আজকের শিরোনাম :

আবেগের মেঘে ঢেকে গেছে সত্যের সূর্য

  প্রভাষ আমিন

০২ নভেম্বর ২০১৯, ১৫:১২ | অনলাইন সংস্করণ

ক্রিকেট আমাদের কাছে দারুণ এক আবেগের নাম। রাজনীতি, ধর্ম, বর্ণ, ধনী, গরিব নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে দেয় ক্রিকেট। আমরা ক্রিকেটে খাই, ক্রিকেট ঘুমাই; ক্রিকেট আমাদের আনন্দে ভাসায়, ক্রিকেটই চোখে জল আনে। ক্রিকেট এখন আমাদের দেশপ্রেম আর জাতীয়তাবাদের দূরন্ত প্রকাশের মাধ্যম।

আমার বয়স ৫০ পেরিয়েছে। অন্য অনেক আবেগ সংবরণ করতে পারি। কিন্তু ক্রিকেট এলেই সব এলোমেলো হয়ে যায়, যুক্তিহীন আবেগে ভেসে যায়। আশরাফুলকাণ্ডের পর অভিমানে দুই বছর আমি সব ধরনের ক্রিকেট দেখা ছেড়ে দিয়েছিলাম। ক্রিকেট দেখতে বসলেই নিজেকে প্রতারিত মনে হতো। মনে হতো, দুই বছর পর হয়তো জানব, এই ম্যাচটিও পাতানো ছিল। ব্যাকডেটে প্রতারিত হতে চাইনি বলেই খেলা দেখা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।

ক্রিকেট আমার কাছে নেশার মত ছিল। সেই নেশা ছাড়াতে অনেক কষ্ট হয়েছে। ক্রিকেট খেলা হলে হইচই শুনলে আমার গলা উসখুস করত, শরীরে এক ধরনের অস্বস্তির অনুভূতি হতো। সিগারেট যেমন মানুষ বারবার ছাড়ে আর ধরে, আমিও তেমন ক্রিকেট দেখা শুরুর একটা উসিলা খুঁজছিলাম।

২০১৫ সালের বিশ্বকাপে আমি মনে মনে একটা টার্গেট ঠিক করি, বাংলাদেশ যদি কোয়ার্টার ফাইনালে যেতে পারে, তাহলে আবার খেলা দেখা শুরু করব। আশরাফুল প্রতারণা করলেও বাংলাদেশ আমার মান রেখেছিল। সেই থেকে আবার ক্রিকেট নেশায় মজেছি। কিন্তু আবারও ধাক্কা খেলাম। আশরাফুলের নিষেধাজ্ঞার পর যেমন বেদনায় দুমড়ে মুচড়ে গেছি। সাকিবের নিষেধাজ্ঞার পরও একই অনুভূতি ফিরে এসেছে। প্রথমে শোনার পর আর সবার মত আমিও ভেবেছি, আশরাফুল তো ম্যাচ পাতানোতে জড়িত ছিলেন, সাকিব তো তা নন। তিনি জুয়াড়ির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। তার ভুল শুধু আইসিসিকে না জানানো। এটা অপরাধ নয়, ছেলেমানুষি ভুল বা । তাতেও বেদনা কমেনি। সাকিবের মত একজন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের এক বছর না থাকা বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য অপুরনীয় ক্ষতি। কিন্তু আইসিসির রায়ের বিস্তারিত পড়ার পর আমার বেদনার সাথে যোগ হয়েছে ক্ষোভ। আশরাফুলের ঘটনার মত এবারও নিজেকে প্রতারিত মনে হচ্ছে। সাকিব আল হাসানও আমার ভালোবাসা নিয়ে প্রতারণা করেছেন।

গত কদিন ধরেই ফেসবুকে সাকিবকে নিয়ে রীতিমত ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ফেসবুকে অনেক প্রশ্ন- এই মূহুর্তে কেন? ভারত সফরের আগে কেন? দুই বছর আগের ঘটনায় এখন সাজা হচ্ছে কেন? নানামুখী ষড়যন্ত্র তত্ত্বে সয়লাব ফেসবুকের টাইম লাইন।

সবচেয়ে জনপ্রিয় ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হলো, আইসিসির ওপর ভারতের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। তাই তারা ভয় পেয়ে বাংলাদেশের ভারত সফরের আগেই সাকিবকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। আরেকটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হলো, যেহেতু সাকিব খেলোয়াড়দের বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাই পাপন ষড়যন্ত্র করে পুরনো ঘটনা সামনে এনে আইসিসিকে দিয়ে সাকিবকে নিষিদ্ধ করিয়েছেন। অসম্ভব হলেও দ্বিতীয় তত্ত্বটিই এখন সবার মুখে মুখে। নাজমুল হাসান পাপন এখন গণশত্রু। আর অপরাধ স্বীকার করে শাস্তি পাওয়া সাকিব আল হাসান এখন জাতীয় বীর!

