আজকের শিরোনাম :

রোহিঙ্গা ইস্যু থেকে লাভবান হচ্ছে কারা?

  আফসান চৌধুরী

১২ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৮:৪১ | অনলাইন সংস্করণ

রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন চালানোর পেছনে মিয়ানমারের হয়তো অনেক কারণ রয়েছে, কিন্তু এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না যে, মিয়ানমার এখান থেকে অনেক কিছু অর্জন করেছে।

আইসিজে সম্প্রতি যে তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং সম্ভব হলে মিয়ানমারের আইকনিক নেতা অং সান সু চিকে বিচারের মুখোমুখি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে যে, এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কিছু নেতিবাচক দিক রয়েছে। মিয়ানমারের জাতীয় রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক শক্তি – উভয়েরই একটা প্রভাব রয়েছে এই ইস্যুটির উপর।
 
মিত্র হিসেবে চীন গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারের বন্ধু অনেকেই আছে কিন্তু চীন হলো তাদের ঘনিষ্ঠতম, অস্তিত্বের জন্য যার উপর নির্ভর করতে হয়। সে কারণে আন্তর্জাতিকভাবে চীনকে লক্ষ্য করে যত সমালোচনা হচ্ছে, তার খানিকটা ইয়াঙ্গুনের উপরও পড়ছে। আসলে চীন এখানে গুরুত্বপূর্ণ এবং মিয়ানমার ক্রমেই এখানে একটা অজুহাত হয়ে উঠছে। হংকং ইস্যু চীনের শত্রুতার মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

আরসার হামলার পাল্টা-জবাবের কার্ডটি মিয়ানমার আর ব্যাবহার করতে পারবে না। রোহিঙ্গারা ২০১৭ সালে প্রথম যখন বাংলাদেশে ঢুকলো, তখনও এই কার্ডে কাজ হয়নি। মিয়ানমার তখনই বিষয়টা বুঝতে পেরেছে। বিশ্ব জুড়ে ইসলামি চরমপন্থার ব্যাপারে যে মনোভাব রয়েছে, সেটা তাদেরকে সাহায্য করেছে। এতে মিয়ানমারের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে দোষারোপের মাত্রা খানিকটা লঘু হয়েছে। কিন্তু সেই সমীকরণেরও এখন ততটা মূল্য নেই কারণ এখন হংকংকে কেন্দ্র করে চীন-পশ্চিম প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেক বেড়ে গেছে, যেখানে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভূমিকা অনেক বড়।

মিয়ানমারের  রোহিঙ্গা রাজনীতি

রোহিঙ্গাদের বহিষ্কার করার পেছনে মিয়ানমারের কারণটা খুবই সাদামাটা। দেশের ভেতরে জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য এটা সবচেয়ে সস্তা, সহজ উপায়। মিয়ানমার কখনই রোহিঙ্গাদেরকে তাদের নিজেদের নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করেনি, যদিও কয়েক শতাব্দি ধরে তারা সেখানে বাস করে আসছে। ঔপনিবেশিক শাসনসহ বিভিন্ন শাসন ব্যবস্থার অধীনে তারা সেখানে বাস করে আসছে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির কারণে তাদের স্ট্যাটাস বদল হয়েছে – ব্রিটিশ শাসনের অধীনে তারা বৈধ ছিল কিন্তু মিয়ানমারের শাসনাধীন রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়েছে তারা।

তারা গরিব, গায়ের রং কালো এবং অ-মঙ্গোলীয় এবং তাদের উৎস হলো আরেকটি গরিব দেশ – বাংলাদেশ। তাই মিয়ানমারের জন্য তারা কোন বাড়তি অর্থ নিয়ে আসেনি। তাদের ধর্মবিশ্বাস ইসলাম মিয়ানমারের সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের থেকে অনেকটাই আলাদা এবং এটাকে ‘সন্ত্রাসবাদের’ সাথে জুড়ে দেয়াটা সহজ। এইসব বৈশিষ্ট্যের কারণে অনেকগুলো সুবিধা রয়েছে এখানে, যেগুলো অগ্রাহ্য করাটা মিয়ানমারের জন্য কঠিন।

এদের সাথে একীভূত হওয়ার প্রশ্ন উঠছে না কিন্তু দরিদ্র কৃষক একটা জনগোষ্ঠি – যারা কোনভাবেই কারো জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে না – তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার বিষয়টি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাদেরকে বের করে দেয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু মিয়ানমার একটা সঙ্ঘবদ্ধ দেশ নয় এবং এখানকার বিভিন্ন গ্রুপগুলো একে অন্যের সাথে লড়াই করছে।

প্রশ্ন হলো রোহিঙ্গাদেরকে কেন ঠিক এখনই বের করে দেয়া হলো। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্ট পর্যালোচনা করলে মনে হয়, এর কারণ লুকিয়ে আছে বেসামরিক শক্তি ও সামরিক বাহিনীর সম্পর্কের মধ্যে। রিপোর্টগুলোতে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, যে সব কাজ সামরিক বাহিনীকে জনপ্রিয় করবে, সেগুলোকে নিজেদের জন্য জরুরি মনে করে সামরিক বাহিনী। রোহিঙ্গারা দন্তহীন একটা জাতিগত গ্রুপ, যাদেরকে উৎখাত করলে পাল্টা কোন সামরিক শক্তির মোকাবেলা করতে হবে না, যেমনটা করতে হবে শান, কাচিন বা কারেনদের মতো গোষ্ঠিগুলোর ক্ষেত্রে, যারা অনেক বেশি শক্তিশালী ও সঙ্ঘটিত।

