তিস্তা চুক্তি
নরেন্দ্র মোদি কি চুপ থাকবেন না-কি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন?
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৩:৩২ | অনলাইন সংস্করণ
তার প্রথম জমানায় তিনি ঢাকা শহরে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করে এসেছিলেন তার জমানায়, অর্থাৎ ২০১৯ এবং হাসিনার জমানা ২০১৮ সালের মধ্যে ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে তিস্তা বণ্টন নিয়ে দুদেশের মধ্যে চুক্তি হবে। কিন্তু তা হয়নি। কেন হয়নি তার একমাত্র জবাব দিতে পারেন নরেন্দ্র মোদি।
আগামী মাসে অর্থাৎ অক্টোবরের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আবার দিল্লি সফরে আসছেন। তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে কথা বলেছিলাম পশ্চিমবঙ্গের সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে। বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ, কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র, সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সূর্যকান্ত মিত্র- এদের মতে হাসিনার দিল্লি সফরকালে তিস্তা চুক্তি সফল হোক। তিস্তা চুক্তি নিয়ে দিল্লি যতবার এগিয়েছে ততবারই বাধা এসেছে বঙ্গেশ^রীর কাছ থেকে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র আর একধাপ এগিয়ে বলেন, কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ২০১০ সালে ঢাকা সফরে গিয়ে তিস্তা চুক্তি করতে চেয়েছিলেন। তখন বাধা দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মনমোহন সিং ঢাকা সফরকালে তার সাথী ছিলেন ভারতের ৬টি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা; কিন্তু মমতা যাননি।
লোকসভার বিরোধী দলনেতা অধীর চৌধুরী যিনি বহরমপুরের সংসদ সদস্য- তিনি বলেন, মমতা প্রতিবেশী বাঙালি দেশের বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ়তর করতে চায় না। তাই তিনি নাটক করে যাচ্ছেন। অধীরের কড়া মন্তব্য বঙ্গেশ্বরী বিদেশনীতি বোঝেন না বা বোঝার মতো তার বিদ্যে-বুদ্ধি নেই। ফলে তার একগুঁয়েমির জন্য বিষয়টি এখনও ঝুলে আছে। অধীর আরও জানান, মনমোহন সিং-এর ঢাকা সফরের আগে লোকসভার বিজেপি এবং রাজ্যসভার বিজেপির সদ্য প্রয়াত সুষমা স্বরাজ, প্রয়াত অরুন জেটলি ও এলকে আদভানির সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করে গেছেন। ঢাকা থেকে ফিরে এসে তিনি ঐ তিন নেতাকে তার সফরের বিস্তারিত জানিয়েও ছিলেন। সীমান্ত চুক্তি নিয়ে বিজেপি-র আপত্তি রাজ্যসভায় খারিজ হয়ে যায়। তখন তৃণমূলের রাজ্যসভার সদস্যরাও বিজেপির সঙ্গে সুর মিলিয়ে কথা বলেছিলেন।
ড. মনমোহন সিং-এর ঢাকা সফরের আগে সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন তিন তিনবার কলকাতায় এসে মমতাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, কোনো সাড়া না পেয়ে তিনি মন্তব্য করেছিলেন- পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুদেশের মধ্যে সুসম্পর্কের জন্য যে নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন, সে-বিষয়ে তার কোনো ধারণা নেই।
উত্তরবঙ্গ, সিকিম, ভুটান থেকে যেসব নদীর উৎস সে-ব্যাপারে মমতার কোনো ভৌগোলিক জ্ঞান নেই। সুতরাং তিস্তা চুক্তি যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের কাছে এ-বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। আমার মনে আছে, ২০১২ সালে আমার জন্মস্থান বাংলাদেশের ঝালকাঠিতে আমি গিয়েছিলাম। সেখানে বিকেলের দিকে ২০-২৫ জন তরতাজা আওয়ামী লীগকর্মী খবর পেয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে আমাকেই প্রশ্ন করেছিলেনÑ আপনারা কেন আমাদের তিস্তার পানি দিচ্ছেন না? আমি তাদের উত্তরে বলেছিলাম, আমি সরস্বতী বা কোনো রাজনৈতিক দলের লোক নই। তবে আপনাদের উদ্বেগের কারণটা বুঝি। আমি এই উদ্বেগের কথা দিল্লিতে পৌঁছে দেব। তা দিয়েও ছিলাম। এরপর ২০১৫ সালে আমি ঢাকার বনানীতে একটি রিকশায় চেপে যাচ্ছিলাম। আমার পরিচয় জেনে রিকশাচালক আমাকে বললেন, ‘আপনারা আমাগো দ্যাশ স্বাধীন করার জন্য এত সাহায্য করেছেন। আর এখন তিস্তার পানি দিচ্ছে না।’ আমি তার কথা শুনে চুপ করেছিলাম। বস্তুত, ভৌগোলিক কারণেই বাংলাদেশের শুধু উত্তরের নয় দক্ষিণেরও বহু এলাকায় বহু নদ-নদীর জল শুকিয়ে গেছে। জ্যোতি বসু ও সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গনিখান চৌধুরীর উদ্যোগে ১৯৯৬ সালে হাসিনা প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর ফরাক্কার পানি চুক্তি হয়েছিল, ঐ উভয় নেতার মধ্যে মাত্র ১০ মিনিট আলোচনার মধ্যেই আমি তার সাক্ষী।