এটা ঠিক, বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানামুখী ষড়যন্ত্র হয়েছে। বারবার পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ের শিকার হয়েছে নবীন বাংলাদেশ। যারা আমাদের সবচেয়ে বেশি সহায়তা করতে পারত, সেই ভারতের বিরুদ্ধেই অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। আর আইসসির ওপর ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যই সবচেয়ে বেশি। কারণ আইসিসির আয়ের প্রধান উৎস ভারত। এতসব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট।

তবে সবকিছুতে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খোঁজা দুর্বলদের কাজ। সব ষড়যন্ত্র উড়িয়ে দেয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, ভালো খেলা এবং আরো ভালো খেলা; জবাবটা মাঠে দিতে পারলেই সবচেয়ে ভালো।

সাকিবের শাস্তি এতদিন পরে এই সময়ে কেন? এই প্রশ্নটি যারা করেন, কোনো পর্যায়ের বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কেই তাদের কোনো ধারণা আছে বলে মনে হয় না। তারা মনে হয়, ক্রসফায়ারের সমর্থক। যে কোনো বিচার প্রক্রিয়ার মূল অংশ তদন্ত। আর নির্দোষ কেউ যাতে সাজা না পান, তা নিাশ্চিত করতে সঠিক ও নিরপেক্ষ তদন্তটাই সবচেয়ে জরুরি। ঘটনা দুই বছর আগে হলেও এই সময়ে আইসিসির দুর্নীতিবিরোধী ইউনিট তদন্ত করেছে।

সাকিবের সাথে দুই দফায় কথা বলেছেন তারা। নিশ্চিত হয়েই তারা সাকিবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন। তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ হলেও বিচার প্রক্রিয়া কিন্তু শুরুই হয়নি। সাকিব তদন্ত প্রক্রিয়ায় আইসিসিকে সহায়তা করেছেন এবং বিচার শুরুর আগেই অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছেন। তাই তাকে তদন্ত শেষেই শাস্তি দেয়া হয়েছে, যেটা সাকিব মেনেও নিয়েছেন। যদি সাকিব আইসিসির দুর্নীতিবিরোধী ট্রাইব্যুনালে আইনি লড়াইয়ে যেতেন, তাহলে হয়তো সে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ পেতেন। তবে সে ক্ষেত্রে শাস্তি আরো বেশি হতে পারত।

সাকিব যেহেতু জানেন, তিনি অপরাধটা করেছেন, তাই ট্রাইব্যুনালে লড়ার ঝুঁকি তিনি নেননি। তার আগেই আপিল অযোগ্য এক বছরের সাজা মেনে নিয়েছেন। ট্রাইব্যুনালে গেলে চূড়ান্ত রায় আসতে আরো সময় লাগতে পারত। ভারত সফরের আগেই কেন শাস্তি? এই প্রশ্নের জবাবটাও সহজ। আইসিসির দুর্নীতি বিরোধী ইউনিট যখন নিশ্চিত হয়ে যাবে, একজন ক্রিকেটার অপরাধ করেছেন। তখন তো তাকে আর খেলতে দেবে না, সিরিজটা তার বা তার দেশের জন্য যত গুরুত্বপূর্ণই হোক। আমাদের কাছে ভারত সফরে সাকিবের উপস্থিতিটা জরুরি, কিন্তু আইসিসির চোখে তো তিনির একজন অপরাধীমাত্র।

