আজকের শিরোনাম :

জরুরি সেবায় সেনাবাহিনী কাজে লাগানো হোক

  স্বদেশ রায়

১৩ এপ্রিল ২০২০, ০৯:৪৬ | অনলাইন সংস্করণ

প্রতিবেশী দেশ ভারতে ‘লকডাউন’ এর সময়সীমা এপ্রিল মাসের শেষ অবধি বাড়ানো হয়েছে। এর ঠিক আগেই আয়ারল্যান্ড ৫ মে এবং ইতালি ২ মে অবধি ‘লকডাউন’ এর সময়সীমা বাড়িয়েছে। দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ার প্রায় সব দেশে এপ্রিল মাস জুড়ে আগে থেকেই ‘লকডাউন’ ঘোষণা করেছিল। এখন তাদের সামাজিক ও আর্থিক পরিকল্পনা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তারা নানান পদ্ধতিতে এই লকডাউন আগামী মে ও জুন মাস অবধি চলমান রাখবে। বাংলাদেশ ২৫ মার্চ থেকে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে এবং সেভাবেই লকডাউনের মেয়াদ বাড়িয়ে এখন ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত করেছে। এটা যে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত যাবে তাতে এখন আর কোনও সন্দেহ নেই। কারণ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১০ এপ্রিল জানিয়েছে এ মুহূর্তে ‘লকডাউন’ তুললে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেবে।

‘লকডাউন’ এর রাস্তায় যেতে সামান্য দেরি করায় আমেরিকা, ইতালি, স্পেন কী ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে তা বিশ্ব দেখছে। এসব দেশ আগে লকডাউনে গেলে- তাদের যেহেতু স্বাস্থ্য পরিসেবা ভালো, জাতিগতভাবে তারা শৃঙ্খল, তাতে তারা পূর্ব বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মত কম সংক্রমণ ও কম মৃত্যুর ভেতর দিয়ে পার হতে পারতো। আমেরিকা, ইতালি, স্পেন, গ্রেট ব্রিটেনের মত দেশগুলো সে পথে না গিয়ে ভুল করেছে; অর্থাৎ লকডাউন দেরিতে করেছে। তাই পৃথিবীর এই দুই অংশের অভিজ্ঞতা এখন আমাদের সামনে। এখান থেকে আমাদের বাংলাদেশের কঠোর ‘লকডাউন’ ছাড়া দ্বিতীয় কোন সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ নেই। যদি  কেউ মনে করেন আমাদের স্বাস্থ্য অবকাঠামো দিয়ে আমরা করোনা মোকাবিলা করবো তিনি বাস্তবতার বাইরে আছেন। আর এখন বাস্তবতার বাইরে থাকার কোনও সুযোগ নেই।

 আমাদের প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্যাকেজের ধরন ও পরিমাণ বিশ্লেষণ করলে এটা পরিষ্কার বোঝা যায়, তিনি এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, কীভাবে এগোতে হবে। তাঁর কাছে এখন বিষয়টি স্পষ্ট, সম্পূর্ণ কঠোর লকডাউনের পরেও হঠাৎ করে একদিনে পুরো ‘লকডাউন’ তোলার মত পরিবেশ আসবে না। তখন হয়তো ‘হটস্পট’গুলো চিহ্নিত করে, অর্থাৎ ক্লাস্টার বিস্তার ও কমিউিনিটি বিস্তারের এলাকা গুলো চিহ্নিত করে- সেভাবে ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে ‘লকডাউন’ তুলে নিতে হবে। সব মিলে জুন- জুলাইয়ের আগে দেশকে পরিপূর্ণ সচল অবস্থায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে না। আমাদের আগে যে সকল দেশ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছে তাদের এবং প্রথম আক্রান্ত চীনের উহানের ঘটনাকে যদি এমুহূর্তে সঞ্চিত অভিজ্ঞতা হিসেবে ধরা হয়, তাহলে তা পর্যালোচনা করে এমন সিদ্ধান্তই আসে।

