আজকের শিরোনাম :

বঙ্গবন্ধু’র লেখা আরেকটি বই : আমার দেখা নয়াচীন

  সুভাষ সিংহ রায়

০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৫:৪৩ | অনলাইন সংস্করণ

বিদগ্ধ পাঠক মাত্রই জেনে থাকবেন, বিগত কয়েক বছর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজের হাতে লেখা দু দু’টো বই প্রকাশিত হয়েছে। একটির (অসমাপ্ত আত্মজীবনী) প্রকাশক ইউপিএল আরেকটির (কারাগারের রোজনামচা) প্রকাশক বাংলা একাডেমি। এবারের নতুন বই ‘ আমার দেখা নয়াচীন ’ এর প্রকাশক বাংলা একাডেমি। এই বইয়ের ভূমিকায় শেখ হাসিনার লেখাটা খুবই যথাযথ ও অবশ্যই তা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৫২ সালের চীন ভ্রমণের এ কাহিনি তিনি রচনা করেছিলেন ১৯৫৪ সালে যখন কারাগারে। তাঁর লেখা খাতাখানার ওপর গোয়েন্দা সংস্থার সেন্সর ও কারাগার কর্তৃপক্ষের যে সিল দেয়া আছে তা থেকেই সময়কালটা জানা যায়। ২০১৮ সালে নেলসন ম্যান্ডেলের এক অসাধারণ আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছে -` The prison letters of Nelson Mandela. প্রকাশক প্রতিষ্ঠান লিভাররাইট পাবলিশিং কর্পোরেশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তার এক বছর আগে ২০১৭ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু’র ‘কারাগারের রোজনামচা ’ প্রকাশিত হয়েছিল। আমরা বেশ ভালো করেই জানি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের এক সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা করা হয়েছিল। মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জন মৃত্যুবরণ করেন।

শেখ হাসিনা আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যান। এই ঘটনার পর শোক-কষ্ট-বেদনায় যখন জর্জরিত ঠিক তখন শেখ হাসিনার কাছে এই খাতাগুলো (বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে লেখা) এসে পৌঁছায়। সে এক আশ্চর্য ঘটনা। এত দুঃখ-কষ্ট-বেদনার মাঝেও যেন একটু আলোর ঝলকানি। এই ভূমিকায় শেখ হাসিনা লিখেছেন এই ভাবে, “আমি ২১ আগস্ট মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি। মনে হয় যেন নতুন জন্ম হয়েছে। আর সেই সময় আমার হাতে এল আব্বার হাতের লেখা এই অমূল্য আত্মজীবনীর চারখানা খাতা! শেষ পর্যন্ত এই খাতাগুলো আমার এক ফুফাতো ভাই এনে আমাকে দিল। আমার আরেক ফুফাতো ভাই বাংলার বাণী সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণির অফিসের টেবিলের ড্রয়ার থেকে সে এই খাতাগুলো পেয়েছিল। সম্ভবত আব্বা শেখ মণিকে টাইপ করতে দিয়েছিলেন, আত্মজীবনী ছাপাবেন এই চিন্তা করে।”

যা হোক, আমি সব কাজ বাদ দিয়ে এই বইটা হাতে আসার পর টানা বারো ঘণ্টায় তিনবার পড়েছি । খুবই আশ্চর্য হয়েছি আজ থেকে সাত দশক আগে বঙ্গবন্ধু কতটা দূরদর্শী ছিলেন। সময়ের থেকে তিনি কতদূর এগিয়ে ছিলেন। প্রথম বিষয় বইয়ের শুরুতে খুব স্পষ্ট করে ‘পিকিং-এ শান্তি সম্মেলনে’ কেন যোগ দিতে আগ্রহী হয়েছিলেন এবং কতটা বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে নয়াচীনে গিয়েছিলেন। আরেকটা বিষয় গোড়াতেই জানিয়ে রাখি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঠিকানা ছিল- আওয়ামী লীগের অফিস। ৬৯ পৃষ্ঠায় আমরা দেখবো চীনের সাংহাই শহরে ভারতের ডেলিগেট মি : ফরিদীর সাথে বঙ্গবন্ধু’র ঘনিষ্টতার বর্ণনা পেয়েছি । সেখানে মি: ফরিদীকে আওয়ামী লীগের অফিসের ঠিকানা দিয়েছিলেন।“ হঠাৎ সেপ্টেম্বর মাসে আমন্ত্রণ এলো পিকিং-এ শান্তি সম্মেলনে যোগদান করতে হবে। তথাপি দুনিয়ায় আজ যারাই শান্তি চায় তাদের শান্তি সম্মেলনে আমরা যোগদান করতে রাজি। রাশিয়া হউক, আমেরিকা হউক, ব্রিটেন হউক, চীন হউক যে-ই শান্তির জন্য সংগ্রাম করবে তাদের সাথে আমরা সহস্র কণ্ঠে আওয়াজ তুলতে রাজি আছি, ‘আমরা শান্তি চাই’। কারণ যুদ্ধে দুনিয়ার যে ক্ষতি হয় তা আমরা জানি ও উপলব্ধি করতে পারি; বিশেষ করে আমার দেশে যে- দেশকে পরের দিকে চেয়ে থাকতে হয়, কাঁচামাল চালান দিতে হয়।