তিস্তার পানি বণ্টন কীভাবে হবে এবং শুকনা মৌসুমে কোন দেশ কতটা পানি পাবে সে-ব্যাপারে ‘টেকনিক্যাল’ দিকগুলো খতিয়ে দেখার জন্য বিশিষ্টা নদী বিশেষজ্ঞ ড. কল্যাণ রুদ্রের নেতৃত্বে একটি কমিটি নিয়োগ করা হয়েছিল, সেই কমিটির রিপোর্টেও পানি বণ্টনের চুক্তি করা হলে উভয় দেশের স্বার্থের কোনো ক্ষতি হবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের নদী বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বর্ষার সময় তিস্তার নাব্য বাড়ানোর জন্য জল ধরে রেখে শুকনা মৌসুমে সেই জল বণ্টন সম্ভব। তিস্তাসহ উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে নাব্য বাড়ানোর জন্য নদীর ড্রেজিং করা দরকার বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ড্রেজিং করা হলে অনেকটা জল ধরে রাখা যায়। যেমন করা হয় গঙ্গায়। বড় বড় জাহাজ আসার সময় ড্রেজিং করে নাব্যতা বাড়ানোর একটা প্রথা চালু আছে, হাসিনার অগেরকার দিল্লি সফরের সময় বিষয়টি নিয়ে মমতার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘ আলোচনা হয়। হাসিনা ঢাকায় ফিরে যাবার পর যেমন দুষ্টের দলের অভাব হয় না তেমনিই মমতা তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বাঙালি সাংবাদিককে ডেকে বলেছিলেন- তিস্তা নয়, তোর্সা নদীর জলের ভাগ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আর এই তোর্সা নদীর উৎস ভুটানে। তার এই দুষ্টু বুদ্ধির নেপথ্যে কোনো পশ্চিমী বিদেশি দেশ কলকাঠি নেড়েছিল। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের নামজাদা সাহিত্যিক মমতার ঘনিষ্ঠ উত্তরবঙ্গের মানুষ সমরেশ মজুমদার বলেছিলেন তোর্সা তো ভুটানে। তবে ভুটানকে ডেকে এনে ত্রিপাক্ষিক কেন করতে চাইছেন। এর কোনো জবাব আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তিস্তার জল না পেয়ে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশি ইলিশ পশ্চিমবঙ্গে রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কিন্তু কূটনৈতিক সূত্রে বলা হয়, বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের একজন প্রথমসারির নেতা বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনের মাধ্যমে মমতাকে নিয়মিত ইলিশ পাঠান। বিষয়টি নিয়ে আমি ঢাকায় এক সাবেক মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছিলাম, যাই হোক ইলিশ মাছ বড় বিষয় নয়-বড় বিষয় হলো তিস্তার জল।
মমতার ঘনিষ্ঠ তৃণমূলের এক প্রবীণ মন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলাম- তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে দিল্লিতে আসছেন। আপনারা কী করবেন? তিনি মুখে আঙুল চেপে বলেন, দিদিকে বলুন, আমরা জানি না। যাই হোক- এরপর বাংলার সমস্ত রাজনৈতিক দলই একবাক্যে বলেছিল- তারা চান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন দিল্লির সফরের সময় তিন দশক থেকে পড়ে থাকা তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন করে মোদি তার প্রতিশ্রুতি রাখবেন। শেখ হাসিনাও হাসিমুখে ঢাকা ফিরে গিয়ে বলতে পারবেন আমার সফর সফল। ১৯৭২ সালে ঢাকায় এবং ১৯৭৪ সালে দিল্লিতে ইন্দিরা-মুজিব যে চুক্তি হয়েছিল, সেই চুক্তির শর্তেই ছিল ঢাকা ও ভারতের মধ্যে যে কোনো সমস্যার দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধান করতে হবে। এবারও যদি মমতা আপত্তি তোলে, তবে এবারও কি নরেন্দ্র মোদি চুপ করে বসে থাকবেন? না-কি তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন? ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে এটাই এখন বড় প্রশ্ন।
লেখক : ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক
এই বিভাগের আরো সংবাদ