বাংলাদেশ-ভারতের চুক্তিসমূহ নিয়ে কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য
ড. সেলিম মাহমুদ
২২ অক্টোবর ২০১৯, ১৫:৫৭ | আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০১৯, ১৬:২৯ | অনলাইন সংস্করণ
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কিছু চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সাক্ষরিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে কিছু ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে কিছু মতামত দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের জাতীয় স্বার্থ, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে এই মতামত গুলো বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন রয়েছে।
ভৌগলিক দিক থেকে বাংলাদেশ পুরোপুরি তিন দিক থেকে ভারতের সীমানা দ্বারা পরিবেষ্টিত। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের দুই দেশের অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। বাংলাদেশ-ভারতের মোট সীমানা ৪,১৫৬ কিলোমিটার যা কোন একক রাষ্ট্রের সাথে পৃথিবীর পঞ্চম দীর্ঘ স্থল সীমানা। এই দীর্ঘ সীমানা সম্বলিত নিকটতম প্রতিবেশী হওয়ার কারণে দুই দেশের মধ্যে বেশ কিছু পারস্পরিক নির্ভরশীলতার বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ ধরণের ভৌগলিক অবস্থানের কারণে আমাদের অনেক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় প্রতিবেশী ভারতের সাথে সম্পৃক্ত। এই স্বার্থ আদায়ের একমাত্র পথই হচ্ছে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে চুক্তি সম্পাদন। পৃথিবীর সকল সভ্য ও উন্নত দেশ তাদের প্রতিবেশী দেশের সাথে চুক্তির মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ করেছে। ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহ তাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে অসংখ্য চুক্তি করেছে।
বাংলাদেশ-ভারতের চুক্তি সমুহ
বাংলাদেশ ও ভারতের সাথে এ যাবত ৯০ টিরও বেশি চুক্তি/সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সরকারের সময় মোট ১১ টি চুক্তি হয়েছিল যার সবগুলোই বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষনের জন্য করা হয়েছিল। পচাত্তুর পরবর্তী তিন সরকারের সময় অর্থাৎ জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ ও খালেদা জিয়ার তিন সরকার মিলে মাত্র কয়েকটি চুক্তি করতে সক্ষম হয়েছিল। এর মধ্যে তিনটি উল্লেখযোগ্য। ৫ মে ১৯৭৮ তারিখে বিমান চলাচল সম্পর্কিত একটি চুক্তি হয়। ২০ ডিসেম্বর ১৯৮০ তারিখে দুই দেশের ব্যবসায়ী সমিতিসমূহের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তারপর ৩১ জুলাই ১৯৯১ তারিখে দুই দেশের মধ্যে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরী বিষয়ে সহযোগিতা সম্পর্কিত চুক্তি হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের উদ্যোগে ভারতের সাথে মোট ৭৭ টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তিগুলোর প্রায় সবগুলোই বাংলাদেশের স্বার্থে করা হয়েছিল। জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সরকার সর্বমোট দীর্ঘ ৩১ বছর ক্ষমতায় থাকলেও বাংলাদেশের স্বার্থে মৌলিক কোন বিষয়ে ভারতের সাথে কোন চুক্তি করতে পারেনি। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সম্পাদিত পঁচিশ বছরের ফ্রেন্ডশিপ চুক্তিকে গোলামী চুক্তি বলে অপপ্রচার করেছিল পচাত্তুর পরবর্তী অবৈধ সরকারগুলো ও তাদের উচ্ছিষ্টভোগী কিছু নীতিভ্রষ্ট বুদ্ধিজীবী। অথচ জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষন ও মর্যাদার সুরক্ষা বিবেচনায় জাতির পিতার সরকারের সাথে ভারত সরকারের এই চুক্তি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম চুক্তি। এই চুক্তির মাধ্যমেই মাত্র তিন মাসের মাথায় ভারত বাংলাদেশ থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছিলো। পৃথিবীর প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কোন অঞ্চলে যুদ্ধপরবর্তী সময়ে এভাবে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘটনা ঘটেনি। প্রকৃত অর্থে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে টেকসই করার ক্ষেত্রে এই চুক্তির বিশেষ ভূমিকা ছিল। মহলবিশেষ এতো বছর এটিকে একটি গোলামী চুক্তি হিসেবে অপপ্রচার করলেও এই চুক্তির বারোটি (১২) অনুচ্ছেদের প্রতিটি অনুচ্ছেদই ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পরিচায়ক ও বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূলে। ভৌগলিক সীমারেখা বিবেচনায় প্রতিবেশী কোন ছোট রাষ্ট্রের সাথে বৃহৎ কোন রাষ্ট্রের এই ধরণের আন্তরিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ চুক্তি পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়গুলোর বহুমাত্রিক দিক রয়েছে। দুই দেশের সম্পর্ককে একটি দীর্ঘ পথ পরিক্রমা বলা যেতে পারে। একটি বা দুইটি চুক্তির মাধ্যমেই এই সম্পর্কের পূর্ণতা বা সার্বিকতা মূল্যায়ন করা যায় না। দুই একটি ছাড়া দ্বিপাক্ষিক প্রায় সকল চুক্তিতেই বাংলাদেশের স্বার্থ বেশী প্রাধান্য পেয়েছে। ইতোপূর্বে ভারতের সাথে তাঁর প্রতিবেশী রাষ্ট্র সমুহের মধ্যে নদী সংক্রান্ত মোট পাঁচটি চুক্তি হয়েছিল। এর মধ্যে নদীর পানি বণ্টনের চুক্তি হয়েছিল মাত্র দুটি, যার একটি বাংলাদেশের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে করা হয়েছিল ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর। দেশের সম্পদ ও সমুদ্র রক্ষায় আওয়ামী লীগের ভূমিকা
দেশের সর্বোচ্চ স্বার্থ সমূন্নত রাখার লক্ষ্যে স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু উপনিবেশিক শাসনের প্রভাব ও ‘লিগেসি’(legacy) অবসানের জন্য কিছু সাংবিধানিক, আইনী ও প্রশাসনিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এর অন্যতম একটি উদ্যোগ ছিল সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪৩। এই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সকল খনিজ সম্পদের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা (Permanent Sovereignty Over Natural Resources) প্রতিষ্ঠা করেন। এই আইনি অধিকারের ধারণাটি তৎকালীন সময়ে আন্তর্জাতিক আইন অঙ্গনে খুবই নতুন ছিল। ঔপনিবেশিক শক্তি ও বহুজাতিক কোম্পানী সমূহের অনুকূলে খনিজ ও জ্বালানী সম্পদের উপর আরোপিত ইজারা ভিত্তিক মালিকানা জাতীয় স্বার্থে বাতিল করে জারি করা বঙ্গবন্ধুর এই বিধান সমকালীন সময়ে পৃথিবীর খুব কম দেশই তাদের সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করতে পেরেছিল। বঙ্গবন্ধুর এই পদক্ষেপ ছিল তাঁরই নেতৃত্বে বাঙ্গালীর মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী মাইলফলক অর্জন। এই নীতির আলোকেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের মধ্যেই দেশের সকল গ্যাস সম্পদ বহুজাতিক কোম্পানী শেল ইন্টারন্যাশনাল এবং তেল সেক্টরের সকল স্থাপনা ঊঝঝঙ ঊধংঃবৎহ ওহপ এর কাছ থেকে অধিগ্রহণ করেছিলেন। জাতির পিতা ১৯৭২ সালে সংবিধানের ১৪৩ (১) (খ) অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জলসীমার অন্তর্বর্তী মহাসাগর ও বাংলাদেশের মহিসোপানে অবস্থিত সকল খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের সমুদ্র ও সমুদ্রসীমা রক্ষার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে ‘The Territorial Waters and Maritime Zones Act’ প্রণয়ন করেন। পরবর্তীকালের সরকারগুলো এই বিষয়ে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। সমুদ্র ও সমুদ্রসীমা রক্ষায় শেখ হাসিনা ২০০১ সালে জাতিসংঘের ১৯৮২ সালের সমুদ্র আইন (UNCLOS) অনুসমর্থন (Ratification) করেন। এই সমুদ্র আইন অনুসমর্থনের ফলেই বঙ্গোপসাগরে আমাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ ও সাহসী নেতৃৃত্ব এবং সফল এনার্জি ডিপ্লোমেসির কারণে আমরা মিয়ানমার ও ভারতের দাবীর বিরুদ্ধে বিশাল সমুদ্রসীমা অর্জন করেছি। আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে পৃথিবীর খুব কম দেশই এত সফলভাবে সমুদ্রের উপর তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। শেখ হাসিনার এই সমুদ্র জয়ের ফলে ‘দক্ষিণ এশিয়ার নর্থ সী’ (North Sea of South Asia) খ্যাত বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস সম্পদ আহরণের মাধ্যমে দেশের জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সরকার ইতোমধ্যে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কার্যক্রম কার্যকরী ও সুদক্ষভাবে পরিচালনা করছে। বর্তমানে ৭টি সমুদ্র ব্লকে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানীসমূহ একক ও যৌথভাবে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। স্থল সীমানা নির্ধারণ চুক্তি প্রসঙ্গে
