বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক
শেখর দত্ত
২৭ নভেম্বর ২০১৯, ২০:২৮ | অনলাইন সংস্করণ
দুই মাসের মধ্যে পর পর দুইবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করলেন। ভারত হঠাৎ করে পেঁয়াজ রপ্তানী বন্ধ করায় প্রথমবার বিগত অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও নানা সমালোচনার মধ্যে দিল্লী সফর শুরু হয়। সেখানে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী রপ্তানী বন্ধের প্রতিক্রিয়া জানালে তা খুলে দেয়া হয়। ফলে তখনকার মতো সেই বিরূপতা থাকে না। কিন্তু ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ ও ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে চুক্তি বিশেষত উপকূলে সার্বক্ষণিক মনিটরিং ব্যবস্থা, ত্রিপুরায় এলজিপি গ্যাস রপ্তানি, ফেণী নদীর পানি আর সেই সাথে যৌথ ঘোষণায় এনআরসি বিষয়টি অনুল্লেখ থাকায় বাংলাদেশের জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। এমনকি এলজিপি গ্যাস কি তা না বুঝে প্রতিক্রিয়া দেয়ার ফলশ্রুতিতে প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্র হত্যার জঘন্য ও নিন্দনীয় ঘটনা পর্যন্ত সংঘটিত হয়। বেশ কয়েক বছর পর এমন ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়।
এমনটা যে হবে তা ১০দিন আগে ২৮ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বৈঠকের ফাঁকে যখন শেখ হাসিনা-নরেন্দ্র মোদির বৈঠক হয়, তখন একেবারেই মনে হয় নাই। কেননা সেই বৈঠকের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ভারত-বাংলাদেশ ‘চমৎকার সম্পর্ক’। এনআরসি নিয়ে ‘উদ্বেগের কিছু নেই’। দুই দেশ সার্বভৌমত্ব, সমতা-আস্থা ও বোঝাপড়ার ওপর ভিত্তি করে এমন দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্ব গড়ে তুলেছে, যা স্টাটেজিক পার্টনারশিপকে ছাড়িয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে উষ্ণ সম্পর্কের জের ধরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এমন ইতিবাচক ধরনের কথার প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের আগে বাংলাদেশের জনগণের মনে সাধারণভাবে এমন একটা মনোভাব জাগ্রত হয় যে, এবারের সফরে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক আরেক ধাপ অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণ হয় নাই বরং নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
এটা কারোরই অজানা নয় যে, ঐতিহাসিকভাবে পারস্পরিক স্বার্থ সমুন্নত রেখে দুই দেশ সমঝোতা ও সহযোগিতার পথে অগ্রসর হোক এমন মতের মানুষ বাংলাদেশে যেমন রয়েছে, তেমনি তীব্রভাবে অন্ধ ভারতবিরোধী মানুষও রয়েছে। এককথায় বলা যায়, উল্লিখিত সফরের ভেতর দিয়ে সমঝোতা-সহযোগিতার পক্ষাবলম্বী মানুষ অনেকটাই কোনঠাসা হয়েছে এবং বড় দেশ হিসাবে ভারতের ভূমিকার ব্যাপারে পূর্বের মতো সাধারণভাবে নানা প্রশ্ন ও সন্দেহ দানা বেধে উঠছে। যা মোটেও কাম্য নয়। ওই সফরের রেশ কাটতে না কাটতেই কলকাতায় ক্রিকেট ইতিহাসের গোলাপী বলে প্রথম অনুষ্টিত বাংলাদেশ-ভারত টেস্ট খেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের উদ্বোধক হিসাবে প্রথমে বিসিসি সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলী