সহিষ্ণুতার এক জীবন্ত নমুনা প্রণব মুখোপাধ্যায়
জয়ন্ত ঘোষাল
১৯ আগস্ট ২০১৯, ১০:৫৯ | অনলাইন সংস্করণ
ভারতের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় সম্মান হলো ভারতরত্ন। দেশের রাষ্ট্রপতি যিনি দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক ব্যক্তিত্ব, তিনি এই সম্মান তুলে দেন প্রাপকের হাতে। পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, এমনকি পদ্মবিভূষণের মতো সম্মানও রাষ্ট্রপতি প্রদান করেন। কিন্তু কাকে কাকে এই সম্মান দেওয়া হবে, তা স্থির হয় এক প্রলম্বিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে একটা বিচারকমণ্ডলী গঠিত হয়। তারপর সেই নামগুলো ক্যাবিনেটে মঞ্জুর হয়। ভারতরত্ন হলো ভারতীয় নাগরিকদের জন্য সেই সর্বোচ্চ সম্মান, যা প্রধানমন্ত্রী বা ক্যাবিনেট পরামর্শ দিতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি নিজেই এই নাম চূড়ান্ত করেন। এ ক্ষেত্রে চাইলে প্রকাশ্যে না হলেও একান্তে রাষ্ট্রপতি কোনো নামের ব্যাপারে ‘না’ বলে ভেটো দিয়ে দিতে পারেন।
সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়িকে ভারতরত্ন সম্মান দেন। আর প্রণববাবুকেই এই সম্মান দিলেন রাষ্ট্রপতি কোবিন্দ। আর প্রণববাবুর নামটা প্রস্তাব করেন খোদ নরেন্দ্র মোদিই। মোদি এই সম্মান দিয়ে আসলে গান্ধী পরিবারকেই অস্বস্তিতে ফেলতে চেয়েছেন—এমন একটা ব্যাখ্যা তখন দিল্লির অলিন্দে অলিন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তখন রাহুল গান্ধী এই সম্মানের জন্য প্রণববাবুকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, কংগ্রেস প্রণববাবুর এই প্রাপ্তির জন্য বিশেষভাবে গর্বিত। কারণ কংগ্রেসের একজন আপনজন তাঁর জনসেবা ও জাতি নির্মাণে বিশেষ অবদানের জন্য এই সম্মান পেলেন। রাহুল গান্ধী এ কথা বললেও কয়েক দিন আগে যখন প্রণববাবুকে এই সম্মান দেওয়া হলো তখন রাষ্ট্রপতি ভবনের মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানে সোনিয়া ও রাহুল গান্ধী কেন হাজির হলেন না, এ প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। প্রণববাবু ছাড়া এ বছর যে দুজনকে এ সম্মান দেওয়া হয়েছে তাঁরা দুজনই প্রয়াত। একজন হলেন ভূপেন হাজারিকা আর অন্যজন হলেন নানাজি দেশমুখ। নানাজি দেশমুখ আরএসএসের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছিলেন। অতীতে রাজনীতি করলেও শেষ জীবনটা তিনি রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ দূরে সরে গিয়ে শুধু সমাজসেবামূলক কাজ করেন মধ্য প্রদেশে। ভূপেন হাজারিকাও একসময় আইপিটিএ আন্দোলনে সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে ছিলেন, যেভাবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী বা দেবব্রত বিশ্বাসরা ছিলেন। কিন্তু শেষ জীবনে রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। তাঁর পরিচয় ছিল এক মানবতাবাদী শিল্পী হিসেবে। তাই রাজনৈতিক নেতা হিসেবে এবার প্রণববাবুই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি।
