আজকের শিরোনাম :

শিক্ষাব্যবস্থার হালচাল

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ জুন ২০১৮, ১৬:৪৭

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ১০ জুন, এবিনিউজ : আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক গলদ, ফাঁক ফাঁকি ইত্যাদি রয়েছে। সে নিয়ে কথাবার্তা হয়, হওয়া খুবই প্রয়োজন। কিন্তু যে অন্তর্যামী অনালোচিত থেকে যায় সে হলো দীক্ষাগুরু, নাম যার পুঁজিবাদ। ওই গুরুকে বিদায় না করতে পারলে ত্রুটিগুলো শুধরানো অসম্ভব। শুধরানো অসম্ভব যে সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। সংস্কারের উদ্যোগ তো কম নেওয়া হয় নি; হামেশাই নেওয়া হচ্ছে। একের পর এক কমিটি, কমিশন আসছে যাচ্ছে, সুচিন্তিত নানা ধরনের সুপারিশ পাওয়া যাচ্ছে, আরও পাওয়া যাবে, থামবে না। কিন্তু যতই যা করা হোক শিক্ষাব্যবস্থাটা মোটেই সবল হচ্ছে না, উল্টো ক্রমাগত দুর্বল হচ্ছে। এর কারণ দীক্ষাগুরুর তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। অব্যাহত রয়েছে বললে সবটা বলা হবে না, তৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, প্রবল হচ্ছে। আর ওই প্রবলতাই হচ্ছে মূল কারণ যে জন্য শিক্ষাব্যবস্থাটা বিপদগ্রস্ত হতে হতে এখন প্রায় ধ্বংসের প্রান্তে এসে পৌঁছেছে।

আমাদের দেশে শিক্ষার স্বীকৃত উদ্দেশ্যটা কী? এ প্রশ্নের জবাবে নানান কথা বলা যায়, এবং বলা হয়; কিন্তু মূল উদ্দেশ্যটা যে মুনাফা–গুরুগম্ভীর আলোচনাতে সেই সত্য কথাটা বেরিয়ে আসে না; যদিও লোককথায় সেটা বহুকাল ধরে স্বীকৃত হয়ে আছে। লোককথায় পরিষ্কারভাবেই বলা আছে যে লেখাপড়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে গাড়ি–ঘোড়ায় চড়া। আমি লেখাপড়া শিখবো, কারণ না–শিখলে আমার গাড়িঘোড়ায় চড়া হবে না। গাড়িতে নিজে চড়ে অন্যদেরকে চাকার তলায় চেপে মারবো, এই কথাটা অবশ্য বলা হয় না, তবে সেটা না–বললেও চলে, কেননা কে না জানে যে কান টানলে মাথাও আসবে। একজনই যদি শুধু ওঠে, তবে নয়জন অবশ্যই নামবে। নিজের উন্নতির এই আগ্রহটাই শিক্ষার পেছনের আসল কথা, তা যে আচ্ছাদনেই তাকে উপস্থিত করা হোক না কেন।

দীক্ষাগুরুই প্রধান শিক্ষক। আর এই শিক্ষকের প্রধান শিক্ষা হচ্ছে ধনী হও, বড় হও। এটা সে ঘরে শেখায়, বাইরে শেখায়। শিক্ষার বেলাতেও ওই শিক্ষার কোনো ব্যতিক্রম ঘটে না। ব্যতিক্রম ঘটা সম্ভবও নয়। তাই তো দেখা যায় শিক্ষা নয়, শিক্ষার ছাপই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। ছাপটা থাকে পরীক্ষার রেজাল্ট। পরীক্ষায় কে কেমন রেজাল্ট করলো, কতটা উজ্জ্বল হলো, স্বর্ণের মতো নাকি তারকার, সেটাই হয়ে পড়ে জ্ঞাননিরূপণের মানদন্ড। শিক্ষা পিছনে পড়ে থাকে, ছোটাছুটি চলে পরীক্ষাগৃহে। চলতে থাকে মুখস্থ করা, নকল করা, ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন ক্রয় করার মতো কাজগুলো। অভিভাবকেরা লজ্জা পায় না ফাঁস হয়ে–যাওয়া প্রশ্নপত্র কিনতে। সবকিছুর পেছনে প্রণোদনা ওই একটিই, পরীক্ষায় ভালো করা। ক্লাসরুমে যে শিক্ষা নেই, শিক্ষা সে যে চলে গেছে কোচিং সেন্টার, গাইড বুক, প্রাইভেট টুইশন ইত্যাদির নির্ভরযোগ্য জায়গাতে তার কারণও ওই একটাই; পরীক্ষায় ভালো ফল করার অস্থির আকাঙক্ষা।

