আজকের শিরোনাম :

লাইলাতুল কদর : হাজার মাসের শ্রেষ্ঠ রজনী

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ জুন ২০১৮, ১৬:৩১

ড. আ. ম. মুহাম্মদ কাজী হারুন উর রশীদ, ১২ জুন, এবিনিউজ : আজ ২৬ রমজান মঙ্গলবার দিবাগত রাতই লাইলাতুল কদর। দীর্ঘ এক বছর পর ফিরে এলো আমাদের মাঝে আল্লাহপাক যে একটি রাতকে ইবাদত বন্দেগিতে হাজার মাসের চেয়েও অধিক সওয়াব অর্জনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সে সম্মানিত ও মহিমান্বিত রজনী লাইলাতুল কদর। কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ রজনী। আল্লাহপাক এ রজনীর গুরুত্ব বোঝানোর জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা অবতীর্ণ করেছেন। পবিত্র কুরআনুল করিমে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন– নিশ্চয় আমি কুরআনকে অবতীর্ণ করেছি কদরের রাতে। আর তুমি কি জানো কদরের রাত কি? কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। সে রাতে ফেরেশতাগণ ও রুহ (হযরত জিবরাঈল) অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিই শান্তি সেই রজনী, সুবহে সাদিক পর্যন্ত।– (সুরা আল–কদর, আয়াত: ১–৫)।

একদিন নবী করিম (সা.) বনি ইসরাঈলের শামউন নামক একজন আবিদ ও জাহিদের দীর্ঘকালের কঠোর সাধনা সম্পর্কে বলছিলেন। সে মহৎ ব্যক্তি এক হাজার মাস লাগাতার সিয়াম ও জিহাদে রত থাকতেন এবং সারারাত জেগে আল্লাহর ইবাদত বন্দেগি ও জিকির–আজকারে কাটিয়ে দিতেন। সাহাবায়ে কিরাম আবিদ ও জাহিদের কথা শুনে নিজেদের স্বল্প আয়ুর কথা ভেবে আফসোস করে বললেন– হায়! আমরাও যদি ঐ লোকটির মতো দীর্ঘ হায়াত পেতাম তাহলে আমরা ওই রকম ইবাদত বন্দেগির মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করতাম। এ সময় আল্লাহপাক এ সম্মানিত সূরা আল–কদর অবতীর্ণ করেন।

‘লাইল’ এবং ‘কদর’ দু’টিই আরবি শব্দ। ‘লাইল’ শব্দের অর্থ হচ্ছে রাত। আর ‘কদর’ শব্দের অর্থ হচ্ছে সম্মান। পূর্ণাঙ্গ অর্থ হলো সম্মানিত রাত। তবে কদর শব্দের অর্থ আরবি ভাষা বিশেষজ্ঞদের মতে– মাহাত্ম, তাকদির, আদেশ ইত্যাদিও হতে পারে। লাইলাতুল কদরকে শবে কদরও বলা হয়। ‘শব’ শব্দটি ফার্সি। এর অর্থও রাত। ইমাম যুহরী (রহ.) বলেছেন, লাইলাতুল কদর বা মহিমান্বিত রজনী এ জন্য বলা হয় যে, মানব জীবনের জন্যে এ রাত অত্যন্ত মূল্যবান ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন। শেখ আবু বকর ওয়াররাক (রহ.) বলেছেন– এ মহান রাতে ইবাদতের কারণে এমন লোকেরও মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধি পায়, ইতোপূর্বে যাদের কোনো মর্যাদা ও সম্মান ছিলো না। তাই এ রাতকে মহিমান্বিত রজনী বলা হয়। ‘কদর’ শব্দের অন্য অর্থ হচ্ছে আদেশ ও তাকদির। সৃষ্টির প্রথম দিনে প্রত্যেক মানুষের ভাগ্যে যা কিছু লিখা থাকে, এক রমজান থেকে অপর রমজান পর্যন্ত তার সরবরাহের হুকুম ও দায়–দয়িত্ব আল্লাহ তায়ালা এ রাতেই ফেরেশতাদের দিয়ে দেন। হযরত আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা.)-এর এক বর্ণনা মতে, শাবান মাসের পনের তারিখ রাত (শবে বরাত) আল্লাহতায়ালা এক বছরের জন্যে বান্দার রুজি, রিজিক, হায়াত–মউত ও অন্যান্য তাকদিরের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আর শবে কদরে সে সকল সিদ্ধান্তের প্রয়োগ এবং রুজি রিজিক প্রভৃতি সরবরাহের দায়িত্ব আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদের দিয়ে থাকেন।-(কুরতুবী)।

আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনুল করিমে ইরশাদ করেছেন, হা–মিম! শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। নিশ্চয়ই আমি তা (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি এক মুবারক রজনীতে। নিশ্চই আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়। -(সুরা আল–দুখান, আয়াত: ১–৪) লাইলাতুল কদর হচ্ছে কুরআন নাজিল হওয়ার ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত রাত। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে ২৭ রমজানের এ রাতে রাসুলে করিম (সা.)-এর কাছে জিবরাইল (আ.) কুরআনের বাণী নিয়ে এসেছিলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, হযরত জিবরাঈল (আ.) লাইলাতুল কদরে কুরআনুল করিমকে লওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার নিকটবর্তী আসমানে বায়তুল ইজ্জত পর্যন্ত একত্রে নিয়ে আসেন এবং হযরত জিবরাঈল (আ.) অন্য ফেরেশতাদের নিয়ে লিপিবদ্ধ করান। এরপর হযরত জিবরাঈল (আ.) ২৩ বছরে কুরআনুল করিমের কিছু কিছু অংশ নিয়ে রাসুলেপাক (সা.)-এর কাছে হাজির হতে থাকেন।

লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব অপরিসীম। হাজার মাস ইবাদত করে যে সওয়াব হয়, কদরের এক রাতের ইবাদত তার চেয়ে বেশি সওয়াব হয়। লাইলাতুল কদরের এ ফজিলতপূর্ণ রাতে মু’মিনদের ওপর আল্লাহর অশেষ রহমত ও নিয়ামত বর্ষিত হয় এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে মাগফিরাত ও নাজাতের পরম সুযোগ লাভ করা যায়। লাইলাতুল কদর সম্পর্কে হাদিসে এসেছে– হযরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, একদা রমযান আগমন করলে রাসুল (সা.) বললেন–তোমাদের সামনে এমন একটি মাস এসেছে। এ মাসে একটি রাত রয়েছে যা হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। যে ব্যক্তি এ রাতে ইবাদত থেকে বঞ্চিত হলো ; সে যেনো যাবতীয় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো। একমাত্র হতভাগ্য ব্যক্তিই এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকে। -(ইবন মাজাহ, মিশকাত)

লাইলাতুল কদরের মর্যাদা সম্পর্কে রাসুল (সা.) আরো বলেছেন– যখন লাইলাতুল কদর উপস্থিত হয় তখন জিবরাঈল (আ.) ফেরেশতাদের একটি বিরাট দল নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেন এবং বসা ও দাঁড়ানো যে কোনো অবস্থায় আল্লাহর জিক্‌রে মগ্ন বান্দাদেরকে অভিবাদন জানান এবং তাদের প্রতি আল্লাহর রহমত বর্ষণের জন্যে দোয়া করেন। প্রখ্যাত সাহাবী ও সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী হযরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সা.) বলেছেন– যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমানের সাথে সওয়াবের নিয়তে নামাজ পড়ে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাপ করে দেয়া হয়।-(মিশকাত)। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে দু’রাকাআত নফল নামাজ আদায় করলো এবং আল্লাহর কাছে আপন গুনাহের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করলো, আল্লাহতায়ালা তাকে ক্ষমা করে দেবেন।’

উম্মুল মু’মিনিন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) আরো বলেছেন, রমজানের শেষ দশ দিন শুরু হলে রাসুল (সা.) লাইলাতুল কদর লাভ করার জন্যে পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নিতেন। রাত জাগতেন এবং নিজের পরিবার–পরিজনকেও জাগাতেন।-(বুখারি ও মুসলিম)।

লাইলাতুল কদর কোন রাত তার কোনো নির্দিষ্ট তারিখ নেই। সঠিক তারিখ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তাফসিরে মাজহারি গ্রন্থাকার আল্লামা সানা উল্লাহ পানিপথি (রহ.) বলেছেন–লাইলাতুল কদর রমজানের শেষ দশ দিনে হয়ে থাকে। কিন্তু এরও কোনো নির্দিষ্ট তারিখ নেই; বরং যে কোনো রাতে হতে পারে। বুখারি শরিফের হাদিসে বলা হয়েছে ‘তাহাররু লাইলাতাল কদরি ফি আশারিল আওয়াখিরি মিন রমজান’ অর্থাৎ– রমজানের শেষ দশ দিনে তোমরা লাইলাতুল কদর অন্বেষণ কর। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সা.) বলেছেন– তোমরা লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করো রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে।-(মিশকাত)।