ও পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণ পেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ভারত যান, তখন সম্পর্কোন্নয়ন ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের সহায়ক বিধায় ওই সফরকে ঘিরে বাংলাদেশ আলোড়িত হয়ে ওঠে এবং দেশবাসী সফরকে ‘ইতিবাচক’ হিসাবে বিবেচনায় নেয়। এই সফরে ভারত বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের মানুষও উদ্বেলিত হয়ে ওঠে।
প্রসঙ্গত এই সফরের কয়েকদিন আগে কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব-সংলাপে অতিথি হিসাবে বাংলাদেশ সফরে আসেন ভারতের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও বিজেপি দলীয় সাংসদ এম জে আকবর। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যনেল নিউজ টুয়েন্টি ফোরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিশেষত বাংলাদেশে জন্য স্পশকাতর ইস্যু তিস্তার পানি, এনআরসি, রোহিঙ্গা শরণার্থী ও চীনের সাথে সম্পর্ক প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলেন। ‘তিস্তার পানি চুক্তি সম্পন্ন করার প্রয়াস অব্যাহত আছে’, ‘আমার মনে হয় না এনআরসি বিষয়ে অন্য কোনো দেশের ওপর প্রভাব পড়া উচিত’, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত যতটুকু পারছে সহযোগিতা করছে’ প্রভৃতি কথা তিনি বলেন। চীনের সাথে সম্পর্ক বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। তার নিজস্ব বৈদেশিক নীতি আছে। কোন্ দেশের সাথে কি সম্পর্ক বজায় রাখবে তা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো হচ্ছে, বাংলাদেশেরও হোক। তা সমস্যার কিছু নয়। দেশগুলোর বাণিজ্যিক সম্পর্ক সব সময়ে যে সমানতালে চলে তা নয়। বাণিজ্যিক সম্পর্কের প্রবৃদ্ধিতে দুই দেশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। জলের যেমন ভারসাম্য থাকে, তেমনি প্রতিটি দেশ নিজেদের ভারসাম্য তৈরি করে নেয়।’ কথাগুলো স্বব্যাখ্যাত।
তিনি হাসিনা-মোদি আমলে বাংলাদেশ-ভারত ‘যুগলবন্দী’ ‘মাইলফলক ছুঁয়েছে’ বলে উচ্ছ্বসিত মন্তব্য করেন। সার্বিকভাবে সাক্ষাৎকারে সমস্যা থাকার কথাটা যেমন প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি প্রচেষ্টা বিশেষত ভারতের মনোভাবও ওই সাক্ষাৎকারে প্রকাশ পেয়েছে। প্রসঙ্গত উপমহাদেশ বিভক্তির সময় থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদ্যয় এবং পরবর্তীতে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ এটা ভালো করেই বুঝে যে, বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি ও জনগণের জীবনমান উন্নতির জন্য ভারতের সাথে পারস্পরিক স্বার্থ সমুন্নত রেখে দেয়া-নেয়ার সুসম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়। তদুপরি এটাও বুঝে যে, এই সম্পর্ক উজ্জীবিত রাখার পথ সোজা-সরল নয়। এটা বড় দেশ ভারতের জন্য যেমন তেমনি ছোট দেশ বাংলাদেশের জন্যও অবিরত সংগ্রাম। সর্বোপরি সরকারে-সরকারে চলমান চুক্তি-সমঝোতার প্রভাবে দুই দেশের জনগণের মধ্যে আস্থা-বিশ^াস-ভ্রাতৃত্ববোধ কতটা গভীর ও জাগ্রত থাকে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সেটাই প্রধান বিষয়।