চিকিৎসা এবং শিক্ষার মতো অতিজরুরি প্রয়োজনগুলো মেটানোর দায়িত্ব নেবার কথা রাষ্ট্রের। আমাদের দেশে এক সময়ে রাষ্ট্র ছিল ঔপনিবেশিক; চিকিৎসা ও শিক্ষার দায়িত্ব সে–রাষ্ট্রের নেবার কথা ছিল না; কিন্তু তবুও তাদের শাসন–শোষণ ব্যবস্থাটা টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনেই দায়িত্ব কিছুটা নিতো। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়া যাবে বলে আশা করা যেতো; সরকারি স্কুলে বেতন ছিল যৎসামান্য, স্কুলের শিক্ষকরা হতেন দক্ষ । এখন স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীলতা কমতে কমতে একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। স্কুলে বিনাবেতনে মেয়েদের শিক্ষা, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়েছে বটে, কিন্তু পরীক্ষা পাসের জন্য ক্লাসরুমের শিক্ষার ওপর নির্ভর করার ইতিহাস বিলুপ্তির পথে, ভরসা এখন প্রাইভেট ব্যবস্থা। চিকিৎসা যেমন কেনাবেচার সামগ্রী হয়ে গেছে, শিক্ষারও সেই একই দশা। কিনতে হয়, নইলে পাওয়া যায় না। শিক্ষা ও চিকিৎসার অত্যাবশ্যকীয় ক্ষেত্র দুটির দিকে তাকালেই বুঝতে পারা যায় উন্নতিটা কোন ধারায় ঘটছে। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র বিদায় নিয়েছে, এসেছে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রকে দেশের সব মানুষ মিলে, যুদ্ধ করে প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু এই রাষ্ট্র পুঁজিবাদী, যার অর্থ এটি দশজনের নয়, একজনের। এটি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রেরই ‘উন্নত’ সংস্করণ মাত্র। এটি আরও বেশী পুঁজিবাদী, আরও বেশী নিপীড়নকারী।

পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়েও নানা রকমের উল্টাপাল্টা কাজ কর্ম চলে। এমসিকিউ আনা হয়েছিল। এখন বলা হচ্ছে ওটা ভালো না। প্রশ্ন ফাঁসে সুবিধা করে দেয়া হয়, মোবাইলে প্রশ্নের উত্তর সরবরাহতেও ভারি সুবিধা ঘটে। ওটা বাদ যাক। তবে সৃজনশীল থাকছে। সৃজনশীল প্রশ্নের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। প্রশ্ন নয় উত্তর যাতে সৃজনশীল হয় চোখ রাখা উচিত ছিল সেদিকে। অথচ করা হয়েছে ঠিক উল্টোটা। প্রশ্ন নিজেই সৃজনশীল হয়ে গেছে। তবে এই সৃজনশীলতা জিনিসটা যে কি সেটা ছাত্র বোঝে না, অভিভাবক বোঝেন না, বোঝেন না শিক্ষকও। শিক্ষকের না–বোঝার ব্যাপারটা রীতিমত ভয়াবহ। প্রশ্নের জন্য তারা ছোটেন গাইড বইয়ের কাছে। ফলে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক উভয়ের গন্তব্য অভিন্ন হয়ে পড়ছে। দু’হাতে মুনাফা করছে গাইড–বইয়ের ব্যবসায়ীরা। কোচিং বাণিজ্য তো আছেই। যতো বেশী পরীক্ষা ততো বেশি কোচিং বাণিজ্য। সবকিছুই কিন্তু ঘটছে দীক্ষাগুরুর শিক্ষামাফিক। একেবারে নির্ভুল ভাবে। বলা হচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর দুর্নীতি ঢুকেছে। তা ব্যবসা–বাণিজ্যের কোন ক্ষেত্রটি আজ দুর্নীতিমুক্ত শুনি? দোষ কি কেবল শিক্ষার? ভালো কথা, জানা যায় সৃজনশীল নাকি এসেছে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের টাকায়। বোঝাই যাচ্ছে ওই ব্যাংক আমাদের কতবড় বন্ধু।

