আজকের শিরোনাম :

মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা অতুলনীয়

  সাইদুল করিম মিন্টু

১১ এপ্রিল ২০২০, ১১:৫৮ | অনলাইন সংস্করণ


মুক্তিযুদ্ধ শুরুর এক মাসের মধ্যেই ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠন করা হয় বাংলাদেশ সরকার, যা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত। যার পর থেকে ১৭ এপ্রিল দিনটি বাঙালি জাতির জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন হিসেবে গেঁথে আছে। আমরা এই দিনটি ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস হিসেবে পালন করে আসছি। আমাদের স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে দেশের আগামীদের প্রত্যাশিত দিকনির্দেশনা, সাংবিধানিক এবং যৌক্তিক অধিকার রক্ষার জন্য মুজিবনগর সরকার গঠন করা তৎকালীন সময়ের অপরিহার্য ছিল।


১৯৭০ সালের নির্বাচনে পর তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকচক্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করতে না চাওয়ার কারণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এদেশের সকল শ্রেণী পেশার মানুষ যখন বাংলাদেশ স্বাধীনতার পতাকা হাতে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য শপথ নিয়েছিল তখনই মুজিবনগর সরকার গঠন করার প্রয়োজনীয়তা সামনে এসেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল তদানীন্তন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। তৎকালীন সময়ে মেহেরপুর মুক্ত এলাকা হওয়ার কারণে এবং ১০ এপ্রিল এম.এন.এ ও এমপিদের কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় অনুষ্ঠিত অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে যুদ্ধ পরিচালনা ও পাক হানাদার বাহিনীকে আমাদের স্বদেশ ভূনি থেকে বিতাড়িত করার জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি), তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম.এ মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তৎকালীন কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়।  এইদিন ১০ এপ্রিল গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। 

বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। পবিত্র কোরান তেলওয়াতের পর বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশন এবং নবগঠিত সরকারকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়, মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী বক্তব্য রাখেন। 

এমনিভাবেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সংসদের নেতৃত্বে একটি সাংবিধানিক সরকার বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করলো।

শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান শেষে তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘আমরা যা করছি সবই শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে, পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে তাদের কবর রচিত হয়েছে। এই অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সাবেক মন্ত্রী মরহুম আবদুল মান্নান। বিশাল নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে এই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। শপথ অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে জেনারেল ওসমানী সবাইকে এটি দ্রুত সম্পন্ন করার আহ্বান জানান। ক্ষণিকের মধ্যে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এসে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানস্থল লণ্ডভণ্ড করে। এদিনই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বৈদ্যনাথতলার নামকরণ করেছিলেন ‘মুজিবনগর’। 

মুজিবনগর সরকার গঠনের শুরুতে যে ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়েছিল তার ৬ষ্ঠ অনুচ্ছেদে লেখা ছিল, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনগণের অবিসংবাদিত নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলার জনগণের প্রতি উদাত্ত আহবান জানান।

ঘোষণাপত্রের নবম অনুচ্ছেদে লেখা ছিল, যেহেতু বাংলার জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাদের কার্যকরী কর্তৃক প্রতিষ্ঠা করিয়াছে, সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকার বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি ম্যান্ডেট দিয়েছেন সেই ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য সেহেতু আমরা বাংলাদেশকে রূপায়িত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি এবং উহা দ্বারা পূর্বেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি।

ঘোষণাপত্রে আরো উল্লেখ করা হয়, এতদ্বারা আমিরা আরো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রেপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্র প্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদেও অধিষ্ঠিত থাকবেন। রাষ্ট্রপ্রধান সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী। 

সদ্যসৃষ্ট রাষ্ট্রের সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা লাভের অদম্য স্পৃহায় মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত সর্বস্তরের বিপুল সংখ্যক জনগণ ও দেশী-বিদেশী সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। মুজিবনগর সরকার গঠন করার ফলে বিশ্ববাসী স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামরত বাঙালিদের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম সরকার মুজিবনগর সরকার গঠন বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য গৌরবগাঁথা সাফল্যের স্বাক্ষরও বটে।

যেসব মুক্তিযোদ্ধা এ দেশকে স্বাধীন করার জন্য গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল এবং নেতৃত্ব দিয়েছিল মুজিবনগর সরকার ছিল তাদের ঐক্য ও নির্দেশনার প্রতীক। মুজিবনগর সরকারে যারা দায়িত্বে ছিল তারাই মুলতঃ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান করেছেন। দেশকে শত্রু মুক্ত করার জন্য গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হলেও মুজিবনগর সরকারই হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম দায়িত্বশীল সরকার। এই সরকারের মূল দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যৌক্তিকতার প্রশ্নে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা, বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরের কর্তৃক স্থাপন করা, মুক্তিযোদ্ধাদের তদারকি করা এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা, দেশের ভিতরে এবং বিদেশী সাংবাদিকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা এবং পশ্চিমাদের অপপ্রচার প্রতিহত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের পর পাড়ায় পাড়ায় মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হলেও মুজিবনগর সরকারই প্রথমে মুক্তিবাহিনীদের বিভিন্ন থানা থেকে অস্ত্র এবং কলকাতা ও আগরতলা ট্রেজারি থেকে টাকা পয়সা এনে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্যক যুদ্ধে সকল প্রকার সহযোগিতা করেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের তদারকি করাসহ দেশের ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের পাশে দাড়ানোর জন্য মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেক আতাউল গনি ওসমানী মুজিবনগর সরকারের নির্দেশে সারাদেশে ছয়টি জোনে ভাগ করে মুজিবনগরের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জাতীয় সেনা অফিসারদের দায়িত্ব প্রদান করেন। মুজিবনগর সরকার ধীরে ধীরে দেশের সর্বস্তরে কর্তৃক প্রতিষ্ঠা করে বিভিন্ন সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে ব্যক্তিদের দায়িত্ব প্রদান করেন। মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে ভারতীয় সৈন্যদের সকল ধরনের সমর্থন আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহযোগিতা করেছে। ভারতীয় সৈন্যরা শুধু আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংই দেননি, যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদিও প্রেরণ করেছেন। যার ফলে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পেরেছেন এবং পাক হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করেন। 

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনী যখন আত্মসমর্পণ করে তখনই মুজিবনগর সরকার রাজধানী ঢাকায় এসে নতুন একটি দেশ বাংলাদেশের সকল দায়িত্ব বুঝে নেয়, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যখন ভারতে নামলেন তখন বঙ্গবন্ধুকে মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ভারত সরকার লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়েছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলে বাংলার জনগণ হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা দিয়ে বরণ করে। 

১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থাকে পরিশুদ্ধ করে মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকারের ব্যবস্থার রূপরেখা প্রণয়ন করেন। যার ফলে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। 

মুজিবনগর সরকার হচ্ছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম কার্যকরী সরকার। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার দিবসটি বাঙালি জাতির জীবনের এক অবিস্মরণীয় গৌরবগাঁথা দিন। জাতির জন্য দিনটি একটি ঐতিহাসিক দিনও বটে। কারণ মুজিবনগর সরকার স্বাধীনতা যুক্তিযুদ্ধে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।  মুক্তিযুদ্ধে এই সরকারের অবদানের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশকে সমর্থন করেছে৷ স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই কারণেই বাংলাদেশের জনগণ দিবসটি মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক হিসেবে এবং জাতির চেতনাবোধ জাগ্রতের দিন হিসেবে পালন করে থাকে।  তাই এই সরকারের দায়িত্ব প্রাপ্ত সকলের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। 

লেখক : সাধারণ সম্পাদক
ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগ

এই বিভাগের আরো সংবাদ