অনেকে বলছেন, সাকিব বাংলাদেশের না হয়ে ভারত বা অস্ট্রেলিয়ার হলে তাকে সাজা পেতে হতো না। প্রবল আবেগের তোড়ে আমাদের যুক্তি ভেসে গেলেই কেবল এমনটা বলা সম্ভব। ম্যাচ পাতানোর দায়ে আজহারউদ্দিন, সেলিম মালিক, ক্রনিয়েদের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে। বল টেম্পারিংয়ের দায়ে তুখোড় ফর্মে থাকা দুই অস্ট্রেলিয়ান স্টিভ স্মিথ আর ডেভিড ওয়ার্নারকে আইসিসি দুই ম্যাচ নিষিদ্ধ করলেও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া করেছিল এক বছর।

বল টেম্পারিং ব্যক্তিগত লাভালাভের জন্য নয়, তারা করেছিলেন অস্ট্রেলিয়াকে জেতাতে। তারপরও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ান জনগণ তাদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়নি। দেশের জন্য করলেও তারা যা করেছিলেন তা ক্রিকেটের চেতনার পরিপন্থি। ক্রিকেট এবং অস্ট্রেলিয়ার মর্যাদাহানির অভিযোগ আনা হয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে। দেশের মুথে চুনকালি মাখার দায়ে, এমনকি ফিরে আসার পরও তাদের ধুয়ে দিয়েছে। আর আমরা সবাই আবেগের জোয়ারে ভেসে একজন আত্মস্বীকৃত অপরাধীর জন্য চোখের জলে সাগর বানিয়ে ফেলছি।

এটা ঠিক, সাকিব ম্যাচ পাতানোর সাথে জড়িত নন। কিন্তু তথ্য গোপনের দায়েও সাকিবের আগে অনেকের সাজা হয়েছে, যাদের মধ্যে আছেন জয়সুরিয়ার মত বিশ্বকাপজয়ী তারকাও।

২১ অক্টোবর ক্রিকেটারদের আন্দোলন, বোর্ডের সাথে সমঝোতা, নিয়ম ভেঙ্গে গ্রামীণফোনের সঙ্গে সাকিবের চুক্তি এবং এর জন্য সাকিবকে বোর্ডের শোকজ, ২৯ অক্টোবর সাবিকের নিষেধাজ্ঞা- সব মিলিয়ে মাত্র নয় দিনে বাংলাদেশ ক্রিকেটে এমন তুলকালামকে কেউ কাককালীয়, আবার কেউ সাকিবের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র বলছেন। আমি কিন্তু ষড়যন্ত্র মনে করি না, কাকতালীয় তো নয়ই। পুরো বিষয়টিই আমার কাছে সুপরিকল্পিত কৌশল বলেই মনে হয়েছে। আর আমার মনে হয়, সে কৌশলটা এঁকেছেন সাকিব নিজেই। কারণ একমাত্র তিনিই তার সম্ভাব্য শাস্তির বিষয়টি জানতেন। যখন জেনে গেলেন বাঁচার আর কোনো উপায় নেই, তখনই তিনি ক্রিকেটারদের ১১ দফা নিয়ে মাঠে নামলেন। বাংলাদেশে ক্রিকেটারদের অবিসংবাদিত নেতা এবং এখন ওয়ানডে দলের অধিনায়ক মাশরাফিকে বাইরে রেখে সাকিব যখন এই আন্দোলন এবং তাৎক্ষণিকভাবে ধর্মঘটের ডাক দিলেন; তখন অনেকেই অবাক হয়েছেন। যেই সাকিব নেতৃত্ব এনজয় করেন না, সেই সাকিব হঠাৎ ক্রিকেটারদের মহানেতা বনে গেলেন। ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।

আবার ১১ দফা দাবিতে ধর্মঘটে যাওয়ার পরদিনই তড়িঘড়ি করে বিসিবিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে গ্রামীণফোনের সঙ্গে তার চুক্তিও রহস্যজনক। আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় রেগে গিয়েই আসলে হেরে গেছেন বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান পাপন। নিয়ম না মেনে গ্রামীণফোনের সাথে চুক্তি করলেন সাকিব, আর শোকজ করে ভিলেন হলেন পাপন। অথচ সাকিবের তিন কোটি টাকা চুক্তির কারণে বোর্ডের ১০০ কোটি টাকার সম্ভাব্য চুক্তি ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ক্রিকেটারদের আন্দোলন এবং সাকিবকে শোকজের ঘটনায় পাপনের ক্রিকেটারবিরোধী ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে। এর পরপরই সাকিবের বিরুদ্ধে আইসিসির নিষেধাজ্ঞার জন্য গোটা জাতি ভিলেন বানিয়ে ফেলেছে পাপনকে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন ধারণা প্রায় প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়, সাকিবকে শায়েস্তা করতে পুরনো ঘটনা টেনে এনে পাপন আইসিসিকে দিয়ে সাকিবকে নিষিদ্ধ করিয়েছেন। কেউ কেউ আরো এক দফা এগিয়ে বলছেন, আইসিসি নয়, আসলে পাপনই সাকিবকে নিষিদ্ধ করেছেন।

