আজকের শিরোনাম :

এক হাতে তালি বাজে না তালি বাজাতে দুহাত লাগে

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০১৮, ১২:৪৮

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ০৪ জুলাই, এবিনিউজ : রবীন্দ্রনাথের একটি গানের কথা- ‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই।’ এই সোনার হরিণটি কোথায় পাওয়া যায় তা কেউ জানে না। বাংলাদেশে একটি সাধারণ নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই কোনো কোনো মহল থেকে জোর দাবি উঠেছে—‘স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচন চাই।’ কিন্তু সোনার হরিণের মতো এই অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের চেহারাটি কী হবে, কেমন করে তাকে ধরাছোঁয়ার মধ্যে আনা যাবে, তা কারো বক্তব্যে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, আর দশটা গণতান্ত্রিক দেশের মতো তাদের সরকারের তত্ত্বাবধানে যে নির্বাচন হবে, তা সুষ্ঠু ও অবাধ হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়নি, এটা প্রমাণ করতে না পারলে এ ধরনের উদ্দেশ্যপরায়ণ অভিযোগ তোলা উচিত নয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এই সেদিন বলেছেন, ‘আসন্ন নির্বাচন একটি নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে হবে। এই সরকার আকারে খুবই ছোট হবে এবং কার্যত হবে নির্বাচন তদারককারী সরকার। প্রাত্যহিক কাজকর্ম করা ছাড়া এই সরকারের আর কোনো ক্ষমতা থাকবে না।’

এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এই আশ্বাস দিয়েছেন। এখন দলের সাধারণ সম্পাদক দিলেন। কিন্তু এটা বিএনপি জোটের মনঃপূত নয়। তারা যে নিরপেক্ষ সরকার চাচ্ছে, তা আসলে তাদের দ্বারা গঠিত ইয়াজউদ্দিনের তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো সরকার। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সেনানিবাসে খালেদা জিয়ার বাসভবনে ও হাওয়া ভবনে বসে মাতা-পুত্র (খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান) মিলে সেসব নির্দেশ দিতেন, ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেই নির্দেশ মেনে একটি প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। এক-এগারোর সামরিক কর্মকর্তারা সে সময় হস্তক্ষেপ না করলে দেশে একটি রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ হতো।

বর্তমানেও নির্বাচন তদারকির নামে বিএনপি জোট একটি ইয়াজউদ্দিন মার্কা ‘নিরপেক্ষ সরকার’ চায়। আমাদের ‘নিরপেক্ষ’ সুধীসমাজ ও দুটি মিডিয়া তাতে সমর্থন জোগাচ্ছে। বাংলাদেশের স্বনিযুক্ত অভিভাবক এক শ্রেণির বিদেশি রাষ্ট্রের দূতদের দ্বারা বাংলাদেশে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলানো হচ্ছে। আসলে তারা নিরপেক্ষতার আবরণে বিএনপি জোটের দাবিকেই সমর্থন জানাচ্ছে। অর্থাৎ বিএনপি জোট নিজের ইচ্ছায় নির্বাচনে না এলে দেশের আর সব ছোট-বড় রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিলেও এই নির্বাচন তাদের কাছে স্বচ্ছ ও অবাধ হবে না। বৈধতা পাবে না। এ খেলা তারা ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময়েও খেলেছে। সফল হননি। এবারেও হবে মনে হয় না।

আসলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়ে সরকার বদল দ্বারা নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা যায় না। নিশ্চিত করা যায়, প্রতিদ্বন্দ্বী সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে নির্বাচনের স্বচ্ছতা বজায় রাখার ঐকমত্য সৃষ্টি দ্বারা। মুখের ঐকমত্য নয়, কাজের ঐকমত্য। আওয়ামী লীগ সরকারকে যেমন প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, নির্বাচনের সুষ্ঠুতা তারা বজায় রাখবে, তেমনি বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকেও অঙ্গীকার করতে হবে যে তারা ভোটকেন্দ্রে কোনো প্রকার অরাজকতা সৃষ্টি করবে না, কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধিয়ে নির্বাচন ভণ্ডুল করার চেষ্টা করবে না। ভোটদাতাদের ভোট দেওয়ার পথে কোনো বাধা সৃষ্টি করবে না এবং তাদের রায় নিঃসন্দেহে মেনে নেবে।

