর রহমান

১৬ মে ২০২০, ১৯:৩৭ | অনলাইন সংস্করণ

ভরসার বাতিঘর, জাতির বিবেক, পথপ্রদর্শক, ধর্মান্ধতা ও কুপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে সাহসী যোদ্ধা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তবুদ্ধি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সংরক্ষণে সদা সক্রিয় আমাদের প্রিয় আনিসুজ্জামান স্যারের চিরবিদায় পরিণত বয়সে হলেও মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। স্যারের সঙ্গে আমার ছিল এক আত্মিক সম্পর্ক। আমার অভিভাবক। মুক্তবুদ্ধি চর্চার পথিকৃৎ জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সব অর্থেই একজন অনুকরণীয় শিক্ষক ছিলেন। জাতির প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নেই তাকে দেখা গেছে সম্মুখ সারিতে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ, আশির দশকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলন এবং নব্বইয়ের দশকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তিনি সদা তৎপর ছিলেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে তিনি জাতিকে চির কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করে গেছেন।

স্বল্পভাষী, নিপাট ভালো মানুষ, নীতিতে অটল কিংবদন্তিতুল্য শিক্ষক আনিসুজ্জামান স্যার বিশ্বখ্যাত একজন গবেষক ছিলেন। পৃথিবীর নানা বিশ্ববিদ্যালয় ও জ্ঞানকেন্দ্রে তিনি অতিথি গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন। 'মুসলমান মানস ও বাংলা সাহিত্য', 'স্বরূপের সন্ধানে', 'আমার একাত্তর', 'বাঙালি নারী :সাহিত্যে ও সমাজে', 'কাল নিরবধি', 'বিপুলা পৃথিবী'র মতো অসংখ্য কালজয়ী সাহিত্য ও সৃষ্টিশীল কর্মের জন্য তিনি চিরদিন অমর হয়ে থাকবেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য, মুক্ত স্বদেশে প্রথম শিক্ষা কমিশনের সদস্য, নজরুল ইনস্টিটিউট এবং বাংলা একাডেমির ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি ছাড়াও অসংখ্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের মাননীয় উপদেষ্টা, জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছিলেন বহুমুখী এক বিরল প্রতিভা। শিল্প-সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার ছাড়াও অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ভারত সরকার তাকে পদ্মভূষণে ভূষিত করেছে। দু'বার আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'জগদ্দাত্রি' পুরস্কার এবং রবীন্দ্র-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি-লিট প্রাপ্ত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সৃষ্টিশীলতা ও মেধা সারাবিশ্ব জুড়েই স্বীকৃত।

স্যার বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ছিলেন। আমাদের সংবিধানের বাংলা ভাষ্য লেখার দায়িত্ব তিনি তাকেই দিয়েছিলেন। শিক্ষা কমিশনেও যুক্ত করেছিলেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধুর নান্দনিক ভাবনা বিষয়ক আমার এক গবেষণার জন্য স্যারের সঙ্গে তার গুলশানের বাসায় সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। শরীর ভালো নেই। তবুও কী উদার আহ্বান। দীর্ঘক্ষণ কথা বললেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশের জন্য তাই ওই আলাপচারিতার প্রধান প্রধান অংশ পাঠকদের সামনে তুলে ধরাকেই আমি শ্রেয় মনে করছি।

প্রশ্ন : বঙ্গবন্ধুর যে ব্যক্তিত্ব, তার যে চরিত্র, তার যে সংস্কৃতি-প্রীতি, তার কণ্ঠ, তার দেহ-সৌষ্ঠব, শিল্প-সংস্কৃতিজনদের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক, শিক্ষকদের প্রতি তার যে শ্রদ্ধা, একেবারে সাধারণ মানুষের প্রতি তার যে ভালোবাসা, রবীন্দ্রনাথকে তিনি যেভাবে ধারণ করেছেন, নজরুলকে যেভাবে ধারণ করেছেন, সব মিলিয়েই একটা নান্দনিক চরিত্র বলে মনে হয় বঙ্গবন্ধুকে। আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, বিশ্নেষণ, মতামত সব মিলিয়ে এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?