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অখন্ডতা নিষ্কন্টক ও টেকসই করার লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ভারতের সাথে স্থল সীমানা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী এই চুক্তি সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সরকারের সময় অনুসমর্থনকৃত (ratification) হয়। ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৬৮ অনুযায়ী এধরনের চুক্তি সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে অনুসমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। পঁচাত্তুর পরবর্তী বাংলাদেশের সরকার গুলোর আন্তারিকতার অভাব ও জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে তাদের উদাসীনতার কারণে পরবর্তীতে এই চুক্তির বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। শেখ হাসিনার সরকার ২৯ জুন ২০০১ তারিখে বহু বছরের অনিষ্পন্ন বাংলাদেশ-ভারত স্থল সীমানা নির্ধারন সমস্যার সমাধানের লক্ষে বাংলাদেশ-ভারত জয়েন্ট বর্ডার ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করেন। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের অসহযোগিতার কারনে জয়েন্ট বর্ডার ওয়ার্কিং গ্রুপ এর কর্মকান্ড এগোয়নি। ১৯৭৪ সালের Land Boundary Agrement (LAB) এর বিধান মোতাবেক ছিটমহলগুলোতে দুই দেশের সরকার কর্তৃক আদমশুমারী (Census) করার বাধ্যবাদকতা রয়েছে। কিন্তু বিএনপি-জামাত সরকার এ কাজটি সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ করতে দেয়নি। শেখ হাসিনার সরকারের সময় ২০১০ সালের নভেম্বরে ওয়ার্কিং গ্রুপ Census করার সিদ্ধান্ত নেয় যা ২০১১ সালের জুলাইতে সম্পন্ন হয়। এ চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম (যেমন : Signing of the strip maps and exchange of the strips map ) ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারীর মধ্যে শেষ হয় । কংগ্রেস সরকার স্থল সীমানা চুক্তি পার্লমেন্টে রেটিফাই করতে পারেনি মূলত: আসামের আঞ্চলিক রাজনীতির কারণে। জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে এই ইস্যুতে বিজেপি কংগ্রেস সরকারকে সমর্থন করতে চাইলেও বিজেপি’র আসাম ইউনিট ও অসম গণসংগ্রাম পরিষদ এই বিলের তীব্র বিরোধীতা করেছিল। বিজেপি তার আঞ্চলিক রাজনৈতিক কারণে তখনকার সময়ে এই চুক্তি অনুসমর্থনের পক্ষে ছিল না। এই অবস্থা অনেকটা তিস্তা চুক্তির মতোই ছিল। তাই তিস্তা নিয়ে আমাদের আশার আলো রয়েছে। ভারতের পার্লামেন্ট ২০১৫ সালের ৭ মে এই সীমান্ত চুক্তি অনুসমর্থনের জন্য সংবিধানের ১০০তম সংশোধনী আনে। ১৯৭৪ সালে সীমান্ত চুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল ছিটমহল বিনিময় এবং আন্তর্জাতিক সীমানার সহজীকরণ করা। ভারত কর্তৃক ৬ জুন ২০১৫ তারিখে অনুসমর্থনকৃত চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের ৫১টি ছিট মহল ভারত গ্রহণ করেছে যার মোট আয়তন ৭১১০ একর ভূমি । অন্যদিকে, ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশ পেয়েছে যার মোট আয়তন ১৭,১৬০ একর ভূমি। এর ফলে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে ১০,০৫০ একর বা ৪০.৬৭ স্কোয়ার কি:মি: ভূমি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক চুক্তি সম্পাদন ও শেখ হাসিনা কর্তৃক চুক্তি বাস্তবায়নের কারণে আজ বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে এই উল্লেখযোগ্য পরিমান ভূমি লাভ করল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে যেভাবে ৪০.৬৭বর্গ কিমি: ভুমি আদায় করে নিল, এটি বাংলাদেশ তথা দক্ষিন এশিয়ায় একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এই ৪০.৬৭ বর্গ কি:মি: এরিয়া পৃথিবীর ৪টি দেশের চেয়ে বড়। দেশগুলো হচ্ছে: ভ্যাটিক্যান সিটি (.৪৪ বর্গ কি:মি:), ফ্রান্সের পাশে অবস্থিত মোনাকো (২ বর্গ কি:মি:), অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব দিকে অবস্থিত দ্বীপ রাষ্ট্র নাগুরু (২১ বর্গ কি:মি:), অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত দ্বীপ রাষ্ট্র টুভালু (২৬ বর্গ কি:মি:)। পৃথিবীর পঞ্চম ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্রও মাত্র ৬১ বর্গ কি:মি: যার নাম স্যান ম্যারিনো (ইটালীর পাশে অবস্থিত)। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন পাকিস্তান সরকার ২৪ বছরে, জিয়া এরশাদ ও খালেদা জিয়ার মোট ৩১ বছর শাসনামলে এই স্থল সীমান্ত সমস্যার সমাধান করতে পারেনি; ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খানের সাথে ভারত সরকার এই বিষয়ে একটি চুক্তি করেছিল। সেই চুক্তি কোনদিন বাস্তবায়ন হয়নি। বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার
ভারতের উত্তর -পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো কর্তৃক বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের বিষয়ে মহল বিশেষ যে বক্তব্য দিচ্ছে, জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এ বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ই লাভবান হবে। এর ফলে বাংলাদেশ পাবে পরিবহন থেকে আয়, মাশুল ও বীমা থেকে আয় এবং বাড়বে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান। অন্যদিকে, আমাদের উপর ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নির্ভরশীলতা তৈরী হবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ভূ-রাজনীতির নিয়ম অনুযায়ী এর ফলে দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কে আমাদের barganing power (দর কষাকষি) বৃদ্ধি পাবে। কারণ এই ধরনের ট্রেড রিলেশনস্ এর ফলশ্রুতিতে যে নির্ভরশীলতা তৈরী হয়, তা ভূ-রাজনীতিকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এই রাজ্যগুলোর সাথে বাংলাদেশের কানেকটিভিটি তৈরী হলে সেখানে অনেক বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরী হবে। সেখানে বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ত্রিপুরার মূখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ত্রিপুরায় বাংলাদেশী বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করার জন্য অনুরোধ জানান। বিদেশী কোন রাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের ফলে বিনিয়োগ ও ব্যবসা বানিজ্যের সমৃদ্ধি এবং অর্থনীতির অগ্রগতির সূচকে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গণে এগিয়ে যাবে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট রেটিং সূচকেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ভারত কর্তৃক আমাদের বন্দর ব্যবহারের বিষয়টি একদিকে যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রমানপত্র হিসেবে কাজ করছে, অন্যদিকে এই স্থিতিশীলতার সংরক্ষণসহ এটিকে টেকসই করার ক্ষেত্রে বন্দর ব্যবহারের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। বর্তমানে ভারতের সাথে বাংলাদেশের বানিজ্য ঘাটতি প্রায় ৭.৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সরকার এই বানিজ্য ঘাটতি কমানোর জন্য নানাভাবে চেষ্টা করছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো কর্তৃক বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করা হলে এই বানিজ্য ঘাটতি কিছুটা কমবে। ভারত ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে তাদের দুটি ইস্ট কোস্ট পোর্ট (কলকাতা ও হালদিয়া পোর্ট) ব্যবহার করার প্রস্তাব দিয়েছে। সাম্প্রতিক কালে ভারত ইরানের শাবাহার (Chabahar) পোর্ট ব্যবহার করে আফগানিস্থান ও সেন্ট্রাল এশিয়াতে তার বিনিয়োগ ও বানিজ্য সম্প্রসারনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এই পোর্ট ব্যবহারের ফলে Multi Mode North South Transport Corridor রয়েছে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশী বানিজ্যের সুযোগ তৈরী হবে। ভারত কর্তৃক আমাদের বন্দর দুটি ব্যবহার প্রসঙ্গে মহল বিশেষ নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে। এই পোর্ট ব্যবহারের চুক্তির ফলে এই পোর্ট দুটি ‘treaty ports’ এ রূপান্তরিত হচ্ছে না। উনিশ শতকে চীনের বেশ কয়েকটি পোর্ট কিছু পশ্চিমা দেশ (রাশিয়া, বৃটেন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জাপান, বেলজিয়াম, জার্মানী, ইটালী, পর্তুগাল ইত্যাদি) ‘treaty ports’ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। মূলত: যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র চীনের ঐ সকল পোর্টগুলোতে concession right Ges extra territorial jurisdiction প্রয়োগ করতো। চুক্তিতে উল্লিখিত concession period অনেকটা তাদের মালিকানার মতো ছিল। বন্দর ব্যবহার সম্পর্কিত ভারতের সাথে আমাদের চুক্তির মাধ্যমে ভারতকে কোন ধরনের concession right দেয়া হয়নি। এই চুক্তি বাতিল করারও বিধান রয়েছে। চুক্তির মাধ্যমে ভারতকে শুধু পোর্ট ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হয়েছে; কোন extra territorial jurisdiction দেয়া হয়নি। বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে নর্থ ইস্টে মালামাল ও পণ্য পরিবহনে ব্যাপকভাবে খরচ কমে আসবে। বাংলাদেশ সীমানার বাইরে ভারতের ‘চিকেন নেক’ (Chicken Neck) এর মধ্যে দিয়ে আগরতলা থেকে কলকাতার দূরত্ব প্রায় ১৭০০ কি:মি:। আগরতলা থেকে সাব্রুম হয়ে চট্টগ্রাম পোর্ট এর দূরত্ব মাত্র ২০৭ কি:মি:। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের কারণে ভারতীয় পণ্য পরিবহনে বিপুল খরচ কমে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত বন্দর ও কাস্টমস্ কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন ফি ও চার্জ এবং পণ্য পরিবহনের মূল্য যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা বাঞ্চণীয়। এই ফি, চার্জ ও পরিবহন মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘cost based pricing’ এর পরিবর্তে ‘opportunity cost pricing’ পদ্ধতি গ্রহণ করা সঠিক হবে। বর্তমান অবস্থায় এই পদ্ধতি গ্রহণ করলে প্রকৃত অর্থে ‘win win principle’ বাস্তবায়িত হবে। পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশ তাদের বন্দরগুলো আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এর ফলে ঐসকল দেশ বিনিয়োগ ও বানিজ্যিক hub-এ পরিনত হয়েছে। এশিয়ার মধ্যে সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান ও হংকং তাদের পোর্টসমূহ ব্যাপকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক সমৃদ্ধি লাভ করেছে। জার্মানীর বৃহৎ ও মাঝারী ১১টি পোর্ট থাকা সত্ত্বেও দেশটি নেদারল্যান্ডের রটারডাম (Rotterdam) পোর্ট ব্যবহার করছে। ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ বর্তমানে এই পোর্ট ব্যবহার করে। যৌথভাবে ডেনমার্ক ও সুইডেনে অবস্থিত কোপেনহেগেন মালমো পোর্ট (CMP)। ডেনমার্ক, সুইডেনসহ বাল্টিক ও উত্তর সাগর তীরবর্তী বেশ কিছু দেশ এই বন্দর ব্যাপকভাবে ব্যবহারের কারণে এটি একটি বানিজ্যিক hub-এ পরিনত হয়েছে। অন্যদিকে, ডেনমার্কের কোপেনহেগেন এয়ারপোর্ট সুইডেনের স্ক্যানিয়া প্রভিন্সের মালমো সিটিসহ অধিকাংশ সিটির জনগণ ব্যবহার করে। সুইডেন কর্তৃক ডেনমার্কের এয়ারপোর্ট ব্যবহারের ফলে ডেনমার্কের অতিরিক্ত রাজস্ব আয় হচ্ছে। অন্যদিকে দূরত্ব কম হওয়ার কারণে সুইডেনের নাগরিকগণের জন্যও এই এয়ারপোর্ট ব্যবহার অনেক সাশ্রয়ী। বর্তমানে বাংলাদেশের কুমিল্লা ও ব্রাহ্মনবাড়িয়া অঞ্চলের বেশ কিছু মানুষ আগরতলা এয়ারপোর্ট ব্যবহার করে ভারতের বিভিন্ন নগরে যাতায়াত করছে। এ অঞ্চলের মানুষের জন্য ঢাকা বা বাংলাদেশের অন্যান্য এয়ারপোর্টের তুলনায় ভারতের যে কোন সিটিতে যাতায়াতের জন্য সময় ও খরচ বিবেচনায় আগরতলা বিমান বন্দর অনেক বেশী সাশ্রয়ী। ২০১০ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর যৌথ ঘোষনায় নেপাল ও ভুটানকে বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করার বিষয়ে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। বিবিআইএন অঞ্চলে বিনিয়োগ ও বানিজ্য অধিকতর সম্প্রসারনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বন্দর দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমানে নেপাল ও ভুটান ভারতের পোর্ট ব্যবহার করছে। ১৯৬০ সালে সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে নেপাল ভারতের কলকাতা ও হালদিয়া পোর্ট ব্যবহার করছে। ভুটান বর্তমানে ভারতের কলকাতা পোর্ট ব্যবহার করছে। সাম্প্রতিককালে ভুটান থেকে সড়ক পথে প্রেরিত পণ্য আসামের ধুবরী থেকে কার্গো জাহাজের মাধ্যমে অভ্যন্তরীন নৌপথে (ব্রহ্মপুত্র নদী পথের মাধ্যমে) বাংলাদেশের নারায়নগঞ্জ পৌছে। ২০১৮ সাল থেকে ধুবরী কে ‘পোর্ট অফ কল’ ঘোষনা করা হয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে অধিকতর বেগবান করতে হলে আমাদের বন্দরগুলো শুধুমাত্র অভ্যন্তরীন ব্যবহারের জন্য সীমাবদ্ধ না রেখে আঞ্চলিক কিংবা উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে এর ব্যবহার সুনিশ্চিত করার প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের বন্দর দুটি নেপাল, ভুটান ও ভারত কর্তৃক ব্যবহৃত হলে এই উপ-অঞ্চলে বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বানিজ্যের ব্যাপক প্রসার হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিনিয়োগ ও বানিজ্য hub-এ পরিনত হবে। বর্তমানে ভারতের সাথে আমাদের বানিজ্য ঘাটতি রয়েছে। আমাদের সাথে নেপালের গত তিন বছর ধরে বানিজ্য ঘাটতি রয়েছে। আবার, ভুটানের সাথে আমাদের বানিজ্য ঘাটতি রয়েছে। এটি উল্লেখ্য যে, বর্তমানে বাংলাদেশের ৯০% রপ্তানী ও আমদানী চট্টগ্রাম পোর্টের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। এই পোর্টের ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ পোর্টটি-কে আধুনিকীকরনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অন্যদিকে, মংলা পোর্টের ধারণ ক্ষমতার প্রায় ৫০% বর্তমানে ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকার ইতোমধ্যে এই পোর্টের ধারন ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। উপকূলে সার্ভিলেন্স সিস্টেম স্থাপন সংক্রান্ত চুক্তি প্রসঙ্গে
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ভারত সফরে ভারতের সাথে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয় যার শিরোনাম ‘MOU on Eastablishment of Coastal Surveillance Radder System in Bangladesh’। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের সার্বিক নিরাপত্তা সংরক্ষণের লক্ষ্যে এই সার্ভিলেন্স সিস্টেম স্থাপন করা হবে। কেউ কেউ এই চুক্তিটির ভুল ব্যাখ্যা এবং অপব্যাখ্যা করছেন। সার্ভিলেন্স সিস্টেমটি যেহেতু বাংলাদেশের সমুদ্রসীমানায় স্থাপন করা হবে, তাই এর নিয়ন্ত্রন অবশ্যই বাংলাদেশের হাতে থাকবে। এর নিয়ন্ত্রন ভারত কিংবা তৃতীয় কোন রাষ্ট্রের কাছ থাকছেনা। কেউ কেউ আবার এই প্রশ্ন তুলেছেন যে, এই সিস্টেমটির মালিকানা বাংলাদেশে থাকলেও সিস্টেমটির ব্যবহৃত সফটওয়্যার ও তথ্যের উপর ভারতের নিয়ন্ত্রন থাকবেনা, তার নিশ্চয়তা কী। তাঁরা আরও বলছেন, এই সিস্টেম স্থাপনের ফলে ভারত বঙ্গোপসাগরে চীনের উপর নজরদারী করতে পারবে এবং এ বিষয়টি আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারত-চীন ভারসাম্য রক্ষার যে বিষয়টি রয়েছে, তার লংঘন হবে। দুটি বন্ধুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থে নিরাপত্তা সংক্রান্ত সহযোগিতা বর্তমান বিশ্বে বহুল প্রচলিত একটি প্রথা (custom)। আর ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে সামরিক ও নিরাপত্তা বিষয়ে কারিগরী সহযোগিতা ও তথ্য আদান-প্রদান একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এ ক্ষেত্রে মূল বিষয়ই হচ্ছে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সহযোগিতা প্রদান। দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ ঘোষনায় প্রতিরক্ষা খাতে অধিকতর সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয়। এছাড়া, এই ঘোষনায় দুই দেশের মেরিটাইম সিকিউরিটি পার্টনারশীপকে স্বাগত জানানো হয়। বাংলাদেশ যখন চীনের কাছ থেকে সাবমেরিন ক্রয় করেছিল, তখন এই ব্যক্তিবর্গই বলে আসছিল যে, ভারত এই বিষয়ে অসন্তুষ্ট হবে। এখন তাঁরাই আবার বলছে, ভারতের সহযোগিতায় উপকূলে সার্ভিলেন্স সিস্টেম স্থাপন করা হলে ভারত-চীন বিষয়ে ভারসাম্য বজায় রাখার বাংলাদেশের বর্তমান নীতির লংঘন হবে। একটি বিষয় লক্ষনীয়, তাদের পূর্বের বক্তব্যটি অর্থাৎ চীনের কাছ থেকে সাবমেরিন কেনার কারনে ভারত সংক্ষুব্ধ হয়েছে-এটি সত্য হলে তাদের পরের বক্তব্যটির অসারতা প্রমানিত হয়। চীনের কাছ থেকে সাবমেরিন ক্রয় এবং পরবর্তীতে ভারতের কারিগরি সহযোগিতায় বাংলাদেশের উপকূলে সার্ভিলেন্স সিস্টেম স্থাপন করার বিষয়টি বরং এই অঞ্চলের বিশেষ ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা ও বাংলাদেশের সার্বিক স্বার্থে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এতে পররাষ্ট্র নীতিতে সার্বিক ভারসাম্য রক্ষার কৌশলের কোন ব্যতয় ঘটেনি। এই সকল সমালোচক একবার ভারতের সংক্ষুব্ধ হওয়ার বিষয়টি সামনে আনছেন, আবার বঙ্গোপসাগরে চীনের ‘স্বার্থহানী’র বিষয়টি আনছেন। এই সকল ব্যক্তি মূলতঃ বিদেশী স্বার্থ সুরক্ষার জন্যই ব্যস্ত। বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বিক উন্নয়নে তাদের কোন ইতিবাচক ভূমিকা নেই; এতদসংক্রান্ত বিষয়ে তাদের প্রণীত কোন কৌশলপত্র নেই। যারা আজ বঙ্গোপসাগর নিয়ে মায়া কান্না করছেন, তাদের একথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার উদ্যোগেই আমরা আমাদের সমুদ্র রক্ষা করতে পেরেছি। শেখ হাসিনাই তাঁর সুদক্ষ কৌশল, কুটনীতি ও অসীম সাহসিকতাপূর্ণ উদ্যোগের মাধ্যমে ভারত ও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিশাল সমুদ্র অর্জন করেছেন। আমাদের সমুদ্র সম্পদ ও সমুদ্র এলাকা সুরক্ষার জন্য তিনি আমাদের নৌবাহিনীতে সাবমেরিন যুক্ত করেছেন। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব (sovereignty) ও সার্বভৌম অধিকার (sovereign rights) অধিকতর নিরাপদ করার লক্ষ্যে শেখ হাসিনার সরকার উপকূলে সার্ভিলেন্স সিস্টেম স্থাপন করতে যাচ্ছে। শেখ হাসিনার সরকার “Friendship to all and malice to none” বঙ্গবন্ধুর এই পররাষ্ট্রনীতিকে ধারণ করেই ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা ও আমাদের জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখতে যে সকল উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন তার প্রত্যেকটা উদ্যোগই গ্রহণ করছে। ফেনী নদীর পানি ব্যাবহার সম্পর্কিত চুক্তি প্রসঙ্গে
