স্মৃতিপটে শৈশবের দুর্গাপূজা
"আমার হৃদয়ভূমি-মাঝখানে
জাগিয়া রয়েছে নিতি
অচল ধবল শৈল-সমান
একটি অচল স্মৃতি।"
......রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কবির কাছে স্মৃতি অচল। শৈশবের দুরন্তপনার মত স্মৃতি ছুটতে পারেনা। শৈশবের স্মৃতি যৌবনবার্ধক্যে নিষ্প্রাণ বটে। স্মৃতি কথা বলতে পারেনা, চলতে পারেনা। তবে জীবনে স্মৃতি সত্য, সদা হাস্যজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। স্মৃতি স্বপ্ন ও অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখে। দুর্গাপূজা আসলেই স্মৃতি রোমš’নে শৈশবের দুর্গাপূজার দিনগুলি স্মরণ করে দেয়। মন্ডপে মন্ডপে দুরন্তপনার ন্যায় ছুটে চলার যে আনন্দ, যে অনুভূতি সেই দিনগুলো হৃদয়পঞ্জিকার সেরা দিন তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
শৈশবের দুর্গাপূজা মানেই নিষ্পাপ আনন্দ। শরৎকাল আসলেই পুজো পুজো গন্ধ শুরু হয়। কোন মন্ডপে আগে প্রতিমা বানানো শুরু করেছে, সে খবরের মাধ্যমেই শুরু হয় পুজোর আগমনী আমেজ। কয়েকজন মিলে হেটে কিংবা সাইকেলে করে দেখতে ছুটে যেতাম কাচা মাটির প্রতিমা। মহালয়ার দিন টেলিভিশনে অনুষ্ঠান দেখতে ঘুম না ভাঙলে মা ডেকো দিত। বাড়ির ছোটদের অনেকেই টেলিভিশনের সামনে বসে থাকতাম মহলয়ার অনুষ্ঠান দেখার জন্য। ভোরবেলায় ঘুম থেকে ওঠার জন্য গায়ে শীত শীত অনুভূতি হত। তবে এই হালকা শীতের মাঝে আনন্দের উষ্ণতাই ছিল বেশি। মহালয়া পর থেকেই শুরু হয় নতুন জামা কাপড় কেনাকাটার ধুম। শৈশবের পুজো মানেই নতুন জামা-কাপড়। আমাদের তিন ভাইয়ের জামা প্যান্ট সেলাই করত পুলেন জ্যাঠা। প্রতিদিন সকালে উঠে জ্যাঠার কাছে যেতাম কাপড় নিয়ে কিনা জানতে। না আনলে মন খারাপ হত। কোনো পুজায় ষষ্ঠী বা কোনোবার সপ্তমীর সকালে মা ডেকো দিত, যা তোর বড়বা (জ্যাঠা) কাপড় আনছে। ঘুম থেকে উঠেই দৌড়ে যেতাম কাপড় আনতে। নতুন কাপড় এনে সবাইকে দেখাতাম। এভাবে জ্যাঠাত ভাইবোনের মধ্যে কারও আগেই নতুন কাপড় আনলে সবাই দেখত। যাদের আনতে দেরি হচ্ছে তাদের একটু মন খারাপ হত। মরার উপর খাড়ার ঘা'র মত বয়োজ্যেষ্ঠরা বলত, নতুন জামাপ্যান্ট ছাড়া নাকি দেবীদুর্গা দেখা দিবেনা। এই কথা সত্যি কিনা মিথ্যা শৈশবে কখনো যাচাই করা হয়নি। কেননা, নতুন কাপড় পড়েই মন্ডপে মন্ডপে দেবীদুর্গার প্রতিমা দেখতে যেতাম। তবে সময়ের পরিক্রময়ায় এখন বুঝতে পারি, পুরাতন কাপড়েও দেবীদুর্গা দর্শন দেয়।