যে দেশের মানুষ না খেয়ে মরে, সামান্য দরকারি জিনিস জোগাড় করতে যাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, সে দেশে যুদ্ধে যে কতখানি ক্ষতি হয় তা ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের কথা মনে করলেই বুঝতে পারবেন। কোথায় ইংরেজ যুদ্ধ করছে, আর তার জন্য আমার দেশের ৪০ লক্ষ লোক শৃগাল-কুকুরের মতো না খেয়ে মরেছে। তাদের পাট, চা, তুলা অন্যান্য জিনিস বিদেশে বিক্রি না করলে দেশের জনগণের কষ্টের সীমা থাকবে না। দুর্ভিক্ষ মহামারি সমস্ত দেশকে গ্রাস করবে। তাই মানুষের মঙ্গলের জন্য, পাকিস্তানের স্বার্থের জন্য- যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। ঠিক করলাম শান্তি সম্মেলনে যোগদান করতে হবে। আমাদের পূর্ব বাংলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, জনাব আতাউর রহমান খান, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন, যাকে আমরা সকলে ‘মানিক ভাই’ বলি, বন্ধুবর খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস আর ইউসুফ হাসান এবং আমি, এই পাঁচজন যাবো ঠিক হলো।”

আমরা ইতিহাস পাঠ থেকে জেনে থাকবো তারও ২০ বছর পরে  ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে কলকাতায় তাঁর সম্মানে প্রদত্ত নাগরিক সংবর্ধনায় তিনি পাকিস্তানের প্রতি দৃষ্টি রেখে বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না প্রতিশোধ গ্রহণে কোনো মহৎ কর্তব্য পালন করা যায়।’ ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালের সন্ধ্যায় কলকাতার রাজভবনে তাঁর সম্মানে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রদত্ত ভোজসভায় তিনি একটি ঐতিহাসিক উক্তি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার একান্ত কামনা, উপমহাদেশে অবশেষে শান্তি ও সুস্থিরতা আসবে। প্রতিবেশীদের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধিতার বন্ধ্যা নীতির অবসান হোক। আমাদের জাতীয় সম্পদের অপচয় না করে আমরা যেন তা আমাদের দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ব্যবহার করি। দক্ষিণ এশিয়াকে একটি শান্তিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত করায় আমরা সচেষ্ট রইব, যেখানে আমরা সুপ্রতিবেশী হিসেবে পাশাপাশি বাস করতে পারি এবং যেখানে আমাদের মানুষের মঙ্গলার্থে আমরা গঠনমূলক নীতিমালা অনুসরণ করতে পারি। যদি আমরা সেই দায়িত্বে ব্যর্থ হই, ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।’ উপমহাদেশের উত্তেজনাময় পরিস্থিতিতে, যখন রণাঙ্গন থেকে রক্তের দাগও মুছে যায়নি, আঞ্চলিক সহযোগিতা বিকাশের এই উদাত্ত আহ্বান, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের একজন রাষ্ট্রনায়কের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর পরিপক্কতার পরিচায়ক। দেশে বঙ্গবন্ধু করেছিলেন একই কথার পুনরাবৃত্তি। ১৯৭৪ সালের মার্চের ৪ তারিখে তিনি কুমিল্লার দাউদকান্দিতে এক জনসভায় বলেছিলেন, ‘এই উপমহাদেশে আমরা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল আর শ্রীলঙ্কা মিলে শান্তিতে বসবাস করতে চাই। আমরা কারও সঙ্গে বিবাদ চাই না। আমরা স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে, আত্মমর্যাদার সঙ্গে একে অন্যের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ মনোভাব নিয়ে বাস করতে চাই। আমি চাই না যে আমাদের বিষয়াদিতে কেউ হস্তক্ষেপ করুক। আমরাও অন্যের বিষয়াদিতে হস্তক্ষেপ করতে আগ্রহী নই।’

‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে নয়াচীনের রেলভ্রমণের বর্ণনা এসেছে দারুণভাবে। তিনি যা দেখেছিলেন তাই বিশ্লেষণ করেছেন। অসংখ্য বিষয়বস্তু এবং তার ব্যাখ্যা খুবই প্রাঞ্জল ভাষায় তার বর্ণনা এসেছে। সে সময়কার আমেরিকা রাশিয়ার বৈশ্বিক রাজনীতির ব্যাখ্যা দিয়েছেন বস্তুনিষ্টভাবে (বইয়ের ৩০ পৃষ্ঠা, ৩১ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)। আমরা জানি, বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে ২৫ সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে বাংলায় বক্তব্য দিয়েছিলেন। তারও ২২ বছর আগে তরুণ শেখ মুজিব চীনের শান্তি সম্মেলনে বাংলায় বক্তব্য দিয়েছিলেন। বইয়ের ৪৩ পৃষ্ঠায় বর্ণনা এসেছে এভাবে। “আমি বক্তৃতা করলাম বাংলায়, আর ভারত থেকে বক্তৃতা করলেন মনোজ বসু বাংলা ভাষায়। বাংলা আমার মাতৃভাষায় বক্তৃতা করাই উচিত। কারণ পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের কথা দুনিয়ার সকল দেশের লোকই কিছু কিছু জানে। মানিক ভাই, আতাউর রহমান খান ও ইলিয়াস বক্তৃতাটা ঠিক করে দিয়েছিল। দুনিয়ার সকল দেশের লোকই যার যার মাতৃভাষায় বক্তৃতা করে। শুধু আমরাই ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা করে নিজেদের গর্বিত মনে করি।”

৬০ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অসাধারণ ভাষায় শিশুদের নিয়ে ভাবনা ও নয়াচীনের সে সময়কার দুই বছরের সরকারের অর্জন করেছে তা বিস্তৃত করেছেন। এক এক দেশে এক এক প্রকারের ‘স্বার্থ সংশ্লিষ্ট শ্রেণি’ ( ) আছে- যেমন আমাদের দেশে অর্থশালী জমিদাররা ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’, অন্য দেশে শিল্পপতিরা ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’। এই প্রিভিলেজড ক্লাস’টা সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। নয়াচীন সরকারের হুকুম, প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে স্কুলে দিতে হবে, একটা পরিমাণ ঠিক করে দিয়েছে, সেই পরিমাণ খেতে দিতে হবে। পোশাক ঠিক করা আছে, সেই পোশাক দিতে হবে। যাদের দেবার ক্ষমতা নাই তাদের সরকারকে জানাতে হবে। সরকার তাদের সাহায্য করবে। নতুন মানুষের একটা জাত গড়ে তুলছে নয়াচীন। এখনকার সময়ে ’বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন (১৭ মার্চ) শিশু দিবস হিসেবে পালিত হয়। আমরা জেনে থাকবো বঙ্গবন্ধু শিশুদের ভীষণ রকম ভালোবাসতেন। তরুণ শেখ মুজিবের বয়স যখন ৩২ তখন নয়াচীন সফর করার সময়ে শিশুবিষয়ক অভিজ্ঞতা পরবর্তী জীবনে রাষ্ট্র গঠনে কাজে লাগিয়েছেন। তাঁর উপলব্ধির কথা অকপটে বর্ণনা করেছেন।

