আজকের শিরোনাম :

দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছিল কারা?

  সুভাষ সিংহ রায়

১৬ অক্টোবর ২০১৯, ১০:০৩ | অনলাইন সংস্করণ

বাংলাদেশ ভারতের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেয়। এক কোটিরও বেশি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে প্রশিক্ষণ নেন এবং শেষ দিকে বাংলাদেশ-ভারত মিত্রবাহিনী মহান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় এনে দেয়। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর সবারই প্রত্যাশা ছিল যে দুই দেশের পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে দুটি দেশই এগিয়ে যাবে—অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শান্তির পথে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাদখলকারী মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি সেই চিত্র পাল্টে দেয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধা আর আস্থার বদলে পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো হয় অবিশ্বাস আর বিশ্বাস ভঙ্গের কূটকৌশল। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতবিরোধী স্লোগানের আড়ালে রয়েছে কুৎসিত রাজনীতি। ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ভারতের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম করা হলেও বাংলাদেশের দাবিদাওয়া ভারতের কাছে উত্থাপন এবং বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে তা আদায়ের প্রশ্নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। অথচ এটিই বাংলাদেশের জন্য ছিল সবচেয়ে মঙ্গলজনক। ভারত নিয়ে এই রাজনীতির গূঢ় রহস্য বুঝতে হলে আমাদের পেছনে ফিরে দেখতে হবে। তথ্যগুলো তুলে ধরতে হবে মানুষের সামনে—

১৯৭২-৭৫ (বঙ্গবন্ধুর শাসনকাল)

১৯৭২ : ১০ জানুয়ারি, পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু দিল্লিতে সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি করেন। এখানে এক সমাবেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তারা বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিল, খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়েছিল। রণাঙ্গনে হাজার হাজার ভারতীয় প্রাণ দিয়েছে।’ তিনি ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকারও প্রশংসা করেন। তিনি ভারতকে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের বন্ধুত্ব অটুট থাকবে।’

১৯৭২ : ৬ ফেব্রুয়ারি, বঙ্গবন্ধু মাত্র এক দিনের সফরে কলকাতায় যান। ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে বঙ্গবন্ধু প্রথম সুযোগেই বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি উত্থাপন করেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার শুরু হবে।

১৯৭২ : ১৭ মার্চ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ঢাকায় আসেন। ১৯ মার্চ আনুষ্ঠানিক বৈঠকে ২৫ বছর মেয়াদি শান্তি, সহযোগিতা ও মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

১৯৭২ : জুন, যৌথ নদী কমিশন গঠিত হয়।

১৯৭৪ : ১২ মে, বঙ্গবন্ধু ভারত সফর করেন। ওই সফরে ছিটমহল সমস্যার সমাধান নিয়ে চুক্তি হয়। তিনবিঘা করিডর বাংলাদেশকে চিরস্থায়ী ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

১৯৭৫ : ১৮ এপ্রিল, ফারাক্কা চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী ৫৫ হাজার কিউসেক পানির মধ্যে ৪৪ হাজার কিউসেক পানি বাংলাদেশের জন্য সুনিশ্চিত করা হয়।

১৯৭৬-৮১ (জিয়ার শাসনামল)

১৯৭৭ : ৩০ এপ্রিল, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান বৈঠক করেন। বৈঠকে তিনি দেশ পরিচালনায় ভারতের সহযোগিতা কামনা করেন।

১৯৭৭ : যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে গঙ্গার পানির হিস্যা ৪৫ হাজার কিউসেক থেকে কমিয়ে ২০ হাজার কিউসেক করা হয়। বি এম আব্বাস এটির নেতৃত্বে বাংলাদেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।

১৯৭৮ : যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে ভারত টিপাইমুখ ব্যারাজের নকশা উপস্থাপন করলে বাংলাদেশ তাতে সম্মতি জানায়।

১৯৮০ : ২১ জানুয়ারি, জিয়াউর রহমান ইউনিডোর সম্মেলনে যোগ দিতে ভারতে যান। জনপ্রিয় দৈনিক হিন্দুর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ফারাক্কা বাঁধ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশের কিছু বলার নেই।’ বাণিজ্য ঘাটতি প্রসঙ্গে জিয়া বলেন, ‘ভারত বড় দেশ, তাই বাণিজ্য ঘাটতি স্বাভাবিক ঘটনা।’

১৯৯১-৯৬ (বেগম জিয়ার শাসনামল)

১৯৯১ : বন্যা নিয়ন্ত্রণে বিশ্বব্যাংক সমীক্ষা প্রতিবেদন  FAP-1, বাংলাদেশ সরকারের কাছে পেশ করা হয়। সমীক্ষা প্রতিবেদনে সিলেট অঞ্চলে বন্যা ঠেকাতে ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা সমর্থন করা হয়। সমীক্ষা প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদের সপ্তম বৈঠকে অনুমোদিত হয়।

১৯৯২ : ভারত সফরে যান তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী কর্নেল (অব.) অলি আহমদ। এই সফরে যৌথ ঘোষণায় ভারতের পণ্য সরবরাহ সুবিধা দিতে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে পণ্য পরিবহনের সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়।

