আজকের শিরোনাম :

মহামারী : ১৯১৮ সালে পারলে ২০২০ সালে কেন নয়?

  চিররঞ্জন সরকার

৩০ মার্চ ২০২০, ১২:৫৮ | অনলাইন সংস্করণ

আজ থেকে ১০২ বছর আগে ১৯১৮ সালে মরণথাবা বসিয়েছিল স্প্যানিস ফ্লু। তার নাম ছিল এইচওয়ানএনওয়ান (H1N1 Virus)। প্রায় দেড় বছর সেই রোগ মানবজাতির ঘাড়ে চেপেছিল। সারা বিশ্বে পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।

আজ যেভাবে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কোয়ারেন্টিন এবং আইসোলেশনের মধ্য দিয়ে এই রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে, সেদিনও তাই হয়েছিল। স্প্যানিশ ফ্লুর কোনও ওষুধ ছিল না। সেদিন ভারতবর্ষে এক কোটি সত্তর লক্ষেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। তখন সমাজ ছিল অনেক পিছিয়ে। মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও সচেতনতা ছিল না। মিডিয়া ছিল না। বর্তমান সময়ের মতো হাসপাতাল-চিকিৎসা, পথঘাট যানবাহন ও পরিকাঠামোর অভাব ছিল। তখন দেশের শাসনকর্তা ছিল ব্রিটিশরা। তাদের অবহেলাও ছিল চরম। তখন মানুষ পথেঘাটে শেয়াল-কুকুরের মতো অবহেলায় মরেছিল।

সেই সময় মহাত্মা গান্ধীও এই ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। অসুস্থতার মধ্যে তরল জাতীয় খাবার খেয়ে এবং ঘরে একা একা থেকে দিন কাটাতেন। এভাবে কোয়ারেন্টিন এবং আইসোলেশনের মধ্য দিয়ে তিনি বেঁচে ওঠেন। তখন স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন সাহিত্যিক প্রেমচন্দও। তিনিও পরে সুস্থ হয়ে ওঠেন।

শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসেও আমরা পেয়েছি ‘কোয়ারেন্টিন’ শব্দটি। উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৮ সালে। শরৎচন্দ্র লেখেন, ‘‘পরদিন বেলা এগার-বারটার মধ্যে জাহাজ রেঙ্গুনে পৌঁছিবে; কিন্তু ভোর না হইতেই সমস্ত লোকের মুখচোখে একটা ভয় ও চাঞ্চল্যের চিহ্ন দেখা দিল। চারিদিক হইতে একটা অস্ফুট শব্দ কানে আসিতে লাগিল, কেরেন্টিন্‌। খবর লইয়া জানিলাম, কথাটা quarantine: তখন প্লেগের ভয়ে বর্মা গভর্নমেন্ট অত্যন্ত সাবধান। শহর হইতে আট-দশ মাইল দূরে একটা চড়ায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়া খানিকটা স্থান ঘিরিয়া লইয়া অনেকগুলি কুঁড়েঘর তৈয়ারি করা হইয়াছে; ইহারই মধ্যে সমস্ত ডেকের যাত্রীদের নির্বিচারে নামাইয়া দেওয়া হয়। দশদিন বাস করার পর, তবে ইহারা শহরে প্রবেশ করিতে পায়। তবে যদি কাহারও কোন আত্মীয় শহরে থাকে, এবং সে Port Health Officer-এর নিকট হইতে কোন কৌশলে ছাড়পত্র যোগাড় করিতে পারে, তাহা হইলে অবশ্য আলাদা কথা।……

ডাক্তারবাবু আমাকে তাঁহার ঘরের মধ্যে ডাকিয়া লইয়া বলিলেন, শ্রীকান্তবাবু, একখানা চিঠি যোগাড় না ক’রে আপনার আসা উচিত ছিল না; Quarantine-এ নিয়ে যেতে এরা মানুষকে এত কষ্ট দেয় যে কসাইখানায় গরু-ছাগল-ভেড়াকেও এত কষ্ট সইতে হয় না। তবে ছোটলোকেরা কোন রকমে সইতে পারে, শুধু ভদ্রলোকদেরই মর্মান্তিক ব্যাপার। (শ্রীকান্ত – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)।’’

