আজকের শিরোনাম :

হঠাৎ করে যেন দেশে দম বন্ধ হওয়া পরিবেশ

  আবদুল মান্নান

০৪ আগস্ট ২০১৯, ১০:৩৫ | অনলাইন সংস্করণ

বাংলাদেশে যা ঘটে তার পেছনে অনেক সময় অদৃশ্যমান অনেক ঘটনা থাকে, যা সাধারণত অশুভ শক্তি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ঘটায়। সোজা কথায় ষড়যন্ত্র। ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার আগে এ রকম অনেক ঘটনা ঘটেছিল, যা বঙ্গবন্ধু তেমন একটা গুরুত্ব দেননি-যার ফলাফল হয়েছিল ভয়াবহ। ১৯৯৬ ও ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা ক্ষমতায় আসার পর এ ধরনের ঘটনার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে। ইদানীং দেখা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো একটি রাষ্ট্রীয় কাজে অথবা নিজের চিকিৎসার প্রয়োজনে একটু বাড়তি সময়ের জন্য দেশের বাইরে গেলে দেশে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়, যা দেশের মানুষকে চরম অস্বস্তিতেই ফেলে। শুধু তা-ই নয়, অনেক সময় মনে হয় মানুষের মনে এক অজানা আতঙ্ক ভর করেছে। শুরুটা হয়েছিল হঠাৎ মহামারি আকারে ধর্ষণ এবং বলাৎকারের ঘটনা দিয়ে। সঙ্গে যোগ হলো ধর্ষণের শিকারকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা। সংবাদে প্রকাশ, গত ছয় মাসে দেশে ৮২৬ শিশু ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক ক্ষেত্রে এসব ঘটনার প্রধান কারিগর ছিলেন মাদরাসার অধ্যক্ষ বা শিক্ষক, যাঁরা নাকি ধর্মশিক্ষায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে তোলেন। তারপর প্রধানমন্ত্রী লন্ডন গেলেন ইউরোপে দায়িত্ব পালনরত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতদের বার্ষিক সভায় যোগ দিতে, এরপর তিনি চোখের চিকিৎসা করালেন। এর আগেরবার তিনি তাঁর অন্য এক চোখের চিকিৎসা করিয়েছেন। বয়স হলে মানুষের নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। শেখ হাসিনাও তার ব্যতিক্রম নন। তার ওপর তিনি ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর অনেক ঝড়ঝাপটার মধ্য দিয়ে গেছেন। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় তিনি তাঁর এক কানের শ্রবণশক্তি অনেকটা হারিয়েছেন। এবার প্রধানমন্ত্রী লন্ডন যাওয়ার পরই শুরু হলো পদ্মা সেতুতে শিশুদের মাথা লাগবে গুজব দিয়ে। এই গুজবটা সারা দেশে আগুনের মতো ছড়িয়ে গেল। দু-এক স্থানে সত্যি সত্যি কয়েকজন মাদকসেবীর ব্যাগে শিশুর কাটা মাথা পাওয়া গেল। কিন্তু সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটল, যখন ছেলেধরা সন্দেহে ঢাকার বাড্ডায় এক মাকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা হলো, আর অন্য আরো কয়েক স্থানে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হলো। গুজবটির উৎপত্তি কোথায় তা জানা না গেলেও সাধারণ মানুষ এতে যথেষ্ট আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে গেল। অথচ বিশ্বের সব দেশেই অনেক বড় বড় সেতু হয়েছে, কোথাও নরবলি দিতে হয়নি। এটি একটি কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়। একসময় ভারতবর্ষে নরবলির প্রচলন ছিল। এখন তার কথা আর শোনা যায় না। যারা এই গুজবটি ছড়িয়েছে, তারা যে তা বদ মতলবে করেছে, তা পরিষ্কার। অনেকের ধারণা, এর  পেছনে যারা পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্র করেছিল তাদের প্রচ্ছন্ন হাত রয়েছে।

