কষ্ট করে হলেও নিয়মটা মেনে চলুন
জয়ন্ত ঘোষাল
১৩ এপ্রিল ২০২০, ১০:২৯ | অনলাইন সংস্করণ
ভারতে ভাবা যায়? ভারত কেন, বাংলাদেশ বা ঝঅঅজঈ, এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে এমনটা সম্ভব কি না, জানি না। অন্তত এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে আমার তো জানা নেই। এই করোনাকাণ্ডের সময়ই এমন ঘটনা দেখছি বিবিসিতে।
অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্য সরকারের শিল্পকলামন্ত্রী ডন হারউইনের কাহিনি। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় রাজ্যে অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের দায়ে তাঁকে জরিমানা করেছিল দেশটির পুলিশ বিভাগ। নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের প্রমাণসহ অভিযুক্ত হন ডন হারউইন। এবার সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি মন্ত্রীর পদ থেকেও ইস্তফা দিলেন।
অভিযোগ কী ছিল? অভিযোগ হলো, ডন হারউইন কয়েক সপ্তাহ ধরে তাঁর সিডনির পূর্ব শহরতলির মূল বাড়ি থেকে প্রায় এক ঘণ্টা দূরত্বের কেন্দ্রীয় উপকূলবর্তী এলাকার অবকাশকালীন বাড়িতে যাতায়াত করছিলেন। সরকার করোনার সময় এই যাতায়াত ঠিক নয় বলে মনে করে। শুধু তা-ই নয়, শহরতলিতে ইস্ট গার্ডেনস ওয়েস্ট ফিল্ডে একটি শপিং সেন্টার আছে। সেখানে গিয়ে তিনি নিজে কেনাকাটাও করছিলেন।
আমাদের দেশে তো মন্ত্রীরা নিজে সকালে গিয়ে দোকানে পাউরুটি, দুধ, ডিম—এসব কেনেন এমনটা দেখা যায় না, ভাবাও যায় না। তো, অস্ট্রেলিয়ার এই মন্ত্রী রোজ সকালে গিয়ে বোধ হয় একঘেয়েমি কাটাতে বাজার করতেও শুরু করে দিয়েছিলেন। প্রমাণসহ এটা প্রকাশিত হয় স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে। এটা জানাজানির পর স্থানীয় পুলিশ মন্ত্রীকে এক হাজার ডলার জরিমানা করে। তিনি এরপর ক্ষমা চান।
ক্ষমা চেয়ে তিনি সিডনির বাড়িতে ফিরেও আসেন। রাজ্যবাসীর কাছে সরকার তাঁর আচরণের জন্য ক্ষমা চায়। পরে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে পদত্যাগও করেছেন। প্রিমিয়ার গ্ল্যাডিস বেবেজিক্লিয়ান তাঁর ইস্তফাপত্র গ্রহণ করেছেন। রাজ্যের পুলিশ কমিশনার মিক ফুলার বলেছেন, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। জনস্বাস্থ্য আদেশ লঙ্ঘনের দায়ে হারউইনকে জরিমানা করা হয়। তবে তিনি ইস্তফাও দিলেন। এটা বড় গণতান্ত্রিক দৃষ্টান্ত। আমাদের দেশে বড় বিরল।
তবে এ সপ্তাহে আপনাদের সঙ্গে করোনা প্রসঙ্গে ভারত আর বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়েই আলোচনা করা যেতে পারে।
পুরো পৃথিবীতে করোনায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১৭ লাখ অতিক্রম করেছে। এসবের মধ্যে ভারতেও করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার হতে যাচ্ছে, মৃত্যুর সংখ্যা এখনো ২০০। সত্যি বলছি, প্রতিদিন সন্ধ্যায় টিভির দিকে তাকিয়ে এই মৃত্যুর সংখ্যা গুনতে ভালো লাগছে না। ১৪ এপ্রিলের জায়গায় ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউন এরই মধ্যে পাঞ্জাব বা ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী করে দিয়েছেন।
বাংলাদেশেও মৃতের সংখ্যা এখন পর্যন্ত ৩৪। ৬২১ জন আক্রান্ত। এর মধ্যে ৩৯ জন সেরে গেছে। ভারত যেভাবে পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছে, নরেন্দ্র মোদি যেভাবে ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করেছেন, সেগুলোকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে থেকে প্রশংসা করা প্রয়োজন। দেখুন বাংলাদেশে মৃতের সংখ্যা ৩৪, পাকিস্তানে সরকারিভাবে ৬৬।
ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার কিছু বিশেষ অসুবিধাও আছে; যেমন—গুজব। গুজব তো কোনো বিশেষ সার্বভৌম দেশের নয়। গুজবের বিশ্বায়ন হয়েছে। ভারতেও প্রথম দিকে হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করে নানা ধরনের গুজব ছড়ানো হচ্ছিল। একটা ছোট্ট ঘটনা বলছি : এই যে কিছুদিন আগে দিল্লির আনন্দবিহার বাস টার্মিনালে একসঙ্গে প্রচুর বিহার আর উত্তর প্রদেশের লোক জড়ো হয়ে গেছিল, তার কারণ কী বলুন তো? তার কারণ ছিল, একটা ছোট্ট গুজব দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল যে ওখানে পাটনা আর এলাহাবাদ যাওয়ার জন্য বাসের ব্যবস্থা হয়েছে। ব্যস, অসংগঠিত শ্রমিকের দল, যাদের দিনগত রুটিরুজি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পকেটে পয়সা নেই, খেতে পাচ্ছে না, ভীতসন্ত্রস্ত, কী করবে বুঝতে পারছে না; তাই তারা দলবদ্ধভাবে বাসস্ট্যান্ডে এসে আরো আতঙ্ক ছড়ায়। করোনার প্রকোপ বাড়ে। এখন তো হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা পাঠানোর ব্যাপারেও নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা হয়।
বাংলাদেশে গুজব ছড়ানোর জন্য অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বরগুনার আমতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা জি এম দেলোয়ারের মৃত্যু করোনাভাইরাসের কারণেই হয়েছে, তা-ও জানা গেছে। দেখুন, গণতন্ত্রের সমস্যা যেমন ভারতে, তেমনি আপনাদের দেশেও। প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জি এম দেলোয়ারের জানাজায় সহস্রাধিক লোক অংশ নেয়। বরগুনার জেলা প্রশাসন আমতলী উপজেলা লকডাউন ঘোষণা করেছে।
গুজবের যে কথা হচ্ছিল। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস নিয়ে গুজব ছড়ানোর জন্য ৫০ জনকে আটক করা হয়েছে। বিরোধী প্রতিপক্ষ ভারতেও বলছে, ঢাকায়ও বলছে—গুজব ছড়ানোর নামে সরকারবিরোধী সমালোচকদের আসলে আটক করছে। তবে গুজব ব্যাপারটা এখন পুরো পৃথিবীতেই ভয়াবহ। ভারতীয় সাবেক এক আমলা আমাকে বলেছিলেন, টিভিতে খবর না শুনলে আমি uninformed হই বটে, কিন্তু টিভি দেখলে সমস্যা হচ্ছে misinformed হই। টিভি সম্পর্কে এই রসিকতার পক্ষে আমি নই। কারণ করোনা-দুর্যোগে ঘরে বসে সামাজিক একাকিত্বে এই টিভি চ্যানেলই তো দুনিয়ার সব খবর আমাকে দিচ্ছে। ড্রয়িংরুমে বসে শুনছি, তবে ভধশব হবংি আর গুজবের দাপট, তা বেশি সোশ্যাল মিডিয়ায়। একটা বই পড়ছিলাম।
India misinformed the true story. লেখক প্রতীক সিনহা, ড. সুমাইয়া শেইখ ও অর্জুন সিদ্ধার্থ। এ বইয়ে মিথ্যা প্রচারের নানা নমুনা দেখানো হয়েছে। দল-মত-নির্বিশেষে। নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধেও হচ্ছে, রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধেও হচ্ছে। বইটিতে একটি উদাহরণ দেওয়া হয়েছে যে সাবেক সিবিআইপ্রধান অলক ভার্মা ইস্তফা দিয়েছেন, মোদিকে তাতে লিখেছেন, স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রধানমন্ত্রীকে এই চিঠি লিখছি। ওপরে এই ফেসবুক-টুইটার-হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে লেখা : আই সাপোর্ট রবিশ কুমার, ইট ইজ ভাইরাল বিগ ব্রেকিং নিউজ। বাস্তব হলো, সেদিন অলক ভার্মা ইস্তফা দেন; কিন্তু তিনি ইস্তফাটা দেন পারসোনেল ও ট্রেনিং মন্ত্রকের কাছে। তাঁর চিঠিতে নরেন্দ্র মোদির কথা বলাই হয়নি।
করোনার মৃত্যু ও ভয়াবহতা নিয়ে গুজব ছড়ানো বড় গর্হিত অমানবিক অপরাধ। বাংলাদেশের কত মানুষ পৃথিবীর কত প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। কত লোক আক্রান্ত। কত লোক মারা যাচ্ছে। সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়েছে। কারণ দূতাবাস জানিয়েছে, ওরা একসঙ্গে দলবদ্ধভাবে থাকত। একটা পার্কে গিয়ে একসঙ্গে জটলা করত। আমেরিকায় এত মানুষ মারা গেছে যে কবর দেওয়ার জন্য আলাদা জায়গা নেই। একসঙ্গে অস্থায়ী বড় গর্ত খুঁড়ে কবর দেওয়া হচ্ছে। এসব শুনলে মনে হয়, আমরা তো অনেক ভালো আছি। অনেক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী বিদেশে গিয়ে নিজেদের রেস্ত শেষ করে ফেলেছেন, এখন যেকোনো মূল্যে দেশে ফিরতে চাইছেন। বাংলাদেশ দূতাবাসে চাপ দিচ্ছেন। কোনো উপায় নেই। বিদেশে কত মানুষ, কত শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে নানা দেশে। তাদের বরফে রাখা হয়েছে অস্থায়ীভাবে। শেষকৃত্য করতে চাইছে দূতাবাস, পরিবার বলছে না—একবার শেষবারের মতো দেহটা দেখব।
এসব শোনার পর মনে হয়—না, কষ্ট করে হলেও নিয়মটা মেনেই চলি।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
এই বিভাগের আরো সংবাদ