বাংলাদেশের মতো দেশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সেই ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকে। তিনি ছিলেন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অতি ঘনিষ্ঠ মন্ত্রী। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত তিনি দুই দেশের সুসম্পর্ক রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
আর সবচেয়ে আনন্দের বিষয়, তিনি জীবদ্দশায়ই এই সম্মান লাভের অধিকারী হলেন। আর ১৯৮৭ সাল থেকে জীবিত যতজন ভারতরত্ন পেয়েছেন, তাঁদের সংখ্যা কম। সত্যজিৎ রায় ও রবিশঙ্করের পর তিনিই তৃতীয় ব্যক্তি। বাংলার রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তিনিই প্রথম। বাঙালি হিসেবে এ জন্য আমরা নিশ্চয়ই গর্বিত। টি কৃষ্ণমাচারি ও সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন এ সম্মান পান। কলকাতার মানুষ মাদার তেরেসার প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন প্রণববাবু স্বয়ং। মোরারজি দেশাই ক্ষমতায় এসে এই পদ্ম সম্মানটাই বন্ধ করে দেন। মোরারজি এই রাষ্ট্রীয় ভাবনারই বিরোধী ছিলেন। তিনি মনে করতেন এ হলো এক ধরনের বদান্যতা। এ জন্য ১৯৭৮ ও ১৯৭৯—এই দুই বছর কোনো পদ্ম সম্মান দেওয়া হয়নি। ১৯৮০ সালের ২৬ জানুয়ারি মাত্র ১২ দিন আগে ইন্দিরা গান্ধী আবার ক্ষমতায় ফিরে এলেন। তিনি ক্ষমতাসীন হওয়ার পরই প্রণববাবুকে ডেকে পাঠালেন। তখন শুধু ক্যাবিনেট নয়, প্রণববাবু রাজ্যসভার দলীয় নেতাও ছিলেন। তখন ইন্দিরা বলেন, ‘আমি আবার পদ্ম সম্মান চালু করতে চাই।’ প্রণববাবু প্রমাদ গোনেন। তিনি বলেন, ‘এত অল্প সময়ের মধ্যে পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ—এসব সম্মান দেওয়া যাবে না। তবে আমরা ভারতরত্ন সম্মান দিতে পারি।’ কাকে দেওয়া যায়? এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মাদারের নাম মাথায় আসে প্রণবের। ইন্দিরা লাফিয়ে ওঠেন। দারুণ ব্যাপার। প্রণববাবু শুধু একবার চেক করে নেন যে তিনি আলবেনিয়ার নাগরিকত্ব এখনো রাখেননি তো! দেখা গেল, না, তিনি ভারতীয় নাগরিক।
নরেন্দ্র মোদি ২০১৯ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসের ঠিক এক দিন আগে অর্থাৎ ২৫ জানুয়ারি প্রণববাবুকে ফোন করে বলেন, ‘প্রথা অনুসরণ করে আমার নিজেরই আপনার কাছে গিয়ে এ প্রস্তাব দেওয়া উচিত ছিল; কিন্তু এখন সময় কম। তাই বলছি, সরকার আপনার নাম ভারতরত্নের জন্য স্থির করেছে। আপনি সম্মতি দিলে আমি রাষ্ট্রপতিকে বলব। আমি তাঁকে এ প্রস্তাব দিলে রাষ্ট্রপতি সঙ্গে সঙ্গে তাতে সহমত পোষণ করেছেন। কিন্তু আপনার সবুজ সংকেত ছাড়া রাষ্ট্রপতির কাছে আমি নামটা চূড়ান্ত ধরতে পারছি না।’ প্রণববাবু তারপর রাজি হলেন।
কোনো সন্দেহ নেই প্রণববাবু বাংলার যোগ্য সন্তান। তাঁর সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো তিনি কিন্তু সংঘাতের পথে না গিয়ে সবাইকে নিয়ে অর্থাৎ নানা মতের মানুষকে নিয়েই চলতে আগ্রহী। খুব সাধারণ এক মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আজ তিনি কোথায় এসে পৌঁছেছেন সেটাই দেখার বিষয়। তাঁর জন্ম কির্নাহারের মিরিটি গ্রামে। স্কুলের লেখাপড়াও সেখানে। তরুণ বয়সে সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজে পড়াশোনা করেন। হাফ প্যান্ট পরা ছেলে, কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৫২ সালে। তখন প্রণব ছিলেন ধীরস্থির মিতবাক। লাজুক স্বভাব ছিল তাঁর। সিউড়ি কলেজ থেকে পাস করে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুটি বিষয়ে এমএ করেন। এলএলবি ডিগ্রিও প্রাপ্ত হন। তারপর দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটা কলেজে অধ্যাপনা। তখনো কিন্তু প্রণববাবু জানতেন না তাঁর ভবিষ্যৎ কোন পথে। ষাটের দশকের মধ্যভাগে মেদিনীপুরের আগস্ট আন্দোলনের নেতা অজয় মুখোপাধ্যায় দলত্যাগ করে নতুন পৃথক দল বাংলা কংগ্রেস গঠন করলে শুরুতেই প্রণববাবু তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। কিছুদিনের মধ্যে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলা কংগ্রেসের থিংক ট্যাংক। এমনকি ওই বাংলা কংগ্রেসের সংবিধানের খসড়াও লিখেছিলেন সেদিনের নবীন প্রণব মুখোপাধ্যায়।
বাবা প্রয়াত কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায় ভারতের এক বিশিষ্ট স্বাধীনতাসংগ্রামী ও রাজ্য কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতা ছিলেন। সম্ভবত এই গান্ধীবাদী নেতার প্রভাব প্রণববাবুর ওপর ছিল। অর্থাৎ রাজনীতি তাঁর রক্তে ছিল। উনসত্তর সালে অজয় মুখোপাধ্যায় তাঁকে বাংলা কংগ্রেসের সদস্য হিসেবে রাজ্যসভায় পাঠান। তারপর প্রণববাবু আর কখনোই পেছনের দিকে তাকাননি। সুদীর্ঘ যাত্রাপথ।
শেষ জীবনে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নাগপুরে আরএসএসের সদর দপ্তরে যাওয়া নিয়ে বিতর্ক হয়। শোনা যায় গান্ধী পরিবার এ ঘটনায় অসন্তুষ্ট হয়। কিন্তু যখন তারা দেখল প্রণববাবু নাগপুরে গিয়ে সেই মঞ্চ থেকে নেহরুর ভারত ভাবনার প্রয়োজনীয়তার কথাই ছত্রে ছত্রে তুলে ধরলেন তখন সবাই চুপ। আসলে প্রণব মুখোপাধ্যায় নামক মানুষটা থেকে রাজনীতিকে কখনোই আলাদা করা যায় না। তিনি রাজনৈতিক অস্পৃশ্যকে মানেন না; কিন্তু চান আলাপ-আলোচনা। প্রণববাবু মানছেন নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে ভারত হিন্দু জাতীয়তাবাদের দিকে হাঁটছে। প্রণববাবু সব সময় বলতেন আমেরিকায় প্রধানমন্ত্রীরা বাইবেল স্পর্শ করে শপথ নেন, ভারতে তা হয় না। ভারতে সংবিধানকে স্পর্শ করে প্রধানমন্ত্রী শপথ নেন। এটাই আমাদের শক্তি। প্রণববাবুর উক্তি : সংবিধানই হলো আমার ধর্মগ্রন্থ আর সংসদ হলো মন্দির। প্রণববাবুর সবচেয়ে বড় শক্তি তিনি সারা জীবন সব ধরনের মত ও পথের মানুষকে নিয়ে চলেছেন। এই সহিষ্ণুতার তিনি এক জীবন্ত নমুনা ।
৪০ বছর এই সংসদে তিনি দাপটের সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন। জীবনে যদি কখনো দুঃখ থেকে থাকে, সম্ভবত সেটা একটাই—প্রধানমন্ত্রী হতে না পারা। সোনিয়া প্রণবকে নয়, মনমোহনকেই বেছে নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য। রাষ্ট্রপতির মনোনয়ন অবশ্য সে দুঃখমোচন করেছিল অনেকটাই। তবে সব শেষে ভারতরত্নের সম্মান লাভের পর প্রণববাবুর জীবনে আর কোনো অভিমান থাকল না কারোর কাছেই।
লেখক : সাংবাদিক, কলাম লেখক
এই বিভাগের আরো সংবাদ