এই সফরে পানি বণ্টনের যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেটি কনভেনশনাল পানি বণ্টন চুক্তি নয়। ত্রিপুরার সাব্রুম শহরের জন্য খাবার পানি হিসেবে ফেনী নদীর মোট পানি প্রবাহের মাত্র ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করা হবে যা ফেনী নদীর শুষ্ক মৌসুমের পানি প্রবাহের মাত্র শুন্য দশমিক ২২ শতাংশ। আমি মনে করি, এই সমঝোতা স্মারক ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে যে সকল চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে, তার উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। একটি কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এখন আর 'zero sum game principle' কার্যকরী নয়। এর পরিবর্তে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এখন পৃথিবীব্যাপী 'win-win principle' কার্যকরী হচ্ছে। 'zero sum game principle' এর অর্থ হচ্ছে একজনের কিছু সুবিধা পাওয়া-কে অন্য পক্ষের স্বার্থ বিরোধী মনে করা হয়। অন্যদিকে, 'win-win principle' এর অর্থ হচ্ছে, এক পক্ষ কিছু সুবিধা পেলে অন্য পক্ষ তাতে মন খারাপ না করে তার তার নিজের সার্বিক স্বার্থটাই দেখা উচিত। এলপিজি রপ্তানি প্রসঙ্গে
ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় এলপিজি রপ্তানি নিয়ে যে অপপ্রচার হচ্ছে সেটা নিয়ে কথা বলা দরকার। বাংলাদেশ থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানী করা হচ্ছে না। বাংলাদেশের দুটি বেসরকারি কোম্পানি বিদেশ থেকে এলপিজি (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস) আমদানি করে তার অংশ বিশেষ সেখানে রপ্তানি করবে। আর সেটিও বাংলাদেশের এলপিজি'র চাহিদা মেটানোর পরই তারা রপ্তানি করবে। এই এলপিজি আমাদরে দশেীয় প্রাকৃতকি গ্যাস কিংবা আমদানিকৃত এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) থকেে উৎপাদতি হচ্ছে না। এটি crude oil থেকে উৎপাদিত আমদানিকৃত এলপিজি। আমাদের দেশে সিলিন্ডার গ্যাস বা রান্নার গ্যাস হিসেবে পরিচিত। বাংলাদশেরে দুটি কোম্পানরি পক্ষ থকেে ভারতে এলপজিি রপ্তানরি বষিয়টি বিষয়টি নিঃসন্দেহে অর্থনীতির অগ্রগতির সুচকে বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হবে। এছাড়া, এলপিজি'র এই বাণিজ্য বাংলাদেশ-ভারত সম্পকে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এই জন্য যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীতি অনুযায়ী আন্তঃরাষ্ট্রীয় জ্বালানী বানিজ্য ভূ-রাজনীতিকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। এটি উল্লেখ্য যে, আন্তরাষ্ট্রীয় জ্বালানী সহযোগিতার (cross border energy cooperation) এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশের দুটি বেসরকারী কোম্পানী ভারতে এই এলপিজি রপ্তানি করবে। এটি স্মরণ করা প্রয়োজন যে, আমাদেরও জ্বালানীর জন্য ভারতের উপর নির্ভরশীলতা রয়েছে। আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রয়োজনীয় জ্বালানী সরবরাহ নির্বিঘ্ন করতে ভারতের নুমালীগড় রিফাইনারীর শিলিগুড়ি টার্মিনাল থেকে বাংলাদেশের পার্বতীপুর পর্যন্ত ১৩০ কিঃমিঃ দীর্ঘ ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ পাইপলাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। আমাদেরকেও ভারতের কাছ থেকে জ্বালানী তেল আমদানি করতে হচ্ছে। তাছাড়া, যেই ত্রিপুরা'র একটি শহরকে ফেনী নদী থেকে আমরা সামান্য খাবার পানি দিচ্ছি, তারা তাদের নিজস্ব গ্যাস পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সেই বিদ্যুৎ আমাদেরকে দিচ্ছে। আর গ্যাস রপ্তানির যে কথা বলা হচ্ছে, সে প্রসঙ্গে কিছু বলা উচিত। গ্যাস রপ্তানি শেখ হাসিনার সরকার করতে দেয়নি, তাই আওয়ামী লীগকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে নির্বাচনে হারানো হয়েছিল। এই বষিয়ে পরর্বতী অংশে বস্তিারতি আলোচনা করা হয়ছে। ঐতিহাসিকভাবে জাতীয় ও আঞ্চলিক জ্বালানী নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় ক্রসবর্ডার বা আন্ত:রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানী বানিজ্য একটি গুরুত্বপূর্ন পদ্ধতি হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম রাষ্ট্রনায়ক যিনি ‘এনার্জি ডিপ্লোমেসি’-কে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক ও দ্বি-পাক্ষিক পর্যায়ে প্রধান্য দিয়ে আসছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ভারত থেকে নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ আনার জন্যে ভেড়ামারায় যে ক্রসবর্ডার ইন্টারকানেকশন স্থাপিত হয়েছে, সেটি বাংলাদেশের জন্য একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এছাড়া ভারতের ত্রিপুরার সাথে ক্রসবর্ডার ইন্টারকানেকশন স্থাপিত হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের মোট সরবরাহকৃত বিদ্যুতের ৭% (১১৬০ মে:ও:) ভারত থেকে আসছে যা দেশের উৎপাদিত বিদ্যুতের গড় মূল্যের তুলনায় অনেক সাশ্রয়ী। এছাড়া ভারতের ঝাড়খন্ড ও ত্রিপুরা থেকে যথাক্রমে ১৪৯৬ ও ৩৪০ মে:ও: বিদ্যুৎসহ মোট ১৮৩৬ মে:ও: বিদ্যুৎ আমদানীর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা যাবে না। এতে অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে পড়বে। সরকার আশা করছে, ২০৪১ সাল নাগাদ আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ বানিজ্য ও রিজিওনাল গ্রীড থেকে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য পরিমান বিদ্যুৎ পাবে। বাংলাদেশের জ্বালানী নিরাপত্তার স্বার্থে শেখ হাসিনার সরকার জলবিদ্যুৎ সক্ষমতা সমৃদ্ধ ভুটান ও নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানীর কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করছে। নেপালের সাথে ইতোমধ্যে সমঝোতা স্মারক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ভুটানের সাথে চুক্তির খসড়া চুড়ান্ত করা হয়েছে। ভুটান ও নেপালের সাথে বাংলাদেশের পৃথক পৃথক বিদ্যুৎ বানিজ্যে ভারত অংশীদার হিসেবে থাকছে। এই বিদ্যুৎ আমদানিতে ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন। আমাদরে ভবষ্যিৎ জ্বালানী নরিাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষত্রেে ক্রসবর্ডার বদ্যিুৎ ও জ্বালানী বাণজ্যিরে গুরুত্বর্পূণ ভুমকিা রয়ছে। তাই আমাদের ভবিষ্যৎ জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে ভারতের সার্বিক সহযোগিতা দরকার। গ্যাস নিয়ে বিএনপি-জামাত জোট সরকারের দেশ বিরোধী নীতি
আজকে বাংলাদেশকে কেন LNG আমদানী করতে হচ্ছে ? বিএনপি-জামাত জোট সরকারের ভ্রান্ত নীতি ও দেশ বিরোধী সিদ্ধান্তের কারণেই আজ আন্তর্জাতিক বাজার থেকে LNG আমদানী করা হচ্ছে। আপনাদের মনে আছে, ২০০৪/২০০৫ সালে মিয়ানমার থেকে স্বল্প মূল্যে পাইপ লাইন গ্যাস আমদানীর প্রস্তাব ছিল। বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারতের মধ্যে এ বিষয়ে MOU স্বাক্ষরও হয়েছিল। ঐ সময়ে দীর্ঘ মেয়াদী পাইপ লাইন প্রকল্প থেকে যে পরিমান গ্যাস পাওয়ার কথা ছিল, সেটি পাওয়া গেলে আজ আমাদেরকে এভাবে খঘএ আমদানী করতে হতো না। আমাদের প্রাথমিক জ্বালানীর এরকম সংকট তৈরী হতো না। আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, ঐ সময়ে বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের সাথে দীর্ঘমেয়াদী গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পে অংশগ্রহন করলে মিয়ানমার পরবর্তীতে রোহিঙ্গা ইস্যুর মতো একটি প্রকট মানবিক সংকট চাপিয়ে দেয়ার মতো আচরণ আমাদের সাথে করতে পারতো না। কারণ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীতি অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদী আন্তঃরাষ্ট্রীয় জ্বালানী বানিজ্য ভূ-রাজনীতিকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। খালেদা জিয়ার সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে মিয়ানমার থেকে গ্যাস পাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করলেও ২০০১ সালে নির্বাচনের পর দেশের সীমিত গ্যাস সম্পদ বিদেশে রপ্তানীর উদ্যোগ গ্রহন করেছিল। কারণ নির্বাচনের পূর্বে গ্যাস রপ্তানির মুচলেকা দিয়ে বিএনপি-জামাত ষড়যন্ত্রমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল। অথচ প্রধানমন্ত্রী শখে হাসনিা ২০০০ সালে জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে সীমিত জাতীয় সম্পদ গ্যাস রপ্তানীর সিদ্ধান্তের পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদে নিজস্ব ব্যবহারের জন্য গ্যাস মজুদের সিদ্ধান্ত দয়িছেলিনে। দেশের স্বার্থে গৃহীত এই সিদ্ধান্তের কারনেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে দেয়া হয়নি। পরবর্তীতে ২০০৩ সালের অক্টোবরে আওয়ামী লীগের প্রতিরোধের মুখে খালেদা জিয়ার সরকার ইতোপূর্বে তাঁরই গৃহীত গ্যাস রপ্তানীর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। অর্থাৎ জাতির পিতা যে গ্যাস সম্পদ আমাদেরকে দিয়ে গিয়েছিলেন, দেশের জ্বালানী নিরাপত্তা তথা সার্বিক উন্নয়নের জন্য সেই সম্পদ রক্ষা করেছিলেন তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা। লেখক পরিচিতি: ড.সেলিম মাহমুদ বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএল.বি সম্মান (প্রথম শ্রেনীতে প্রথম), এলএল.এম এবং যুক্তরাজ্যের ডান্ডি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জ্বালানী আইন ও পলিসি বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন (২০০৮)। ড. মাহমুদ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরী কমিশন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান (২০১৬-২০১৯) এবং বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরী কমিশনের সদস্য (২০০৯-২০১৬) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে দক্ষিন এশীয় আন্তঃরাষ্ট্রীয় টাস্ক ফোর্স- সাউথ এশিয়ান রিজিওনাল ইনিশিয়েটিভ/এনার্জি ইন্টিগ্রেশন এর টাস্কফোর্স সদস্য (২০১৩-২০১৭) হিসেবে দক্ষিন এশিয়ায় জ্বালানী ভিত্তিক আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় জ্বালানী বানিজ্য উন্নয়নে ‘এডভোকেসী’ কার্যক্রমে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরী কমিশনের সদস্য হিসেবে তিনি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানীর যৌক্তিক ট্যারিফ নির্ধারনের মাধ্যমে এখাতে ভর্তুকি সংস্কারসহ ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণ এবং ইউটিলিটিগুলোর ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা ও আর্থিক শৃংখলা প্রতিষ্ঠায় সরকারী উদ্যোগে বিশেষ সহযোগিতা করেন। একজন আইনজ্ঞ হিসেবে তাঁর জ্বালানী আইন ও পলিসি, আরবিট্রেশন, সাংবিধানিক আইন, ইনভেস্টমেন্ট আইন এবং কর্পোরেট ও কমার্শিয়াল আইনে বিশেষ অভিজ্ঞতা রয়েছে। ড. মাহমুদ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন কমিটির একজন সদস্য।