পুজোর দিনগুলি বিশেষ করে সপ্তমী, অষ্টমী আর নবমীর দিন ছোটরা এই মন্ডপ থেকে ছুটতাম আরেক মন্ডপে। প্রতিযোগিতামূলক কে কতটি মন্ডপ ঘুরল সেটার হিসাব কষাও হয়। মাহিগঞ্জবাজার, শিয়ালডাঙ্গা, দেবীরডাঙ্গা (হাড়িপাড়া), কালিরধাম, ডোমারের পানীয়কুন্ড, সাহাপাড়া, চাকধাপাড়া, হাইস্কুল মাঠ এভাবেই মন্ডপের হিসাব মিলাতাম। বাবা-মার সাথে পুজোর রাতে গ্রামের মন্ডপগুলোতে পালাগান কিংবা যাত্রাগান শুনতে যেতাম। বিসর্জনের পর দশমীর দিন পাশের গ্রাম দেবীরডাঙ্গায় যেতাম মেলা দেখতে। কেনা হত, খেলনা পিস্তল। বাড়ি ফিরে আসতে আসতে বারুদের কার্তুজ দিয়ে ফোটাতাম। আহা! কি অনুভূতি।ফেলে আসা দিনগুলি সত্যিই সোনায় মোড়ানো। সময়ের পরিক্রমায় বড় হতে শুরু করলাম। অনেক কিছুর পরিবর্তন আসল। দেবীদুর্গার বিসর্জনের মতো আমার মা'য়ের একদিন বিসর্জন হলো। পরবর্তীতে আমার দুই অনুজের শৈশব আমার শৈশবের মত আনান্দদায়ক ও সুখকর হয়তো হয়নি। কিন্তু পুজো আসলে গ্রামে এখনো নতুন প্রজন্মের ছোটদের দুরন্তপনায় আমার শৈশবকে দেখতে পাই। তবুও ঢের পরিবর্তন এই পাওয়া। এখন পুলেন জ্যাঠার সেলাই করা কাপড়ের গন্ধ পাইনা। আমরা নব্য সভ্য সমাজের অনেকেই এখন রেডিমেড গার্মেন্টসের কাপড়ে অভ্যস্ত। মহালয়ার ভোরে ঘুম থেকে উঠিনা। এখন মন্ডপে মন্ডপে ঘুরে মন্ডপের সংখ্যা হিসাব করিনা। কিন্তু বর্তমান সমাজ কে কত লক্ষ, কত কোটি টাকা দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক পুজোর প্রতিমা-সাজসজ্জা করলো সেই হিসাব কষে। এখন পুজোর রাতে যাত্রাগান দেখা যায়না, দেখা গেলেও তা নগণ্য, কেননা নগ্নতা ঐতিহ্যবাহী যাত্রাপালাকে কলঙ্কিত করেছে। পুজোয় আমি এখন খেলনা পিস্তল ফোটাইনা। বাস্তবজীবনে বাস্তব পিস্তল-রাইফেল দিতে তাজা বুলেটে ফায়ার করি। তবে এতে সেই কাগজে পেচানো বারুদের কার্তুজ ফোটানো গন্ধ পাইনা। এই বুলেটে আনন্দ নাই। আমার শৈশবের সুখ নাই। পরিবর্তনের পরিক্রমা আমাকে পরিবর্তন করেছে। ঠিক যেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা জীবন স্মৃতির মত, "স্মৃতিরপটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানি না। কিন্তু যেই আঁকুক সে ছবিই আঁকে। অর্থাৎ যাহাকিছু ঘটিতেছে, তাহার অবিকল নকল রাখিবার জন্য সে তুলি হাতে বসিয়া নাই। সে আপনার অভিরুচিঅনুসারে কত কী বাদ দেয়, কত কী রাখে। কত বড়োকে ছোটো করে, ছোটোকে বড়ো করিয়া তোলে। সে আগের জিনিসকে পাছে ও পাছের জিনিসকে আগে সাজাইতে কিছুমাত্র দ্বিধা করে না। বস্তুত তাহার কাজই ছবি আঁকা, ইতিহাস লেখা নয়।"
লেখক:
পুলিশ উপ-পরিদর্শক (ট্রেনিংরত ক্যাডেট এসআই)
বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমী, রাজশাহী।