মাধ্যমিকের দুর্দশা বৃদ্ধি শুধু যে পরীক্ষার মাধ্যমে ঘটানো হচ্ছে তা নয়। পাঠ্যসূচিকেও দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। ধর্মীয় শিক্ষা শিক্ষার্থীর ঘরেই হবার কথা; তাকে নিয়ে আসা হয়েছে বিদ্যালয়ে। অথচ এই রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ই ঘটেছিল ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার আশা নিয়ে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যেটা এমন কি পাকিস্তান আমলেও ছিল না। ওদিকে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে ইতিহাসের পাঠ। বাংলাদেশের অভ্যুদয় যে হঠাৎ করে ঘটে নি, তাকে যে আসতে হয়েছে কঠিন সংগ্রামের দীর্ঘপথ অতিক্রম করে এবং এর বাইরেও যে এদেশের মানুষের সুদীর্ঘ এক ইতিহাস রয়েছে তার সঙ্গে পরিচয় না থাকলে কোনো ব্যক্তিকেই যে শিক্ষিত বলা চলে না, এই সামান্য জ্ঞানটি মনে হয় শিক্ষা পরিকল্পনাকারী জ্ঞানী ব্যক্তিদের নেই। এধরনের হস্তিমূর্খদের আর যেখানেই স্থান হোক শিক্ষাব্যবস্থাপনায় স্থান হবার কথা নয়। কিন্তু তারাই তো শিক্ষার হর্তাকর্তা। সকলই গুরুর ইচ্ছায়। গুরু এমনটাই চায়।

হেফাজতে ইসলাম নাম দিয়ে যে রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাব ঘটেছে দেখতে পাচ্ছি তার সবিশেষ লালনপালন মাদ্রাসাগুলোতে। শিক্ষা সংস্কারকেরা বলেন তাঁরা চেষ্টা করছেন মাদ্রাসা শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার স্তরে টেনে তুলতে; ওদিকে হেফাজতিরা চায় বাংলা মাধ্যমিক শিক্ষাকে মাদ্রাসার স্তরে টেনে নামাতে। টানাটানির এই ব্যাপারে দেখা যাচ্ছে হেফাজতিদের জোরটাই বেশি। বাংলা পাঠ্যপুস্তকের ইহজাগতিক ও গণতান্ত্রিক যে অল্পস্বল্প উপাদান ছিল সেটুকুও তাদের পছন্দ হয় নি। হুঙ্কার দিয়েছে, বাদ দিতে হবে। সেই হুঙ্কারে নত হয়েছে শিক্ষা প্রশাসন; হেফাজতিদের আপত্তির অংশগুলো মেপে মেপে ছেঁটে ফেলে দিয়েছে। প্রতিবাদ হয়েছে; কিন্তু আন্দাজ করা গিয়েছিল যেণ্ডযে রচনাগুলো ফেলে দেওয়া হয়েছে তা আর ফেরৎ নেওয়া হবে না। নেওয়া হয় নি। বেচারা প্রতিবাদকারীদের স্টীম শেষ হয়ে গেছে অল্প পরেই। এটা একটা ঘটনা বটে, কিন্তু বিচ্ছিন্ন নয়, আবার প্রতীকও। এটি পরীক্ষার ভারে কাবু মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যাপারে কর্তাদের উদাসীনতার প্রতীক। আবারও বলতে হয় যে উদাসীনতার মূল কারণ বাংলা মাধ্যম থেকে বিত্তবান গৃহের সন্তানদের দূরবর্তিতা। বাংলা মাধ্যমের শিক্ষা ধ্বংস হয়ে গেলে ধনীদের কি আসে যায়। তাদের বরং লাভই হবার কথা। প্রতিযোগীর সংখ্যা হ্রাস পাবে।