কাজেই ছোঁয়াচে রোগ এবং কোয়ারেন্টিন কোনোটাই এ অঞ্চলে নতুন নয়। এর বিরুদ্ধে লড়াই, শঙ্কা, অব্যবস্থাপনাও নতুন নয়। বর্তমানে আমাদের দেশে অনেকেই কোয়ারেন্টিন মানছে না। এ ক্ষেত্রে শিক্ষিতরা সবচেয়ে বেশি অনিয়ম করছেন। গত দুই মাসে যারা বিদেশ থেকে এসেছেন, তাদের অনেকেই উচ্চশিক্ষিত। অনেকে উচ্চবিত্ত শ্রেণির, সেলেব্রিটি, আবার প্রভাবশালীও বটে। কিন্তু তাদের অনেকেরই অসচেতনতা দেখে মনে হয়েছে তারা আসলে ভয়ানক দরিদ্র। তাদের দারিদ্র্যটা বুদ্ধির, সচেতনতার, মানসিকতার। শুধু আত্মম্ভরিতা আর অবিবেচক হওয়ার কারণে অল্প কয়েকজন বিদশফেরত ব্যক্তি গোটা দেশকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। তারা দেশে করোনাভাইরাসের বীজাণুটা ছড়িয়ে দিয়েছেন।

তারা মনে করেছেন, এসব রোগ আমার জন্য নয়। আমি কেন কোয়ারেন্টিনে যাব, পরীক্ষা করাব? এই অহংকারই আজ দেশের অসংখ্য সাধারণ মানুষকে সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছে। তারা বুঝিয়ে দিয়েছেন, আমাদের দেশের প্রধান অভিশাপ অশিক্ষা নয়। অভিশাপ হল, এদেশের শিক্ষিত কিছু মানুষের দায়িত্বজ্ঞানহীন নির্বুদ্ধিতা।

১৯১৮ সালে ভারতবর্ষে যে স্প্যানিশ ফ্লু ছড়িয়ে পড়েছিল, সেদিনও তা এসেছিল বিদেশ থেকেই। ইতিহাসবিদদের মতে, ১৯১৮ সালের এক মধ্যরাতে বোম্বাই (বর্তমানে মুম্বাই) বন্দরে এসে নোঙর করে একটি জাহাজ। সেই জাহাজ থেকে নামেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফিরে আসা সেনারা। সেই সেনা কর্মীদের মধ্য দিয়েই সেদিন ভারতে ঢুকেছিল স্প্যানিশ ফ্লুয়ের জীবাণু। এই রোগ ছড়িয়ে পড়তে বেশি দেরি হয়নি। তখনকার হেল্থ ইন্সপেক্টর জে এস টার্নার বলেছিলেন, ‘রাতের অন্ধকারে ভারতে যেন চোরের মতো ঢুকে পড়েছিল এক গুপ্ত ঘাতক।’ তারপর সেই রোগ ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়েছিল দক্ষিণ ভারতের উপকূল বরাবর। এরপর জ্যামিতিক হারে তা বাড়তে থাকে। ভারতের অন্য অংশেও তা মৃত্যুর এক ভয়াবহ চিহ্ন এঁকে দিয়েছিল (‘The Evolution of Pandemic Influenza: Evidence from India, 1918-19’, by Siddharth Chandra and Eva Kassens-Noor: BMC Infectious Diseases, 4, 510 (2014)।

এখানে বলে রাখা ভালো যে, ভাইরাসের জীবাণু কিন্তু লাফিয়ে লাফিয়ে ছড়ায়। এর সংক্রমণ বাড়ে জ্যামিতিক নিয়মে। সাধারণত যেকোনও সংক্রমণের দুটি গাণিতিক নিয়ম রয়েছে— অ্যারিথমেটিক প্রোগ্রেশন এবং জিওমেট্রিক প্রোগ্রেশন। পাটিগণিতের নিয়মে আক্রান্তের সংখ্যা নির্দিষ্ট হারে যোগ হতে হতে যায়। যেমন— ৩, ৬, ৯, ১২, ১৫। প্রতিবারই আক্রান্তের সংখ্যা তিন করে বাড়ছে। কিন্তু জিওমেট্রিক প্রোগ্রেশনে আক্রান্তের সংখ্যা গুণিতক হারে বাড়ে। অর্থাৎ ৩, ৯, ২৭, ৮১, ২৪৩, ৭২৯। এভাবে কিছুদিনের মধ্যেই তা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। স্পেনিশ ফ্লু, নোভেল করোনাভাইরাস এই দ্বিতীয় নিয়ম, অর্থাৎ জিওমেট্রিক প্রোগ্রেশনে এগচ্ছে। তাই এই ভাইরাস নিয়ে গোটা বিশ্বের এত মাথাব্যথা।