বিজয়ী ও পরাজিত

দুই বছরের মাথায় মিয়ানমার কোন খাতেই তেমন কিছু অর্জন করতে পারেনি এবং গণতন্ত্রের প্রতীক সু চির শাসিত রাষ্ট্র হিসেবে যে মর্যাদা ছিল তাদের, সেটাও হারিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের জন্যও আকর্ষণ কমে গেছে দেশটির।

এখানে লাভবান হয়েছে চীন, মিয়ানমারের উপর এখন যাদের প্রভাব আগের চেয়ে বেড়েছে। চীনের সাথে মিয়ানমার খুব একটা দর কষাকষিতে যেতে পারে না, কারণ তাদের শর্তহীন একমাত্র মিত্র হলো চীন। চীন মিয়ানমারকে জাতিগত নিধন চালাতে বলেনি কিন্তু নিশ্চিতভাবে এটা থেকে তারা লাভবান হয়েছে।

অভ্যন্তরীণভাবে, ২০১৭ সালের নিধন অভিযান ছিল মূলত সামরিক বাহিনীর পরিচালিত অভিযান এবং এটার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মাঝে নিজেদের জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনতে পেরেছে সেনাবাহিনী যদিও আনুষ্ঠানিক ক্ষমতায় তারা নেই। সে কারণে এটা মূলত একটা রাজনৈতিক ক্ষেত্র হিসেবেই রয়ে গেছে। সু চি-কেও আন্তর্জাতিক সমালোচনার তীরগুলো বুক পেতে নিতে হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি আন্তর্জাতিকভাবে নিজের অবস্থানটাকে তুলে ধরার সুযোগ পাচ্ছেন এবং ঘন কুয়াশার সময়টাতে নিজের হারানোর প্রতীকটাকে উদ্ধারের চেষ্টা করতে পারছেন।

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী আসলে দি হেগে সু চির সাফল্য নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্নই হবে কারণ তাদের রোহিঙ্গা অভিযানের মূল্য উদ্দেশ্য ছিল রাজনীতিতে কর্তৃত্বের জায়গায় অবস্থান করা।

তবে, সেনাবাহিনী এমন কঠিন সমালোচনার মুখে পড়েছে যে, এর থেকে কিছুটা মুক্তি পেলে তারা স্বস্তিই পাবে। কিন্তু সেনাবাহিনী নিশ্চিতভাবে চাইবে না যে সু চি আবার স্বমহিমায় ফিরে আসুক।

সু চি এখন ঠিক সেটাই করতে শুরু করেছেন, ২০১৭ সালের পর সেনাবাহিনী যেটা করেছিল, সেটা হলো সড়কের শক্তিকে পক্ষে আনা। তার সমর্থনে বেশ কিছু সমাবেশ হয়েছে। আইসিজে এবং আইসিসি উভয়েই চাপ দিচ্ছে কিন্তু উভয়েই তারা সু চিকে এই ইস্যুটি নিয়ে কিছু বলার সুযোগ দিয়েছে। আর আইসিজেসহ যে কোন জায়গাতেই সু চি কিছু বললে এটা তার জন্য কিছু সহানুভূতি তৈরি করবে, বিশেষ করে যেহেতু তার একটা আইকনিক স্ট্যাটাস রয়েছে।

বড় লড়াইটা অন্যখানে?

কিন্তু এখান থেকে বেশি কিছু প্রত্যাশা করাটা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না কারণ লড়াইটা হচ্ছে অন্য পর্যায়ে – চীন বনাম পশ্চিম। হংকং দেখিয়েছে যে, চীনের সমর্থন পেয়ে যেমন মিয়ানমার লাভবান হয়েছে, তেমনি পশ্চিমাদের সমর্থন থেকে লাভবান হয়েছে হংকংয়ের বিক্ষোভকারীরা। হংকংয়ের লড়াইয়ে চীন জিততে পারেনি। পরিস্থিতি এখন আর একতরফা নয়, যেমনটা একসময় ছিল। কারণ এটা চীনের ভেতরে। তবে, পশ্চিমা বেশ কিছু মানবাধিকার সংগঠনকে হংকংয়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

মিয়ানমারের জাতিগত নিধন নীতিকে সমর্থন করতে পারে না চীন। আবার মিয়ানমারের ব্যাপারে তাদের উদাসীনতা দেখানোও চলে না।

আরসা ছাড়া আর কাউকে দোষ দিতে পারছেন না সু চি, কিন্তু নিজেকে আরও বেশি মানবিক দেখানোর জন্য তিনি এটা বোঝানোর চেষ্টা করবেন যে, তার ক্ষমতা দেশের মধ্যে সীমিত। কিন্তু তার ক্ষমতার উৎস জনতার যে অংশ, তারা রোহিঙ্গাদের ঘৃণা করে আর তাই তিনি ক্ষমা চাইতে পারছেন না বা সেনাবাহিনীকে দোষা দিতে পারছেন না।

নতুন একটা আন্তর্জাতিক খেলা চলছে কিন্তু এটা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আর চীন/পশ্চিমাদের আন্তর্জাতিক যুদ্ধ নিয়ে। এই দুটোর কোনটাতেই রোহিঙ্গাদের সংশ্লিষ্টতা নেই। রোহিঙ্গারা মূলত এখন বাংলাদেশের সমস্যা।

লেখক : শিক্ষক, কলাম লেখক

এই বিভাগের আরো সংবাদ