লাইলাতুল কদর অনির্দিষ্ট রাখার মধ্যেও অসংখ্য তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। যদি নির্দিষ্ট তারিখ থাকতো তাহলে সবাই একটি মাত্র রাতে ইবাদত করে নিশ্চিত মনে স্বীয় আমলের উপর নির্ভর করে বসে থাকতো। কিন্তু প্রত্যেকটি মানুষ যাতে লাইলাতুল কদর খুঁজতে গিয়ে বেশি বেশি ইবাদত করে তাই আল্লাহতায়ালা এই তারিখটি অনির্দিষ্ট রেখেছেন। তবে বুজুর্গানে দ্বীন গবেষণার মাধ্যমে বেজোড় রাতের মধ্যে ২৭ তারিখের রাতকে নির্ধারণ করেছেন। মোট কথা, লাইলাতুল কদর পাওয়ার জন্য রমজানের শেষ দশকের রাতসমূহে মশগুল থাকা বাঞ্চনীয়। তবে সাতাশতম রাতের ব্যাপারে বেশি বর্ণনা পাওয়া যায় এবং এ মোতাবেক উম্মতের মধ্যে আমল জারি রয়েছে।

লাইলাতুল কদরের আমল সম্পর্কে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বর্ণনা করেছেন. তিনি বলেছেন– আমি রাসুল (সা.)-কে বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি যদি লাইলাতুল কদর পেয়ে থাকি তাহলে সে রাতে কী দোয়া করবো? উত্তরে রাসুল (সা.) বললেন, তুমি বলবে ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফায়ফু আন্নী।’ অর্থাৎ, হে আল্লাহ! নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, আপনি ক্ষমা করা পছন্দ করেন। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দিন।-(মিশকাত)।

আজকের রাতে কুরআন নাজিল হয়েছে। তাই এ রাতে বেশি বেশি করে কুরআন তিলাওয়াত করুন। কুরআন শরিফ তিলাওয়াতের সওয়াব সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন– যে ব্যক্তি কুরআনের একটি অক্ষর পাঠ করবে, সে ব্যক্তি এর বদলে একটি নেকী লাভ করবে। আর একটি নেকী হলো দশটি নেকীর সমান। -(তিরমিজি)। রাসুল (সা.) আরও বলেছেন– কুরআন তিলাওয়াত শ্রেষ্ঠ ইবাদত। হাদিসের মধ্যে আরো এসেছে– রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন– তোমরা কুরআন পড়ো। কেননা, এ কুরআন কিয়ামতের দিন পাঠকারীদের জন্যে সুপারিশ করবে।-(মুসলিম)। রাসুল (সা.) অন্য হাদিসের মধ্যে ইরশাদ করেছেন-‘যে ব্যক্তি কুরআনুল করিম অধ্যয়ন করবে এবং তদনুযায়ী আমল করবে কিয়ামতের দিন তাঁর পিতা–মাতাকে এমন একটি মুকুট পরিধান করানো হবে, যার জ্যোতি সূর্যের চেয়েও উজ্জ্বল হবে।’

লাইলাতুল কদর গোটা জাতির জন্যে একটা পুণ্যময় রজনী। আজকের এ পুণ্যময় রজনী লাইলাতুল কদর অবহেলায় না কেটে সারারাত জেগে ইবাদত–বন্দেগি করার নির্দেশ রয়েছে। আজ ২৬ রমজান সূর্য ডুবার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হবে লাইলাতুল কদর এবং সকাল না হওয়া পর্যন্ত এ রাতের সৌন্দর্য, মাধুর্য ও মাহাত্ম বিরাজ করবে। আজকের এ রাতে মাগরিব, ইশা, তারাবিহ ও ফজরের নামাজ মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে আদায় করার পাশাপাশি প্রচুর নফল নামাজ, জিকির–আযকার, কুরআন তিলাওয়াত, দরুদ পাঠ, কবর জিয়ারত, দান–খায়রাত, ক্ষমা প্রার্থনা করে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি, মৃত পিতা–মাতা, উস্তাদ, আত্মীয়–স্বজন এবং সকল মু’মিন–মু’মিনাত ও মুসলিম–মুসলিমাতের জন্যে সাওয়াব রসানী করা উচিত। আসুন, আমরা প্রতিটি মু’মিন বান্দা আজকের এ মহামূল্যবান রাত ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করি। আল্লাহপাক আমাদের তওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
(সংগৃহীত)

এই বিভাগের আরো সংবাদ