উল্লেখিত প্রেক্ষাপটে উদ্বোধনে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসার পর টেস্ট ক্রিকেটে ভারতের কাছে লজ্জাজনক হারে বাংলাদেশের মানুষের যখন বুক ফেটে যাচ্ছিল, তখনই প্রকাশিত হয় কলকাতার আনন্দবাজার দৈনিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর নিয়ে একটি সংবাদ। হেডিং হচ্ছে: ‘মিত্র হাসিনার শীতল সম্বর্ধনা, কাঠগড়ায় দিল্লী’। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতে সর্বশেষ দুই সফরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘শীতল অভ্যর্থনা’ জানানো হয়েছে। কোনো কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও উচ্চ পর্যায়ের আমলার স্বাগত না জানানোকে ‘কূটনৈতিক প্রথা এবং সৌজন্য বিরোধী’ বলে মন্তব্য করেছে পত্রিকাটি। প্রথমবারের অভ্যর্থনা জানাতে দিল্লী বিমান বন্দরে উপস্থিত ছিলেন প্রথমবারের সাংসদ নারী ও শিশুকল্যান প্রতিমন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরী এবং পরের বার কলকাতা বিমান বন্দরে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো মন্ত্রী বা শীর্য আমলা উপস্থিত না থাকার বিষয়টি পত্রিকাটি প্রতিবেদনে বিষয়টি উল্লেখ করেছে। ওই প্রতিবেদনে এটা বলা হয়েছে যে, উদাসীনতা বিষয়ে দিল্লীর সাউথ ব্লক নিশ্চুপ।
সঠিক-বেঠিক জানি না, প্রতিবেদন এটাও বলেছে শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী বাংলাদেশের নেতারা ঘরোয়াভাবে বলেছেন, ‘এটা যেচে অপমান নেওয়া।’ ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে ভারতের অনুরোধে ঢাকা তাদের দেশের ভেতর দিয়ে আসাম-ত্রিপুরায় পণ্য পরিবহন ফি এক ধাক্কায় ১০৫৪ টাকা থেকে কমিয়ে ১৯২ টাকা করেছে। প্রতিবেদনে প্রতিবেশি দেশ শ্রীলংকা, নেপাল, ভূটান প্রভৃতি দেশের সাথে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সমস্যার টানোপোড়েন ও বিপদ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘প্রতিবেশিদের মধ্যে একমাত্র ঢাকাই বিভিন্ন চড়াই উৎরাইয়ে পাশে পেয়েছে দিল্লী।’ ভারতের এই আচরণে শেখ হাসিনা যে ‘ঘরোয়াভাবে চাপে থাকবে’ সেটাও উল্লেখ করা হয়েছে। বলাই বাহুল্য দিল্লী সফরের পর থেকেই অব্যাহতভাবে বাংলাদেশ সরকারের ওপর এই চাপ বাড়ছে এবং বাংলাদেশে মানুষের প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য ভারত বিরোধীতা আবারও ক্রমে পূর্বাবস্থায় যাওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে খবরে জানা যাচ্ছে, ‘ভারত থেকে অব্যাহতভাবে বাংলাভাষীদের ভারত পাঠানো’ নিয়ে ‘সীমান্তে উত্তেজনা’ বাড়ছে। বিজিবি সূত্রের বরাত দিয়ে জানানো হচ্ছে, চলতি মাসের ১ থেকে ২২ তারিখের মধ্যে ভারত থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশের কারণ দেখিয়ে ২১৪ জন নারী-পুরুষ-শিশুকে পুশইন করেছে ভারত। খবরে বলা হচ্ছে যত জনকে আটক করা হয়েছে, তার চাইতে পুশইন হচ্ছে আরো বেশি। আনন্দবাজার পত্রিকা এ নিয়ে রিপোর্টে বলেছে, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুলিশ কর্তারা স্বীকার করেছেন, ‘সাম্প্রতিক অতীতে এত বড় সংখ্যায় বাংলাদেশি নাগরিকদের এভাবে এরাজ্য দিয়ে পুশব্যাক করা হয়েছে বলে তারা মনে করতে পারেন না।’ পত্রিকাটি এটাও বলে চলেছে যে, বাংলাদেশের সাথে এমন শীতল ব্যবহারে ভারতে ‘অবাক অনেকেই।’ এদিকে ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকা বলেছে, এনআরসি নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগ উপেক্ষা করা ঠিক হবে না।
অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, ভারতের এই অবস্থান দুই দেশের জন্যই ক্ষতিকর হবে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কেন এমনটা হচ্ছে তা সুস্পষ্ট না হওয়ার এ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সন্দেহ-অবিশ^াস বাড়ছে। বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন পোস্টিং হচ্ছে, ‘মোদি সরকার কি আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে তার দেশের রাজ্য সরকার প্রধানের স্তরে নামিয়ে ফেলছেন।’ ‘জতির সম্মান বিনষ্ট’, ‘বেইমানি’ ইত্যাদি ভারত বিরোধী মন্তব্য করে বলা হচ্ছে, ‘বাংলাদেশ থেকে সব সুবিধা নেওয়া কি শেষ? নাকি আরো বেশি বগলে রাখতে চাপ সৃষ্টি।’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের পারস্পরিক সন্মান ও মর্যাদা প্রত্যক্ষ পরোক্ষ ব্যবহার এবং চুক্তি সমঝোতা স্বাক্ষর ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। দুই দেশের জনগণের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যদি উইন-উইন মনোভাব জাগ্রত না হয় কিংবা কোনো একটি দেশের জনগণ যদি বিন্দুমাত্র চাপ অনুভব করে বা স্বার্থবিঘিœত হয়েছে বলে সন্দেহ পোষণ করে, তবে তা বাধাগ্রস্থ হতে বাধ্য। এমনটা হলে জনগণকে সাথে নিয়ে বহু যতœ করে দুরদৃষ্টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতবিরোধী শক্তির প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য চাপ সত্ত্বেও সম্পর্কের উন্নতিতে যেভাবে উষ্ণতা ফিরিয়ে এনেছেন, তা বিপদাপন্ন হবে।
হুবহু মিল না হলেও এক্ষেত্রে শেখ হাসিনার ১৯৯৬-০১ শাসনামলের বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নেওয়া যায়। ১৯৯৮ সালে দুই দেশের সম্পকোন্নয়নে বাংলাদেশ ভারতের সেভেন সিস্টারের বিদ্রোহী উলফার নেতা অনুপ চেটিয়ার গ্রেপ্তার করেছিল। এই দিনগুলোতে খালেদা জিয়া গ্যাস ও তেল সম্পদ ভারতকে দিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে উত্তেজনাকর প্রচার চালান। ভারত বিরোধী প্রচারনা যখন তুঙ্গে, তখন ভারত তার সীমান্তে কাঁটা তারের বেড়া নির্মাণ করতে থাকে। ২৭ জানুয়ারি কলকাতার বইমেলার উদ্বোধনে প্রধান অতিথি হিসাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গেলে সেখানে তাকে ‘মুখ্যমন্ত্রী’ বলে সম্বোধন করা হয়েছিল। ফলে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। এই দিনগুলোতে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সরকারের সমালোচনায় নামে। বিডিআর-বিএসএফের বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা পর্যন্ত ঘটে। ঠিক তখনকার নেতাদের মতো এখনও অবশ্য আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়েদুল কাদের বলছেন, ভারতের সাথে সম্পর্ক কোনো টানাপোড়েন নেই।