তখন এত মৃত্যু হয়েছিল দাফন-কাফনেরও উপায় ছিল না। মানুষ নদীতে দেহ ভাসিয়ে দিত। গঙ্গাসহ বিভিন্ন নদনদীতে ভেসে যেত পচাগলা মানুষের দেহ। এর ফলে সংক্রমণ আরও বেড়েছিল।

সে সময় দেশে ডাক্তারের অভাব ছিল প্রবল। অনেক ডাক্তারকে আবার বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়েছিল। ফলে যেটুকু চিকিৎসার সুযোগ ছিল, তাও জোটেনি। তখন দেশের মানুষের শুশ্রুষার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন একদল লড়াকু তরুণ। তারা চাঁদা তুলে পাড়ায় পাড়ায় ক্যাম্প তৈরি করে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করতেন। খাদ্য, জল সরবরাহ করতেন তারা। কেউ মারা গেলে তারাই অন্ত্যেষ্টির দায়িত্ব নিতেন।

তখন সংবাদপত্রের এমন রমরমা ছিল না। যে কয়েকটা পত্রিকা ছিল সেগুলো মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা চালাত। সংবাদপত্রে লেখা হতো, ‘কেউ বাইরে বেরোবেন না। ঘরে থাকুন। অন্যজনের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকুন।’ সেদিন কিন্তু মানুষ দুর্বলতর হয়েও সচেতনতা দিয়ে লড়াই করেছিল। সেদিন এ অঞ্চলের মানুষ সেই লড়াইয়ে সরকারকে পাশে পায়নি। এখন কিন্তু সরকার পাশে আছে। বিজ্ঞান প্রযুক্তি গণমাধ্যম সবই আছে।

১৯১৮-র সেই লড়াই কিন্তু আজকের থেকে আরও ভয়ংকর ছিল। সেদিন অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও মানুষ লড়াই করে বেঁচে উঠেছিল। আমরা এবারও সবাই নিয়মশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারি।

‘ঘরে থাকা’ বা ‘সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং’ হলো এই ভাইরাসের গতিকে স্তব্ধ করার শ্রেষ্ঠ উপায়। মানুষ বিচ্ছিন্ন থাকবেন, ‘গৃহবন্দি’ থাকবেন। করোনা আক্রান্ত মানুষ বেশি লোকের সংস্পর্শে আসবেন না। ধরা যাক, ঘরে না থাকলে একজন করোনা আক্রান্ত ৫০ জনের সংস্পর্শে এসে ১০ শতাংশ হারে পাঁচজন মানুষকে আক্রান্ত করত। কিন্তু ঘরে থাকলে তিনি কেবল তার পরিবারের বড়জোর তিন-চারজন ব্যক্তির সংস্পর্শে আসবেন। সেক্ষেত্রে পরিবারের একজন ব্যক্তি নতুন করে আক্রান্ত হতে পারেন। ফলে আক্রান্তের সংখ্যা নাগালে থাকবে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে না। মনে রাখতে হবে যে, প্রত্যেকের নিজস্ব নিরাপত্তা নিজের কাছে এবং নিজের নিরাপত্তাটুকু বজায় রাখলে অন্যদের নিরাপত্তাও রক্ষিত হবে।

নিজেকে ‘গৃহবন্দি’ করে রাখার পাশাপাশি আমাদের সবারই উচিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। একইসঙ্গে মানবধর্ম পালন করা। অপেক্ষাকৃত গরিবদের যথাসাধ্য সাহায্য করা। আমরা যদি আমাদের বাসার কাজের লোক, ড্রাইভার, অফিসসহকারী, প্রতিবেশী গরিব লোকটিকে সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করি, তাদের ছুটি দিয়ে বেতনটা দিয়ে দিই, তাহলে গরিবগুলো বাঁচবে। তাদের পক্ষেও ঘরে থাকা সম্ভব হবে। এ জন্য প্রয়োজনে আমাদের দৈনন্দিন বাজেট একটু কাট-ছাঁট করা যেতেই পারে।

মানুষ তো মানুষেরই জন্য। আর মানব কল্যাণই সবচেয়ে বড় ধর্ম!

লেখক : কলামিস্ট

এই বিভাগের আরো সংবাদ