আজকের শিরোনাম :

সেসব আওয়ামী লীগার গেলেন কোথায়?

  আবদুল মান্নান

০৩ অক্টোবর ২০১৯, ১২:৩১ | অনলাইন সংস্করণ

লেখার শুরুতে একজন ওহাব মিয়ার কথা দিয়ে শুরু করি। বর্তমান প্রজন্ম ওহাব মিয়ার কথা শোনার কথা নয়। আসল নাম এমএ ওহাব। বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারী। ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারী সংসদীয় এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রথমে প্রাদেশিক পরিষদ ও পরে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর ওই এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী আর কোনো নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারেননি। ওহাব মিয়া পেশায় একজন কৃষক ছিলেন। নিজের সামান্য জমিতে নিজেই চাষ করতেন। অনেকটা জন্ম থেকেই আওয়ামী লীগের একজন তৃণমূল কর্মী থেকে সংগঠক ও নেতা। ওহাব মিয়াকে মানুষ শ্রদ্ধা করত তার সততার জন্য। বঙ্গবন্ধু সত্তরের নির্বাচনে তাকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদে মনোনয়ন দিলে নির্বাচনের পোস্টার ছাপানোর জন্য এলাকার মানুষকে চাঁদা তুলতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর অনেক অসাধারণ গুণের মধ্যে একটি হচ্ছে, তিনি কাকে দিয়ে কী কাজ হবে তা জানতেন, মানুষ চিনতে ভুল করতেন না। একবারই ভুল করেছিলেন, সেটি স্বাধীনতার পরে। তিনি খন্দকার মোশতাক, জেনারেল জিয়া, মাহবুব-উল আলম চাষী, কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য জহিরুল কাইয়ুম প্রমুখকে চিনতে ভুল করেছিলেন। এর জন্য তিনি নিজের জীবন দিয়ে তার মূল্য দিয়েছেন। এরা সবাই বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। এদের অনেকেই বাকশালেও যোগ দিয়েছিলেন। আবার ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর লাশ ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে সিঁড়িতে রেখে মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন কেউ কেউ।

ওহাব মিয়া চট্টগ্রাম কলেজে পড়ার সময় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন, ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। সত্তরের নির্বাচনে তিনি মুসলিম লীগের প্রার্থী আলি আহম্মদকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধু তাকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগদান করেন। '৭৩-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ওহাব মিয়া ৩১ হাজারেরও বেশি ভোটে জাসদের আবদুস সোবহানকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ওহাব মিয়া যেভাবে সাদামাটা জীবন শুরু করেছিলেন, ঠিক সেভাবেই ২০১১ সালের ২৮ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি কখনও অর্থবিত্তের লোভ করেননি। অনেক সময় হয়তো কেউ একজন খবর নিয়ে এলেন, ওহাব মিয়াকে বঙ্গবন্ধু তাঁর সঙ্গে ঢাকায় দেখা করতে বলেছেন। তিনি তখন মাঠে লাঙল দিয়ে চাষ করছেন। বাড়িতে গিয়ে পুকুরে গোসল করে হাতে ধোয়া পাজামা আর পাঞ্জাবিটা পরে রাবারের জুতো জোড়া পায়ে দিয়ে রাতের ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণির টিকিট কেটে ঢাকা রওনা হয়েছেন। চট্টগ্রামের আর দুই কিংবদন্তি নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী এবং আবদুল আজিজ (আজিজ মিয়া) দলের জন্য সবকিছু উৎসর্গ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের ঠিক আগে আগে আজিজ মিয়ার অকস্মাৎ মৃত্যু হলে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, চট্টগ্রামে তাঁর একজন সিপাহসালার অকাল মৃত্যু হলো জাতির এক অত্যন্ত ক্রান্তিকালে। বাংলাদেশের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ঢাকায় তার কোনো বাড়ি নেই। দলের সভায় যোগ দিতে ময়মনসিংহ থেকে টিনের ছোট ট্রাঙ্ক নিয়ে ট্রেনে ঢাকা রওনা হয়েছেন। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে এখনও অনেক ওহাব মিয়া বা সৈয়দ নজরুল ইসলাম আছেন; কিন্তু তারা কালো টাকা আর পেশিশক্তির কাছে পরাজিত এবং এই পরাজয়ের কারণ এক শ্রেণির দুর্বৃত্ত নামধারী রাজনীতিবিদদের অশ্নীল দৌরাত্ম্য। বর্তমান সময়ে এদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ছিদ্র দিয়ে দলে অনুপ্রবেশ করে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এবং তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার বহুকষ্টে লালন করা দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে উইপোকার মতো কুরে কুরে খেয়ে শেষ করে দিচ্ছে। এরা আওয়ামী লীগ থেকে ছাত্রলীগ সব ক্ষেত্রে সদর্পে বিচরণ করছে।