এমনিতে পাপনের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। বিশেষ করে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত লোকমান হোসেন ভুইয়ার সাথে বন্ধুত্বের কারণে পাপন সমালোচিত হয়েছেন। এছাড়া আশরাফুল কেলেঙ্কারির সময় যার নাম এসেছিল, বরাবরই সেই খালেদ মাহমুদ সুজনের বোর্ডের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন আছে।

প্রশ্ন আছে পাপনের ঘনিষ্ঠদের বোর্ডে ক্ষমতাধর হয়ে ওঠা নিয়েও। আছে নানান দুর্নীতির প্রশ্ন। তাছাড়া পাপনের অনেক দিনের রাজত্বে ক্রিকেটে এক ধরনের ক্লান্তি ও স্থবিরতা ভর করেছে। তাই পরিবর্তনের একটা আকাঙ্ক্ষা আছে অনেকের মধ্যেই।

পাপনের বিরুদ্ধে হাজারটা অভিযোগ আনা যাবে। কিন্তু সাকিবের বিরুদ্ধে আইসিসির নিষেধাজ্ঞায় তার হাত আছে, এমন ভাবনা হাস্যকর। আসলে এটা অসম্ভব। পাপন চাইলেও আইসিসির দুর্নীতি দমন ইউনিটকে প্রভাবিত করে কাউকে সাজা দেওয়াতে পারবেন না। পাপনের এত ক্ষমতা থাকলে, বাংলাদেশ ক্রিকেট অনেক এগিয়ে যেত। ক্রিকেটে মাঠে খেলার চেয়ে টেবিলে খেলা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সাবের হোসেন চৌধুরীরা ক্রিকেট ডিপ্লোম্যাসি লড়ে টেস্ট স্ট্যাটাস আদায় করে এনেছিলেনন। বাংলাদেশ এখন মাঠের পারফরম্যান্সেও ভালো না, টেবিলের পারফরম্যান্স তো নয়ই।

খেলোয়াড়দের সাথে সমঝোতার পরদিনই পাপনের অফিসে গিয়ে সাকিব তাকে সম্ভাব্য শাস্তির কথা জানিয়েছেন এবং তার সহায়তা চেয়েছিলেন। পাপনও সব তিক্ততা ভুলে সাকিবের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন। তবে প্রধানমন্ত্রীও যেমন বলেছেন, সাকিবের শাস্তির ব্যাপারে বোর্ডের করার কিছু নেই। কারণ সাকিব আগেই অপরাধ স্বীকার করে শাস্তি মেনে নিয়েছেন। তারপরও সবার অভিযোগের তীর পাপনের দিকেই। আন্দোলন থেকে শুরু করে গ্রামীণফোণের সাথে চুক্তি- সব মিলিয়ে সাকিব কৌশলে পাপনকেই ক্রিকেটের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে পেরেছেন। আস্তে করে বলটা চলে গেছে পাপনের কোর্টে। জনআবেগটা এখন এমন- সাকিব যেহেতু প্রতিভাবান তাই বোর্ডের নিয়ম না মেনে চুক্তি করলেও তাকে কিছু বলা যাবে না। নিয়ম না মেনে জুয়াড়ির সাথে যোগাযোগ করলেও তাকে কোনো শাস্তি দেয়া যাবে না।

তবে একটা কথা ঠিক, সাকিব বলার আগে পাপন কিছুই জানতেন না, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ ক্রিকেটারদের আন্দোলনের পরদিন তিনি জবাব দিতে গিয়ে ফিক্সিংয়ের সন্দেহের কথা বলেছিলেন। আসলে মধ্য অক্টোবরে আইসিসির বৈঠক থেকেই পাপন বিষয়টা সম্পর্কে আঁচ পেয়েছিলেন। হতে পারে, বিস্তারিত জেনেছেন সাকিবের কাছ থেকে।