পদ্মা সেতুর জন্য নরবলির গুজবের রেশ কাটতে না কাটতেই হঠাৎ শুরু হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একজন প্রিয়া সাহার দেওয়া বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে কিছু বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ব্যাপক আলোচনা। প্রিয়া সাহা বাংলাদেশে একটি এনজিওর সঙ্গে জড়িত। থাকেন ঢাকায়। প্রিয়া সাহার বক্তব্য অনুযায়ী তিনি স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে সেই দেশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে আসা ২০টি দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন ট্রাম্প। এটি তাদের একধরনের জনসংযোগ কর্মকাণ্ড, যদিও তাদের নিজ দেশে বর্ণ-ধর্ম-জাতি-নির্বিশেষে মানুষ নিয়মিত নিগৃহীত হচ্ছে, গুম হচ্ছে, পুলিশের গুলিতে মারা পড়ছে। বাংলাদেশ থেকে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষে তিনজন প্রতিনিধি পাঠানো হয়েছিল, তার মধ্যে প্রিয়া সাহা ছিলেন না। যদিও তিনি বলেছেন, তিনি স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে সেখানে গিয়েছেন; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কোনো একটি সংগঠন যদি স্পন্সর না করে, তাহলে স্টেট ডিপার্টমেন্ট নিজ থেকে কাউকে আমন্ত্রণ জানায় না। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে প্রিয়া সাহাকে স্পন্সর করেছে ওয়াশিংটনভিত্তিক ‘হিন্দু আমেরিকান ফাউন্ডেশনের’ পরিচালক জে কানসারা। তিনি ওয়াশিংটন এলাকার অনেক সনাতন ধর্মের প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। এই প্রতিষ্ঠানটি ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য কাজ করে বলে প্রকাশ। রাজনৈতিক বিশ্বাসে কানসারা ভারতের বিশ্ব হিন্দু পরিষদের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রিয়া সাহা ট্রাম্পের কাছে যা নালিশ করেছেন, তা এরই মধ্যে দেশের মানুষ নানাভাবে জেনেছেন। তিনি ভুলে গেছেন যে তিনি বাংলাদেশের নাগরিক এবং তাঁর স্বামী সরকারের একজন উচ্চপর্যায়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। তিনি বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ‘নির্যাতনের’ কথা বলেছেন এবং তিন কোটি ৭০ লাখ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের গুম হয়ে যাওয়ার বিষয়ে ট্রাম্পের কাছে নালিশ করেছেন। অথচ সে অনুষ্ঠানে অন্যান্য অনেক দেশের প্রতিনিধিরা ছিলেন। তাঁদের কেউই নিজ দেশ সম্পর্কে এ ধরনের বক্তব্য তুলে ধরেননি। তবে প্রিয়া সাহা হয়তো বুঝতে পারেননি, তিনি তাঁর এই বক্তব্যের কারণে বাংলাদেশ ও ভারতের সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উসকানি দিয়েছেন। এটি ঐতিহাসিক সত্য যে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই জাতি-ধর্ম-বণ-নির্বিশেষে সংখ্যালঘুরা নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে ভারত, পাকিস্তান তার ব্যতিক্রম ছিল না। এটিকে অনেকে জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের ফসল বলে থাকেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সংখ্যালঘু নির্যাতন এ দেশে কখনো সমস্যা ছিল না। তারা আমাদের সঙ্গে একাত্তরে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। সংখ্যালঘুরা বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন। অনেক স্থানে জায়গাজমি-সম্পত্তি নিয়েও সংঘাত হয়েছে। সেটি যেমন নিজের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে হয়েছে, একইভাবে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গেও হয়েছে। আর অনেকের ধারণা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ দেশ ত্যাগ করে ভারতে যায়। এটি একটি ভুল ধারণা। বিশ্বায়নের যুগে সামর্থ্য থাকলে একজন মানুষ ইচ্ছা করলে বিশ্বের যেকোনো দেশে যেতে পারে। গত তিন দশকে দেশের ধর্মীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের যত মানুষ দেশের বাইরে গিয়ে বসতি স্থাপন করেছে, তা কি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের চেয়ে কম? আর্থিক সংগতি থাকলে যে কেউই এখন মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, দুবাই, কানাডা, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের অনেক দেশে বাড়িঘর কিনছেন, সেখানে পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকছেন, দেশের সঙ্গে ব্যাবসায়িক যোগাযোগ রাখছেন। অনেকে হাত খুলে দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে দিচ্ছেন। অনেক বড় বড় সুধীজন এক নিঃশ্বাসে বলে থাকেন, শান্তিতে থাকলে কেউ দেশ ত্যাগ করে না। কথাটা মোটেও ঠিক নয়। দেশে যাঁরা নানা ব্যবসা আর সম্পদের মালিক, তাঁদের অনেকে বিদেশে স্থায়ীভাবে পাড়ি দেন। তাঁরা কী কেউ দেশে অশান্তিতে ছিলেন?