এই সামান্য অভিজ্ঞতাকে পূঁজি করেই এখন সব দেশকে তার নিজ নিজ অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে এগুতে হবে। আমাদের এই উপমহাদেশের তিনটি দেশেই অর্থাৎ বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতে কমিউনিটি সংক্রমণ হয়েছে । এর মূল কারণ, এই তিনটি দেশই অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ। এছাড়া এই তিন দেশের মানুষ যেমন কম স্বাস্থ্য সচেতন তেমনি কম শৃঙ্খলও। এ বিবেচনায় দেরিতে কোভিড-১৯ এর বিস্তার ঘটলেও বাংলাদেশের সামনে এখন  দুটো কঠিন কাজ: মানুষকে শৃঙ্খলার মধ্যে রাখা ও অভাবমুক্ত রাখা। মানুষকে এখনও শতভাগ শৃঙ্খলার মধ্যে আনা যায়নি। তবে গত কয়েকদিনে বেশ কিছু প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়ায় অনেকটা শৃঙ্খলার মধ্যে এসেছে। এখন প্রয়োজন মানুষকে খাদ্যাভাব মুক্ত রাখা।

 ২৫ তারিখ থেকে ১১ এপ্রিল অবধি ছুটির ছদ্মাবরণে যে লকডাউন ছিল ওই সময়টাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠির খুব একটা খাদ্যের দরকার ছিল না। কারণ, বাংলাদেশে এখন ওই তীব্র দারিদ্র্য নেই যে ১৫ দিন কাজ না থাকলে মানুষ না খেয়ে থাকবে। কারণ, এখন একদিন কাজ করেই মানুষ তার পরিবারের এক সপ্তাহের চাল কিনতে পারে। কিন্তু এই ১৫ তারিখ থেকে ২৬ তারিখ অবধি যে লকডাউন হয়েছে ( ধারণা করা হচ্ছে এটা স্বাভাবিকই ৩০ তারিখ অবধি যাবে) এই সময়ে শহর ও গ্রামের একটি শ্রেণি ও পেশার মানুষের খাবারের প্রয়োজন হবে। এবং এর পরেও তো একদিনে শতভাগ লকডাউন উঠে যাবে না তাই আরো কয়েক মাস শহর ও গ্রামের একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের খাবারের প্রয়োজন হবে। প্রধানমন্ত্রী হয়তো এমন একটি হিসাব করে তার ৭২ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজে ২২ হাজার কোটি টাকা রেখেছেন সোশ্যাল সিকিউরিটি খাতে। এই ২২ হাজার কোটি টাকা কীভাবে ব্যয় হবে তার পরিপূর্ণ পরিকল্পনা এখনো জনগণের সামনে আসেনি। তবে প্রণোদনা ঘোষণার দিন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বিনামূল্যে খাদ্য, ১০ টাকা কেজি চাল সরবরাহ করা হবে। এছাড়া, যেসব সোশ্যাল সিকিউরিটির প্রোগাম চালু আছে সেগুলো আরো সচল ও আরো বৃদ্ধি করা হবে। অন্যদিকে তিনি দেশের বিত্তবান মানুষ ও তার দলের লোকজনকে দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াতে বলেছিলেন। দুঃখের বিষয় হলেও সত্য, গত এই কয়দিনে এ সাহায্য যেভাবে দেয়া হয়েছে- তা যেমন শালীন ছিল না, তেমনি সুশৃঙ্খলও ছিল না। বরং অনেক ক্ষেত্রে সাহায্যদাতারা কোভিড -১৯ ছড়াতে পারে এমন কাজও করেছেন। বিপুল সংখ্যক মানুষকে এক জায়গায় জড়ো করা হয়েছে। তারপরে তাদেরকে খাবার দেবার সময় ছবি তোলার হিড়িক দেখা গেছে। এসবই কোভিড-১৯ ছড়ানোর কারণ। অন্যদিকে, ভিডিও কনফারেন্সে বা ফেসবুকে কোন কোন নেতাকে বলতে শোনা গেছে, তিনি দুই হাজার বা তিন হাজার দরিদ্র পরিবারকে খাবার পৌঁছেছেন। 

