আজকের শিরোনাম :

ঈদের চাঁদ ও চাঁদের রাজনীতি : আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ জুন ২০১৮, ১২:৪৭

ঢাকা, ১৯ জুন, এবিনিউজ : ঈদ এসেছিল এবং ঈদ চলে গেল। বিশ্ব মুসলমানের জীবনে এটি  সবচেয়ে বড় উৎসব। ঈদুল ফিতর। এরপর ঈদুল আজহা। একটি সংযমের উৎসব। আরেকটি ত্যাগের উৎসব। সংযম আর ত্যাগকে ভিত্তি করে ইসলাম যে মানবতার ডাক ছড়িয়ে দিয়েছিল, সারা বিশ্ব তাকে বরণ করে নিয়েছিল। আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল ইসলাম। প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন (খিলাফত), নারীর অধিকার, ধনী-গরিবের মধ্যে সমতা, শিক্ষার বিস্তার, শাসিতের কাছে শাসকের জবাবদিহি ইত্যাদি বিষয়ে ইসলাম বিশ্বের মানুষকে পথ দেখিয়েছিল বলে বার্নার্ড শ থেকে শুরু করে মানবেন্দ্রনাথ রায় পর্যন্ত মনীষীরা ইসলাম ধর্মের প্রশংসা করেছেন। ঈসা, মুসা ও দাউদ (আ.) ছিলেন বিভিন্ন ধর্ম ও ধর্ম সম্প্রদায়ের নবী। কিন্তু ইসলামের প্রবর্তক মহানবী (সা.) ছিলেন রাহমাতুল্লিল আল-আমিন অর্থাৎ সারা বিশ্বের জন্য রহমত (আশীর্বাদ), শুধু মুসলমানের জন্য নন।

ধর্ম নিয়ে আলোচনা করতে বসিনি। শুধু রমজানের ঈদ পালন শেষে ভাবতে বসেছি, যে ধর্মের অনুসারীরা ৭০০ বছর সারা  বিশ্বে সভ্যতার আলো জ্বালিয়েছে, মানবতার প্রতীক হয়েছে, বিজ্ঞানের শিক্ষা প্রবর্তন ও ধারণ করেছে; আজ সারা বিশ্বে তাদের মধ্যে অজ্ঞানতা, অনৈক্য ও অন্ধ সংস্কারের এত প্রাধান্য কেন? একটি ঈদোৎসবও মুসলিম বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ হয়ে পালন করতে পারে না। উৎসবের মধ্যেও লেগে থাকে সংঘর্ষ ও হানাহানি। এবারও এই বিলাতেও একই দিনে ঈদ পালিত হয়নি। একাধিক দিবসে হয়েছে। আর কথায় কথায় মুসলমানদের এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে মুরতাদ, কাফের আখ্যা দেওয়া তো এখন নিত্যদিনের রেওয়াজ।

শৈশব থেকেই এটি দেখে আসছি। মুসলমানরা ব্যাবহারিক জীবনে সৌরমাসের ক্যালেন্ডার অনুসরণ করলেও ধর্মজীবনে চান্দ্রমাসের ক্যালেন্ডার মেনে চলে। অর্থাৎ আকাশের চাঁদ দেখে রোজা ভাঙতে হবে। ঈদ করতে হবে। কিন্তু চাঁদ দেখা তো সব সময় সম্ভব নয়। যেসব দেশের আকাশ মেঘাবৃত থাকবে, তারা চাঁদ  দেখবে কোথা থেকে? এ জন্য সেই পাকিস্তান আমলেও রুয়তে হেলাল নামে কমিটি গঠিত হয়েছিল। তারা কোথাও চাঁদ দেখা নিয়ে নিশ্চিত হয়ে ঘোষণা দিলে অথবা চাঁদ দেখা নিয়ে সৌদি আরব থেকে কোনো ঘোষণা এলে তখন ঈদ উদ্যাপন করা হতো।

এই ঈদ যাপন নিয়ে মারামারি, সংঘর্ষ লেগেই থাকত। মুসলমানরা বিভিন্ন মাজহাবে বিভক্ত। এক মাজহাব যেদিন ঈদ পালন করে, অন্য মাজহাব সেদিন তা করতে চাইত না। রুয়তে হেলাল কমিটি গঠিত হওয়ার পরও নয়। পুরো ৩০ দিন  রোজা  পালন অনেক সময় হয় না। হঠাৎ হয়তো ঘোষণা এলো, অমুক জায়গায় চাঁদ দেখা গেছে। অমনি হুড়মুড় করে আমরা রোজা ভেঙে ফেলতাম। আমার শৈশব ও কৈশোরে এমন হয়েছে বহুবার।