“ছেলেমেয়েদের পড়ার জন্যও একটা রুম আছে। সেখানে দেখলাম ছোটদের পড়বার উপযুক্ত বইও আছে বহু, ইংরেজি বইও দেখলাম। লাইব্রেরির সাথে ছোট একটা মাঠ আছে, সেখানে বসবার বন্দোবস্ত রয়েছে। মাঠে বসে পড়াশোনা করার মতো ব্যবস্থা রয়েছে। আমার মনে হলো কলকাতার ইমপেরিয়াল লাইব্রেরির মতোই হবে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, লাইব্রেরিটা বহু পুরানা। চিয়াং কাইকেশ সরকারও এর কিছু উন্নতি করেছিল।” শ্রমিকদের কথা দারুণভাবে বইটাতে ওঠে এসেছে। তার চেয়েও বড় নয়াচীনের আগের স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে তরুণ শেখ মুজিবের অবস্থান বইয়ের নানা জায়গায় এসেছে। কিন্তু সেই সরকারের দু-একটা ভালো কাজের কথাও তিনি উল্লেখ করতে ভোলেননি। “ মালিক ও শ্রমিকদের পক্ষ থেকে আমাদের সংবর্ধনা জানানো হলো। ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি পাশাপাশি বসেছেন। যিনি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি তিনিও একজন শ্রমিক। মিলগুলি জাতীয়করণ না করেও এমন বন্দোবস্ত করা হয়েছে যে, ইচ্ছামতো লাভ করা চলে না। সরকারকে হিসাব দাখিল করতে হয়। যে টাকা আয় হবে তা শ্রমিকদের বেতন, তাদের বাসস্থানের বন্দোবস্ত, চিকিৎসার ব্যবস্থার জন্য ব্যয় করতে হবে। আর যা বাঁচবে তা দিয়ে মিলের উন্নতি করতে হবে। আর যারা মালিক তাদের লভ্যাংশের কিছু অংশ দেয়া হয়।

শ্রমিক নেতৃবৃন্দ ও মালিকদের একমত হয়ে এসব ঠিক করতে হয়। আমরা দেখে আনন্দিত হলাম, মেয়ে শ্রমিকরা যখন কাজে যায় তখন তাদের ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করার জন্য মিলের সাথে নার্সিং হোম আছে। কাজে যাওয়ার সময় ছেলেমেয়েদের সেখানে দিয়ে যায় আর বাড়ি যাবার সময় নিয়ে যায়। যে-সমস্ত শ্রমিক বিবাহ করে নাই তাদের জন্য বিরাট বিরাট বাড়ি আছে। শ্রমিকদের জন্য আলাদা হাসপাতাল আছে। অসুস্থতার সময় বেতনসহ ছুটি দেয়া হয়। বৎসরে তারা একবার ছুটি পায়। যারা বাড়ি যেতে চায় তাদের বাড়িতে যেতে দেয়া হয়, আর যারা স্বাস্থ্যনিবাসে যেতে চায় তাদেরও ব্যবস্থা করা হয়। শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুল আছে। মিলটা দেখে যখন আমরা বিদায় নেব তখন শ্রমিক ও মালিকদের পক্ষ থেকে আমাদের জন্য একটা সভার আয়োজন করা হলো। ম্যানেজিং ডিরেক্টর বক্তৃতা করলেন, শ্রমিক প্রতিনিধিও বক্তৃতা করলেন। তারা উভয়েই বললেন, ‘‘আমরা শ্রমিক ও মালিক পাশাপাশি দেশের কাজ করছি। মিলটা শুধু মালিকের নয়, শ্রমিকের ও জনসাধারণেরও। আজ আর আমাদের মধ্যে কোনো গোলমাল নাই। আমরা উভয়েই লভ্যাংশ ভাগ করে নেই। শ্রমিকের স্বার্থও আজ রক্ষা হয়েছে, মালিকের স্বার্থও রক্ষা হয়েছে। চিয়াং কাইশেকের আমলে আমাদের মধ্যে তিক্ততা ছিল। মাঝে মাঝে মিল বন্ধ রাখা হতো। আমাদেরও ক্ষতি হতো আর শ্রমিকদেরও ক্ষতি হতো।’ এখানে পীর সাহেব বক্তৃতা করলেন।