মাত্র সাতদিনের লকডাউনে যদি একজন নেতার দুই থেকে তিন হাজার পরিবারের খাবারের প্রয়োজন পড়ে তাহলে এগার বারো বছরের উন্নয়ন কোথায় গেল? এত খাদ্য উৎপাদনের ফলাফল কি এই! আবার এর ভেতর ত্রাণের খাদ্য চুরির ঘটনাও ঘটেছে। যাহোক, রাজনৈতিক নেতাদের ওই কাজ কেবল কোভিড-১৯ ছড়ানোর সম্ভাবনা ছাড়া দেশের আর কোন ক্ষতি হয়নি। কিন্তু এখন প্রয়োজন পরিকল্পিত পথে কাজহীন হয়ে পড়া মানুষগুলোর জন্যে সাহায্য দেয়া।

শ্রীলংকা ইতোমধ্যে কোন শ্রেণি-পেশার কত মানুষকে কীভাবে কতদিন সাহায্য করবে তার একটি পরিকল্পনা করে তা কার্যকর করা শুরু করেছে। যেমন যানবাহন বন্ধ হবার ফলে যে সকল ড্রাইভার, কন্ডাকটর ও হেলপার যারা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করতো তাদেরকে মোবাইল  অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বা সরাসরি নগদ অর্থ সাহায্য করছে। এমনিভাবে তারা গ্রাম ও শহরে কোন কোন শ্রেণি-পেশার মানুষ কতজন কর্মহীন হয়েছে তার ডাটাবেজ তৈরি করে কাজ করছে। এই সাহায্য সেবায় তাদের দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরাও অর্থ জোগান দিচ্ছে সরকারকে। এ বিষয়ে শ্রীলংকার সিনিয়র সাংবাদিক জেমিনি শরদের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, শতভাগ স্বচ্ছভাবে যে কাজ হচ্ছে তা নয়। কিছুটা অনিয়ম হচ্ছে। তারপরেও মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে অর্থ ও খাদ্য।

 আমাদেরও সময় এসেছে আগামী চার-পাঁচ দিনের মধ্যে ডাটাবেজ তৈরি করার। করোনাভাইরাস আক্রান্ত পরিস্থিতি সার্বিক লকডাউন,পরবর্তীকালের আংশিক লকডাউন এবং লকডাউনের ধাক্কা কাটানোর জন্যে এরও পরে কিছুটা সময় অবধি এই সাহায্য চালিয়ে যাওয়া। 

এই সাহায্য যদি সততার সঙ্গে, সুচারুভাবে করা যায় তাহলে প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনার বাইরের কোন অর্থের দরকার নেই। প্রণোদনার যে ২২ হাজার কোটি টাকা সোশ্যাল সিকিউরিটিতে আছে সেখান থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা নিলেই এই সাহায্য সেবা সুন্দরভাবে চালানো সম্ভব হবে। আর যদি আরো অর্থ জোগান দেয়ার দরকার হয় সে সামর্থ্যও বাংলাদেশের অর্থনীতির আছে। অন্যদিকে, হয়তো প্রকৃতির বিরূপ প্রভাবে গোটা পৃথিবী জুড়ে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। এমনও বলা যায়, করোনাভাইরাস চীনে শুরু হবার পরেই গোটা পৃথিবী সর্তক না হওয়াতে এমনটি হয়েছে। তবে তারপরেও বাংলাদেশের ফসলে এখনও বিরূপ প্রকৃতির কোন ছাপ পড়েনি। বিশেষ করে গত কয়েকদিনে কোন ঝড় বা বৃষ্টি হয়নি। হাওরেও পানি আসেনি। এরফলে কৃষক নিরাপদে বোরো ঘরে তুলতে পারছেন। সরকারের কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তিনি এই লকডাউনের মধ্যে বিশেষ ব্যবস্থায় উত্তরবঙ্গ থেকে ধানকাটার শ্রমিকরা যাতে হাওর এলাকায় যেতে পারে তার ব্যবস্থা করিয়েছেন। এবার আমাদের বোরোর লক্ষ্যমাত্র ২ কোটি ২ লাখ টন। বোরো চাষ হয় যে এলাকাগুলোতে তার অনেক এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, এবার বোরো অন্যবারের থেকে ভালো হবে। তাতে লক্ষ্যমাত্রার থেকে বোরো বেশি হবে। তাই যে সময়ে  গোটা দেশ কোভিড-১৯ এ লকডাউন সে সময় কৃষকরা ২ কোটি ২ লাখ টনের বেশি বোরো ধান ঘরে তুলছেন। 