আনিসুজ্জামান : বঙ্গবন্ধু যে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গান ভালোবাসতেন, গুন গুন করতেন এবং তার বক্তৃতার মধ্যে যে ব্যবহার করতেন, এই কথা আমরা সবাই জানি। আব্বাস উদ্দিনের গান শুনে তিনি বিশেষভাবে মোহিত হতেন। বলেছেন যে, ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে বাতাস যখন বয়ে যায়, তখন ধানক্ষেতের যে ছবি তিনি দেখেন, তার সঙ্গে আব্বাস উদ্দিনের গানের সাযুজ্য তিনি দেখতে পান। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আছে, অল্প বয়সে যখন তিনি দিল্লি-আগ্রা গিয়েছিলেন, তখন বিশেষ করে সেখানকার স্থাপত্য দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি কেন মুগ্ধ, সেটির বর্ণনা থেকে তার নান্দনিক বোধ বোঝা যায়। পরবর্তীকালে বাংলা সংস্কৃতির প্রতি তার যে ভালোবাসা, সেটা নানাভাবে প্রকাশ পেয়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বেরিয়ে আসার পর বাংলা একাডেমিতে গিয়ে তিনি বাংলা ভাষা প্রচলনের সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতিকে আপন করে নেওয়ার প্রসঙ্গে বললেন। ১৯৭২ সালে আমাদের সংবিধান রচিত হয়। স্থির হলো যে, এ কে এম আব্দুর রউফ গোটা সংবিধান হাতে লিখবেন এবং তারপর সংসদ সদস্যরা তাতে সই করবেন। বঙ্গবন্ধু শিল্পী জয়নুল আবেদিনকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, যে কপিটায় সই করা হবে, সেটায় অলংকরণ করে দেওয়ার জন্য। বলে দিলেন যে, বাঙালি সংস্কৃতির রূপ যেন এর পাতায় ফুটে ওঠে। জয়নুল আবেদিন সে দায়িত্ব নিলেন। মনে আছে, আবেদিন সাহেব বঙ্গবন্ধুকে বলছেন যে, একটা লোক-সংস্কৃতি জাদুঘর করে দেওয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলেন এবং এই আলোচনার ভিত্তিতে সোনারগাঁয়ে লোক-সংস্কৃতি জাদুঘর গড়ে উঠল। এটাও লোক-সংস্কৃতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর যে ভালোবাসা এবং বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি তার যে সার্বিক ভালোবাসা তার অংশ। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে যেভাবে ভাষার ব্যবহার করছেন, তার আঞ্চলিক-বাংলা মিশিয়ে বলার মধ্যেও আমি একটা নান্দনিকতা দেখি। প্রথমত, এটা তার অন্তরের ভেতর থেকে আসছে। দ্বিতীয়ত, সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর মতো ভাষা। সারাজীবন তিনি রাজনীতি করেছেন, কিন্তু সেই সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি প্রবল ভালোবাসা পোষণ করেছেন।

প্রশ্ন : আমরা জানি যে, তিনি খুব উদারমনা, আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনেও তিনি খুব গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন এবং সবাইকে নিয়ে কাজ করেছেন। যদি সেদিকে একটু আলোকপাত করেন।

আনিসুজ্জামান : অসাম্প্রদায়িকতার কথা যদি আমরা বলি তাহলে প্রথম বলতে হবে যে, উনি ১৯৪৭-এ যখন কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন, তখন তার রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করতে যান। সোহরাওয়ার্দী বিদায়কালে বলেন- 'যাও দেখ পূর্ববাংলায় যেন দাঙ্গা- হাঙ্গামা না হয়'। তখন বঙ্গবন্ধু মনে করলেন যে, অসাম্প্রদায়িকতার মন্ত্র ছড়ানো তার দায়িত্ব। সেটা আমরা কলকাতায় থাকাকালীন দাঙ্গার সময়েও তার ভূমিকার কথা জানতে পারি তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে। তো এইভাবেই উনি কাজ আরম্ভ করেছিলেন। আমরা দেখছি, তিনি অসাম্প্রদায়িকতা প্রচার করছেন, সেটাকে গ্রহণ করছেন এবং হিন্দু-মুসলমান যাতে একসঙ্গে থাকেন, তার চেষ্টা করছেন। তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ১৯৬৪ সালে যখন দাঙ্গা লাগল, তখন উনি ট্রাকের ওপর চড়ে ঢাকা শহর ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং সেখানে লেখা ছিল 'পূর্ব বাংলা রুখে দাঁড়াও'।

প্রশ্ন : আমরা তার আত্মজীবনীতে এবং রোজনামচাতেও দেখতে পাই যে, কারাগারের ভেতরে একেবারে সাধারণ যারা কয়েদি, লেদুর মতো কয়েদি অথবা কফিলুদ্দিন যে কিনা একজন পাগল, তাদের নিয়ে তার যে পাতার পর পাতা লেখা, তাদের সম্পর্কে যে মানবিক অনুভূতি এবং সেগুলো পরবর্তীতে সংবিধানেও (সাম্য) প্রতিফলিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আপনার মূল্যায়ন কী?