উইপোকাদের দলে অনুপ্রবেশ শুরু হয়েছিল ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে, যখন আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত ছিল। কারণ বিএনপি নিজের পাপের ভারে এতই ন্যুব্জ ছিল যে, তাদের পক্ষে আর উঠে দাঁড়ানো অনেকটা অসম্ভব ছিল। চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের একজন ডাকসাইটে নেতা (বর্তমানে প্রয়াত) একেবারেই রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কবিহীন; কিন্তু অঢেল কালো টাকার মালিক তাকে মনোনয়ন পাইয়ে দিতে কত না চেষ্টা করলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যার দৃঢ়তার জন্য তিনি সফল হলেন না। পরে সেই ব্যক্তি বিএনপি নেতাদের কয়েক কোটি টাকা দিয়ে রাতারাতি মনোনয়ন বাগিয়ে নিলেন। নির্বাচনের আগের রাতে পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন কয়েক বাক্স পাঁচশ' টাকার বান্ডিলসহ। নির্বাচনের দিন সেই ব্যক্তি হাজতেই কাটালেন। এমন বহু ব্যক্তি এখন শুধু আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেই প্রবেশ করেননি, বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে সংসদ সদস্যও হয়েছেন। গত এক দশকে এত কালো টাকার মালিক হয়েছেন যে, তারা এখন খোদ বঙ্গবন্ধুকন্যাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো দৃষ্টতা দেখাতে দ্বিধা করছেন না। তারা ভুলে গেছেন, শেখ হাসিনার ধমনিতে এমন একজন ক্ষণজন্মা পুরুষের রক্ত প্রবহমান, যিনি স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে নিজ দলের ২৩ জন জাতীয় সংসদ সদস্যকে বহিস্কার করতে দ্বিধা করেননি। শেখ হাসিনার চাওয়া বা পাওয়ার তো এখন আর কিছু নেই। তিনি টানা তিনবারসহ মোট চারবার বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। নিজেই তিনি একটি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। যেসব রাজনৈতিক টোকাই দলের জন্য এখন একটা বিরাট দায় হয়ে তার সামনে দাঁড়িয়েছে, তাদের কেন তিনি সহ্য করবেন? এসব রাজনৈতিক দুর্বৃত্তকে দল থেকে ডাস্টবিনে ফেলে দিলে তার লাভ ছাড়া ক্ষতির কিছু নেই।