আবার এমনও হয়েছে, স্থানীয়ভাবে কোনো মসজিদের ইমাম হয়তো ঘোষণা দিলেন, আজ ঈদ। কারণ তিন মুসল্লিসহ তিনি চাঁদ দেখেছেন। অমনি চ্যালেঞ্জ আসত অন্য মসজিদের ইমামের কাছ থেকে। তিনি প্রথম মসজিদের ইমামকে ধর্মভ্রষ্ট ও বিদ’আতপন্থী আখ্যা দিয়ে ওই দিন ঈদ উদ্যাপন ‘হারাম’ ঘোষণা করতেন। শুরু হতো দুই ইমামের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ। ঈদের জামাতে দুই পক্ষের হানাহানিতে বহু লোক হতাহত হয়েছে এবং পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। শিয়া বনাম সুন্নি এবং সুন্নি বনাম আহমদিয়াদের মধ্যেই এই হানাহানিটা বেশি হতো। লা-মাজহাবিদের তো মুসলমান বলেই গণ্য করা হতো না। তাদের জমায়েতের ওপর প্রায়ই হামলা চালানো হতো। অথচ মওলানা আকরম খাঁর  মতো আলেম ছিলেন লা-মাজহাবি।

আমার শৈশব, কৈশোর ও প্রাক-যৌবনে রোজা-রমজান নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে এই গোত্রবিবাদ, রক্তাক্ত হানাহানি ছিল একটি নিয়মিত ব্যাপার। হিল্লা বিবাহ, তিন তালাক ধর্মীয় ব্যবস্থা বলে চালিয়ে দেওয়া হতো। প্রতিবাদকারীর জীবন সংশয় হতো। আমাদের গ্রামে যখন প্রথম লাউড স্পিকার আসে তখন মসজিদে তা ব্যবহারের পক্ষে ও বিপক্ষে দুই দল দাঁড়িয়ে যায়। বিপক্ষের আলেমরা বলেন, লাউড স্পিকার মসজিদে ব্যবহার করা যাবে না। কারণ ওই যন্ত্রের মধ্যে শয়তান বসে আছে। এটি নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে মারপিট হয়েছে। বেশিদিন নয়, গত শতকের ত্রিশের দশকের শেষার্ধ ও চল্লিশের দশকের মধ্যভাগের কথা। এখন সেই মসজিদের গম্বুজের ওপর লাউড স্পিকার শোভা পায়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজান ওই লাউড স্পিকার থেকেই প্রচারিত হয়।

পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে বেসরকারি রুয়তে হেলাল কমিটির বদলে সরকারি রুয়তে হেলাল কমিটি গঠিত হয়। উদ্যোগটি গ্রহণ করেন সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খান। তিনি ঘোষণা দেন, সারা পাকিস্তানের মুসলমানদের একই দিনে ঈদোৎসব পালন করতে হবে। চাটগাঁ থেকে পেশোয়ার—যেখানেই চাঁদ দেখা দিক, রুয়তে হেলাল কমিটি তা ঘোষণা করবে এবং টেলিভিশন ও বেতার ঘোষণায় তা সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হবে। ওই একই দিনে ঈদ সমাধা করতে হবে।

আইয়ুব আরো একটি বড় কাজ করেন। তিনি অর্ডিন্যান্স বলে পাকিস্তানের মুসলিম ফ্যামিলি ল পরিবর্তন করেন। তিনি বহুবিবাহ বাতিল করেন এবং প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া (তা-ও সরকারি কর্তৃপক্ষের অনুমোদনসহ) দ্বিতীয় বিবাহ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। জানা যায়, তিনি হিল্লা বিবাহও অর্ডিন্যান্স জারি করে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অমনি দেশময় এক শ্রেণির রক্ষণশীল আলেম, বিশেষত মওদুদী জামায়াতের মধ্যে হৈচৈ পড়ে গেল। তারা আইয়ুবের অর্ডিন্যান্সকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিল।

এই সময়ের এক দিনের কথা, ইত্তেফাক অফিসে প্রয়াত  সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া তাঁর কক্ষে বসে আছেন। তাঁর সামনে বসা শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিব বললেন, ‘আইয়ুব আমাদের একটা বিপাকে ফেলে দিয়েছেন। ঈদ ও দুই বিয়ে সম্পর্কে তাঁর অর্ডিন্যান্স প্রগতিশীল এবং সমর্থনযোগ্য। কিন্তু সমর্থন করতে গেলে ধর্মপ্রিয় সাধারণ মানুষ বিগড়ে যাবে।’ মানিক মিয়া উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ‘আইয়ুবকে আমি সমর্থন করি না। কিন্তু তাঁর এই অর্ডিন্যান্স সমর্থন করি। কেন সমর্থন করি সেটা মানুষকে বোঝাতে হবে। জামায়াতিদের চক্রান্তে পা দিলে চলবে না।’

শেখ মুজিব (তখনো বঙ্গবন্ধু হননি) মানিক মিয়াকে বললেন, ‘আপনি আমাকে সাহস দিলেন। আজই তাজউদ্দীনকে বলব, দলের বৈঠক ডেকে এ সম্পর্কে আমাদের মতামত স্পষ্টভাবে সবাইকে জানিয়ে দিতে।’ আমি তখন ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করি। মানিক মিয়া নির্দেশ দিলেন পরিবার আইন অর্ডিন্যান্স সম্পর্কে একটি সম্পাদকীয় লিখে ফেলতে। এর এক দিন বা দুই দিন পরই জানা গেল, মওলানা  ভাসানী আইয়ুবের অর্ডিন্যান্সের পক্ষে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এই অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে জামায়াতের আন্দোলনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ কোনো সাড়া দেয়নি।