আনিসুজ্জামান : বলা হয় যে তিনি সব মানুষের নেতা। এগুলো তিনি তার জীবনে আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। যাদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে তার অধিকাংশের নাম তিনি মনে রাখতে পারতেন। এটি কিন্তু কম কথা না। মানুষকে তিনি সবসময় কাছে আসতে দিয়েছেন। তিনি যখন অসুস্থ ছিলেন, তাতেও লোকজনের আগমন বন্ধ হয়নি এবং যেই এসেছে, তার সঙ্গে কথা বলেছেন। আমি ১৯৭৪ সালের একসময় তাকে বলেছিলাম আপনার শরীর ভালো না, আপনি ঢাকার বাইরে গিয়ে বিশ্রাম নেবেন। তিনি বললেন, 'আমার কাছে তো লোক আসবে।' তখন আমি বললাম, আসলে দেখা দেবেন না। তখন তিনি বললেন, 'মানুষকে খেতে দিতে পারছি না, পরতে দিতে পারছি না, দেখাও যদি না করি তাহলে আমার আর কী থাকবে।' এই যে তার মানুষের সঙ্গে একাত্মতা, এটা একটা অসাধারণ ব্যাপার ছিল।

প্রশ্ন : ১৯৭২ সালে তিনি ফিরে এলেন, দেশ পুনর্গঠনে হাত দিলেন। সেগুলো ছাড়াও লাখ লাখ মা-বোন যারা আত্মত্যাগ করেছেন, পাকিস্তানিদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন, তাদের পুনর্বাসনের সময় তিনি তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এসব বিষয় নিয়ে একটু বলবেন?

আনিসুজ্জামান : আমি জানি এদের সসম্মানে পুনর্বাসিত করতে খুব জোর দিয়েছিলেন এবং কোনো পরিবার তাদের ফিরিয়ে নিতে না চাইলে তাদের বলা যে না নিতে হবে, তাদের পিতার নাম তিনি শেখ মুজিব লিখতে বলেছিলেন। এভাবে তিনি তাদের যোগ্য সম্মান দিতে চেয়েছেন।

প্রশ্ন : আমি শুনেছি আপনাকে নাকি শিক্ষা সচিবেরও দায়িত্ব দিতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এ রকম একটা ভঙ্গুর দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে গড়ে তুলতে তিনি কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাই।

আনিসুজ্জামান : যখন শিক্ষা কমিশনের কাজের উদ্বোধন হয়, আমি জানতে চেয়েছিলাম বাজেটের কত অংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় হয়। তখন তিনি আমাকে বললেন, 'এগুলো নিয়ে চিন্তা করবেন না, আমি দরকার হলে ভিক্ষা করে টাকা নিয়ে আসব। কিন্তু আপনারা একটা ভালো শিক্ষানীতি দেন, যাতে দেশ একটা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারে।' পরে অবশ্য আমরা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট দিতে দেরিও করলাম, তখন আবার দেশের দুর্ভিক্ষ অবস্থা। এটা আর আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ বা প্রয়োগ করার সময় হলো না। কিন্তু উনি চেয়েছিলেন যে এমন একটা শিক্ষানীতি আমরা গ্রহণ করি, যাতে করে সবাই শিক্ষার আওতায় আসে এবং সবাই একটা উপযুক্ত শিক্ষা পায়, যা দিয়ে তারা স্ব-নিয়োজিত হয়েও খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে। এই যে মানুষকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে হবে, শিক্ষা তার অবলম্বন হবে- এটা তার চিন্তার মধ্যে ছিল।

পুরো জাতি যখন করোনা আক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত, ঠিক এমনই এক কঠিন সময়ে কেন তাকেই যেতে হলো এভাবে? এই প্রশ্ন বুকে চেপেই প্রত্যাশা করছি করোনামুক্ত বাংলাদেশ হবে আরও আধুনিক, মানবিক, উদার গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায়ভিত্তিক। যেমনটি তিনি সর্বদাই চাইতেন। আরও চাইতেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বাংলাদেশকে। কেবল তার আদর্শের প্রতি অনুগত থেকেই আমরা পারি জাতির এই বিবেকের প্রতি প্রকৃত বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে। স্যারের আত্মা শান্তিতে ঘুমুক, সেই প্রার্থনা করছি।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
[email protected]

দৈনিক সমকাল থেকে সংগৃহিত

এই বিভাগের আরো সংবাদ