তারপর গেলাম শ্রমিকদের বাজার দেখতে। যাবতীয় মালপত্র সেখানে আছে, দাম করতে হয় না। যার যা প্রয়োজন টাকা দিয়ে নিয়ে চলে আসে। দেখলাম, বহুলোক বাজার করছে। পুরুষ মেয়ে একসাথেই বাজার করে, জিনিসপত্র বিক্রি করে। সে দেশে পুরুষ কাজ করে আর মেয়েরা বসে খায় না। পুরুষ ও মেয়ে সমান, এই তাদের নীতি। হাজার হাজার শ্রমিক পুরুষ ও শ্রমিক মেয়ে রয়েছে। প্রায়ই শ্রমিকদের মধ্যেই বিবাহ হয়। বিবাহ হলেই তারা থাকার মতো বাড়ি পায় এবং কিছু দিনের জন্য ছুটি পায় আমোদ করার জন্য। তারপর আবার কাজ শুরু করে। বিবাহের পরেই যদি ছুটি দিতে না পারে তবে একসাথে বৎসরের ছুটির সময় দিয়া দেয়। আমরা শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের খেলার মাঠে গেলাম। দেখলাম বহু ছেলেমেয়ে খেলছে, তাদের সাথে মাস্টারও আছেন। আমি যেই সেখানে গেলাম আর যায় কোথায়! শুরু হলো স্লোগান। আমার ক্যামেরা দিয়া যখন ফটো নিতে চাইলাম তখন সমস্ত ছেলেমেয়েরা লাইন বেঁধে দাঁড়াইয়া গেল। কেউ কেউ সামনে দাঁড়াবার জন্য চেষ্টা করছে। যাকে বলা হয় ঠেলাঠেলি করে আগে আসা। পরে আমরা লাইব্রেরি দেখতে যাই। শুনলাম সাংহাই শহরের মধ্যে সকলের চেয়ে বড় পাবলিক লাইব্রেরি। খুবই বড় লাইব্রেরি সন্দেহ নাই, ব্যবস্থাও খুব ভালো। রিডিং রুমগুলি ভাগ ভাগ করা রয়েছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়ার জন্যও একটা রুম আছে। সেখানে দেখলাম ছোটদের পড়বার উপযুক্ত বইও আছে বহু, ইংরেজি বইও দেখলাম।

লাইব্রেরির সাথে ছোট একটা মাঠ আছে, সেখানে বসবার বন্দোবস্ত রয়েছে। মাঠে বসে পড়াশোনা করার মতো ব্যবস্থা রয়েছে। আমার মনে হলো কলকাতার ইমপেরিয়াল লাইব্রেরির মতোই হবে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, লাইব্রেরিটা বহু পুরানা। চিয়াং কাইশেক সরকারও এর কিছু উন্নতি করেছিল। দোভাষীকে বললাম, ‘‘চলুন যেখানে সকলের চেয়ে বড় বাজার, সেখানে নিয়ে চলুন।’ সেখানে পৌঁছিয়াই একটা সাইকেলের দোকানে ঢুকলাম। সেখানে চীনের তৈরি সাইকেল ছাড়াও চেকশ্লোভাকিয়ার তৈরি তিন-চারটা সাইকেল দেখলাম। তাতে দাম লেখা ছিল। চীনের তৈরি সাইকেল থেকে তার দাম কিছু কম। আমি বললাম, ‘‘বিদেশি মাল তা হলে কিছু আছে?’’ দোকানদার উত্তর দিল, ‘‘আমাদের মালও তারা নেয়’’। আমি বললাম, ‘‘আপনাদের তৈরি সাইকেল থেকে চেকশ্লোভাকিয়ার সাইকেল সস্তা। জনসাধারণ সস্তা জিনিস রেখে দামি জিনিস কিনবে কেন?’’

দোকানি জানায়, ‘আমাদের দেশের জনগণ বিদেশি মাল খুব কম কেনে। দেশি মাল থাকলে বিদেশি মাল কিনতে চায় না, যদি দাম একটু বেশিও দিতে হয়’। সাংহাইয়ের অনেক দোকানদার ইংরেজি বলতে পারে। জিনিসপত্রের দাম বাড়তে পারে না, কারণ জনসাধারণ খুব সজাগ হয়ে উঠেছে। যদি কেউ একটু বেশি দাম নেয়, তবে তার আর উপায় নাই। ছেলে বাপকে ধরাইয়া দিয়েছে। স্ত্রী স্বামীকে ধরাইয়া দিয়েছে, এ রকম বহু ঘটনা নয়াচীন সরকার কায়েম হওয়ার পরে হয়েছে। তাই দোকানদারদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়েছে। সরকার যদি কালোবাজারি ও মুনাফাখোরদের ধরতে পারে তবে কঠোর হস্তে দমন করে। এ রকম অনেক গল্প আমাদের দোভাষী বলেছে। রাতে হোটেলে ফিরে এলাম। আগামীকাল সকালে আমরা রওয়ানা করব।