অনেকেই বলছেন, সাকিবকে লঘুপাপে গুরুদণ্ড দেয়া হয়েছে। তিনি তো জুয়াড়ির প্রস্তাব মানেননি, প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাই তার নিন্দা না করে বরং প্রশংসা করা উচিত। একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমারও একজন বাংলাদেশি ক্রিকেটারের পক্ষেই থাকা উচিত। কিন্তু একজন ক্রিকেটারের পক্ষে থাকা আর একজন অপরাধীকে সমর্থন দেয়া এক কথা নয়। রায়ের বিস্তারিত পড়ার পর আমার মনে হয়েছে, সাকিবের অপরাধ মোটেই লঘু নয়, আর এটি নিছক ভুল নয়, সুনির্দিষ্ট অপরাধ।

আরো অনেকের মত সাকিবের অপরাধকে লঘু, খামখেয়ালি, নিছক ভুল, অবহেলা হিসেবে বিবেচনা করতে পারলে আমারও ভালো লাগতো, স্বস্তি পেতাম। কিন্তু রায় পড়লে আপনিও বুঝবেন, বিষয়টা অত সহজ নয়।

ভারতীয় জুয়াড়ি দিলীপ আগরওয়ালের সাথে সাকিবের যোগাযোগের শুরুটা ২০১৭ সালের নভেম্বরে, আর সাকিবের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী তা চলেছে ২৬ এপ্রিল ২০১৮ পর্যন্ত। যদি একটা-দুইটা বিচ্ছিন্ন ফোন কল বা বার্তা বিনিময় হতো, তাহলে তাকে বেনিফিট অব ডাউট দেয়া যেত। কিন্তু সেই সুযোগই রাখেননি সাকিব। জুয়াড়ি দিলীপ আগরওয়াল সাকিবের নাম্বারটি পেয়েছিলেন সাকিবেরই পরিচিত একজনের মাধ্যমে এবং সাকিব সেটা জানতেনও।

২০১৭ সালের ৪ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ খেলা হয়েছে। তখন থেকেই আগরওয়ালের সাথে সাকিবের যোগাযোগ। সাকিব তার সাথে বিভিন্ন সময়ে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা আদানপ্রদান করেছেন। আগরওয়াল তখন সাকিবের সাথে দেখাও করতে চেয়েছিলেন।

২০১৮ সালের ৯ ও ১০ জানুয়ারি মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবের (এমসিসি) বৈঠকে জুয়াড়িদের নাম-ধাম, ছবি দেখিয়ে সবাইকে সতর্ক করা হয়েছিল। সাকিব নিজে সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং জুয়াড়িদের তালিকায় আগরওয়ালের নামও ছিল। তারপরও সাকিব সতর্ক হননি। বরং তার পরপরই বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং জিম্বাবুয়ের মধ্যকার ত্রিদেশীয় সিরিজের সময় আবার আগরওয়ালের সাথে সাকিবের যোগাযোগ হয়।

২০১৮ সালের ১৯ জানুয়ারি আগরওয়াল বার্তা পাঠান, ‘আমরা কি এখনই কাজ করব, নাকি আইপিএল পর্যন্ত অপেক্ষা করব?’। সাকিব নিজেই স্বীকার করেছেন, এই বার্তায় ‘কাজ’ বলতে ত্রিদেশীয় সিরিজের ভেতরের তথ্যের কথা বলা হয়েছে। সে বছরই ২৩ জানুয়ারি আগরওয়াল আবার বার্তা পাঠান, ‘ব্রো, এই সিরিজে কিছু আছে?’ সাকিব নিশ্চিত করেছেন, এই বার্তার মাধ্যমেও সিরিজের ভেতরের খবর জানতে চাওয়া হয়েছিল।

২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিল আইপিএলে কিংস ইলাভেন পাঞ্জাবের বিপক্ষে সাকিবের সানরাইজ হায়দ্রাবাদের ম্যাচের আগে আগরওয়াল একজন নির্দিষ্ট ক্রিকেটার এই ম্যাচে খেলবেন কিনা জানতে চেয়েছিলেন। এরপরও আগরওয়ালের সাথে সাকিবের বার্তা বিনিময় চলতে খাকে। আগরওয়াল কথা বলেন বিটকয়েন, ডলার একাউন্ট নিয়ে।