শিক্ষা তো কেবল দিলেই চলে না, শিক্ষার্থীরা তা গ্রহণ করতে পারছে কি না সেটাও দেখতে হয়। দেখাদেখির এই ব্যাপারেও শিক্ষাকর্তৃপক্ষ ভীষণ উদাসীন। শিশু শিক্ষা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সকল স্তরের শিক্ষাই এখন আনন্দহীন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আনন্দলাভের জন্য প্রয়োজনীয় পরিসরের মারাত্মক অভাব। খোলা জায়গা নেই, খেলবার মাঠ নেই; গ্রন্থাগার আছে কি নেই বোঝা যায় না; সাংস্কৃতিক কাজকর্ম প্রায় অনুপস্থিত। শিক্ষার্থীদের জন্য নিজেদের গৃহে আনন্দ নেই, আনন্দ নেই বিদ্যালয়েও। ওদিকে ছুটির ঘণ্টা বাজতে না বাজতেই তাদেরকে ছুটতে হয় কোচিং সেন্টারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে গত ২৭ বছর ধরে কোনো ছাত্রসংসদ নেই এই ঘটনাকে কেবল কর্তাদের উদাসীনতা বলে মেনে নিলে চলবে না। এও একটা রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ বটে। জ্ঞানগ্রহণে ছাত্রদের সক্ষমতাকে খর্ব করা, তাদেরকে জ্ঞানী হতে না–দেওয়ার পুঁজিবাদী নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এটি একটি কর্মপন্থা বটে।

দেখা যাচ্ছে মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান শিক্ষার কদর ক্রমাগত কমছে। অথচ আগের দিনে মেধাবানদের প্রথম পছন্দ ছিল বিজ্ঞান। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা মানবিক বিদ্যার আগ্রহও হারিয়েছে। কারণ ওই একই। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ওসব বিদ্যা কাজে লাগে না। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে তো মানবিক বিদ্যা প্রায় নিষিদ্ধ বিষয়। সামাজিক বিদ্যার অবস্থাও তথৈবচ। শিক্ষার্থীরা যদি সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি ইত্যাদি না জানে তাহলে তাদেরকে শিক্ষিত বলা যাবে কি? আর বিজ্ঞান শিক্ষা যদি শিকায় ওঠে তাহলে শিক্ষার অগ্রগতির অর্থটা দাঁড়াল কী?

বুঝতে অসুবিধা নেই যে দীক্ষাগুরুর শিক্ষা সর্বত্র বিস্তৃত। ঘরে, পরিবারে, সমাজে, বাজারে, অফিস–আদালতে ওই একই শিক্ষা। নিজের চরকায় তেল দাও। মুনাফা করো। বড় হও। বৃহৎ হও। মহৎ হবার চেষ্টা করো না, করলে মুনাফা অর্জনে বিঘ্ন ঘটবে। এই শিক্ষা আজকের নয়। যুগযুগান্তের। এ শিক্ষা রাষ্ট্র দেয়, সমাজ দেয়, দেয় বিশ্বব্যবস্থা। এর হাত থেকে আমরা মুক্তি চেয়েছি। মুক্তি চেয়েছি ঠিকই, কিন্তু মুক্তি পাই নি। পাই নি সেটা তো প্রতি মুহূর্তে প্রতি ক্ষেত্রে টের পাই।

লেখক : শিক্ষাবিদ; ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(সংগৃহীত)

এই বিভাগের আরো সংবাদ