চীনের অবস্থা আরও ভয়াবহ ছিল। কারণ ‘আইন’ বলে কোনো জিনিস ছিল না। আইন জমিদারদের হাতে, তারা ইচ্ছা করলে প্রজাদের ধরে এনে বেত মারতো, না খাওয়াইয়া আটকাইয়া রাখতো। আমাদের দেশেরও পূর্বে এই ব্যবস্থা ছিল। যদি কোনো কৃষকের মেয়ে দেখতে ভালো হতো, তবে তো আর উপায় ছিল না। জমিদারের হুকুম তাকে জমিদারের বাড়ি পৌঁছাইয়া দিতে হবে, খাজনার পরিবর্তে। যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন তার ওপর জমিদার অথবা তার ছেলেরা পাশবিক অত্যাচার করবে এবং কামভাব চরিতার্থ করবে। মৃত্যু পর্যন্ত তার জমিদার বাড়িতে থাকতে হবে ঐ একইভাবে। যদি কোনো মেয়ের বাবা-মা আপত্তি করে তবে তার সর্বস্ব কেড়ে নেয়া হবে এবং অমানুষিক অত্যাচার করে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে। বছরে বছরে দুর্ভিক্ষ হতো। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বলতে কিছুই ছিল না। কারণ যা উপার্জন করতো তার চেয়ে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি, তাই তা মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। নয়াচীন সরকার কায়েম হওয়ার পরে তারা প্রথম কাজ শুরু করলেন, ‘লাঙল যার জমি তার’ এই প্রথা প্রবর্তনের মাধ্যমে। বড় বড় জমিদারদের জমি বাজেয়াপ্ত করে গরিব জমিহীন কৃষকের মধ্যে বণ্টন করে দিল। সত্যিকারের কৃষক জমির মালিক হলো। নয়াচীনে একখণ্ড জমি দেখলাম না, যা অনাবাদি অবস্থায় পড়ে আছে। রেললাইনের পাশে যে গর্তগুলি পড়ে থাকে সেগুলিতেও ফসল করা হয়েছে। যদি কোনো জমি ইচ্ছাকৃতভাবে পড়ে থাকে তহালে সরকার কঠোর শাস্তি দেয়।

কৃষক যে জিনিস উৎপাদন করে তার দাম আমাদের দেশের মতো কম হতে পারে না। আমাদের দেশে যখন ধান-পাট চাষির ঘরে থাকে, তখন দাম অল্প হয়। যখন মহাজনদের ঘরে থাকে তখন দাম বাড়তে থাকে। চাষি উৎপাদন খরচও পায় না। আর অন্যান্য জিনিস যা কৃষকের কিনতে হয়, যেমন নুন, তেল, কাপড়, এগুলির দাম এত বেশি থাকে আমাদের দেশে, যে কৃষক যা উৎপাদন করে তা দিয়ে তাদের সংসার চলে না। কিন্তু নয়াচীনে একটা সামঞ্জস্য বিধান করেছে, কৃষক যা বিক্রি করে তার দাম দিয়ে ভালোভাবে অল্প দামে তেল, নুন, কাপড় কিনতে পারে। এতে তাদের জমির ফসলের দাম দিয়েই সংসার চালানো সহজ হয়েছে। গরিবদের পাঁচ টাকায় এক মণ পাট বিক্রি করে ৪ টাকায় এক সের ডাল তেল কিনতে হয় না তাদের দেশে। প্রত্যেক এলাকায় সরকারি দোকান আছে সেখানে সস্তায় সমস্ত জিনিস পাওয়া যায়। কোনো দোকানদার ইচ্ছা করলেই বেশি দাম নিতে পারে না। কারণ যদি লোকে জানতে পায় যে কোনো দোকানদার বেশি দাম নিচ্ছে তখন তারা সরকারি কর্মচারীদের খবর দিয়ে নিজেরাই ধরাইয়া দেয় এবং মিটিং করে ঠিক করে ঐ দোকানদারের দোকানে কেউই জিনিসপত্র কিনতে পারবে না। এতে চাষিদের যথেষ্ট উপকার হয়েছে। দেশের ভেতর গণজাগরণ এসেছে বলে এটা সম্ভবপর হয়েছে।