তিনি সাকিবের কাছে তার ডলার একাউন্টের বিস্তারিত জানতে চাইলে সাকিব আগে দেখা করার কথা বলেন।

সাকিব স্বীকার করেছেন, তিনি ২৬ এপ্রিলের অনেকগুলো বার্তা মুছে দিয়েছেন। ৯ ও ১০ জানুয়ারি এমসিসির বৈঠকে এই আগরওয়ালের ব্যাপারে সতর্ক করা হলেও সাকিবেকর দাবি, তিনি এপ্রিলে এসে বুঝতে পেরেছেন আসলে আগরওয়াল জুয়াড়ি। বোঝার পরে তিনি দেখা করতে চেয়েছিলেন। আগরওয়ালের সাথে পুরো আলাপচারিতায় সাকিবের দিক থেকে কোনো প্রত্যাখ্যান ছিল না।

দুর্নীতি বিরোধী ইউনিটে তদন্ত এখানেই শেষ। এরপর সব ধোঁয়াশা। সাকিবের সাথে কি আগরওয়ালের দেখা হয়েছিল? এই প্রশ্নের উত্তর নেই। কারণ তদন্ত আর এগুনোর মত প্রমাণ ছিল না তাদের। তবে আলাপের ধারাবাহিকতায় দেখা হওয়াটাকেই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। আগের বছর নভেম্বরে আগরওয়াল দেখা করতে চেয়েছিলেন সাকিবের সাথে। আর ছয় মাস পর সাকিব দেখা করতে চাইছেন আগরওয়ালের সাথে। আগরওয়াল নিশ্চয়ই সাকিবের দেখা করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেননি। তদন্ত এবং বিচার প্রক্রিয়া আরো এগুলে আরো কেলেঙ্কারি বেরিয়ে আসতে পারে, এমন শঙ্কাতেই কি সাকিব আগেভাগে অপরাধ স্বীকার করে শাস্তি মাথা পেতে নিয়েছিলেন?

অপরাধের মাত্রাটা সাকিব জানতেন না, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। একজন সিনিয়র খেলোয়াড় হিসেবে সাকিব আইসিসির দুর্নীতিবিরোধী অনেক সেশনে অংশ নিয়েছেন। তিনি জানেন, তথ্য গোপন করাটা গুরুতর অপরাধ। আর জানেন বলেই এসএমসএস মুছেও দিয়েছেন। আইসিসির দুর্নীতি দমন ইউনিটের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অবশ্য তিনি অপরাধ স্বীকার করেননি। পরে যখন এসএমএস'র স্ক্রিনশট দেখানো হয়, তখন তিনি বাধ্য হয়ে মুখ খোলেন।

২০০৮ সালে সাকিব যখন সত্যিই ইনোসেন্ট ছিলেন, তখন তিনি ঠিকই সন্দেহজনক যোগাযোগের কথা সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছিলেন। এবারও আইসিসির দুর্নীতি দমন ইউনিট মুশফিকের ফোন পরীক্ষা করেছে, কিন্তু সন্দেহজনক কিছু পায়নি।

এছাড়া বিভিন্ন সময়ে মাশরাফি, তামিম; এমনকি জাতীয় দলের সুযোগ পাওয়ার আগে আফিফও সন্দেহজনক যোগাযোগের কথা সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছিলেন। যেটা সাকিব করেননি। সাকিবের পারফরাম্যান্স যেমন সবারই নজর টানে, জানে, তার লোভের কথাও কারো অজানা নয়।

সর্বগ্রাসী লোভের ফাঁদেই কি তবে আটকে গেল এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের ক্যারিয়ার? নিষেধাজ্ঞা শেষে আশরাফুল আবার জাতীয় দলে ফিরতে চেয়েছিলেন, পারফরম্যান্সও খারাপ ছিল না। কিন্তু সাকিবের প্রবল আপত্তির কারণে আশরাফুলকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। সাকিব নাকি ম্যাচ পাতানোর দায় আছে এমন কারো সঙ্গে ড্রেসিং রুম শেয়ার করতে রাজি নন। নিয়তির নির্মম পরিহাস, সেই সাকিব আজ নিষিদ্ধ, আর সেদিনই জাতীয় লীগে ঠিক ১৫০ রান করেছেন আশরাফুল। এক বছর পর সাকিব ফিরে এলে তখন যদি কেউ তার সঙ্গে ড্রেসিং রুম শেয়ার করতে না চান, তখন কেমন লাগবে তার?