আবার লকডাউন যখন আংশিক অবস্থা থেকেও সরে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে সে সময়ে কৃষক গতবারের হিসাব অনুযায়ী হলেও ২৯ লাখ টন আউশ ধান ঘরে তুলবেন। আর কোভিড-১৯ দুর্যোগ পরের সময়ে তাদের জন্যে আছে মূল ধানের ফসল অর্থাৎ আমন। এর পাশাপাশি এবার আলুর ফসল ও ভূট্টার ফসল ভালো হয়েছে। তাই লকডাউনে গ্রাম এলাকায় খাদ্যের অভাব খুব বেশি হবে না। যা হবে তা নগদ টাকার অভাব। খাদ্য ও টাকার দুটোরই অভাব হবে শহর ও আধা শহর এলাকায় কয়েকটি শ্রেণি-পেশার মানুষের। তারা হয়তো আগামী সপ্তাহ থেকেই এই সমস্যায় পড়ে যাবে।

 এ কারণে এ মুহূর্তেই অন্তত চার পাঁচ দিনের ভেতর সেনাবাহিনীকে কাজে লাগিয়ে তাদের সঙ্গে সিভিল প্রশাসন, লোকাল গভর্মেন্ট ও রাজনৈতিক নেতাদের একটি সমন্বয় করে একটা প্রকৃত ডাটাবেজ করা দরকার। সেখানে নির্ধারিত থাকবে কাদের কী পরিমাণ খাবার ও নগদ টাকার দরকার হবে । তারও পর্যায়ে ভাগ থাকবে। সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে সবাইকে সংযুক্ত করা দরকার এ কারণে যে, লোকাল গভর্মেন্টের হাতে গেলেই বিষয়টি মুখ চেনার ভিত্তিতে হবে। সেখানে স্থানীয় সরকার সংশ্লিষ্টদের নিজস্ব লোকজনই গুরুত্ব পাবে বেশি। যাদের প্রকৃত অর্থে প্রয়োজন তারা কম গুরুত্ব পাবেন। এই ‘মুখচেনা’ দুর্নীতি থেকে দেশকে মুক্ত করতে অনেক সময় লাগবে। স্থানীয় সরকারে ভরাপেট জোঁক এলেও কবে যে রক্ত খাওয়া বন্ধ করবে তা বলা যায় না। যাক সে প্রসঙ্গ এখানে নয়। 

তাছাড়া এখন একাজে সেনাবাহিনীর দরকার আছে যেহেতু এখানে আপদকালীন বা যুদ্ধকালীন সেবার মতই সেবা দিতে হবে। আপদকালীন এই সেবা পনের দিন বা এক মাস দেয়া যেতে পারে। তার ভেতরই আরো স্পষ্ট হবে এই সেবা কতটা প্রলম্বিত করতে হবে। সেজন্য একটি দীর্ঘ পরিকল্পনা এই সময়ের মধ্যে প্রকৃত বিশেষজ্ঞদের দিয়ে তৈরি করাতে হবে। ওই পরিকল্পনায় শুধু ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যে নগদ অর্থের জোগানের ব্যবস্থা থাকলেই হবে। কারণ, করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউন জনিত ক্ষতিতে খাদ্যভাব বাংলাদেশে হচ্ছে না। অভাব যেটা হবে তা বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের নগদ অর্থের অভাব। বাজারে প্রচুর খাবার থাকবে। তাই ওই অর্থ যাতে তারা সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও মোবাইল অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পায় সেটাই করতে হবে। বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক লোকের কৃষিকার্ড আছে। দশ টাকার অ্যাকাউন্ট আছে। বিধবা ভাতা কার্ড আছে। বয়স্কভাতা কার্ড আছে। এর সঙ্গে আর কত লোকের ‘লকডাউন ক্ষতি অ্যাকাউন্ট’ যোগ করতে হবে সেটাই স্থির করা এখন কাজ। আর এই সব অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা গেলে দুর্নীতিও কম হবে অন্যদিকে মানুষও অভাব মুক্ত থাকবে। 

লেখক : সাংবাদিক

এই বিভাগের আরো সংবাদ