‘প্রত্যেকে প্রত্যেকের জন্য, সকলেই সকলের জন্য’ এই নীতির প্রচার খুব হয়েছে এবং কাজও সেইভাবে হতেছে। গ্রামের গরিব চাষিরা একতাবদ্ধ হয়ে চাষাবাদ করাতে মানুষের মধ্যে বিভেদ ভাব দিন দিন দূর হয়ে যেতেছে। একমাত্র হোয়াংহো নদীতে বন্যায় বৎসরে লক্ষ লক্ষ একর ফসল নষ্ট হতো। সরকার হোয়াংহো নদীতে বাঁধ বাঁধবে বলে জনগণকে ডাক দিল। লক্ষ লক্ষ লোক পেটে খেয়ে সরকারকে সাহায্য করল। হোয়াংহোকে বলা হয় চীনের দুঃখ। চীনারা আগে কোনোদিন এই বাঁধ বেঁধে রাখতে পারে নাই। কিন্তু বিপ্লবের পর দেশপ্রেম ও জাতীয় সংহতির দৃঢ়তায় চীনারা অসাধ্য সাধন করেছে। এখন আর হোয়াংহো নদীতে বন্যা হতে পারে না। লোকের এখন আর চিন্তা করতে হয় না। আরামে বৎসরের পর তাদের পরিশ্রমের ফল তারা পায়।

যদি শোনা যায় যে, কোনো এলাকায় কোনো লোক না খেয়ে মারা গেছে, তবে সেই এলাকার সরকারি কর্মচারীদের কৈফিয়ত দিতে হয়। সন্তোষজনক কৈয়ফিয়ত না দিতে পারলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়। প্রত্যেক গ্রামে পঞ্চায়েত প্রথা চালু করা তাদের কাজ। ঐ সমস্ত এলাকায় কেউ অন্যায় করলে তার বিচার করা, সালিশি করে মিটিয়ে দেয়া পঞ্চায়েতের কাজ। রাস্তাঘাট, স্বাস্থ্য, শিক্ষার দিকে নজর দেয়াও এই পঞ্চায়েতের কাজ। এই পঞ্চায়েত কমিটির সভ্যদের ইলেকশনে মেম্বর হতে হয়। ছোটখাটো বিচার এরাই করে। তবে বিশেষ ধরনের অন্যায় করলে পিপলস কোর্টে বিচার হয়।

কারণ আমার দেশের কথা তখনই মনে পড়ল। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে আমি দেখেছি কত ভদ্র পরিবারের মেয়েরা সতীত্ব বিসর্জন দিয়ে অর্থ উপার্জন করেছে, না খাওয়া, খাওয়ানোর জন্য। হাজার হাজার মেয়ে দুর্ভিক্ষের সময় চার পয়সা দু’পয়সার জন্য সতীত্ব দিয়েছে। এমন খবরও আমি জানি স্বামী-স্ত্রীকে দিয়ে ব্যবসা করিয়ে কোনোমতে সংসার চালিয়েছে। আমি তখন রিলিফের কাজ করতেছিলাম। আইএ পরীক্ষা না দিয়ে সারাক্ষণ রিলিফের কাজ করতাম। আমার সাথে অনেক ভিখারির আলাপ হয়েছে। চোখের পানি ফেলে দিয়ে তারা বলেছে, বাবা পেটের দায়ে আর কী করি?

এমনকি ১৯৫২ সালে খুলনার দুর্ভিক্ষের সময় সাতক্ষীরা মহকুমায় যখন মাওলানা ভাসানী সভা করতে যান, তখন গরিব মেয়েরা এসে মাওলানা সাহেবকে বলেছে, ‘‘হুজুর এখন আর কেউ আমাদের ভিক্ষাও দেয় না। তাই স্বামীর অনুপস্থিতিতে ইজ্জত দিয়ে কোনো রকমে এক বেলা বা একদিন পরে একদিন চারটা খাই।’’ বন্দোবস্ত করে দিতেছি। তোমরা ফ্যাক্টরিতে কাজ করবা অন্য মেয়েরা যেভাবে করে, তারপর যাকে পছন্দ করবা তার যদি মত হয়, তবে তোমাদের বিবাহ হবে, সংসার হবে, ছেলেমেয়ে হবে। তোমরা সাধারণ মানুষের মতো বাস করতে পারবা। এভাবে জীবন নষ্ট করে তোমাদের লাভ কী?