এটা তো আজ সবাই জানে যে, পরবর্তীতে ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে জামায়াতকে সাথে রেখে বিএনপির হাইকমান্ড ভারত ও আমেরিকাকে ওয়াদা দেয় ক্ষমতায় এলে তারা ভারতে গ্যাস রপ্তানীসহ সম্পর্কোন্নয়নে সব কিছু করবে। প্রধানত এই ওয়াদার ফলেই ২০০১ সালের ভোট ডাকাতির নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসে। চাপের কূটনীতি ও আগাম গোপন সমঝোতায় সমূহ ক্ষতি হয়েছিল ভারতের এবং বাংলাদেশেরও। তখনো ভারতে ক্ষমতায় ছিল বিজেপির সরকার। তাতে কি লাভ হয়েছিল ভারতের! বরং ১০ ট্রাক অস্ত্র, উগ্রজঙ্গি তৎপরতা, সেভান সিস্টার উগ্রপন্থী প্রভৃতি ঘটনার ভেতর দিয়ে প্রায় পাকিস্তানের মতো হয়ে গিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত জোট শাসনে বাংলাদেশ। কেবল তা-ই নয়, বঙ্গবন্ধুর আমলে ভারতের চাপের রাজনীতির কথাও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষনে সুস্পষ্ট।আর সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর পরিস্থিতি ও জনগণের মনোভাব না বুঝে বাংলাদেশের যুবকদের নিয়ে সীমান্ত হামলার কথা কিংবা গঙ্গার পানি বন্টন সমস্যা জিইয়ে রাখার অভিজ্ঞতা এক্ষেত্রে দুই দেশের সরকারই স্মরণে রাখতে পারে। সর্বোপরি অভ্যন্তরীন রাজনীতির স্বার্থে সম্পর্ককে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করার পরিণতি দুই দেশের জন্যই বিরূপ ফল দিয়েছে।
এবারেও কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোটের ভারতবিরোধী প্রচার কার্যত বন্ধ রাখা, বিএনপির নেতাদের পদত্যাগ, ভারতের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রচেষ্ঠা প্রভৃতি ঘটনা প্রবাহ বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশে নানা ধরনের গুজব পল্লবিত হচ্ছে। প্রসঙ্গত বিগত সময়ে বিএনপির সাথে ছিল কেবল জামায়াত, এবারে যুক্ত হয়েছেন ড. কামালের গণফোরামসহ অন্যান্য দল। তাতে বিএনপির অভ্যন্তরীন পরিস্থিতি কতটা পরিবর্তন হবে তা কিন্তু অনিশ্চিত। তবে একটা কথা তো ঠিক বিএনপির সাধারণ সমর্থকরা রয়েছে অন্ধ ভারত বিরোধীতা মধ্যে। কথা রয়েছে, বিশেষভাবে নেতাদের বড় অংশ আছেন পাকিস্তান কানেকশনে। সর্বোপরি বর্তমান জাতীয় উপমহাদেশীয় ও বিশ^ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়ন্ত। তাই সংশ্লিষ্ট সকলেরই ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় সজাগ ও সচেতন হওয়া সময়ের দাবি। বাস্তবে জনগণের মনোভাব বিচারে যে ভারসাম্য তৈরি করে সম্পর্কোন্নয়নের পথে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন, তার বাড়তি কিছু সুযোগ বুঝে বা সুযোগ সৃষ্টি করে পেতে চাইলে হিতে বিপরীত ফল হতে বাধ্য।
এই অভিজ্ঞতা সময়ের কষ্টিপাথরে প্রমাণিত। বড় কিছু পেতে বা করতে চাইলে ছোট কিছু ত্যাগ করতেই হয়; এটা প্রথমে বড়কেই বুঝতে হয়, চিন্তায় ও প্রয়োগে এনে অব্যাহত রাখতে হয়। বলাই বাহুল্য প্রধানত বাংলাদেশের উদ্যোগের ফলেই সুদীর্ঘ সময় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ‘যুগলবন্দী’ কার্যকর থেকেছে। মানুষ বলে ভারতকে বাংলাদেশ উজার করে দিয়ে যাচ্ছে। ভারতের কাছ থেকেও আমরা সুদীর্ঘ বছর ঝুলিয়ে রাখা সীমান্ত চুক্তি ও সমুদ্রসীমা স্থিরীকরণ ইত্যাদি পেয়েছি। দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থেই পঞ্চাশ বছর আগের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা স¥রণে রেখে এই ‘যুগলবন্দী’র ধারকে অগ্রসর করে নেওয়া সময়ের দাবি।
-রাজনীতিক, কলাম লেখক
এই বিভাগের আরো সংবাদ