প্রিয়া সাহা কাণ্ডের পরপরই সারা দেশে শুরু হয়ে গেল আলোচনা আর তীব্র সমালোচনা। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ তাঁর বক্তব্যের কোনো দায়িত্ব না নিলেও অনেকে তাঁর বক্তব্যের মধ্যে সত্যতা খুঁজে পেল। ১৯৪৭ সালের পর ভারত থেকে কত মুসলমান পাকিস্তানে এসেছেন (পূর্ব বাংলাসহ) তার সঠিক হিসাব কী কেউ কখনো করেছে? এখনো অনেকে আসছেন। এটি হচ্ছে আমাদের পূর্বপুরুষদের কর্মের ফল। একইভাবে বিভিন্ন সময়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অনেকেই দেশ ত্যাগ করেছে তা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে হঠাৎ করে এই মুহূর্তে বিষয়টি নিয়ে একেবারে ট্রাম্পের দরবারে হাজির হওয়ার অর্থ হচ্ছে, সমস্যাটি বোধ হয় বর্তমান সরকারের আমলে শুরু হয়েছে। প্রিয়া সাহার বিদেশের মাটিতে অবিবেচনাপ্রসূত বক্তব্যের পর এ দেশের মানুষ যদি তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হয়, তাহলে তাদের তো খুব বেশি দোষ দেওয়া যাবে না। তবে শুরুতে সরকারের অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তির এ বিষয়ে সুচিন্তিত বক্তব্য দেওয়া উচিত থাকলেও তা দিতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। অপেক্ষা করতে হয়েছে সুদূর লন্ডনে চিকিৎসারত থাকা অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জন্য। আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলে নয়। বেশ কিছুদিন ধরে কিছু শিক্ষিত আপাতদৃষ্টিতে দায়িত্বশীল ব্যক্তি কোনো একটি মন্দির ভাঙা বা ভিটামাটিতে আগুন দেওয়ার পুরনো ছবি ও কিছু মানুষের বক্তব্য ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বারবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করছেন। দেখলে মনে হবে এগুলো সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা। আর পোড়া ভিটামাটি তো একজন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরও হতে পারে। এই অপকর্মটি করা হচ্ছে স্রেফ উত্তেজনা ছড়ানোর জন্য। এটি আইসিটি নিরাপত্তা আইনে অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়ার কথা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এদিকটা খতিয়ে দেখতে পারে। দেশভাগ যে একটি মারাত্মক ভুল ছিল তা আর কেউ উপলব্ধি না করলেও একজন করেছিলেন, তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান, পরবর্তীকালে জাতির জনক। দেশভাগের পরপরই তিনি ও তাঁর মতো অনেকেই চিন্তা করেছিলেন বাঙালির একটি স্বাধীন আবাসভূমি প্রয়োজন হবে শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য। দেশভাগের ২৩ বছর পর আমাদের এই স্বাধীন আবাসভূমি বাংলাদেশ।

এসবের মধ্যে আবার ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ দেখা দিল। কোনো হাসপাতালে আর রোগী রাখার জায়গা নেই। লাগামহীনভাবে মশা প্রজনন বাড়তে দেওয়ার কারণে এমন একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি। এটি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের চরম ব্যর্থতা। তার সঙ্গে আছে নাগরিকদের নিজেদের স্বাস্থ্য সচেতনতার বড় অভাব। ঢাকার দুই মেয়র আর কিছু মন্ত্রী-মিনিস্টার তাতে ঘি ঢাললেন অপ্রয়োজনীয় কথা বলে। সমস্যা যখন একটা হয়েছে তখন তার সমাধান বের করাই তাঁদের কর্তব্য ছিল। এর ফলে সাধারণ মানুষ অসম্ভব বিরক্ত হয়েছে। অনেকে প্রশ্ন করেছেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এ ব্যাপারে লন্ডন থেকে নিদের্শনা দেবেন, সে অপেক্ষায় কী সবাই বসে আছেন? অবশেষে নির্দেশ এসেছে। তাতে কতটুকু কাজ হবে জনগণ তা দেখার অপেক্ষায়। একই সঙ্গে দেশে আরো একটি গুজবে বাজার সয়লাব হয়েছে। তা হচ্ছে অচিরেই দেশের দুটি বড় বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাবে, যার ফলে দেশের একটি বিরাট এলাকা অন্ধকারে ডুবে যাবে। এসব আলামত কেমন জানি একধরনের অশনিসংকেত বলে মনে হচ্ছে। জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—সব কিছুই যদি প্রধানমন্ত্রীকে করতে হয়, তাহলে এত কারি কারি মন্ত্রী আছেন কেন? আশা করি সমগ্র বিষয় নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরে চিন্তা করবেন। জনগণের অবস্থা হয়েছে ‘ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়’-এর মতো অবস্থা। এ মুহূর্তে কোনো একটা বড় ধরনের রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়ের আলামত না দেখলেও সাবধান হওয়াটা ভালো। ক্ষমতায় যে এখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আর সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। অতীতের অভিজ্ঞতা তেমন একটা ভালো নয়।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

এই বিভাগের আরো সংবাদ