কোনো অন্যায় কাজই বন্ধ করা যায় না, অন্যায় বন্ধ করতে হলে চাই সুষ্ঠু সামাজিক কর্মপন্থা, অর্থনৈতিক সংস্কার ও নৈতিক পরিবর্তন। তাহারা নতুন বিবাহ আইন প্রবর্তন করেছে। ছেলেমেয়ে একমত হয়ে দরখাস্ত করলেই তাদের যার যার ধর্মানুযায়ী বিবাহ দিতে বাধ্য। ‘পুরুষ শ্রেষ্ঠ আর স্ত্রী জাতি নিকৃষ্ট’ এই পুরোনো প্রথা অনেক দেশে বহুকাল থেকে চলে আসছে, তাহা আর নয়াচীনে নাই। আইন করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তাই আজ নয়াচীনে সমস্ত চাকরিতে মেয়েরা ঢুকে পড়ছে। নয়াচীনের মেয়েরা আজকাল জমিতে, ফ্যাক্টরিতে, কল-কারখানাতে, সৈন্যবাহিনীতে দলে দলে যোগদান করছে। সত্যকথা বলতে গেলে, একটা জাতির অর্ধেক জনসাধারণ যদি ঘরের কোণে বসে শুধু বংশবৃদ্ধির কাজ ছাড়া আর কোনো কাজ না করে তা হলে সেই জাতি দুনিয়ায় কোনোদিন বড় হতে পারে না।

নয়াচীনে পুরুষ ও নারীর সমান অধিকার কায়েম হওয়াতে আজ আর পুরুষ জাতি অন্যায় ব্যবহার করতে পারে না নারী জাতির ওপর। আমাদের দেশের কথা চিন্তা করে দেখুন। যদিও আইনে আমাদের দেশে নারী পুরুষের সমান অধিকার, তথাপি আমাদের দেশের শিক্ষিত অশিক্ষিত লোকের মনে এই ধারণা যে, পুরুষের পায়ের নিচে মেয়েদের বেহেশত। পুরুষ যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। মেয়েদের নীরবে সব অন্যায় সহ্য করতে হবে বেহেশতের আশায়। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, মেয়েদের নির্ভর করতে হয় পুরুষদের অর্থের ওপর। কারণ আমাদের দেশে অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত কিছু সংখ্যক মোল্লা পর্দা পর্দা করে জান পেরেশান করে দেয়। কোনো পরপুরুষ যেন মুখ না দেখে। দেখলে আর বেহেশতে যাওয়া হবে না। ইসলামি ইতিহাস পড়লে জানা যায় যে, মুসলমান মেয়েরা পুরুষদের সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে যেত, অস্ত্র এগিয়ে দিতো। আহতদের সেবা শুশ্রূষা করতো। হজরত রসুলে করিমের (সা.) স্ত্রী হজরত আয়েশা সিদ্দিকা নিজে বক্তৃতা করতেন, ‘দুনিয়ায় ইসলামই নারীর অধিকার দিয়েছে’।

আমাদের দেশে অনেকে চার বিবাহ করে। পুরুষ যদি চার বিবাহ করে তবে মেয়েরা অন্যায় করেছে কি? কোরআনে একথা কোথাও নাই যে, চার বিবাহ করো। কোরআন মজিদে লেখা আছে যে, এক বিবাহ করো। তবে তুমি দুই বা তিন বা চারটা পর্যন্ত বিবাহ করতে পারো যদি সকল স্ত্রীকে সমানভাবে দেখতে পারো। কিন্তু আমি প্রশ্ন করি, এমন কোনো মানুষ জন্মগ্রহণ করেছে কি যে সমানভাবে সকল স্ত্রীকে দেখতে পারে? কোনোদিন পারে না। তাই যদি না পারে তবে চার বিবাহ করতে পারে না। আল্লাহর হুকুম সেখানে অমান্য করা হয়।

লেখক : রাজনীতিক বিশ্লেষক, প্রধান সম্পাদক- এবিনিউজ২৪ ডট কম, সাপ্তাহিক বাংলা বিচিত্রা ও দৈনিক বাংলা সময়।

এই বিভাগের আরো সংবাদ