আমার কথা, শুধু হিল্লা বিয়ে, তিন তালাক, বহু বিবাহ ও ঈদের চাঁদ নিয়েই নয়; গোটা বিশ্বেই ধর্মের নামে অনেক অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার ঢোকানো হয়েছে। এগুলোর সংস্কার ও সংশোধন দরকার। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা ধর্মের মূল কাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে তার ব্যাবহারিক দিকগুলো অবশ্যই যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংশোধন ও পরিবর্তন কোরো।’

রাসুলের এই নির্দেশ কেউ মানছে কি? ধর্মের ব্যাবহারিক দিকগুলোকে আসল ধর্ম বলে চালিয়ে তার পরিবর্তনশীলতাকে যেমন ব্যাহত করা হচ্ছে, তেমনি সমাজ-প্রগতিকেও অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ফলে মানবিক ধর্ম ইসলামের বদলে হিংস্র ও বিকৃত  পলিটিক্যাল ইসলামের জন্ম হয়েছে এবং বদ্ধ জলাশয়ে যেমন বিষাক্ত কীটের জন্ম হয়, তেমনি অবরুদ্ধ সমাজেও তরুণ প্রজন্ম মাদক ও সন্ত্রাসের প্রভাবে আত্মহননের পথ ধরেছে।

আমি এক মৌলবাদীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনারা সমাজের কোনো পরিবর্তন মানতে চান না। বিজ্ঞানের দানকে ধর্মবিরোধী আখ্যা দেন। তাহলে এয়ারকন্ডিশন করা মোটরগাড়িতে জেদ্দা থেকে মক্কায় হজ করতে যান কেন? আগে তো উটে চড়ে মরুভূমি পার হয়ে সবাই হজে যেত। তা করেন না কেন? তিনি তাঁর সঠিক জবাব দিতে পারেননি।

আগে পৃথিবী অনেক বড় ছিল। দিল্লির খবর ঢাকায় পৌঁছতে সাত দিন লাগত। সম্রাট আকবর হাতিতে সওয়ার হয়ে দিল্লি থেকে লাহোরে গেছেন সাত দিনে। এখন কয় ঘণ্টা লাগে? আগে পেশোয়ারে ঈদের চাঁদ দেখা গেলে চাটগাঁয় তা জানা যেত না। এখন পৃথিবী খুব ছোট। আলাস্কার খবর কয়েক মিনিটের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো গ্রামেও জানা সম্ভব। আগে সৌর ক্যালেন্ডার ছিল না। মানুষ চাঁদ দেখে মাস, বছর গুনত। এখন কি এগুলোর দরকার আছে? আধুনিক প্রযুক্তি বিজ্ঞানের সাহায্যেই সারা বিশ্বের মুসলমান চাঁদের খবর একসঙ্গে জানতে পারে এবং এক দিনেই সর্বত্র ঈদ করতে পারে। গোত্র বিবাদ ও মাজহাবি বিবাদ ভুলতে পারে।

ইসলামের এই যুগোপযোগী অগ্রগতির সবচেয়ে বড় বাধা মৌলবাদী অন্ধ সংস্কার এবং সৌদি আরবের মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্র। এরা বহুকাল ইসলামের সেবক ও বিশ্ব মুসলমানের নেতা সেজে চাঁদের রাজনীতি করেছে এবং নিজেদের মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্র রক্ষার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করেছে। একটি পশ্চিমা পত্রিকায় সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, সৌদি রাজতন্ত্র কিভাবে তাদের প্রতি সুন্নি মুসলমানদের অন্ধ আনুগত্যের সুযোগ নিয়ে ঈদের দিন, এমনকি হজের দিন নির্ধারণেও সবার চোখে ধুলা দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করেছে। বর্তমানে তাদের এই মুখোশ দ্রুত খুলে যাচ্ছে এবং পলিটিক্যাল ইসলামের পতনের দিনও দ্রুত ঘনিয়ে আসছে বলে অনেকে মনে করে।

খ্রিস্ট ধর্মের মতো ইসলাম ধর্মেও তার ব্যাবহারিক দিনগুলোর যুগোপযোগী বিশাল সংস্কার ও সংশোধন প্রয়োজন। এ সম্পর্কে দেশ-বিদেশের প্রকৃত ধার্মিক ও আধুনিক মনা আলেমসমাজের মধ্যেও সচেতনতা দেখা দিচ্ছে। এটি আশার কথা। এ সম্পর্কে ভবিষ্যতে আরো আলোচনার ইচ্ছা রইল। (কালের কণ্ঠ থেকে সংগৃহীত)

লন্ডন, সোমবার, ১৮ জুন ২০১৮

এই বিভাগের আরো সংবাদ