বাংলাদেশ ও ভারতের সাথে এ যাবত ৯০ টিরও বেশি চুক্তি/সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সরকারের সময় মোট ১১ টি চুক্তি হয়েছিল যার সবগুলোই বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষনের জন্য করা হয়েছিল। পচাত্তুর পরবর্তী তিন সরকারের সময় অর্থাৎ জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ ও খালেদা জিয়ার তিন সরকার মিলে মাত্র কয়েকটি চুক্তি করতে সক্ষম হয়েছিল। এর মধ্যে তিনটি উল্লেখযোগ্য। ৫ মে ১৯৭৮ তারিখে বিমান চলাচল সম্পর্কিত একটি চুক্তি হয়। ২০ ডিসেম্বর ১৯৮০ তারিখে দুই দেশের ব্যবসায়ী সমিতিসমূহের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তারপর ৩১ জুলাই ১৯৯১ তারিখে দুই দেশের মধ্যে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরী বিষয়ে সহযোগিতা সম্পর্কিত চুক্তি হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের উদ্যোগে ভারতের সাথে মোট ৭৭ টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তিগুলোর প্রায় সবগুলোই বাংলাদেশের স্বার্থে করা হয়েছিল। জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সরকার সর্বমোট দীর্ঘ ৩১ বছর ক্ষমতায় থাকলেও বাংলাদেশের স্বার্থে মৌলিক কোন বিষয়ে ভারতের সাথে কোন চুক্তি করতে পারেনি। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সম্পাদিত পঁচিশ বছরের ফ্রেন্ডশিপ চুক্তিকে গোলামী চুক্তি বলে অপপ্রচার করেছিল পচাত্তুর পরবর্তী অবৈধ সরকারগুলো ও তাদের উচ্ছিষ্টভোগী কিছু নীতিভ্রষ্ট বুদ্ধিজীবী। অথচ জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষন ও মর্যাদার সুরক্ষা বিবেচনায় জাতির পিতার সরকারের সাথে ভারত সরকারের এই চুক্তি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম চুক্তি। এই চুক্তির মাধ্যমেই মাত্র তিন মাসের মাথায় ভারত বাংলাদেশ থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছিলো। পৃথিবীর প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কোন অঞ্চলে যুদ্ধপরবর্তী সময়ে এভাবে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘটনা ঘটেনি। প্রকৃত অর্থে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে টেকসই করার ক্ষেত্রে এই চুক্তির বিশেষ ভূমিকা ছিল। মহলবিশেষ এতো বছর এটিকে একটি গোলামী চুক্তি হিসেবে অপপ্রচার করলেও এই চুক্তির বারোটি (১২) অনুচ্ছেদের প্রতিটি অনুচ্ছেদই ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পরিচায়ক ও বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূলে। ভৌগলিক সীমারেখা বিবেচনায় প্রতিবেশী কোন ছোট রাষ্ট্রের সাথে বৃহৎ কোন রাষ্ট্রের এই ধরণের আন্তরিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ চুক্তি পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়গুলোর বহুমাত্রিক দিক রয়েছে। দুই দেশের সম্পর্ককে একটি দীর্ঘ পথ পরিক্রমা বলা যেতে পারে। একটি বা দুইটি চুক্তির মাধ্যমেই এই সম্পর্কের পূর্ণতা বা সার্বিকতা মূল্যায়ন করা যায় না। দুই একটি ছাড়া দ্বিপাক্ষিক প্রায় সকল চুক্তিতেই বাংলাদেশের স্বার্থ বেশী প্রাধান্য পেয়েছে। ইতোপূর্বে ভারতের সাথে তাঁর প্রতিবেশী রাষ্ট্র সমুহের মধ্যে নদী সংক্রান্ত মোট পাঁচটি চুক্তি হয়েছিল। এর মধ্যে নদীর পানি বণ্টনের চুক্তি হয়েছিল মাত্র দুটি, যার একটি বাংলাদেশের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে করা হয়েছিল ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর। দেশের সম্পদ ও সমুদ্র রক্ষায় আওয়ামী লীগের ভূমিকা
দেশের সর্বোচ্চ স্বার্থ সমূন্নত রাখার লক্ষ্যে স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু উপনিবেশিক শাসনের প্রভাব ও ‘লিগেসি’(legacy) অবসানের জন্য কিছু সাংবিধানিক, আইনী ও প্রশাসনিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এর অন্যতম একটি উদ্যোগ ছিল সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪৩। এই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সকল খনিজ সম্পদের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা (Permanent Sovereignty Over Natural Resources) প্রতিষ্ঠা করেন। এই আইনি অধিকারের ধারণাটি তৎকালীন সময়ে আন্তর্জাতিক আইন অঙ্গনে খুবই নতুন ছিল। ঔপনিবেশিক শক্তি ও বহুজাতিক কোম্পানী সমূহের অনুকূলে খনিজ ও জ্বালানী সম্পদের উপর আরোপিত ইজারা ভিত্তিক মালিকানা জাতীয় স্বার্থে বাতিল করে জারি করা বঙ্গবন্ধুর এই বিধান সমকালীন সময়ে পৃথিবীর খুব কম দেশই তাদের সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করতে পেরেছিল। বঙ্গবন্ধুর এই পদক্ষেপ ছিল তাঁরই নেতৃত্বে বাঙ্গালীর মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী মাইলফলক অর্জন। এই নীতির আলোকেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের মধ্যেই দেশের সকল গ্যাস সম্পদ বহুজাতিক কোম্পানী শেল ইন্টারন্যাশনাল এবং তেল সেক্টরের সকল স্থাপনা ঊঝঝঙ ঊধংঃবৎহ ওহপ এর কাছ থেকে অধিগ্রহণ করেছিলেন। জাতির পিতা ১৯৭২ সালে সংবিধানের ১৪৩ (১) (খ) অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জলসীমার অন্তর্বর্তী মহাসাগর ও বাংলাদেশের মহিসোপানে অবস্থিত সকল খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের সমুদ্র ও সমুদ্রসীমা রক্ষার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে ‘The Territorial Waters and Maritime Zones Act’ প্রণয়ন করেন। পরবর্তীকালের সরকারগুলো এই বিষয়ে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। সমুদ্র ও সমুদ্রসীমা রক্ষায় শেখ হাসিনা ২০০১ সালে জাতিসংঘের ১৯৮২ সালের সমুদ্র আইন (UNCLOS) অনুসমর্থন (Ratification) করেন। এই সমুদ্র আইন অনুসমর্থনের ফলেই বঙ্গোপসাগরে আমাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ ও সাহসী নেতৃৃত্ব এবং সফল এনার্জি ডিপ্লোমেসির কারণে আমরা মিয়ানমার ও ভারতের দাবীর বিরুদ্ধে বিশাল সমুদ্রসীমা অর্জন করেছি। আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে পৃথিবীর খুব কম দেশই এত সফলভাবে সমুদ্রের উপর তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। শেখ হাসিনার এই সমুদ্র জয়ের ফলে ‘দক্ষিণ এশিয়ার নর্থ সী’ (North Sea of South Asia) খ্যাত বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস সম্পদ আহরণের মাধ্যমে দেশের জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সরকার ইতোমধ্যে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কার্যক্রম কার্যকরী ও সুদক্ষভাবে পরিচালনা করছে। বর্তমানে ৭টি সমুদ্র ব্লকে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানীসমূহ একক ও যৌথভাবে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। স্থল সীমানা নির্ধারণ চুক্তি প্রসঙ্গে
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অখন্ডতা নিষ্কন্টক ও টেকসই করার লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ভারতের সাথে স্থল সীমানা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী এই চুক্তি সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সরকারের সময় অনুসমর্থনকৃত (ratification) হয়। ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৬৮ অনুযায়ী এধরনের চুক্তি সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে অনুসমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। পঁচাত্তুর পরবর্তী বাংলাদেশের সরকার গুলোর আন্তারিকতার অভাব ও জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে তাদের উদাসীনতার কারণে পরবর্তীতে এই চুক্তির বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। শেখ হাসিনার সরকার ২৯ জুন ২০০১ তারিখে বহু বছরের অনিষ্পন্ন বাংলাদেশ-ভারত স্থল সীমানা নির্ধারন সমস্যার সমাধানের লক্ষে বাংলাদেশ-ভারত জয়েন্ট বর্ডার ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করেন। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের অসহযোগিতার কারনে জয়েন্ট বর্ডার ওয়ার্কিং গ্রুপ এর কর্মকান্ড এগোয়নি। ১৯৭৪ সালের Land Boundary Agrement (LAB) এর বিধান মোতাবেক ছিটমহলগুলোতে দুই দেশের সরকার কর্তৃক আদমশুমারী (Census) করার বাধ্যবাদকতা রয়েছে। কিন্তু বিএনপি-জামাত সরকার এ কাজটি সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ করতে দেয়নি। শেখ হাসিনার সরকারের সময় ২০১০ সালের নভেম্বরে ওয়ার্কিং গ্রুপ Census করার সিদ্ধান্ত নেয় যা ২০১১ সালের জুলাইতে সম্পন্ন হয়। এ চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম (যেমন : Signing of the strip maps and exchange of the strips map ) ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারীর মধ্যে শেষ হয় । কংগ্রেস সরকার স্থল সীমানা চুক্তি পার্লমেন্টে রেটিফাই করতে পারেনি মূলত: আসামের আঞ্চলিক রাজনীতির কারণে। জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে এই ইস্যুতে বিজেপি কংগ্রেস সরকারকে সমর্থন করতে চাইলেও বিজেপি’র আসাম ইউনিট ও অসম গণসংগ্রাম পরিষদ এই বিলের তীব্র বিরোধীতা করেছিল। বিজেপি তার আঞ্চলিক রাজনৈতিক কারণে তখনকার সময়ে এই চুক্তি অনুসমর্থনের পক্ষে ছিল না। এই অবস্থা অনেকটা তিস্তা চুক্তির মতোই ছিল। তাই তিস্তা নিয়ে আমাদের আশার আলো রয়েছে। ভারতের পার্লামেন্ট ২০১৫ সালের ৭ মে এই সীমান্ত চুক্তি অনুসমর্থনের জন্য সংবিধানের ১০০তম সংশোধনী আনে। ১৯৭৪ সালে সীমান্ত চুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল ছিটমহল বিনিময় এবং আন্তর্জাতিক সীমানার সহজীকরণ করা। ভারত কর্তৃক ৬ জুন ২০১৫ তারিখে অনুসমর্থনকৃত চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের ৫১টি ছিট মহল ভারত গ্রহণ করেছে যার মোট আয়তন ৭১১০ একর ভূমি । অন্যদিকে, ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশ পেয়েছে যার মোট আয়তন ১৭,১৬০ একর ভূমি। এর ফলে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে ১০,০৫০ একর বা ৪০.৬৭ স্কোয়ার কি:মি: ভূমি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক চুক্তি সম্পাদন ও শেখ হাসিনা কর্তৃক চুক্তি বাস্তবায়নের কারণে আজ বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে এই উল্লেখযোগ্য পরিমান ভূমি লাভ করল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে যেভাবে ৪০.৬৭বর্গ কিমি: ভুমি আদায় করে নিল, এটি বাংলাদেশ তথা দক্ষিন এশিয়ায় একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এই ৪০.৬৭ বর্গ কি:মি: এরিয়া পৃথিবীর ৪টি দেশের চেয়ে বড়। দেশগুলো হচ্ছে: ভ্যাটিক্যান সিটি (.৪৪ বর্গ কি:মি:), ফ্রান্সের পাশে অবস্থিত মোনাকো (২ বর্গ কি:মি:), অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব দিকে অবস্থিত দ্বীপ রাষ্ট্র নাগুরু (২১ বর্গ কি:মি:), অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত দ্বীপ রাষ্ট্র টুভালু (২৬ বর্গ কি:মি:)। পৃথিবীর পঞ্চম ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্রও মাত্র ৬১ বর্গ কি:মি: যার নাম স্যান ম্যারিনো (ইটালীর পাশে অবস্থিত)। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন পাকিস্তান সরকার ২৪ বছরে, জিয়া এরশাদ ও খালেদা জিয়ার মোট ৩১ বছর শাসনামলে এই স্থল সীমান্ত সমস্যার সমাধান করতে পারেনি; ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খানের সাথে ভারত সরকার এই বিষয়ে একটি চুক্তি করেছিল। সেই চুক্তি কোনদিন বাস্তবায়ন হয়নি। বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার
ভারতের উত্তর -পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো কর্তৃক বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের বিষয়ে মহল বিশেষ যে বক্তব্য দিচ্ছে, জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এ বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ই লাভবান হবে। এর ফলে বাংলাদেশ পাবে পরিবহন থেকে আয়, মাশুল ও বীমা থেকে আয় এবং বাড়বে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান। অন্যদিকে, আমাদের উপর ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নির্ভরশীলতা তৈরী হবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ভূ-রাজনীতির নিয়ম অনুযায়ী এর ফলে দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কে আমাদের barganing power (দর কষাকষি) বৃদ্ধি পাবে। কারণ এই ধরনের ট্রেড রিলেশনস্ এর ফলশ্রুতিতে যে নির্ভরশীলতা তৈরী হয়, তা ভূ-রাজনীতিকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এই রাজ্যগুলোর সাথে বাংলাদেশের কানেকটিভিটি তৈরী হলে সেখানে অনেক বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরী হবে। সেখানে বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ত্রিপুরার মূখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ত্রিপুরায় বাংলাদেশী বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করার জন্য অনুরোধ জানান। বিদেশী কোন রাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের ফলে বিনিয়োগ ও ব্যবসা বানিজ্যের সমৃদ্ধি এবং অর্থনীতির অগ্রগতির সূচকে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গণে এগিয়ে যাবে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট রেটিং সূচকেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ভারত কর্তৃক আমাদের বন্দর ব্যবহারের বিষয়টি একদিকে যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রমানপত্র হিসেবে কাজ করছে, অন্যদিকে এই স্থিতিশীলতার সংরক্ষণসহ এটিকে টেকসই করার ক্ষেত্রে বন্দর ব্যবহারের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। বর্তমানে ভারতের সাথে বাংলাদেশের বানিজ্য ঘাটতি প্রায় ৭.৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সরকার এই বানিজ্য ঘাটতি কমানোর জন্য নানাভাবে চেষ্টা করছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো কর্তৃক বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করা হলে এই বানিজ্য ঘাটতি কিছুটা কমবে। ভারত ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে তাদের দুটি ইস্ট কোস্ট পোর্ট (কলকাতা ও হালদিয়া পোর্ট) ব্যবহার করার প্রস্তাব দিয়েছে। সাম্প্রতিক কালে ভারত ইরানের শাবাহার (Chabahar) পোর্ট ব্যবহার করে আফগানিস্থান ও সেন্ট্রাল এশিয়াতে তার বিনিয়োগ ও বানিজ্য সম্প্রসারনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এই পোর্ট ব্যবহারের ফলে Multi Mode North South Transport Corridor রয়েছে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশী বানিজ্যের সুযোগ তৈরী হবে। ভারত কর্তৃক আমাদের বন্দর দুটি ব্যবহার প্রসঙ্গে মহল বিশেষ নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে। এই পোর্ট ব্যবহারের চুক্তির ফলে এই পোর্ট দুটি ‘treaty ports’ এ রূপান্তরিত হচ্ছে না। উনিশ শতকে চীনের বেশ কয়েকটি পোর্ট কিছু পশ্চিমা দেশ (রাশিয়া, বৃটেন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জাপান, বেলজিয়াম, জার্মানী, ইটালী, পর্তুগাল ইত্যাদি) ‘treaty ports’ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। মূলত: যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র চীনের ঐ সকল পোর্টগুলোতে concession right Ges extra territorial jurisdiction প্রয়োগ করতো। চুক্তিতে উল্লিখিত concession period অনেকটা তাদের মালিকানার মতো ছিল। বন্দর ব্যবহার সম্পর্কিত ভারতের সাথে আমাদের চুক্তির মাধ্যমে ভারতকে কোন ধরনের concession right দেয়া হয়নি। এই চুক্তি বাতিল করারও বিধান রয়েছে। চুক্তির মাধ্যমে ভারতকে শুধু পোর্ট ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হয়েছে; কোন extra territorial jurisdiction দেয়া হয়নি। বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে নর্থ ইস্টে মালামাল ও পণ্য পরিবহনে ব্যাপকভাবে খরচ কমে আসবে। বাংলাদেশ সীমানার বাইরে ভারতের ‘চিকেন নেক’ (Chicken Neck) এর মধ্যে দিয়ে আগরতলা থেকে কলকাতার দূরত্ব প্রায় ১৭০০ কি:মি:। আগরতলা থেকে সাব্রুম হয়ে চট্টগ্রাম পোর্ট এর দূরত্ব মাত্র ২০৭ কি:মি:। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের কারণে ভারতীয় পণ্য পরিবহনে বিপুল খরচ কমে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত বন্দর ও কাস্টমস্ কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন ফি ও চার্জ এবং পণ্য পরিবহনের মূল্য যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা বাঞ্চণীয়। এই ফি, চার্জ ও পরিবহন মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘cost based pricing’ এর পরিবর্তে ‘opportunity cost pricing’ পদ্ধতি গ্রহণ করা সঠিক হবে। বর্তমান অবস্থায় এই পদ্ধতি গ্রহণ করলে প্রকৃত অর্থে ‘win win principle’ বাস্তবায়িত হবে। পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশ তাদের বন্দরগুলো আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এর ফলে ঐসকল দেশ বিনিয়োগ ও বানিজ্যিক hub-এ পরিনত হয়েছে। এশিয়ার মধ্যে সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান ও হংকং তাদের পোর্টসমূহ ব্যাপকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক সমৃদ্ধি লাভ করেছে। জার্মানীর বৃহৎ ও মাঝারী ১১টি পোর্ট থাকা সত্ত্বেও দেশটি নেদারল্যান্ডের রটারডাম (Rotterdam) পোর্ট ব্যবহার করছে। ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ বর্তমানে এই পোর্ট ব্যবহার করে। যৌথভাবে ডেনমার্ক ও সুইডেনে অবস্থিত কোপেনহেগেন মালমো পোর্ট (CMP)। ডেনমার্ক, সুইডেনসহ বাল্টিক ও উত্তর সাগর তীরবর্তী বেশ কিছু দেশ এই বন্দর ব্যাপকভাবে ব্যবহারের কারণে এটি একটি বানিজ্যিক hub-এ পরিনত হয়েছে। অন্যদিকে, ডেনমার্কের কোপেনহেগেন এয়ারপোর্ট সুইডেনের স্ক্যানিয়া প্রভিন্সের মালমো সিটিসহ অধিকাংশ সিটির জনগণ ব্যবহার করে। সুইডেন কর্তৃক ডেনমার্কের এয়ারপোর্ট ব্যবহারের ফলে ডেনমার্কের অতিরিক্ত রাজস্ব আয় হচ্ছে। অন্যদিকে দূরত্ব কম হওয়ার কারণে সুইডেনের নাগরিকগণের জন্যও এই এয়ারপোর্ট ব্যবহার অনেক সাশ্রয়ী। বর্তমানে বাংলাদেশের কুমিল্লা ও ব্রাহ্মনবাড়িয়া অঞ্চলের বেশ কিছু মানুষ আগরতলা এয়ারপোর্ট ব্যবহার করে ভারতের বিভিন্ন নগরে যাতায়াত করছে। এ অঞ্চলের মানুষের জন্য ঢাকা বা বাংলাদেশের অন্যান্য এয়ারপোর্টের তুলনায় ভারতের যে কোন সিটিতে যাতায়াতের জন্য সময় ও খরচ বিবেচনায় আগরতলা বিমান বন্দর অনেক বেশী সাশ্রয়ী। ২০১০ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর যৌথ ঘোষনায় নেপাল ও ভুটানকে বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করার বিষয়ে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। বিবিআইএন অঞ্চলে বিনিয়োগ ও বানিজ্য অধিকতর সম্প্রসারনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বন্দর দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমানে নেপাল ও ভুটান ভারতের পোর্ট ব্যবহার করছে। ১৯৬০ সালে সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে নেপাল ভারতের কলকাতা ও হালদিয়া পোর্ট ব্যবহার করছে। ভুটান বর্তমানে ভারতের কলকাতা পোর্ট ব্যবহার করছে। সাম্প্রতিককালে ভুটান থেকে সড়ক পথে প্রেরিত পণ্য আসামের ধুবরী থেকে কার্গো জাহাজের মাধ্যমে অভ্যন্তরীন নৌপথে (ব্রহ্মপুত্র নদী পথের মাধ্যমে) বাংলাদেশের নারায়নগঞ্জ পৌছে। ২০১৮ সাল থেকে ধুবরী কে ‘পোর্ট অফ কল’ ঘোষনা করা হয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে অধিকতর বেগবান করতে হলে আমাদের বন্দরগুলো শুধুমাত্র অভ্যন্তরীন ব্যবহারের জন্য সীমাবদ্ধ না রেখে আঞ্চলিক কিংবা উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে এর ব্যবহার সুনিশ্চিত করার প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের বন্দর দুটি নেপাল, ভুটান ও ভারত কর্তৃক ব্যবহৃত হলে এই উপ-অঞ্চলে বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বানিজ্যের ব্যাপক প্রসার হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিনিয়োগ ও বানিজ্য hub-এ পরিনত হবে। বর্তমানে ভারতের সাথে আমাদের বানিজ্য ঘাটতি রয়েছে। আমাদের সাথে নেপালের গত তিন বছর ধরে বানিজ্য ঘাটতি রয়েছে। আবার, ভুটানের সাথে আমাদের বানিজ্য ঘাটতি রয়েছে। এটি উল্লেখ্য যে, বর্তমানে বাংলাদেশের ৯০% রপ্তানী ও আমদানী চট্টগ্রাম পোর্টের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। এই পোর্টের ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ পোর্টটি-কে আধুনিকীকরনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অন্যদিকে, মংলা পোর্টের ধারণ ক্ষমতার প্রায় ৫০% বর্তমানে ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকার ইতোমধ্যে এই পোর্টের ধারন ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। উপকূলে সার্ভিলেন্স সিস্টেম স্থাপন সংক্রান্ত চুক্তি প্রসঙ্গে
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ভারত সফরে ভারতের সাথে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয় যার শিরোনাম ‘MOU on Eastablishment of Coastal Surveillance Radder System in Bangladesh’। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের সার্বিক নিরাপত্তা সংরক্ষণের লক্ষ্যে এই সার্ভিলেন্স সিস্টেম স্থাপন করা হবে। কেউ কেউ এই চুক্তিটির ভুল ব্যাখ্যা এবং অপব্যাখ্যা করছেন। সার্ভিলেন্স সিস্টেমটি যেহেতু বাংলাদেশের সমুদ্রসীমানায় স্থাপন করা হবে, তাই এর নিয়ন্ত্রন অবশ্যই বাংলাদেশের হাতে থাকবে। এর নিয়ন্ত্রন ভারত কিংবা তৃতীয় কোন রাষ্ট্রের কাছ থাকছেনা। কেউ কেউ আবার এই প্রশ্ন তুলেছেন যে, এই সিস্টেমটির মালিকানা বাংলাদেশে থাকলেও সিস্টেমটির ব্যবহৃত সফটওয়্যার ও তথ্যের উপর ভারতের নিয়ন্ত্রন থাকবেনা, তার নিশ্চয়তা কী। তাঁরা আরও বলছেন, এই সিস্টেম স্থাপনের ফলে ভারত বঙ্গোপসাগরে চীনের উপর নজরদারী করতে পারবে এবং এ বিষয়টি আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারত-চীন ভারসাম্য রক্ষার যে বিষয়টি রয়েছে, তার লংঘন হবে। দুটি বন্ধুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থে নিরাপত্তা সংক্রান্ত সহযোগিতা বর্তমান বিশ্বে বহুল প্রচলিত একটি প্রথা (custom)। আর ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে সামরিক ও নিরাপত্তা বিষয়ে কারিগরী সহযোগিতা ও তথ্য আদান-প্রদান একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এ ক্ষেত্রে মূল বিষয়ই হচ্ছে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সহযোগিতা প্রদান। দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ ঘোষনায় প্রতিরক্ষা খাতে অধিকতর সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয়। এছাড়া, এই ঘোষনায় দুই দেশের মেরিটাইম সিকিউরিটি পার্টনারশীপকে স্বাগত জানানো হয়। বাংলাদেশ যখন চীনের কাছ থেকে সাবমেরিন ক্রয় করেছিল, তখন এই ব্যক্তিবর্গই বলে আসছিল যে, ভারত এই বিষয়ে অসন্তুষ্ট হবে। এখন তাঁরাই আবার বলছে, ভারতের সহযোগিতায় উপকূলে সার্ভিলেন্স সিস্টেম স্থাপন করা হলে ভারত-চীন বিষয়ে ভারসাম্য বজায় রাখার বাংলাদেশের বর্তমান নীতির লংঘন হবে। একটি বিষয় লক্ষনীয়, তাদের পূর্বের বক্তব্যটি অর্থাৎ চীনের কাছ থেকে সাবমেরিন কেনার কারনে ভারত সংক্ষুব্ধ হয়েছে-এটি সত্য হলে তাদের পরের বক্তব্যটির অসারতা প্রমানিত হয়। চীনের কাছ থেকে সাবমেরিন ক্রয় এবং পরবর্তীতে ভারতের কারিগরি সহযোগিতায় বাংলাদেশের উপকূলে সার্ভিলেন্স সিস্টেম স্থাপন করার বিষয়টি বরং এই অঞ্চলের বিশেষ ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা ও বাংলাদেশের সার্বিক স্বার্থে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এতে পররাষ্ট্র নীতিতে সার্বিক ভারসাম্য রক্ষার কৌশলের কোন ব্যতয় ঘটেনি। এই সকল সমালোচক একবার ভারতের সংক্ষুব্ধ হওয়ার বিষয়টি সামনে আনছেন, আবার বঙ্গোপসাগরে চীনের ‘স্বার্থহানী’র বিষয়টি আনছেন। এই সকল ব্যক্তি মূলতঃ বিদেশী স্বার্থ সুরক্ষার জন্যই ব্যস্ত। বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বিক উন্নয়নে তাদের কোন ইতিবাচক ভূমিকা নেই; এতদসংক্রান্ত বিষয়ে তাদের প্রণীত কোন কৌশলপত্র নেই। যারা আজ বঙ্গোপসাগর নিয়ে মায়া কান্না করছেন, তাদের একথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার উদ্যোগেই আমরা আমাদের সমুদ্র রক্ষা করতে পেরেছি। শেখ হাসিনাই তাঁর সুদক্ষ কৌশল, কুটনীতি ও অসীম সাহসিকতাপূর্ণ উদ্যোগের মাধ্যমে ভারত ও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিশাল সমুদ্র অর্জন করেছেন। আমাদের সমুদ্র সম্পদ ও সমুদ্র এলাকা সুরক্ষার জন্য তিনি আমাদের নৌবাহিনীতে সাবমেরিন যুক্ত করেছেন। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব (sovereignty) ও সার্বভৌম অধিকার (sovereign rights) অধিকতর নিরাপদ করার লক্ষ্যে শেখ হাসিনার সরকার উপকূলে সার্ভিলেন্স সিস্টেম স্থাপন করতে যাচ্ছে। শেখ হাসিনার সরকার “Friendship to all and malice to none” বঙ্গবন্ধুর এই পররাষ্ট্রনীতিকে ধারণ করেই ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা ও আমাদের জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখতে যে সকল উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন তার প্রত্যেকটা উদ্যোগই গ্রহণ করছে। ফেনী নদীর পানি ব্যাবহার সম্পর্কিত চুক্তি প্রসঙ্গে
এই সফরে পানি বণ্টনের যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেটি কনভেনশনাল পানি বণ্টন চুক্তি নয়। ত্রিপুরার সাব্রুম শহরের জন্য খাবার পানি হিসেবে ফেনী নদীর মোট পানি প্রবাহের মাত্র ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করা হবে যা ফেনী নদীর শুষ্ক মৌসুমের পানি প্রবাহের মাত্র শুন্য দশমিক ২২ শতাংশ। আমি মনে করি, এই সমঝোতা স্মারক ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে যে সকল চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে, তার উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। একটি কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এখন আর 'zero sum game principle' কার্যকরী নয়। এর পরিবর্তে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এখন পৃথিবীব্যাপী 'win-win principle' কার্যকরী হচ্ছে। 'zero sum game principle' এর অর্থ হচ্ছে একজনের কিছু সুবিধা পাওয়া-কে অন্য পক্ষের স্বার্থ বিরোধী মনে করা হয়। অন্যদিকে, 'win-win principle' এর অর্থ হচ্ছে, এক পক্ষ কিছু সুবিধা পেলে অন্য পক্ষ তাতে মন খারাপ না করে তার তার নিজের সার্বিক স্বার্থটাই দেখা উচিত। এলপিজি রপ্তানি প্রসঙ্গে
ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় এলপিজি রপ্তানি নিয়ে যে অপপ্রচার হচ্ছে সেটা নিয়ে কথা বলা দরকার। বাংলাদেশ থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানী করা হচ্ছে না। বাংলাদেশের দুটি বেসরকারি কোম্পানি বিদেশ থেকে এলপিজি (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস) আমদানি করে তার অংশ বিশেষ সেখানে রপ্তানি করবে। আর সেটিও বাংলাদেশের এলপিজি'র চাহিদা মেটানোর পরই তারা রপ্তানি করবে। এই এলপিজি আমাদরে দশেীয় প্রাকৃতকি গ্যাস কিংবা আমদানিকৃত এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) থকেে উৎপাদতি হচ্ছে না। এটি crude oil থেকে উৎপাদিত আমদানিকৃত এলপিজি। আমাদের দেশে সিলিন্ডার গ্যাস বা রান্নার গ্যাস হিসেবে পরিচিত। বাংলাদশেরে দুটি কোম্পানরি পক্ষ থকেে ভারতে এলপজিি রপ্তানরি বষিয়টি বিষয়টি নিঃসন্দেহে অর্থনীতির অগ্রগতির সুচকে বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হবে। এছাড়া, এলপিজি'র এই বাণিজ্য বাংলাদেশ-ভারত সম্পকে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এই জন্য যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীতি অনুযায়ী আন্তঃরাষ্ট্রীয় জ্বালানী বানিজ্য ভূ-রাজনীতিকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। এটি উল্লেখ্য যে, আন্তরাষ্ট্রীয় জ্বালানী সহযোগিতার (cross border energy cooperation) এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশের দুটি বেসরকারী কোম্পানী ভারতে এই এলপিজি রপ্তানি করবে। এটি স্মরণ করা প্রয়োজন যে, আমাদেরও জ্বালানীর জন্য ভারতের উপর নির্ভরশীলতা রয়েছে। আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রয়োজনীয় জ্বালানী সরবরাহ নির্বিঘ্ন করতে ভারতের নুমালীগড় রিফাইনারীর শিলিগুড়ি টার্মিনাল থেকে বাংলাদেশের পার্বতীপুর পর্যন্ত ১৩০ কিঃমিঃ দীর্ঘ ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ পাইপলাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। আমাদেরকেও ভারতের কাছ থেকে জ্বালানী তেল আমদানি করতে হচ্ছে। তাছাড়া, যেই ত্রিপুরা'র একটি শহরকে ফেনী নদী থেকে আমরা সামান্য খাবার পানি দিচ্ছি, তারা তাদের নিজস্ব গ্যাস পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সেই বিদ্যুৎ আমাদেরকে দিচ্ছে। আর গ্যাস রপ্তানির যে কথা বলা হচ্ছে, সে প্রসঙ্গে কিছু বলা উচিত। গ্যাস রপ্তানি শেখ হাসিনার সরকার করতে দেয়নি, তাই আওয়ামী লীগকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে নির্বাচনে হারানো হয়েছিল। এই বষিয়ে পরর্বতী অংশে বস্তিারতি আলোচনা করা হয়ছে। ঐতিহাসিকভাবে জাতীয় ও আঞ্চলিক জ্বালানী নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় ক্রসবর্ডার বা আন্ত:রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানী বানিজ্য একটি গুরুত্বপূর্ন পদ্ধতি হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম রাষ্ট্রনায়ক যিনি ‘এনার্জি ডিপ্লোমেসি’-কে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক ও দ্বি-পাক্ষিক পর্যায়ে প্রধান্য দিয়ে আসছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ভারত থেকে নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ আনার জন্যে ভেড়ামারায় যে ক্রসবর্ডার ইন্টারকানেকশন স্থাপিত হয়েছে, সেটি বাংলাদেশের জন্য একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এছাড়া ভারতের ত্রিপুরার সাথে ক্রসবর্ডার ইন্টারকানেকশন স্থাপিত হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের মোট সরবরাহকৃত বিদ্যুতের ৭% (১১৬০ মে:ও:) ভারত থেকে আসছে যা দেশের উৎপাদিত বিদ্যুতের গড় মূল্যের তুলনায় অনেক সাশ্রয়ী। এছাড়া ভারতের ঝাড়খন্ড ও ত্রিপুরা থেকে যথাক্রমে ১৪৯৬ ও ৩৪০ মে:ও: বিদ্যুৎসহ মোট ১৮৩৬ মে:ও: বিদ্যুৎ আমদানীর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা যাবে না। এতে অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে পড়বে। সরকার আশা করছে, ২০৪১ সাল নাগাদ আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ বানিজ্য ও রিজিওনাল গ্রীড থেকে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য পরিমান বিদ্যুৎ পাবে। বাংলাদেশের জ্বালানী নিরাপত্তার স্বার্থে শেখ হাসিনার সরকার জলবিদ্যুৎ সক্ষমতা সমৃদ্ধ ভুটান ও নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানীর কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করছে। নেপালের সাথে ইতোমধ্যে সমঝোতা স্মারক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ভুটানের সাথে চুক্তির খসড়া চুড়ান্ত করা হয়েছে। ভুটান ও নেপালের সাথে বাংলাদেশের পৃথক পৃথক বিদ্যুৎ বানিজ্যে ভারত অংশীদার হিসেবে থাকছে। এই বিদ্যুৎ আমদানিতে ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন। আমাদরে ভবষ্যিৎ জ্বালানী নরিাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষত্রেে ক্রসবর্ডার বদ্যিুৎ ও জ্বালানী বাণজ্যিরে গুরুত্বর্পূণ ভুমকিা রয়ছে। তাই আমাদের ভবিষ্যৎ জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে ভারতের সার্বিক সহযোগিতা দরকার। গ্যাস নিয়ে বিএনপি-জামাত জোট সরকারের দেশ বিরোধী নীতি
আজকে বাংলাদেশকে কেন LNG আমদানী করতে হচ্ছে ? বিএনপি-জামাত জোট সরকারের ভ্রান্ত নীতি ও দেশ বিরোধী সিদ্ধান্তের কারণেই আজ আন্তর্জাতিক বাজার থেকে LNG আমদানী করা হচ্ছে। আপনাদের মনে আছে, ২০০৪/২০০৫ সালে মিয়ানমার থেকে স্বল্প মূল্যে পাইপ লাইন গ্যাস আমদানীর প্রস্তাব ছিল। বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারতের মধ্যে এ বিষয়ে MOU স্বাক্ষরও হয়েছিল। ঐ সময়ে দীর্ঘ মেয়াদী পাইপ লাইন প্রকল্প থেকে যে পরিমান গ্যাস পাওয়ার কথা ছিল, সেটি পাওয়া গেলে আজ আমাদেরকে এভাবে খঘএ আমদানী করতে হতো না। আমাদের প্রাথমিক জ্বালানীর এরকম সংকট তৈরী হতো না। আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, ঐ সময়ে বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের সাথে দীর্ঘমেয়াদী গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পে অংশগ্রহন করলে মিয়ানমার পরবর্তীতে রোহিঙ্গা ইস্যুর মতো একটি প্রকট মানবিক সংকট চাপিয়ে দেয়ার মতো আচরণ আমাদের সাথে করতে পারতো না। কারণ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীতি অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদী আন্তঃরাষ্ট্রীয় জ্বালানী বানিজ্য ভূ-রাজনীতিকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। খালেদা জিয়ার সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে মিয়ানমার থেকে গ্যাস পাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করলেও ২০০১ সালে নির্বাচনের পর দেশের সীমিত গ্যাস সম্পদ বিদেশে রপ্তানীর উদ্যোগ গ্রহন করেছিল। কারণ নির্বাচনের পূর্বে গ্যাস রপ্তানির মুচলেকা দিয়ে বিএনপি-জামাত ষড়যন্ত্রমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল। অথচ প্রধানমন্ত্রী শখে হাসনিা ২০০০ সালে জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে সীমিত জাতীয় সম্পদ গ্যাস রপ্তানীর সিদ্ধান্তের পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদে নিজস্ব ব্যবহারের জন্য গ্যাস মজুদের সিদ্ধান্ত দয়িছেলিনে। দেশের স্বার্থে গৃহীত এই সিদ্ধান্তের কারনেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে দেয়া হয়নি। পরবর্তীতে ২০০৩ সালের অক্টোবরে আওয়ামী লীগের প্রতিরোধের মুখে খালেদা জিয়ার সরকার ইতোপূর্বে তাঁরই গৃহীত গ্যাস রপ্তানীর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। অর্থাৎ জাতির পিতা যে গ্যাস সম্পদ আমাদেরকে দিয়ে গিয়েছিলেন, দেশের জ্বালানী নিরাপত্তা তথা সার্বিক উন্নয়নের জন্য সেই সম্পদ রক্ষা করেছিলেন তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা। লেখক পরিচিতি: ড.সেলিম মাহমুদ বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএল.বি সম্মান (প্রথম শ্রেনীতে প্রথম), এলএল.এম এবং যুক্তরাজ্যের ডান্ডি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জ্বালানী আইন ও পলিসি বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন (২০০৮)। ড. মাহমুদ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরী কমিশন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান (২০১৬-২০১৯) এবং বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরী কমিশনের সদস্য (২০০৯-২০১৬) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে দক্ষিন এশীয় আন্তঃরাষ্ট্রীয় টাস্ক ফোর্স- সাউথ এশিয়ান রিজিওনাল ইনিশিয়েটিভ/এনার্জি ইন্টিগ্রেশন এর টাস্কফোর্স সদস্য (২০১৩-২০১৭) হিসেবে দক্ষিন এশিয়ায় জ্বালানী ভিত্তিক আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় জ্বালানী বানিজ্য উন্নয়নে ‘এডভোকেসী’ কার্যক্রমে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরী কমিশনের সদস্য হিসেবে তিনি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানীর যৌক্তিক ট্যারিফ নির্ধারনের মাধ্যমে এখাতে ভর্তুকি সংস্কারসহ ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণ এবং ইউটিলিটিগুলোর ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা ও আর্থিক শৃংখলা প্রতিষ্ঠায় সরকারী উদ্যোগে বিশেষ সহযোগিতা করেন। একজন আইনজ্ঞ হিসেবে তাঁর জ্বালানী আইন ও পলিসি, আরবিট্রেশন, সাংবিধানিক আইন, ইনভেস্টমেন্ট আইন এবং কর্পোরেট ও কমার্শিয়াল আইনে বিশেষ অভিজ্ঞতা রয়েছে। ড. মাহমুদ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন কমিটির একজন সদস্য।
এই বিভাগের আরো সংবাদ