প্রশ্ন হচ্ছে, এসব রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত আওয়ামী লীগে ঢুকল কীভাবে। যে টোকাই ফুটপাতে দোকান করত, যে ব্যক্তি ক'দিন আগেও ফ্রিডম পার্টি করত, যে কি-না খালেদা জিয়ার নিরাপত্তাপ্রধান ছিল, যার একমাত্র পেশা মাদক আর কালো ধান্ধা, যে বাটপাড় রাস্তায় মাইক লাগিয়ে অহর্নিশ বঙ্গবন্ধুকে জেনারেল জিয়ার পক্ষে গালাগাল করত, যে গলির মোড়ে মাস্তানি করত, যে তস্কর শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করেছে, যে চোরাকারবারি মানব পাচার থেকে শুরু করে দেশের অর্থ-সম্পদ পাচারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেই দুর্বৃত্তরা কীভাবে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের বা সংস্থার কর্ণধার বনে যান? উত্তর একটাই। বাংলাদেশে টাকা দিলে বাঘের চোখও মেলে সংস্কৃতির বিস্ম্ফোরণ। সম্প্রতি ক্যাসিনো কাণ্ডে আটক হওয়া এক দুর্বৃত্ত তো বলেই দিল, এই দেশে শেখ হাসিনা ছাড়া কেউ ঠিক নেই। সে তো মিথ্যা বলেছে বলে মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই। অন্যভাবে বলি, বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ছাড়া সবাইকে কেনা যায়। কথাটা কি মিথ্যা? সার্বিক অবস্থা দেখলে মনে হবে, কথাটা একশ' ভাগ সত্য।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগে দেশে এমন একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, যাতে অনেকে মনে করেছে, দেশটা পাকিস্তান থাকলেই ভালো ছিল। কারণ চারদিকে ষড়যন্ত্র তো ছিলই, তার ওপর আওয়ামী লীগের নাম করে এক শ্রেণির তস্কর তখন চারদিকে দাপিয়ে বেড়ানো শুরু করে দিয়েছিল। তাদের প্রধান কাজ ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদদারি, লাইসেন্স-পারমিট ব্যবসা, মানুষের জায়গাজমি দখল, নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি, চাঁদাবাজির মতো যত সব অপকর্ম। সবই করা হচ্ছে আওয়ামী লীগের নামে। বঙ্গবন্ধু চরম বিরক্ত হয়ে বললেন, 'মানুষ পায় সোনার খনি আর আমি পেলাম চোরের খনি।' বললেন, 'পাকিস্তানিরা সব নিয়ে গেছে, রেখে গেছে এই সব চোরের দল।' বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি সাড়ে তিন বছর বেঁচেছিলেন। এ সময় তিনি যতগুলো বক্তৃতা দিয়েছেন সংসদে ও সংসদের বাইরে, তার মূল ফোকাস ছিল দুর্নীতি আর চোরদের নিয়ে।

মৃত্যুর আগে বঙ্গবন্ধুর চারপাশে একটি অদৃশ্য দেয়াল সৃষ্টি হয়েছিল। জনগণের নেতাকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যার আমলেও একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে। তিনি তাঁর চারদিকে তাকালে তা পরিস্কার বুঝতে পারবেন। যারা এই কাজগুলো করেন, তারা সবচেয়ে বেশি তাঁবেদার হন। সেটি যেমন রাজনীতিবিদদের মধ্যে আছে, ঠিক তেমনি আছে সামরিক-বেসামরিক আমলাদের মধ্যে। বঙ্গবন্ধু হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তো রেখেছিল বড় বড় কিছু আমলা, যেমন মাহবুব-উল আলম চাষী আর আবদুল মোমেন খান। চাষী কলকাতায় খন্দকার মোশতাকের ডান হাত ছিলেন। আবদুল মোমেন খান (বিএনপি নেতা মঈন খানের পিতা) বঙ্গবন্ধুর খাদ্য সচিব ছিলেন। '৭৪-এর খাদ্য সমস্যা সম্পর্কে স্বজ্ঞানে তিনি বঙ্গবন্ধুকে জানানো থেকে বিরত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর জিয়া আবদুল মোমেন খানকে প্রথমে তার খাদ্য উপদেষ্টা ও পরে তার খাদ্যমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। কথায় বলে, আমলাতন্ত্র সবসময় পরবর্তী সরকারের জন্য কাজ করে। কথাটি সব সময়ের জন্য সত্য। সব সরকারে বেশ কিছু ভালো আমলা থাকেন; কিন্তু তাদের অবস্থা সবসময় কোণঠাসা।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আর একজন সৈয়দ নজরুল ইসলাম বা আর একজন ওহাব মিয়া আসবে না। তবে বর্তমানে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে জিহাদ ঘোষণা করেছেন, তা যদি কোনো এক ষড়যন্ত্রের কারণে মাঝপথে বন্ধ হয়ে না যায়, তা হলে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও উন্নতি হতে পারে। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিয়েছেন, দুর্নীতিবাজদের গুলি করে হত্যা করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না। এটি একটি চরম হঠকারী সিদ্ধান্ত বটে; কিন্তু তা সেই দেশের মানুষ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে তেমনটা ঘটুক, তা কেউ চায় না। তবে মানুষ চায়, বঙ্গবন্ধুকন্যা দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ শুরু করেছেন, তা যেন কোনো অবস্থাতেই মাঝপথে থেমে না যায়। দেশের স্বার্থের চেয়ে কারও ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ বড় হতে পারে না।

লেখক : বিশ্নেষক ও গবেষক

এই বিভাগের আরো সংবাদ