১৯৯৩ : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তিন দিনের সফরে ভারতে যান। সেখানে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ফারাক্কা, তিস্তা এবং অমীমাংসিত সীমানা প্রশ্নে কোনো আলোচনা হয়নি। দেশে ফিরে ফারাক্কা প্রশ্নে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না—সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রসঙ্গটি আমি ভুলে গিয়েছিলাম।’

২০০১-২০০৬ (বেগম জিয়ার শাসনামল)

২০০১ : ২৬ আগস্ট, টাইমস অব ইন্ডিয়া জানায়, বিএনপি নেতা রিয়াজ রহমান জানিয়েছেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ ভারতে গ্যাস রপ্তানি করবে। বাংলাদেশে ভারতের পণ্য উন্মুক্ত করা হবে এবং সব ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া হবে।

২০০৩ : ভারত অভিযোগ করে, বাংলাদেশে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জঙ্গিদের আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ এর কোনো প্রতিবাদ করেনি।

২০০৩ : মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ভারত থেকে জঙ্গিরা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে। সেখানে তারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।’ প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ জঙ্গিদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।

২০০৪ : ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করে লস্কর-ই-তৈয়বাসহ বেশ কিছু জঙ্গি সংগঠন বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। ভারত বাংলাদেশ সরকারকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলে।

২০০৫ : ডিসেম্বর, নিরাপত্তার কারণে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় সার্ক সম্মেলন বাতিল হয়ে যায়।

২০০৬ : ২০ মার্চ, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তিন দিনের ভারত সফরে যান। এই সফরে গঙ্গার পানিচুক্তি, পার্বত্য শান্তিচুক্তি, টিপাইমুখ বাঁধ ইত্যাদি কোনো প্রসঙ্গ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উত্থাপিত হয়নি।

১৯৯৬-২০০১ (আওয়ামী লীগের শাসনামল)

১৯৯৬ : ১২ ডিসেম্বর, গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে দীর্ঘ ২২ বছর পর বাংলাদেশ পানির ন্যায্য হিস্যা পায়।

১৯৯৪ : বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যচুক্তির আওতায় আরো ১০৫টি পণ্য ভারতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পায়।

১৯৯৭ : পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ শেষে পাহাড়িরা দেশে ফেরে। শান্তির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।

১৯৯৮ : বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশ সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেওয়ার ঘোষণা দেয়।

২০০০ : অমীমাংসিত সীমানা নির্ধারণে যৌথ কমিটি আলোচনা শুরু করে।

২০০৯-২০১৪ (আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সময়)

২০০৯ : সেপ্টেম্বর, জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা জানান।

২০০৯ : ১১ জানুয়ারি, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক ভারত সফর। ৫০ দফা যৌথ ঘোষণার উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—

* বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে একে অন্যের সমুদ্র, রেল ও সড়ক পথ ব্যবহারে দুই দেশের সম্মতি। নেপাল ও ভুটানে ট্রানজিটের জন্য বাংলাদেশকে ভারতের সীমান্ত ব্যবহারের সুযোগ। * বাংলাদেশ চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ভারতকে ব্যবহার করতে দেবে। একই সঙ্গে এই দুই বন্দর নেপাল ও ভুটানকেও ব্যবহার করতে দেওয়া হবে। * বাংলাদেশের রেলব্যবস্থা সংস্কার, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ও নদী পুনঃখননের জন্য ১০০ কোটি ডলারের সহায়তা দেবে ভারত। * জাতিসংঘের সমুদ্রসীমানা আইন অনুযায়ী দুই দেশের সমুদ্রসীমা পুনর্নির্ধারণে উভয় দেশ সম্মত হয়। * ২০১১-১২ সালে নিরাপত্তা পরিষদে অস্থায়ী সদস্য পদ লাভে ভারত বাংলাদেশকে সমর্থন দেবে। * অপরাধ দমন বিষয়ে পরস্পর আইনি সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। * সাজাপ্রাপ্ত বন্দিবিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

২০১৫ : আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সময়

২০১৫ : ৭ মে, ভারতীয় সংসদ সর্বসম্মতভাবে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুমোদন করে, যা ভারতীয় সংবিধানের ১০০তম সংশোধনী। ফলে দুই দেশের সীমানা নিয়ে ৬৮ বছরের বিবাদ শেষ হয়।

২০১৫ : জুন, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফর করেন এবং দুই দেশের মধ্যে ২২টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০০ কোটি ডলারের ঋণবিষয়ক সমঝোতা হয়, ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেওয়া হয়।

২০১৫ : ৩১ জুলাই, মধ্যরাতে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে ৫০ হাজার বিচ্ছিন্ন নাগরিক, যাদের কোনো জাতীয়তার পরিচয়ই ছিল না, তারা ভারত অথবা বাংলাদেশের নাগরিক হয়।

এখন বিবেচনা করা যেতেই পারে, কোন আমলে কাদের দ্বারা বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে। আর কারা বাংলাদেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছিল।

লেখক :  রাজনৈতিক বিশ্লেষক, প্রধান সম্পাদক - এবিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম ও সাপ্তাহিক বাংলা বিচিত্রা।

এই বিভাগের আরো সংবাদ