পারফরমার সাকিব আল হাসান অবশ্যই বাংলাদেশের জান। কিন্তু একজন চিহ্নিত জুয়াড়ির সাথে টানা ছয় মাস আলোচনা চালিয়ে যাওয়া, ডলার একাউন্ট চাওয়ার বিপরীতে জুয়াড়ির সাথে দেখা করতে চাওয়া লোভী সাকিব আল হাসান অবশ্যই আমাদের জান নয়। আমি অবশ্যই সাকিবের পাশে আছি। আমার সন্তান অপরাধ করলেও আমি তার পাশেই থাকব, তাকে শুধরানোর চেষ্টা করব; কিন্তু তার অপরাধকে জায়েজ করার চেষ্টা করব না। তাকে মাথায় তুলে নাচব না।

সাকিবও আমাদের সন্তানের মত। তার অপরাধের জন্য যতটুকু শাস্তি তার পাওনা, তা তাকে অবশ্যই ভোগ করতে হবে। আর আমাদের ভালোবাসার সাথে প্রতারণা করার জন্য, দেশের মুখে চুনকালি মাখার জন্য ঘৃণাটুকুও তারই পাওনা, জয়ধ্বনি নয়।

সবার মতো সাকিবের জন্য আমারও মন কাঁদে। কিন্তু সাকিব অপরাধী এটা জেনেই আমি মন খারাপ করব। ভালোবাসা যেন আমাদের অন্ধ করে না দেয়, আবেগের মেঘ যেন ঢেকে না দেয় সত্যের সূর্য।

স্মিথ আর ওয়ার্নার এক বছরের নিষেধাজ্ঞা শেষে দুর্দান্তভাবে অস্ট্রেলিয়া দলে ফিরে এসেছেন। আমরা চাই সাকিবও শুদ্ধ ও আরো শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসুক। আর সে ক্ষমতা সাকিবের আছে। তবে ক্রিকেট মানে শুধু মাঠের ভালো পারফরম্যান্স নয়।  ক্রিকেট হলো ভদ্রলোকের খেলা। ক্রিকেট মানে শুদ্ধতা, শুভ্রতা। নীতি-নৈতিকতা ক্রিকেটের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই তো আমাদের সাধারণ মানুষের তথ্য গোপন আর সাকিবের তথ্য গোপনে আকাশ পাতাল ফারাক থাকে। তাই ফিরে আসার পরও সাকিব দলকে নেতৃত্ব দেয়ার নৈতিক অধিকার, তরুণদের আইডল হওয়ার সুযোগ হারিয়েছেন চিরতরে।

আমি জানি, সাকিব এখন প্রবল জনআবেগের নাম। এই লেখার জন্য আমাকে প্রচুর গালিও খেতে হবে। তাই লেখাটা শেষ করার আগে ভেবেছি অনেক। কিন্তু আবেগের মেঘে সত্যের সূর্যটা ঢেকে যাওয়া কখনোই কাম্য নয়। আমরা যারা এখনও প্রবল আবেগে যুক্তি হারিয়ে ফেলেছি, তাদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা সত্যটা জানার চেষ্টা করুন।

আইসিসির ওয়েবসাইটে গেলেই রায়ের বিস্তারিত পাবেন। খালি সাকিবের স্বীকারোক্তির অংশটুকু পড়লেই আপনার বিভ্রান্তি অনেকটা কেটে যাবে, আবেগের আবেশটুকু ফিকে হয়ে যাবে। সাকিব নিজে যেখানে অপরাধ স্বীকার করে শাস্তি মাথা পেতে নিয়েছেন, সেখানে আপনি চাইলেও তাকে হিরো বানাতে পারবেন না।

আর অপরাধ স্বীকার করলেই অপরাধ মাফ হয়ে যায় না। আমি জানি ভুল মানুষকে ভালোবাসার কষ্ট অনেক। বাংলাদেশের প্রথম সুপারস্টার আশরাফুলকে ভালোবেসে গোটা জাতি সে কষ্ট পেয়েছে। আবার পেলে আরেক মেগাস্টার সাকিবকে ভালোবেসে। আসলেই তীব্র ভালোবাসার পাশেই শুয়ে থাকে তীব্রতম বিষাদ।

লেখক : হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

এই বিভাগের আরো সংবাদ