শুধু ক্ষমতাসীন দলই পরাজয়ের আশঙ্কায় নির্বাচন ভণ্ডুল করতে চায় তা নয়, অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে বিরোধী দল জয়ের আশা না দেখলে একই উদ্দেশ্যে হুড়-হাঙ্গামা করে, ভোট জালিয়াতির চেষ্টা করে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে এবার নির্বাচনের সময় কী হয়েছে? ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট সরকারবিরোধী বিজেপি দলকে হয়রানি করেছে এমন কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু রাজ্যের বিরোধী দল বিজেপির কর্মী ও সমর্থকরা যেভাবে বামফ্রন্টের নেতা ও কর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে, তার এন্তার অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচনে বিজেপি জিতেছে বটে, কিন্তু এই বিজয় বিতর্কমূলক।

কোনো দেশে নির্বাচনে কারচুপি হলে সাধারণত ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধেই অভিযোগ ওঠে। কিন্তু কোনো কোনো দেশে বিরোধী দলের মারমূর্তিও দেখা যায়। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে দেখা গেছে, পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক সময়ের পঞ্চায়েত নির্বাচনেও দেখা গেছে। বাংলাদেশেও বিএনপি দলটির ভূমিকা কী? ক্ষমতাসীন দল হিসেবে নির্বাচনে মারদাঙ্গা করেছে (২০০১ সালের নির্বাচন)। বিরোধী দল হিসেবে ২০১৪ সালের নির্বাচনে যোগ না দিয়ে রাস্তায় পেট্রল বোমাবাজি করে শতাধিক নিরীহ নর-নারী ও শিশুহত্যা দ্বারা নির্বাচন ভণ্ডুল করার চেষ্টা করেছে।

গাজীপুরের সাম্প্রতিক সময়ের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় তা বানচালের জন্য তারা যে ভয়ানক চক্রান্ত পাকিয়েছিল, তা এখন ফাঁস হয়ে গেছে। মেজর মিজান নামে বিএনপির এক গণ্যমান্য নেতা টেলিফোনে গাজীপুরের বিএনপিকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাঁরা যেন কিছু যুবক ভাড়া করে এবং নিজেদের মধ্য কিছু যুবক বাছাই করে আওয়ামী লীগের সমর্থক সাজান এবং কয়েকটি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে জাল ভোট দেওয়াসহ মারদাঙ্গা শুরু করেন। এ জন্য অর্থ ও অস্ত্রের ব্যবস্থা তিনি করবেন। তাঁর এই টেলিফোন বার্তা রেকর্ড হওয়ার সঙ্গে তাঁর স্বকণ্ঠে বলা নির্দেশও টেপ করা হয়।

এটা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় নির্বাচন ভণ্ডুল করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। এই চেষ্টা সফল হলে সব দোষ আওয়ামী লীগের ওপর চাপিয়ে বিএনপির প্রচারণার ব্যান্ড সজোরে বেজে উঠত। আর তাতে কণ্ঠ মেলাতেন তাদের পালিত সুধীসমাজটি। কথায় বলে, ‘চোরের মায়ের বড় গলা।’ বিএনপির ব্যাপারে এ কথাটি সত্য। তাদের গলার জোর আওয়ামী লীগের চেয়ে অনেক বেশি। গাজীপুরেও এই সত্যটি ধরা পড়েছে।

গাজীপুর নির্বাচনে সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে গিয়ে বিএনপির এক নেতা হাতেনাতে ধরা পড়ার পর দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল পাগলা মোওয়ালির মতো গলা উঁচিয়ে বলেছেন, ‘সব ঝুট হায়’, কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি, তবু পাল্টা অভিযোগ করেছেন, মেজর মান্নানকে নাকি গুম করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তা না পেরে তাঁকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়েছে। মির্জা ফখরুলের কথা শুনে জার্মানির নাৎসি পার্টির কার্যকলাপের কথা মনে পড়ে। বিরোধী দলের কোনো নেতাকে হত্যা করার পর নাৎসি দলের পতাকা দিয়ে তাঁর মৃতদেহ জড়ানো হতো এবং বিরাট মিছিলসহ সেই মৃতদেহ সমাধিস্থলে নিয়ে যাওয়ার সময় এই হত্যাকাণ্ডের জন্য কমিউনিস্ট ও সোশ্যালিস্ট দলের ওপর দোষ চাপানো হতো। এটাই ছিল নাৎসি প্রপাগান্ডার বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশে বিএনপি সেটাই অনুকরণ করছে।

নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের এক শ্রেণির নেতা ও কর্মী যে অনিয়ম করে না বা করতে চায় না—তা নয়। কিন্তু তা বিএনপির অনিয়ম ও যথেচ্ছাচারের মতো অত ব্যাপক নয়। তা নির্বাচনের ফলাফলের ওপর প্রভাব বিস্তার করে না। যেমন করেনি গাজীপুরে। কিন্তু বিএনপির রেকর্ড হচ্ছে জয়ের সম্ভাবনা না দেখলেই ভোট চুরি, সন্ত্রাস সৃষ্টি ও ভোটদাতাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে জয়লাভের চেষ্টা। মাগুরা উপনির্বাচনে তারা এ কাজটি করেছে। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে তারা ভোটারবিহীন নির্বাচনে জয়ী হওয়ার দাবি করেছে। ২০০১ সালে কথাকথিত সুধীসমাজ কিছু বিদেশি কূটনীতিকের প্রকাশ্য সহযোগিতা ও মিডিয়া ক্যুয়ের দ্বারা নির্বাচনে জিতেছে, পরের নির্বাচনেও তারা তাদের মনোনীত রাষ্ট্রপতি ‘ইয়েসউদ্দিনের’ সাহায্যে নির্বাচন কমিশনকে আজ্ঞাবাহী করে এবং হাজার হাজার জাল ভোটারের তালিকা প্রস্তুত করে নির্বাচন জয়ের ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু এক-এগারোর আবির্ভাবে তা ব্যর্থ হয়ে যায়।

এর পরও তারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একতরফা ভোট জালিয়াতি, নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ অনবরত তুলছে এবং স্বাভাবিক নিয়মে দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা সৃষ্টি করছে। তারা সালিস মানে, কিন্তু তালগাছটির দাবি ছাড়ে না। বাংলাদেশ কেন, সব গণতান্ত্রিক দেশেই নির্বাচন স্বচ্ছ ও অবাধ করার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে একটা অলিখিত সমঝোতা থাকে। সেই সমঝোতা হলো, তারা সবাই নির্বাচন কমিশনের বিধিমালা মেনে চলবে এবং নির্বাচনে কোনো অনিয়ম ঘটানোর চেষ্টা করবে না। এটা যেমন ক্ষমতাসীন দল মেনে চলে, তেমনি বিরোধী দলগুলোও। এক হাতে তালি বাজে না। তালি বাজাতে হয় দুই হাতে। বাংলাদেশেও নির্বাচন তখনই অনিয়ম ও বিতর্কমুক্ত হবে, যখন ক্ষমতাসীন দল নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সাহায্য জোগাবে এবং বিরোধী দল এবং দলগুলোও সেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে কাঁটা না বিছিয়ে তাতে সহযোগিতা করবে।

এবারের সাধারণ নির্বাচন প্রায় আসন্ন। যদি কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা না ঘটে, তাহলে যথাসময়ে, যথারীতিতে নির্বাচনটি হবে। বিএনপি জোটের উচিত, এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে নানা অজুহাতে কাঁটা না বিছিয়ে তা যাতে শান্তিপূর্ণভাবে ও নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হয়, তার ব্যবস্থায় সহযোগিতা করা। তাহলে তারা নিজেদের এবং দেশের মানুষেরও মঙ্গল করবে।

কোনো কোনো বিদেশি রাষ্ট্রদূতের অযাচিত উপদেশ ও উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্য দ্বারা প্রভাবিত হওয়া কোনো দলেরই উচিত হবে না। আমেরিকার রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট মাঝেমধ্যেই স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশকে উপদেশ দেন। তাঁর নিজের দেশে কী ঘটছে, সে কথা মনে রাখেন না। জর্জ বুশ ও আলগোরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় ফ্লোরিডায় শুধু ভোটদানে অনিয়ম নয়, সুপ্রিম জুডিশিয়ারির বিরুদ্ধেও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছিল। বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে এসব বিদেশি দূতকে বলে দেওয়া উচিত, আগে নিজেদের চরকায় তেল দিন। (কালের কণ্ঠ থেকে সংগৃহীত)

লন্ডন ৩ জুলাই, মঙ্গলবার, ২০১৮

এই বিভাগের আরো সংবাদ