আজকের শিরোনাম :

মাজেদ খুনির ফেরারি জীবনের কিছু অপ্রকাশিত কথা

  সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল

১৩ এপ্রিল ২০২০, ১১:০১ | অনলাইন সংস্করণ

সেদিন অসহায় শিশু রাসেল মাজেদদের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিল। তবুও হত্যাকারীদের মন গলেনি। তারা নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করেছে নিষ্পাপ শিশুটিকে। পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে নিষ্ঠুর-নির্মম, নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের সেই খুনি মাজেদের যাযাবর জীবনের কথা আমার দুটি বইয়ে (ইনডেমনিটি বিল : মুজিব হত্যার মামলা, শিখা প্রকাশনী, ২০০৫ এবং কানাডায় খুনি নূর চৌধুরী, চন্দ্রদ্বীপ প্রকাশনী ২০১৫, পৃষ্ঠা-২০/২৯/১০৫) যৎসামান্য ইঙ্গিত দিয়েছিলাম, বিভিন্ন তথ্যসূত্র এবং অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১২ আসামির ১২ রকমের কাহিনী আছে। পলাতকদের রয়েছে আত্মগোপনের নানা রহস্যময় রূপকথা। যেমন- কথিত আছে যে আজিজ পাশা জীবিত থেকেও নিজেকে জিম্বাবুইয়ে মৃত ঘোষণা করে অথবা নূর চৌধুরী টরন্টোতে বসবাস করেও লন্ডনে অবস্থানের মিথ্যা খবর এবং ভুয়া ছবি (এই অপকর্ম করেছে লন্ডনের সাংবাদিক সোয়েব এবং টরন্টোর সাগর) দিয়ে কিংবা মাজেদ ভারতে ধর্মান্তরিত হওয়ার নাটক সাজিয়ে আবার নিরুদ্দেশী মেজর ডালিম ‘মুক্তিযোদ্ধা’ এবং ‘বীর উত্তম’ হিসেবে বাঁচার চেষ্টা করছে নানা ছলে-বলে, কলা-কৌশলে। পাশার ঘটনার মতো খুনি ডালিমের সহযোগীরা ২০১৪ সালের নভেম্বরের মিডিয়ায় গুজব ছড়িয়ে দেয় যে, ‘ডালিম মারা গেছে’। আসলে তা ছিল নিরাপদে থাকার আরেক ব্যর্থ প্রয়াস। তার একটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করছি। কোনো কোনো তথাকথিত গণমাধ্যম এসব নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি করে। যেমন- খুনি নূরকে নিয়ে লন্ডনের একটি সংবাদ সংস্থা ধারাবাহিকভাবে প্রচার করতে থাকে- সে ‘এখলাসুর রহমান’ নামে ২৭ বছর ধরে পূর্ব লন্ডনের ডকল্যান্ড বাস করত, কাজ করত কাপড়ের দোকানে, হাজি হিসেবে নামাজ পড়ত ব্রিকলেনে, স্থানীয় মাঠে সামরিক কায়দায় ব্যায়াম করত, ইত্যাদি ইত্যাদি [দ্র. ইউ কে বি ডি নিউজ, ১৬ আগস্ট, ২০১০, লন্ডন]। এই ভুয়া খবরের সঙ্গে টরন্টো থেকে অনলাইন ‘নতুন দেশ’ নামক আরেকটি পত্রিকা তাল দিয়ে বিভ্রান্ত সৃষ্টি করত। তখন বাধ্য হয়ে অটোয়াস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর নওরীন আহসান ১০ নভেম্বর ২০১০ সালে এক বিবৃতি দিয়ে মনগড়া সংবাদ পরিবেশন থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এটি সর্বসাধারণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার প্রয়াস। [দ্র. দৈনিক আমাদের সময়, ১৭ ডিসেম্বর ২০০৯, ঢাকা।]

‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না’। ভারতে নানা সমস্যা এবং বিশ্বে করোনা সংকটের সুযোগে মাজেদ দেশে ঢোকার সময় ইন্টারপোলের রেড এলার্টে (এ-১৮৩৭/৬-২০০৯) ধরা খেল। আবার অন্য একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, তাকে পুশব্যাক করা হয়েছে। দেশে ঢুকে সে মিরপুরের বাসায় ওঠে এবং গোয়েন্দার নজরদারিতে থাকে। তথ্যের সূত্র ধরে ১০/এ বাড়ি, ১ রোড নম্বর, ক্যান্টনমেন্ট আবাসিক এলাকা থেকে অবশেষে মাজেদকে ৬ এপ্রিল গ্রেপ্তার করে কাউন্টার টেররিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। যা এক ঐতিহাসিক ঘটনা। পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে : বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মাজেদ রেডিও স্টেশনে দায়িত্ব পালন করে এবং ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে দেশ ত্যাগের আগ পর্যন্ত বঙ্গভবনে ‘বিভিন্ন দায়িত্ব’ পালন করে। পরে হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্য সেনা ক্যু-কর্মকর্তাদের সঙ্গে তিনি ব্যাংকক হয়ে লিবিয়ায় চলে যায়। পরে সেনাশাসক জিয়াউর রহমান তাকে সেনেগালের দূতাবাসে তৃতীয় সচিবে নিয়োগ দেন। [সরকারি গেজেট : ১৯৯৬, ৮ জুন]। ১৯৮০ সালে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে দেশে ফেরার পর সেই বছরের ২৬ মার্চ তাকে উপসচিব মর্যাদায় বিআইডব্লিউটিসিতে নিয়োগ দেয়া হয়। পরে যুব উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের ‘ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট’ শাখার পরিচালক এবং জাতীয় সঞ্চয় পরিদপ্তরের পরিচালকের দায়িত্ব পায়। এভাবেই জিয়ার ছায়াতলেই খুনি থেকে সচিব হয় আবদুল মাজেদ! ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পরে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার শুরুর সময়ে পালিয়ে যায় মাজেদ। পালিয়ে প্রথমে ভারত, ভারত থেকে প্রথমে লিবিয়া, পাকিস্তান এমনকি কেনিয়াতেও যাতায়াত করে। দিশাহারা মাজেদ পরে স্থির হয় ভারতের কলকাতায়। তার আগে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় আবদুল মাজেদ নিজেকে ‘আবদুল মজিদ’ পরিচয় দিয়ে ছদ্মবেশে ছদ্মনামে অবস্থান করে। শুধু মাজেদ থেকে মজিদই নয়; হিন্দু নাম ধারণ করেও আত্মগোপনে ছিল প্রায় পঁচিশ বছর। মাজেদ ভারত থাকলেও দিশাহারা উদ্বাস্তু হয়ে ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে সুবিধাজনক দেশে যাতায়াত করত বলে অনুমেয়।

