আজকের শিরোনাম :

সর্বজনীন পেনশন : শুরুই হল না

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ জুন ২০১৮, ১১:৩২

শঙ্কর প্রসাদ দে, ১৩ জুন, এবিনিউজ : অনেকের প্রত্যাশা ছিল উত্থাপিত বাজেটে সর্বজনীন পেনশন খাতে বাজেট বরাদ্দ হবে। হয়নি। কেন হয়নি এবং হলেও প্রকল্পটি বাস্তবায়নযোগ্য কিনা তা আলোচনার অপেক্ষা রাখে। পৃথিবীর সব উন্নত দেশ এবং প্রায় সব উন্নয়নশীল দেশে বয়স্ক ভাতা চালু আছে। বয়স্ক ভাতার বর্ধিত রূপ হলো সর্বজনীন পেনশন। আমাদের দেশেও সীমিত আকারে বৃদ্ধদের জন্য ভাতা চালু করা হয়েছে। গ্রামীণ মহিলা, মুক্তিযোদ্ধারা যে ভাতা পায় তা আসলে বয়স্ক ভাতা। সরকার চিন্তা করছে বেসরকারি কর্মচারী মাত্রই ভবিষ্যতে অবসরে গেলে পেনশন পাবেন এবং তার অবর্তমানে তাঁর স্ত্রী পাবেন।

বর্তমানে পেনশন সুবিধা আছে শুধুমাত্র সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য। তাঁর মৃত্যুতে পেয়ে থাকেন বিধবা স্ত্রী। এখন সরকার এটার পরিধি বাড়িয়ে সকল বেসরকারি কর্মচারীদের জন্য পেনশন চালু করার ইচ্ছে পোষণ করছে। উদ্যোগটি অবশ্যই ভাল। তবে এটি প্রয়োগের আগে বেশ কিছু দাপ্তরিক কাজ শেষ করার প্রয়োজন আছে। প্রথমত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আওতা নির্ধারণ করতে হবে। একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক বা সিমেন্ট শিল্প কারখানার বা তদ্রুপ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী হবেন তা কিন্তু নয়। বেসরকারী চাকরিজীবীর আওতায় বেসরকারি প্র্যাকটিসরত ডাক্তার, সাংবাদিক, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবীরাও পড়বেন। বর্তমান পদ্ধতিতে সরকারি চাকুরেরা অবসর গ্রহণের পর সরকার নিয়মানুযায়ী ঐ চাকরিজীবীর মৃত্যু পর্যন্ত চলার ন্যূনতম টাকা অর্থাৎ পেনশন দিয়ে থাকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো বেসরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন দিতে হলে অর্থের সংকুলান কোথা থেকে হবে? সহজ উত্তর হলো বেসরকারি চাকুরের মাসিক বেতন থেকে একটা অংশ সরকার কেটে নেবে। নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে একটা অংশ, সরকার মাসে মাসে বাধ্যতামূলক কেটে রাখবে। চাকরিজীবী নিজে এবং মালিকের গচ্ছিত অর্থের সাথে সরকারও কিছু টাকা মাথাপিছু জমা রাখবে। ধরে নিন, প্রতি মাসে চাকরিজীবী একশ, নিয়োগকারী একশ এবং সরকার প্রদত্ত একশ টাকা অর্থাৎ মোট তিনশত টাকা জমা হলে অবসরের পর ঐ ব্যক্তি যদি মাসিক এক হাজার টাকা করে পায় তবে তা হবে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর এক উত্তম পদক্ষেপ।

যত সহজে কথাটা বলা গেল সাংগঠনিক কাঠামো তত সহজ না হলেও একেবারে অসম্ভব নয়। কথা হলো তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে বিষয়টি মোটেই বিশাল কোন ব্যাপার না। প্রত্যেকটি কোম্পানি সরকারি তালিকাভুক্তি হবার দিনই পেনশন সুবিধার জন্য কিছু অর্থ জমা রাখবে। অতঃপর যত কর্মচারী বা শ্রমিক নিয়োগ হবে প্রত্যেকের বেতন পরিশোধ হবে ব্যাংকিং চ্যানেলে। প্রতি মাসেই অটোমেটিক বেতনের একটি অংশ প্রত্যেকের পেনশন হিসেবে জমা হয়ে যাবে। মালিকের অংশও ঐ হিসাবে যাবে। সরকারের প্রদত্ত অংশটিও এতে যোগ হবে। তারপর যে যখন অবসরে যাবে, তখনকার স্থিতি ও নিয়মানুযায়ী পেনশন সুবিধা পাবেন। একজন আইনজীবী যদি মনে করেন তিনি পচাঁত্তর বছর বয়সে অবসরে যাবেন। ভাল কথা, ঐদিন থেকে তিনি পেনশন পাবেন তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী পাবেন। এভাবে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, আইনজীবী সহ অন্যান্যরা আওতায় আসবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এই পদ্ধতিতেই সার্বজনীন পেনশন সুবিধা কার্যকর আছে।

ধারণাটির সূত্রপাত ঘটে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর থেকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ সব সমাজতান্ত্রিক দেশে অবসর গ্রহণ বা কর্মক্ষমতা হারানো প্রত্যেক ব্যক্তির ভরণপোষণের দায়িত্ব রাষ্ট্র বহন করা শুরু করে। সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থার মোদ্দা কথাও তাই। তখন পুঁজিবাদী বিশ্ব ভাবলো বয়স্কদের দায়িত্ব রাষ্ট্র নিতে বাধ্য এবং সেটা সরকারি বেসরকারি যেই হোক। এমনকি বয়স্ক লোক যদি ব্যবসায়ী বা কৃষক হন তাতে সমস্যা হবার নয়। বয়সের এক প্রান্তে ব্যবসায়ী, কৃষক, দিনমজুর এই তাত্ত্বিক ধারণার সুফল ভোগী। ধারণাটির প্রথম সকল প্রয়োগ করে সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, বেলজিয়াম, অষ্ট্রেলিয়া সহ ইউরোপের উন্নত দেশগুলো। এখন বয়স্ক অর্থাৎ সিনিয়র সিটিজেনদের সম্পূর্ণ দায়–দায়িত্ব আমেরিকা, কানাডা, জাপান সহ সব পুঁজিবাদী দেশই বহন করে। ভিয়েতনাম, চীন, কিউবা, উত্তর কোরিয়ার মত সমাজতান্ত্রিক দেশতো বহন করেই। যার ফলাফল দাঁড়িয়েছে পৃথিবী ব্যাপী মতবাদ নির্বিশেষে সব দেশেই সিনিয়র সিটিজেনরা সার্বজনীন পেনশনের আওতায় আমৃত্যু সুবিধা পাচ্ছেন।

বাংলাদেশে এ বছরই চালু হবার কথা ছিল। তবে বোধগম্য প্রস্তুতি ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে এ বছর তা চালু হয়নি। অবশ্য জনগণও সর্বজনীন পেন ধারণাটির সাথে সম্যক পরিচিত নয়। ব্যাপকহারে বিষয়টি আলোচিত হওয়া দরকার এবং সমাজের সর্বস্তর থেকে একটি জোরালো দাবী উত্থাপিত হলে সরকারের জন্যও এতো বিশাল প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এগিয়ে যাওয়া সহজ হয়।

লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট
(সংগৃহীত)

এই বিভাগের আরো সংবাদ