২০ আগস্ট ২০১০ সালের দৈনিক সংবাদের একটি খবর থেকে জানা যায়, ২০০৯ সালের ১০ জুলাই নাইরোবি থেকে ভিসার মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার একদিন আগে কৌশলে ভিসার মেয়াদ বাড়ায় তার ভাতিজা সাখাওয়াত হোসেনকে দিয়ে। সেই সময় দূতাবাসে হাইকমিশনার না থাকায় তৃতীয় সেক্রেটারি সাখাওয়াত ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’ থাকা অবস্থায় কেনিয়া ইমিগ্রেশন দপ্তরে মাজেদের ভিসা দুই বছর বাড়ানোর সুপারিশপত্র পাঠান। দীর্ঘদিন ধরে সে এভাবেই বিদেশে যাযাবর জীবনযাপন করত। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে পালাতক তিন খুনি মেজর ডালিম-খন্দকার রশিদ-মাজেদ সম্পর্কে সঠিক তথ্য না থাকায় মাজেদ সেনেগালেও ‘থাকতে পারে’ বলে জানিয়েছিল [দ্র. দৈনিক ইত্তেফাক, ১৫ আগস্ট, ২০১৬, ঢাকা]। মাজেদ মূলত কলকাতায় গোপন আখড়া গাড়ে। পুলিশের ভাষ্য মতে, সর্বশেষ মাজেদের অবস্থান ভারত ও পাকিস্তানে ছিল বলে শোনা যায়। তখন দুই দেশকে চিঠিও দেয়া হয়। জবাবে ভারত বলেছিল, মাজেদ তাদের দেশে নেই। তবে পাকিস্তান কোনো জবাব দেয়নি। (ইত্তেফাক, ৮ এপ্রিল, ২০২০)

সম্প্রতি ভারতে হিন্দু-মুসলিম নাগরিকত্ব আন্দোলনে সে সমস্যায় পড়ে। দেশান্তরী হলেও দেশের সঙ্গে অর্থাৎ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত যোগযোগও ছিল। তার এক ভাতিজা লেখক রেজা মাহমুদ আল হুদা এবং আরেক নাতি ছাত্রলীগের নেতা মুজিবুল্লাহ ওরফে পলাশ বিশ্বাসদের নিয়েও সোশ্যাল মিডিয়া নানা ধরনের খবর আসছে! শুধু পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেই নয়; আমেরিকায় রশিদ চৌধুরী, কানাডায় নূর চৌধুরী এবং অজ্ঞাত স্থানের মেজর ডালিমের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল। যেমন- ডালিম টরন্টো এসে নূরের সঙ্গে দেখা করেন এবং ২০০৯ সালের ১৩ নভেম্বর নভোটেল হোটেল থেকে চেক আউট করে ১৪ নভেম্বর রাত ১২টা ১০-এ ক্যাথে প্যাসিফিক এয়ারলাইন্সে সিএএক্স-২৭ নম্বর ফ্লাইটে হংকং চলে যায়। কিন্তু মেজর ডালিমের মতো মাজেদ ধূর্ত বা অতটা স্মর্ট নয়।
উল্লেখ্য, মাজেদ শুধু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডেই অংশগ্রহণ করেনি- ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকার কারাগারে বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত জাতীয় চার নেতার জেলহত্যায়ও অংশ নিয়েছিল। জেলহত্যার মামলায় আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত দেয়। ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বাটামারা গ্রামের আলী মিয়া চৌধুরীর ছেলে আবদুল মাজেদ। সে চার কন্যা ও এক ছেলে সন্তানের জনক। তার স্ত্রী সালেহা বেগম। ১১ এপ্রিল ফাঁসি কার্যকর করার পর তার মরদেহ নিজ বাড়ি ভোলায় দাফন করতে চাইলে স্থানীয় জনগণ ঘৃণিত খুনির মরদেহ দাফনে আপত্তি এবং প্রতিবাদ তোলায় নারায়ণগঞ্জে শ্বশুরবাড়িতে দাফন করা হয়।

লেখক : কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক

এই বিভাগের আরো সংবাদ